
বিশ্বের অনেক শহরেই নগর-বন করার রীতি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। নগর-বন করতে বেশ খানিকটা বড় পরিসরের জায়গা লাগে। সাধারণত নগরের কোনো পরিত্যক্ত এলাকা বা পতিত জমিতে কোনো স্থাপনা না বানিয়ে সেখানে ছোট আকারে প্রাকৃতিক বন সৃজন হলো নগর-বনের মূল ধারণা। অবশ্যই সেটি কোনো পার্ক বা উদ্যান হবে না, কোনো সাজানো গোছানো বাগান হবে না। হবে সে স্থানের পরিবেশ ও প্রতিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার সমাহার। সে বনে প্রাথমিকভাবে কিছু গাছপালা লাগানো হলেও পরবর্তীতে সেসব গাছের বীজ বা মৃত্তিকাপ্রসারী শিকড় থেকে চারা গজিয়ে আপনা আপনি দ্রুত সেটা একটা প্রাকৃতিক বনে রূপ নেবে। সেসব বনের কোনো ব্যবস্থাপনারই দরকার হয় না।
নগর-বনের পরিবেশে থাকে নানা ধরনের গাছপালা, জলাশয়, ডোবা, টিলা ইত্যাদি। সেসব গাছের ঝরাপাতা সেখানেই বনতলে তৈরি করে এক আলাদা অণু-পরিবেশ, পাতাগুলো পচে মাটির জন্য সার হয়, গাছেরাও পুষ্টি পায়। সেসব ঝরা পাতা ও ঝোপের ভেতর জন্ম নেয় অনেক পোকামাকড় ও অণুজীব। বৃক্ষ, গুল্ম, তৃণ-লতায় সেখানে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয় যেখানে বিভিন্ন জীব-জন্তুও নির্ভয়ে থাকতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। সেসব বনে থাকে না কোনো স্থাপনা ও পাকা পথ-ঘাট। বনপথ তৈরি হয় সেসব বনে যাওয়া মানুষদের চলাচলে। আমেরিকায় গিয়ে এরূপ বেশ কিছু নগর-বন দেখেছি, যেগুলো থাকে সাধারণত নগর বা শহরের উপকণ্ঠে, লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালার ভেতর থাকে পাখি ও প্রজাপতিদের মেলা, এমনকি নির্ভয়ে ঘুরতে দেখেছি বুনো হরিণ ও বুনো হাঁসদের। ঢাকা শহরে এরূপ দুটি নগর-বন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এর একটি হওয়ার কথা ছিল বনানীতে, অন্যটি কল্যাণপুরে। জানি না সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না।
ব্যস্ত শহরের রাস্তার ধার, সুপ্রশস্ত সড়ক দ্বীপ, খেলার মাঠের কোনা, পার্ক, শপিং সেন্টার, কনডোনিয়াম বা আধুনিক আবাসিক এলাকা, ঝিল ও নদীপাড় ইত্যাদি স্থান সবুজ শ্যামলিমায় ভরিয়ে দিতে সম্প্রতি নতুন আর একটি ধারণার চর্চা চলছে। লন্ডন থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত অনেক শহরেই এখন এই ‘খুদে-বন’ ধারণায় শহরকে শ্যামল করার চেষ্টা চলছে। পৃথিবীর প্রায় ৫৬ শতাংশ লোক বাস করে শহরে, কিন্তু অধিকাংশ শহরে নেই পর্যাপ্ত বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমি। বাংলাদেশের ২১ দশমিক ৪ শতাংশ লোকের বাস শহরে, শহরগুলোতে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা মোট শহরগুলোর আয়তনের ১০ শতাংশের বেশি হবে না, যা থাকা উচিত ছিল কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ। এদিক দিয়ে নরওয়ের অসলো শহরে নগর-সবুজের পরিমাণ প্রায় ৭২ শতাংশ, ইউরোপীয় দেশগুলোর শহরে ৪২ শতাংশ। যেসব শহরে সবুজের পরিমাণ কম রয়েছে সেসব শহরে ‘খুদে-বন’ সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
‘খুদে-বন’ ধারণার প্রবক্তা জনৈক জাপানি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও উদ্ভিদ-পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত অধ্যাপক আকিরা মিয়াওয়াকি। তিনি সত্তুরের দশকে এ ধারণাটি দেন। পরে বিশ্বের অনেক দেশেই ‘খুদে-বন’ চর্চা শুরু হয়। মাত্র ৯ বর্গমিটার অথবা ৩০ বর্গফুট জায়গার মধ্যেই এই খুদে-বন তৈরি করা সম্ভব। জায়গা বেশি থাকলে আরও বড় বন করা যেতে পারে। এ ধারণায় সেই স্বল্প পরিসর জায়গায় স্থানীয় বা সে স্থানে যেসব গাছ ভালো জন্মে সেসব স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগানো হয় ঘন করে। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ও আবাসিক দেশি প্রজাতির গাছগুলো লাগানোর সুবিধা হলো, সেসব গাছ দ্রুত সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে এবং দ্রুত বাড়তে পারে। এতে যে বন সৃষ্টি হয় তা হয় টেকসই।
অধ্যাপক মিয়াওয়াকি জাপানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এক হাজারেরও বেশি এ ধরনের ‘খুদে-বন’ তৈরি করেন। বর্তমানে তার এ কৌশল ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন শহরে ‘খুদে-বন’ তৈরি করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে এরূপ বন সৃজন শুরু হয়, ২০২১ সালের আগস্টে পাকিস্তানের সাগিয়ান শহরে ১২ দশমিক ৫ একর জায়গাজুড়ে এরূপ একটি শহুর বন তৈরি শুরু হয়। সে বনে এখন ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি গাছপালা রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া জেলা পরিষদ পাইলট প্রকল্প হিসেবে নদীর পাশে শ্যামপুর ১ নম্বর ব্লকের কমলপুর গ্রামে কয়েক বিঘা জমির ওপর করা হয়েছে এরূপ খুদে-বন। এতে মনে হচ্ছে ‘খুদে-বন’ শুধু শহরে না, গ্রামেও হতে পারে।
বাংলাদেশেও চট্টগ্রামে মিরেরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনার পাহাড়ে এ পদ্ধতির একটি খুদে প্রাকৃতিক বন সৃজন করা হয়েছে। ঢাকা শহরে ধানমন্ডি ঝিলের ধারের একটি ছোট্ট অংশে এরূপ একটি বনের অস্তিত্ব রয়েছে, তবে সেটি আধা-প্রাকৃতিক হয়ে টিকে আছে। সেখানে গেলে ঘন গাছপালা ভরা সে অংশটাকেই কিন্তু ধানমন্ডি ঝিল উদ্যানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গ্রামীণ বন বলে মনে হয়। এ উদাহরণ আমরা দেশের বিভিন্ন শহরের পার্কগুলোতেও সৃষ্টি করতে পারি। দেশে বন গবেষণার নানা দিক নিয়ে গবেষণা হলেও, নগর-বন নিয়ে গবেষণা নেই বললে চলে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে গবেষকরা ভাবতে পারেন এবং দেশের প্রতিটি শহরের জন্য খুদে-বনের কয়েকটি মডেল সুপারিশ করতে পারেন। কোন শহরের খুদে-বনের জন্য কী কী প্রজাতির গাছ সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হবে, সে তালিকাও করে দিতে পারেন বৃক্ষপালনবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।
নগরে এ ধরনের খুদে-বন তৈরির সুবিধা হলো, শহরে গাছপালা লাগানোর জায়গা পাওয়া যায় কম। আবার শহরে বায়ুদূষণও থাকে দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। তাই এমন কিছু গাছপালা দরকার যেগুলো দ্রুত বাড়তে ও বায়ুদূষণ কমাতে পারে। মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে দেখা গেছে, এরূপ বনে লাগানো গাছগুলো প্রতি বছর গড়ে সাধারণ গাছের তুলনায় ১০ গুণ দ্রুত গতিতে বাড়ে। বছরে একটি গাছ গড়ে ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এতে কয়েক বছরের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বন তৈরি করা সম্ভব। মাত্র ২০ বছরেই এ পদ্ধতিতে যে বাগান হবে, তা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে হতে সময় লাগবে এর তিন গুণেরও বেশি। তাছাড়া এরূপ বনে লাগানো গাছগুলোর দুই থেকে তিন বছর পর থেকে আর কোনো পরিচর্যার দরকার হয় না।
এমনকি কোনো গাছ মরে গেলে বা পড়ে গেলে তাকে সেখানে সেভাবেই ফেলে রাখা হয়, সরানো বা পরিষ্কার করা হয় না। সেসব গাছ নিজেরাই বাড়তে থাকে। এমনকি সেসব গাছে কোনো সেচ, সার, বালাইনাশক কিছুই দিতে হয় না। এসব খুদে-বনের গাছগুলো প্রায় ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিশোষণ করতে পারে, যা নগরের পরিবেশ ভালো রাখতে খুবই দরকারি। বর্তমান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা শহরের নগর পরিকল্পনায় সবুজায়ন, জীববৈচিত্র্য ও জলাধার সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন, যা একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নগর সবুজায়নে ‘খুদে-বন’ সৃষ্টির ধারণাকে বিবেচনা করা যেতে পারে।
লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক