
ড. আইনুন নিশাত একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বৈচিত্র্যময় গবেষণা প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। তিনি বাংলাদেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের একজন অগ্রণী বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নে (আইইউসিএন)-এ বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং এশিয়া অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের সিনিয়র উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য এবং ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘতম যমুনা এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শদাতা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা
আমরা পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারিগরি ভিত্তিটাকে মূল ভাবি। কারিগরি লোকদের দোষারোপ করি বা চাপ সৃষ্টি করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যারা কারিগরি বিষয়ে তেমন কিছু বোঝেন না, তারা গভীরভাবে মতামত প্রকাশ করেন। আমি মনে করি, মূল সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতির ভিত্তিতে। রাজনীতির ভিত্তিতে শুধু নদী নিয়ে আলোচনা হবে না, নদীর সঙ্গে অন্য ব্যাপারগুলোকেও যুক্ত করা হবে। মূলকথা হচ্ছে পানি কতটা পাব, কীভাবে পাব, কী ধরনের প্রকল্প হবে, সারা বছরের পানির একটা হিসাব-নিকাশ হবে কি না, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সম্ভাবনা আছে কিন্তু সেটা পাওয়া যাবে কি না, এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। কারণ ভারত তার নিজের স্বার্থ ষোলোআনা অর্জন করতে চায়। আমরা কি আমাদের স্বার্থ রাজনৈতিক মহলে তুলে ধরতে পেরেছি? এর উত্তর হচ্ছে- না।…
খবরের কাগজ: নদীদূষণ রোধে সরকার কী
ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: আমাদের দেশে নদীদূষণ করে দুই গ্রুপ। এক. সরকারি, দুই. প্রাইভেট। প্রথমত, ঢাকা শহরের নদীর ৯০ ভাগই অকেজো হয়ে আছে। আমাদের দেশে পয়োনিষ্কাশন নেই; বিশেষ করে ঢাকা শহরে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ঠিক নেই। গুলশান, বারিধারা, বনানীতে থাকেন শহরের উচ্চবিত্তদের একটা অংশ। তাদের কি স্যানিটারি সিস্টেম আছে? উত্তর হলো- নেই। এই ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরের নদীগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর জন্য সরকারি সংস্থা, ঢাকা-চিটাগং-খুলনার ওয়াসাই দায়ী। দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে- আমাদের কলকারখানার লিকুইড বর্জ্য বা সলিড বর্জ্য নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কারণ, যত্রতত্র লিকুইড বেজড ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এখন ঢাকার কথা যদি বলি- ইতোমধ্যে সার্ভে করে কোন পয়েন্ট থেকে বর্জ্য নিষ্কাষিত হয়, কারা পরিশোধন করে না, তা চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে যদি আইন প্রয়োগ করা হয় কিংবা শিল্পপতিরা যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগুলো ঠিক করেন, তাহলে এ থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। আমি যখন দেখতে পাই যে, আমাদের দেশে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিসগুলো চেষ্টা করছে- কিন্তু তা হচ্ছে না। অথচ লেবার ইন্ডাস্ট্রি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রি। আমি মনে করি, দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে যদি আমাদের লেবার ইন্ডাস্ট্রিগুলো ঠিকমতো পরিশোধনের কাজ না করে তাহলে তাদের নিজেদের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে।
যে কয়েকটা লেবার কোম্পানি বর্জ্যব্যবস্থাপনাসহ কারখানা অপারেট করে, সেগুলো রপ্তানি করতে পারছে। বাকিগুলো পারছে না কেন? মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টা কোম্পানি এটা পারে। ৩০০ থেকে ৪০০ কারখানা পারে না। শুধু এই বর্জ্য ফেলে নদীদূষণের কারণে দেশবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার সঙ্গে বিশ্ব সজাগ হয়ে বলছে- অর্থাৎ তোমরা যদি এগুলো ক্লিন না করো, তাহলে তোমাদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেব। কাজেই এটাকে গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। আমি মনে করি, এর জন্য পর্যাপ্ত আইন আছে। শুধু আইন থাকলে হবে না, তার প্রয়োগ থাকতে হবে। আমাদের দেশে এই প্রয়োগটা নেই। আবারও বলছি, এই প্রয়োগটা সরকারি-বেসরকারি মহল অর্থাৎ দুই দিক থেকেই করতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
খবরের কাগজ: আপনি দীর্ঘ সময় নদী কমিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করেছেন। দেশের পানি বণ্টন ইস্যুতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা যৌথ নদী কমিশন গঠন করি। ওই কমিশনের মাধ্যমে দুই দেশের যে ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে, তার পানি বণ্টন এবং বন্যা মোকাবিলার বিষয়ে আলোচনার শুরু হয়। তখন শুধু গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে কি না, সেই তথ্য ভারত থেকে পাওয়া যেত। তার পর অন্য নদ-নদীগুলোর পানিপ্রবাহের তথ্য দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে জানানো হয়। আমি যৌথ নদী কমিশনের সদস্য থাকা অবস্থায়ও সব অভিন্ন নদ-নদীর তথ্য নিয়ে ভারতের সঙ্গে অনেকবার আলোচনা করেছি। দুই দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা মিলে যৌথভাবে বন্যার পূর্বাভাসের তথ্য আদান-প্রদান করি। এতে দুই দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উপকার হবে। বন্যার পানির আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ঐকমত্য হয়েছে। নদীর তথ্য বিনিময় করলে কোনো দেশের ক্ষতি নেই, উপরন্তু লাভ আছে। আমরা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে এ ব্যাপারে একমত হয়েছি। কিন্তু যখনই এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের জন্য রাজনীতিবিদদের কাছে যাই, তখনই তা আটকে যায়, যা খুবই দুঃখজনক।
আমরা পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারিগরি ভিত্তিটাকে মূল ভাবি। কারিগরি লোকদের দোষারোপ করি বা চাপ সৃষ্টি করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যারা কারিগরি বিষয়ে তেমন কিছু বোঝেন না, তারা গভীরভাবে মতামত প্রকাশ করেন। আমি মনে করি, মূল সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতির ভিত্তিতে। রাজনীতির ভিত্তিতে শুধু নদী নিয়ে আলোচনা হবে না, নদীর সঙ্গে অন্য ব্যাপারগুলোকেও যুক্ত করা হবে। মূলকথা হচ্ছে পানি কতটা পাব, কীভাবে পাব, কী ধরনের প্রকল্প হবে, সারা বছরের পানির একটা হিসাব-নিকাশ হবে কি না, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সম্ভাবনা আছে কিন্তু সেটা পাওয়া যাবে কি না, এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। কারণ ভারত তার নিজের স্বার্থ ষোলোআনা অর্জন করতে চায়। আমরা কি আমাদের স্বার্থ রাজনৈতিক মহলে তুলে ধরতে পেরেছি? এর উত্তর হচ্ছে- না।
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধন কীভাবে সম্ভব?
ড. আইনুন নিশাত: তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রস্তাব এবং ভারত কী করতে চায় তার কোনোটিই এখনো পরিষ্কার নয়। ভারত ও চীন যে দেশই বাস্তবায়ন করুক না কেন কারিগরি দিক বিবেচনায় তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সমস্যার প্রকৃত সমাধান কঠিন হবে। তিস্তা দিয়ে কোনো পানি আসে না। এই শূন্য পানি দিয়ে আপনি কী ব্যবস্থাপনা করবেন? হ্যাঁ, ব্যবস্থাপনা করা যায় উজানে যদি জলাধার নির্মাণ করা যায়। উজানে জলাধার করলে বর্ষায় ৩-৪ লাখ কিউসেক যে পানি আসে, তার পানি ধরে রাখলাম বা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করলাম এবং পানি ছাড়লাম সারা বছর। বর্ষার সময় একটু বেশি কিন্তু শীতকালে কিছুতেই ২০ হাজারের কম হবে না। তাহলে ২০ হাজার হলে ভারত যদি ১০-১২ হাজার কিউসেক নেয় আমাদের ৮ হাজার দিলে দুই দেশের চাহিদা মেটে। কাজেই ব্যবস্থাপনার জন্য জলাধার নির্মাণ প্রয়োজন। এই জলাধার বাংলাদেশের তিস্তার বুকে করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে।
খবরের কাগজ: আপনি পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। দেশে পরিবেশ রক্ষায় আপনার অভিমত কী?
ড. আইনুন নিশাত: আমার মতে, দেশ চলার কথা এবং দেশ চলা উচিত সংবিধানভিত্তিতে। সংবিধানের ১৮ (ক) ধারায় পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে- রাষ্ট্র পরিচালিত হবে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বনভূমি ইত্যাদি সংরক্ষণ করে। আমাদের যারা আইনপ্রণেতা, যাদের আইন রক্ষা করার কথা অর্থাৎ সংসদ সদস্য- তারাই এটার মেইন ভায়োলেট এবং আমরা বাঙালিরা পরিবেশের কথা বুঝি না। মিটিংয়ে গিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলি। তারা এই দূষণ, সেই দূষণ করছে। কারা বায়ুদূষণ করছে? কারা পানিদূষণ করছে? কারা ভূমিদূষণ করছে? কারা শব্দদূষণ করছে? কারা এসব দূষণের শীর্ষে আছে- যারা দেশ পরিচালনায় আছেন তারাই। কাজেই যতদিন আমাদের শিল্পপতিরা, আমাদের ব্যবসায়ীরা দূষণ করা থেকে বিরত থাকবেন- ততদিন দেশ ভালো থাকবে। তারা মনে করেন যে, ফ্রি কান্ট্রি- যার যা খুশি তাই করবেন। দুখের কথা এটাই যে, এই দেশে আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই!
খবরের কাগজ: আমাদের দেশে রাস্তা তৈরিতে যারা নকশা করেছেন বা পরিকল্পনা করেছেন
তারা পানিপ্রবাহের বিষয়টা ভাবেন বলে আপনি কি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: আমি নিজে একজন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পরিকল্পনায় ইঞ্জিনিয়াররা সিদ্ধান্ত নেন না। রাস্তাঘাট নির্মাণে সিদ্ধান্ত নেন আমলা এবং রাজনীতিবিদরা। একসময় সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক ছিলেন রাষ্ট্রের এক নম্বর পজিশনে থাকা ব্যক্তি। তিনি ও তার সহযোগীরা যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে। অন্যদিকে এটার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে পরিবেশ বিভাগ। মূলত এর প্রভাব দেখা যাবে ১০-১৫ বছর পর। কারণ আমাদের আইন অনুযায়ী প্রত্যেকটা রাস্তা হচ্ছে রেড ক্যাটাগরি অর্থাৎ এটা করার আগে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে সেটা ভেবে দেখতে হবে এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে সার্টিফাই করতে হবে। বর্ষাকালে হাওর অঞ্চলে প্রচুর লঞ্চ ও নৌকা চলে। আপনি এই রাস্তা দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দিলেন। বেশ কিছু ব্রিজ হয়েছে কিন্তু সেগুলো কতটা যৌক্তিকভাবে করা হয়েছে, সেটাই বিবেচ্য। সর্বত্রই ঠিকাদার নিয়োগ করে যথেচ্ছ নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা যদি সভ্য দেশ হতাম তাহলে এ রকম হতো না। আমাদের দেশের আইন রয়েছে কিন্তু মানা হয় না। এই দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের। এখন সরকার যদি সরকারের আইন না মানে তাহলে বিশেষজ্ঞরা আর কী-বা করতে পারেন বা করবেন?
খবরের কাগজ: দেশে নদী দখল, খাল ভরাট, স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে; যা বর্তমানে পরিবেশদূষণের অন্যতম বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ড. আইনুন নিশাত: প্রথমত, দেশের নদীগুলো বাঁচাতে হবে। নদী তার নাব্য হারাচ্ছে দিন দিন। সর্বত্র নদী দখল, ভূমি দখল করে শিল্পকারখানা তৈরি করা হয়েছে। নদী দখল করে প্রস্তুত করা এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। নদী দখল করে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার যে মূল বৈশিষ্ট্য, ইতোমধ্যে সেখানে বিরূপ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। সেটা হলো অনিশ্চয়তা। প্রকৃতি কখন কীভাবে কী ধরনের আচরণ করবে, তার পুরো ছন্দটাই নষ্ট হয়ে গেছে বা যাওয়ার পথে। শীতের সময় শীত নেই। অন্যদিকে গরম অনুভূত হলেও পরে দেখা যাচ্ছে গরম একদম কমে গেছে। এই বিরূপ প্রকৃতিকে মোকাবিলা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে অধিকার রক্ষা ও জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি তরুণদের স্বতঃপ্রণোদিত অংশগ্রহণ, একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অধিকার রক্ষার কার্যক্রম ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে এবং মানুষের জীবন-জীবিকা উন্নয়নে নদী, বন ও জলাভূমি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। মূল কথা, আমাদের প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। টেকসই উন্নয়ন মানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানুষের সহায়তা ও পরিবেশ রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ আজ চার ঋতুতে পরিণত হয়েছে। ছয় ঋতু থেকে দুটি ঋতু প্রায় বিলীন হতে চলেছে। আজকাল আষাঢ়েও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। ফলে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য তার সহজাত মাধুর্য হারিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার সংকটও দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে উপকূলের মানুষ ভালো নেই। আগামীতে উপকূলে জলোচ্ছ্বাস ও দুর্যোগ বাড়বে। যা মোকাবিলা করতে এখনই প্রস্তুতি বাড়াতে হবে। একটি নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বশীলদের এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে আমাদেরই এর মাসুল গুণতে হবে বহু গুণ বেশি।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশে আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় গাছপালা কম। সরকারের বনায়ন কর্মসূচি আছে। সেটা কতটা কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: ব্রিটিশরা ১৯৪৭-এ বিদায় হলো, তখন লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি। আজকে ১৮ কোটি। ২ কোটি বিদেশে থাকে। তারা দেশে থাকলে ২০ কোটি হতো। যে কারণে আমাদের অনেক জমি লাগবে। ফ্যাক্টরির জন্য জমি লাগবে- ইত্যাদি ইত্যাদি। সেগুলোকে চিন্তা করে এই কাজটা করতে হবে।
পৃথিবী বিভিন্ন সময়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণে এনে কীভাবে পরিবেশসম্মতভাবে জনজীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, তার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকে। আমরা সেগুলোয় সই করে আসছি। সে অনুযায়ী দেশের ভেতরেও অ্যাকশন প্লান্ট তৈরি করি। যেমন- সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-এর ১৭টি গোল আছে। এই ১৭টার মধ্যে মূলত একটি ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন। সেটার মাধ্যমে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এর আগে যে সরকার ছিল- তাদের সিনিয়র মোস্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব ছিল এই টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে চালু রাখা। দূষণ বলি আর নগরায়ণ বলি কিংবা খাদ্যনিরাপত্তা বলি- সবকিছু তাদের দায়িত্ব ছিল। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টেও একজনকে সিনিয়র সচিবের পদমর্যদায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, বিশ্বে আইন আছে। সে অনুযায়ী আমাদেরও আইন আছে। আমরা সবাই বুঝি কী করতে হবে। কিন্তু আমরা করি না। অর্থাৎ, আমরা জ্ঞানপাপী। দেশের যে আইন আছে, নীতি আছে- সবই ঠিক আছে। সংস্থা আছে, কিন্তু কোনো ইমপ্লিমেন্টেশন বা প্রয়োগ নেই। সেটার জন্য একটা সমস্যা আমরা নির্দেশ করি, যেটাকে আমরা সংক্ষেপে বলি (MEL) মনিটরিং ইভেল্যুয়েশন অ্যান্ড লার্নিং। মনিটরিং ইভেল্যুয়েশনের জন্য আমাদের দপ্তর আছে। কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু মনিটর করে আমরা কিছু শিখি না। কাজেই, উন্নয়ন ঘটাতে হলে আমাদের কাজ আমাদেরই করতে হবে। আমি মনে করি, এটা অর্জন করা সম্ভব। ইইউ বা অনেক দেশ একসময় তারা গাছপালা কেটে, বন কেটে একটা উদ্ভূত অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। তাদের বড় বড় নদীগুলো বেশ ছোট ছিল। কিন্তু তারা সবগুলো পরিষ্কার করেছে। তারা শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। নদীদূষণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। কাজেই পৃথিবীতে যথেষ্ট নজির আছে- আমি বললাম যে, আমাদের আইন আছে, পলিসি আছে, কর্মকর্তা আছেন। আমাদের সবকিছুই আছে কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। এই কাজটা আমাদের দ্রুত করতে হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা এবং তাদের জনজীবনকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে না। কাজেই নতুন প্রজন্মের জন্য প্রকৃতিনির্ভর নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার এখনই সময়। সে লক্ষ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতিতে সুনজর দেওয়ার পাশাপাশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. আইনুন নিশাত: আপনাকেও ধন্যবাদ।