
শিক্ষা এবং রাজনীতি নিয়ে অনেকবার লিখেছি। কখনো শিক্ষা নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে লিখেছি, আবার কখনো রাজনীতি নিয়ে। এমনকি কোনো কোনো সময় শিক্ষায় রাজনীতির প্রভাব নিয়েও লিখেছি। আজকের এই লেখায়ও শিক্ষায় রাজনীতির প্রভাব নিয়ে লিখতে চাই। এ কথা বললে ভুল হবে না যে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবনতি ঘটেই চলেছে। আবার রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি। অবনতি ছাড়া উন্নতি দৃশ্যত এখন নেই। বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি পড়তে শুরু করেছে। এমন প্রবণতা থেকে আমরা কখন বের হয়ে আসতে পারব, সেই শঙ্কাও আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমরা লক্ষ করেছি যে, শিক্ষাকে পরীক্ষামূলক ব্যবহারের প্রবণতা দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে বিদ্যমান। একজন মন্ত্রী পরিবর্তন হলে শিক্ষাকাঠামোয় পরিবর্তন হয়। আবার সরকার পরিবর্তন হলে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। এসব পরিবর্তনের ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মচারী-কর্মকর্তা কেউই রাজনীতির বাইরে না থাকায় পরিবর্তনের সুফল যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না।
ইদানীং যেমন ব্যক্তিজীবনে রাজনীতির প্রভাব বাড়ছে, ঠিক তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও। এতে আমরা শিক্ষায় খুব বেশি ভালো ভবিষ্যৎ খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংগঠনের নামে রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি প্রভাব রয়েছে, যা ক্যাম্পাসে সহিংসতা, ভাঙচুর ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ফলে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং শিক্ষার্থীদের মনোযোগ শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক সংঘাতে নিবদ্ধ হয়। গত জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে ছাত্রদের নেতৃত্বে ক্রমাগত একটি আন্দোলনশক্তি তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগে যথেষ্ট বাধা তৈরি হচ্ছে। ফলে ক্রমেই শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীদের বিরাট একটি অংশ নিজেদের দেশের ক্রীড়নক ভাবতে শুরু করেছে। রাজপথে দাবি তুললে সচিবালয়ে গিয়ে এর প্রভাব পড়ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা যখন ইচ্ছা তখন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে। পাশাপাশি তাদের দেখাদেখি অন্যরাও সেই একই পন্থা অবলম্বন করছে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে দাবি জানানোর সুনির্দিষ্ট জায়গা হিসেবে শুধু সচিবালয় আর যমুনা চিহ্নিত হয়েছে। কারণ, সেখানে জোটবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালেই মিডিয়া কভারেজ পাচ্ছে তারা। সাধারণত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন স্তরে জনপ্রতিনিধি থাকলে দাবি-দাওয়াগুলো জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কেন্দ্রে যায়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সবাই সচিবালয় কিংবা যমুনাকে বেছে নিচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে নতুন নতুন দাবি আমাদের চোখে পড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের একটি বড় অংশ দেশের আমূল পরিবর্তন চান। তারা চান দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির গুণগত মান অনেক উন্নত হোক। তারা চান দুর্নীতি বন্ধ হোক; নাগরিকদের, বিশেষ করে নারীর অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত থাকুক। তারা নির্ভয়ে কথা বলার পরিবেশ চান। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার অবাধ পরিবেশ বজায় রাখার অন্তরায় বলে মনে করে তাদের বড় একটি অংশ।
আমরা লক্ষ করছি, দেশের মূল শক্তি হিসেবে ছাত্রশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আর এ কারণে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। আমরা জানি শিক্ষা ও রাজনীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে এই সম্পর্কটি প্রায়শই একটি বিতর্কিত ও সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং এটি একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, রাজনীতি সমাজের নীতিনির্ধারণ, সম্পদ বণ্টন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় মূল ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে এই দুটি ক্ষেত্রের সম্পর্ক প্রায়শই একটি দ্বন্দ্বের মধ্যে আবর্তিত হয়, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে এবং শিক্ষাব্যবস্থার স্বাধীনতা ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা প্রায়শই রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হয়েছে, যা শিক্ষার গুণগত মান ও উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ন করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে পরিবর্তন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রতিটি সরকারই তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একটি সুশিক্ষিত, সচেতন ও উদারনৈতিক প্রজন্ম গঠনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সময়ে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সংকীর্ণ ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রভাব শুধু পাঠ্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায়ও এর প্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে প্রায়শই মেধার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্য বা পরিচয় অনেক সময় নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন, যা শিক্ষার গুণগত মানকে ব্যাহত করছে।
বাংলাদেশে শিক্ষা ও রাজনীতির সম্পর্কের শুধু নেতিবাচক দিক নিয়েই আলোচনা করা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও উদ্যোগ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা বিগত সময়ে দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার উন্নয়নকে প্রসারিত করতে সরকারের যথেষ্ট আন্তরিক উদ্যোগ ছিল। হয়তো সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব হয়নি। এমনকি সেটি সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক কারণেই। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগগুলোও রাজনৈতিক প্রভাবে বিনষ্ট হয়েছে। আবার এখনো দেখা যাচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অতিমাত্রায় রাজনৈতিক প্রভাব, যা শিক্ষার গুণগত মানকে প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত করছে।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশে শিক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানে কয়েকটি কৌশল ও পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে গভীর এবং কার্যকরভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বদলীয় সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষানীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত, যাতে তা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। শিক্ষানীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রয়োজন, যাতে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানীতিও বদলে না যায়। শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। এই বোর্ডে শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাদের দায়িত্ব হবে শিক্ষার মানোন্নয়ন, পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং শিক্ষক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]