
ড. আইনুন নিশাত একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বৈচিত্র্যময় গবেষণা প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। তিনি বাংলাদেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের একজন অগ্রণী বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নে (আইইউসিএন) বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং এশিয়া অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের সিনিয়র উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য এবং ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি চুক্তি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘতম যমুনা এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শদাতা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে অতিরিক্ত যে খরচ লাগবে- আমি অনুমান করি, এতে বাংলাদেশে সরকারিভাবে খরচ বাড়বে। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের প্রত্যেক খাতকেই প্রভাবিত করবে। প্রত্যেক খাতের কর্মকাণ্ডে জলবায়ু পরিবর্তনকে যোগ করতে হবে। কিন্তু আমরা এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমি বলতে চেষ্টা করছি- বহির্বিশ্বে আমেরিকা কিংবা উন্নত দেশকে আমরা দোষারোপ করতে পারি- তারা অর্থায়ন করছে না। যতটুকু অর্থায়ন করছে এবং বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে যে উন্নয়ন কাজ করছে, সেখানে কি জলবায়ুর বিষয়টা সঠিকভাবে ধরা হচ্ছে বা প্রমোট করা হচ্ছে? উত্তর হচ্ছে- না। কাজেই সে ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে- নিজের ঘর আগে ঠিক রাখতে হবে। তার পর অন্যদের বকাবকি করার কথা ভাবা উচিত।…
খবরের কাগজ: বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে আলোচনার ধারা চলছে, তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সে আলোচনা কিছুটা থমকে দাঁড়ালো। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত যে বৈশ্বিক আইন আছে, যা সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্যারিসে চুক্তি হয়েছিল, তা থেকে সরে যাবে বলে যুক্তরাষ্ট্র মৌখিকভাবে বলেছে। এখন কাগজে-কলমে যুক্তরাষ্ট্রকে নোটিশ দিতে হবে। এর তিন থেকে চার বছর পর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৭-এ চূড়ান্ত করা হয় কিয়োটো প্রোটোকল। যার পেছনে আইনি বাধ্যতামূলক শক্তি আছে। যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিতে সই করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা আর চূড়ান্ত করেনি। ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যাদের দায়ী করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেই তালিকায় ১ নম্বর দেশ ছিল। আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সে সময় এই ব্যবস্থা মেনে নেয়নি। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়াও অন্য যে কয়জন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তারা জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে ওবামা কিংবা বাইডেনের সময় বেশ কিছু কাজ হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য প্রধান অস্ত্র হচ্ছে বায়ুশক্তি, সূর্যের সোলার রশ্মি, জলবিদ্যুৎ- এই তিনটি। এর সঙ্গে যুক্ত নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকে এখনো অফিসিয়ালি কার্যকর করা যায়নি- যা নিরাপদ এনার্জি হিসেবে আনা যেতে পারে। আমি মনে করি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রগামী দেশ।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা অনুযায়ী যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা কাজ করেন তাহলে চার বছর পর দেখা যাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পেছনে পড়ে যাবে। এমনকি ভারতের পেছনেও পড়ে যাবে। এটা তাদের জন্য একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। ১৯৯২ সালে প্রথম যে বৈশ্বিক আইন তৈরি হয় এবং এটার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয় রাজনীতির ভিত্তিতে অর্থাৎ, প্রত্যেকটা দেশের রাজনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে। এ ছাড়া আরেকটা ধারায় কাজ হয়। সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক। যার নাম- ‘ইন্টারন্যাশনাল গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেক্স চেঞ্জ।’ মজার ব্যাপার হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই দুই ধারাতেই এতদিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। আগামী তিন থেকে চার বছর তারা প্যারিস চুক্তির বাইরে থাকবে- কিয়োটো প্রোটোকল তারা মেনে নেননি। UNACCC ১৯৯২ সাল থেকে এটার সঙ্গে যুক্ত। এ থেকে বেরোতে পারবে না। কেন পারবে না, এর কারণ জানা দরকার। এই ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সই করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এ থেকে বের হতে গেলে তাকে অন্ততপক্ষে ৮০টি ভোট পেতে হবে। সিনেটের সংখ্যা ১০০। তার পার্টির দখলে আছেন ৫৫ জন সিনেটর। এদিক-ওদিক থেকে আরও পাঁচ থেকে ছয়জন যুক্ত করলেও এটা ৮০-তে পৌঁছতে পারবে না। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের যে মূল বৈশ্বিক আইন সেটা তাদের মেনে চলতে হবে। তারা এটা যে কারণে করছে, তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন এবং প্রশমন- এই দুই কাজ করার জন্য প্রচুর অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। এই অর্থায়নের দায় উন্নত বিশ্বের। অর্থাৎ, উন্নত বিশ্বের ৩৫-৪০টা দেশের এই দায় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায় যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্র এখন বলতে চেষ্টা করছে যে, চীনের ঘাড়ে দায়টা ফেলা উচিত। ভারতের ঘাড়ে দায়টা ফেলা উচিত। আজকে রিনাই গ্যাস উৎপাদনে সবচেয়ে দায়ী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশও এর জন্য দায়ী। এ ব্যাপারে তারা কোনো আপত্তি জানায়নি। তারা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো ঘটবে তা ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনে অংশগ্রহণ করুক আর নাই করুক, তার ঘাড়ে এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রভাব অত্যন্ত জোরালোভাবে পড়বে। ক্যালিফোর্নিয়ায় আগুন লেগেছে, আজকে যখন আমরা কথা বলছি, তখন উত্তর আমেরিকায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, বরফে দেশ আচ্ছাদিত হয়ে আছে। এই বছর অনেক সাইক্লোন হয়েছে। জায়গায় জায়গায় খরা চলছে। সববিছু মিলে সারা পৃথিবীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে এবং আরও পড়বে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়বে। লবণাক্ততা বাড়বে। আমেরিকার একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে- তাদের ৫০টি এস্টেট আছে, তার মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫টি এস্টেট এসব সিদ্ধান্ত মানছে না। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সরকার না করলেও রাজ্যগুলো এ ব্যাপারে অনেক কাজ করবে। পৃথিবীর উন্নয়শীল দেশ, বিশেষ করে অনুন্নত দেশসহ বড় রাষ্ট্রগুলো এবং আফ্রিকার খারাপ দেশগুলো, যাদের ওপরে বিরূপ প্রভাবের চাপ অনেক পড়বে। তাদের পক্ষে এরূপ বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য যে সহায়তার কথা ছিল, যেমন- প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা, অর্থ দিয়ে সহায়তা, এগুলো বেশ কিছুটা থমকে যাবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থায়ন, সে অর্থায়ন তারা নাও করতে পারে।
খবরের কাগজ: আমরা জানি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ঝুঁকি প্রশমনে করণীয় কী?
ড. আইনুন নিশাত: এর ফলে পৃথিবীর সব দেশ ভুগবে। কিছু কিছু দেশের এই সমস্যা মোকাবিলার ক্ষমতা অনেক কম। এই দেশগুলোকে আমরা দেখেছি- স্বল্পন্নোত দেশ, দ্বীপরাষ্ট্র, সিক্স স্মল আইল্যান্ড ডেভেলপ এস্টেট এবং আফ্রিকার মধ্যভাগ অঞ্চলের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ভুগছে। কোন দেশ কী পরিমাণ ভুগবে তার অনেক হিসাবপদ্ধতি আছে। ১৫-২০ বছর আগে বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হতো। এখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জায়গায় যে তালিকা আছে- তাতে আমাদের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইনটেনসিভিটি এবং ফ্রিকোয়েন্সি বাড়বে অর্থাৎ এটা তীব্রতর হবে এবং এর ঘনত্ব বাড়বে। বাংলাদেশ যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ, আমরা বহুলাংশে এটা মোকাবিলা করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। আমাদের যেমন উপকূলজুড়ে বেড়িবাঁধ আছে, পৃথিবীর অনেক দেশেই তা আছে। আমাদের এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না- সরকার খেয়াল রাখলেই এ ব্যাপারে উন্নতি করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। এ বিষয়ে আমরা যখন কথা বলছি, তখন দেশে মাঘের প্রথম দিক, এ বছর শীত তেমন একটা পড়েনি। শীতের পর যে গরম আসে, মাঘের শেষে ফাল্গুনের প্রথমে, সেই পরিমাণ গরম ইতোমধ্যেই অনুভব হচ্ছে। আমি কিংবা আপনি যতটা অনুভব করছি, তার থেকে বেশি অনুভব করছে বৃক্ষরাজি। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, আম গাছে মুকুল চলে এসেছে। যে মুকুল আসার কথা ছিল আরও তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহ পর। এই যে প্রকৃতিতে মুকুল আগে চলে আসছে, এর ফলাফল কী হতে পারে, সেটা অনুমান করে নেওয়া দরকার। কারণ, জীববৈচিত্র্যের ওপর যে প্রভাব পড়বে, দিনকে-দিন তার প্রভাবটা বাড়তে থাকবে। কাজেই প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরও বেশি অগ্রগামী হতে হবে।
খবরের কাগজ: জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় উন্নত বিশ্ব যে ফান্ড দিয়েছে এবং যেসব কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, সেগুলো যথেষ্ট
কি না।
ড. আইনুন নিশাত: গবেষণা আর প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পেছনে যে অর্থায়ন প্রয়োজন, সেটা হয়তো আমরা যতটা আশা করতে পারতাম, তার থেকে কম পাব। আমার কথা অন্য জায়গায়। সেটা হচ্ছে- বৈশ্বিক যে অর্থায়ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র টাকা দেবে না। বাকি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কানাডা, রাশিয়া, কিংবা জাপান, অস্ট্রেলিয়া তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করবে। বাংলাদেশ কি সেই অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে? উত্তর হচ্ছে- না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজেদের অর্থ ব্যয় করে যে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, সেগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে অতিরিক্ত যে খরচ লাগবে- আমি অনুমান করি, এতে বাংলাদেশে সরকারিভাবে খরচ বাড়বে। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের প্রত্যেক খাতকেই প্রভাবিত করবে। প্রত্যেক খাতের কর্মকাণ্ডে জলবায়ু পরিবর্তনকে যোগ করতে হবে। কিন্তু আমরা এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমি বলতে চেষ্টা করছি- বহির্বিশ্বে আমেরিকা কিংবা উন্নত দেশকে আমরা দোষারোপ করতে পারি- তারা অর্থায়ন করছে না। যতটুকু অর্থায়ন করছে এবং বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে যে উন্নয়ন কাজ করছে, সেখানে কি জলবায়ুর বিষয়টা সঠিকভাবে ধরা হচ্ছে বা প্রমোট করা হচ্ছে? উত্তর হচ্ছে- না। কাজেই সে ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে- নিজের ঘর আগে ঠিক রাখতে হবে। তার পর অন্যদের বকাবকি করার কথা ভাবা উচিত।
খবরের কাগজ: সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে এবং সে ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার এখন থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?
ড. আইনুন নিশাত: হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে আমাদের দুঃখের কথা। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে যেসব জাতীয় পরিকল্পনা প্রয়োজন তা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ অভিযোজনের মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে। ২০২২ সালে তা বিশ্বের কাছে জমা দিয়েছে। বিশ্বে এটা নন্দিত হয়েছে। এটা একটা চমৎকার প্রমাণপত্র। এবং তার প্রক্রিয়া, তার কার্যক্রম করা অতি চমৎকার। আগামী দুই বছর পর এটার উন্নতি কতটুকু হয়েছে সেই রিপোর্ট জমা দিতে হবে। কাজেই বাংলাদেশ যদি জরুরিভাবে এটা নেয়, তাহলে বিশাল অ্যাডাপটেশন [অভিযোজন] প্লান্ট বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে কাজ শুরু করবে। দ্বিতীয় কাজ এনডিসি অর্থাৎ গ্রিন হাউস গ্যাস কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী কাজ করবে সেই কথা বলেছে এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি- আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ‘থ্রি জিরো’ নামে বই লিখেছেন। অর্থাৎ এর একটা হচ্ছে- জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে কাজ করা। জলবায়ু পরিবর্তন ড. ইউনূসের তিনটা শূন্যের একটা শূন্য। বাকি দুটো শূন্য হলো- সবার জন্য উপযুক্ত জীবিকার ব্যবস্থা করা এবং দেশে দারিদ্র্য যেন না থাকে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জীবিকার ব্যবস্থা, দারিদ্র্য হ্রাস আর জলবায়ু পরিবর্তন- এই তিনটা যদি আমরা একসঙ্গে দেখি- তাহলে বলব, আমরাই এই ফরমুলা তৈরি করছি। আমেরিকা কী করবে না করবে- হ্যাঁ আমরা হয়তো পিছিয়ে পড়লাম। পৃথিবী পিছিয়ে গেল। কিন্তু তার জন্য আমাদের বসে না থেকে, কারোর দিকে আঙুল না তুলে আমাদের যা করণীয় এবং যা আমরা করতে পারি- সেটা করা উচিত। যেমন- এতে বারবার বলছি- আমাদের লোকাল গভর্নমেন্ট বা স্থানীয় সরকার, আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য মন্ত্রণালয়, ইভেন্ট অ্যাফেয়ার্স, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়- প্রত্যেককেই জলবায়ু পরিবর্তনকে তাদের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয় তার জগতে বাস করে। বাকি মন্ত্রণালয় যেমন- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সব মন্ত্রণালয়কে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে দায়বদ্ধতা মেনে নিতে হবে। সবকিছুতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দিকে আঙুল তুললে হবে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরামর্শ দিতে পারে। বিদেশের সঙ্গে কথা বলতে পারে। এই মুহূর্তে ঢাকা শহর মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন। কারণ, যেকোনো সময় ২০০, ২৫০, ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই ঢাকার ৮০ ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এজন্য কি সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তথা সিটি করপোরেশন কিছু করেছে? শুধু ঢাকা শহর কেন, বাংলাদেশের প্রত্যেকটা শহরের একই অবস্থা হবে। আমি মনে করি, এসব বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
খবরের কাগজ: বায়ুদূষণে ঢাকা সব সময় শীর্ষ অবস্থানে থাকে। বায়ুদূষণ রোধে করণীয় কী?
ড. আইনুন নিশাত: বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশে পঞ্চম পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। বায়ুদূষণের প্রধান উৎস চিহ্নিত হয়েছে এবং পরিমাণটাও নির্ধারিত হয়েছে। ১৪ থেকে ১৫টি জায়গায় বায়ুদূষণের পরিমাণ মাপা হয়। অবশ্যই ঢাকার অবস্থা সব থেকে খারাপ। এর কারণগুলো জানা থাকলে সেটাকে শুধরানো সম্ভব। প্রথমত, আমার অভিযোগ হচ্ছে- নির্মাণসামগ্রী ব্যবস্থাপনা। দেশ বড় হচ্ছে। মানুষের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে। ভবন নির্মাণ প্রয়োজন, বাড়িঘর নির্মাণ প্রয়োজন, রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রয়োজন। এই কাজে বালু, ইট ও সিমেন্ট ব্যবহার হয়। এগুলোকে আমরা যথাযথভাবে ঢেকে রাখি না। সামান্য বাতাসেই এগুলো থেকে প্রচুর ধুলা ওঠে। এখন এই ধুলাটা কী, তা আমাদের বুঝতে হবে। এর দুটি ধরন আছে- একটি হচ্ছে ১০ মাইক্রো (অর্থাৎ ১০ লাখ ভাগের ১০ ভাগ), আরেকটি হচ্ছে ২.৫ মাইক্রো অর্থাৎ এই মাইক্রো আমরা খালি চোখে দেখি না। এই সূক্ষ্ম বালুকণা যদি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে, সেখানে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই, এটা যদি খুব সহজেই অর্জন করা যায়, যেখানে রাস্তা নির্মাণ হচ্ছে, সেখানে মাটি শুকাতে দেওয়া যাবে না। পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। যেখানে বালু রাখা আছে- বালুটাকে ভিজিয়ে রাখলেই হলো। যেখানে ইট স্তূপ করে রাখা আছে- সেটাকে ভিজিয়ে রাখলেই কিন্তু এই ক্ষুদ্র ধূলিকণার উৎপত্তি হয় না। এটা অবশ্যই সহজ কাজ। এটার জন্য যারা নির্মাণ করছেন, সরকারি নির্মাণকাজ বা বেসরকারি নির্মাণকাজ, ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ- তারা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আমি পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িত ছিলাম এবং সেখানে তাদের কন্টাক্টরকে যে নির্দেশ দেওয়া ছিল- এই এলাকায় কোনো ধুলা উড়তে পারবে না। তারা পর্যায়ক্রমে নদীর পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখত। দ্বিতীয় কারণ হলো- গাড়ির কালো ধোঁয়া। গাড়ির পেট্রোল ঠিকমতো না পুড়লে সেখান থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। একটা গাড়ির পেছনে ভক ভক করে যদি কালো ধোঁয়া বের হয়- তাহলে বুঝতে হবে ইঞ্জিন ঠিকমতো পেট্রোলকে ব্যবহার করতে পারছে না অর্থাৎ পোড়াতে পারছে না। ঠিকমতো যদি পুড়ত তাহলে কোনো ধোঁয়াই বেরোত না। আমাদের দেশে প্রত্যেকটা বাস কিংবা ট্রাক তার নির্ধারিত শক্তির তুলনায় অনেক বেশি ভার বহন করে। একটা ট্রাকের যদি ক্ষমতা থাকে ১০ টন, সে ১৫ টন থেকে ১৮ টন বহন করে। একটা বাসের যদি ক্ষমতা থাকে ৪০ জন যাত্রী বহন করবে, প্রায়শই দেখা যায়, ৭০ থেকে ৮০ জন যাত্রী বহন করে এবং তাদের সঙ্গে প্রচুর মালপত্র থাকে। এটাকে আমাদের কমানো যেতে পারে। ট্রাক-বাস ওভার লোডিং করা যাবে না। এটা রাস্তারও ক্ষতি করে। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে- ইটভাটা। ইটভাটায় যে পরিমাণ কালো ধোঁয়া বের হয়- কয়লা দিয়েই হোক আর ফুয়েলই ব্যবহার করে হোক, এতেও ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং এই ইটভাটার ধোঁয়াকে যদি মডার্ন প্লান্টে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে দূষণ কমতে পারে। যেমন, আমি যদি বলি- মিরপুরে একটা ব্রিক ফ্যাক্টরি আছে, ক্যান্টনমেন্টের পাশে। সেখানে কোনো বায়ুদূষণ নেই। অর্থাৎ, প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ফ্যাক্টরিগুলো করা উচিত। চতুর্থত হচ্ছে- পাহাড়ের ধুলা। ভারতের দিল্লি, বাংলাদেশের ঢাকা, কেউ প্রথম আবার কেউ দ্বিতীয় হয়ে থাকে সবসময়। ওদের কারণ হচ্ছে- শহরের বাইরে চারপাশে যে ফসলের খেত আছে- গম কিংবা ধানের খড়গুলো তারা পুড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে প্রচুর ধোঁয়া হয়। আমাদের দেশে সেটা নেই। কিন্তু শহরের রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ ধুলাবালি-মাটি থাকে, সেটা থেকে দেখতে পাচ্ছি যে, সিটি করপোরেশন সেখানে পানি দিয়ে ধুলাটা কমানোর চেষ্টা করছে। মূল কথা হচ্ছে- আমরা সমাধান জানি- এটার বাস্তবায়ন আমাদের ঘটাতে হবে।
দ্বিতীয় কিস্তি আগামী দিন। চোখ রাখুন…