ঢাকা ১ চৈত্র ১৪৩১, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
English

সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:২৭ পিএম
সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর
রায়হান আহমেদ তপাদার

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জোরেশোরে উঠে এসেছে রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়টি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এদিকে বিএনপি বলেছে, এটা শুধু চ্যালেঞ্জের ব্যাপার নয় বরং এখানে বাস্তব বিষয় হলো- সংস্কার হবে কি হবে না- সেটা ঠিক করবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ ও জনপ্রতিনিধিরা। দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ হলে সবার সব প্রস্তাব সংসদে যাবে। 

সেখানে এগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তার পর দেশ ও জাতির জন্য যেটা যেমন করা দরকার সংসদ তাই করবে। এজন্যই বিএনপি জুন-জুলাইয়ের মধ্যেই নির্বাচন চায়। অনেকের মতে, সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার হবে সংবিধান সংশোধন করে কোনো কিছু গ্রহণের জন্য। সংসদ ছাড়া এসব আলোচনার গুরুত্ব কতটা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই হবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা।

রাজনৈতিক দল, বিশ্লেষক ও সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের কেউ কেউ বলছেন, সুপারিশগুলো সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কিংবা তাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐকমত্য না হয়, তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ শেষ পর্যন্ত কাগজেই থেকে যেতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তাদের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের কারণে যেহেতু শুধু প্রস্তাবই পেশ করতে পারবে বলে মনে হয়, তার পরও জরুরি সমস্যাগুলো সমাধানে জরুরি মনোনিবেশ তাদের করতে হবেই। সে জন্য তাদের একটি প্রধান কাজ হবে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বেঞ্চমার্কগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা। 

এ ছাড়া ঘাড়ের ওপর পড়ে যাওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান করে জনগণকে স্বস্তি দেওয়াও কিন্তু এ সরকারের দায়িত্ব। তাদের বন্ধুরাও এই মুহূর্তে তাই বলছে। সুতরাং, তাদের মূল দায়িত্ব হবে সঠিক ও স্বল্পসংখ্যক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ ছাড়া নানা রকম সৃজনশীল অপ্রচলিত সংস্কার প্রস্তাব বর্তমানে উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের টাস্কফোর্স ও কমিশনগুলোও কিছু পেশ করেছে। কিছু সুপারিশ প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। অর্থনীতির অবস্থানের ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার বিভিন্ন তথ্য নিয়েও পক্ষ-বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। এর মানে বিগত সরকারের সবকিছুই ঠিক ছিল না- সেটাও সত্য নয়। সম্প্রতি দুর্নীতি ও বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও আসলে কীভাবে চরম দারিদ্র্য হার কমল ও মানবউন্নয়ন সূচকগুলোয় উন্নতি অর্জিত হলো- সেটি বর্তমান উন্নয়নবিদদের তলিয়ে দেখা দরকার। কিছুই অর্জিত হয়নি- এ কথা যেমন সত্য নয়, কিন্তু যেটুকু অর্জন সম্ভব ছিল তা অনেকখানি দুর্নীতি ও বৈষম্যের কারণে অর্জন করা যে সম্ভব হয়নি তা আজ সবাই স্বীকার করেন। 

সুতরাং স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে আগামী যে বাজেট অন্তর্বর্তী সরকার প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তাতে তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- কীভাবে বৈদেশিক খাতে উদ্বৃত্ত ব্যালান্স তৈরি করে ক্রমবর্ধমান ডলার রিজার্ভ তারা তৈরি করবে বা করার সূচনা করবে।

নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগনীতি কী হবে? বাজেটে যে প্রচুর রাজস্বঘাটতি থাকবে তা কীভাবে পূরণ করবে? ব্যক্তি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে যথাসম্ভব ধরে রাখা যায় কীভাবে, তার উপায় উদ্ভাবন অর্থাৎ বিনিয়োগ আবহাওয়ার উন্নতি করে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কীভাবে অব্যাহত রাখবে? মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা দুই-ই কাটিয়ে অর্থনীতিতে কীভাবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা আনবে? এবং সর্বশেষ, কয়েকটি চিহ্নিত খাতে সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে? নতুন প্রতিষ্ঠান ও নতুন সৎ ও দক্ষ মানবসম্পদ কোথায় পাবে, যাতে শুধু ভালো আইন বা নীতিই প্রণীত হবে না, তা বাস্তবায়িতও হবে। নিঃসন্দেহে এগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং ও পুঞ্জীভূত কঠিন সমস্যা। কিন্তু এগুলোর জন্য যেসব জরুরি নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন- বিশেষত আর্থিক খাত, জ্বালানি খাত, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় যেসব আশু জরুরি সংস্কার শুরু করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে, তা শুরু না করতে পারলে জনগণের মনে প্রয়োজনীয় বিশ্বাস, আস্থা বা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং গোলযোগ ও সামাজিক বিরোধ আরও বৃদ্ধি পাবে। যার সুস্পষ্ট লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

 সুশাসনের ও শৃঙ্খলার জন্য যে সমস্যাগুলো জরুরিভাবে মোকাবিলা করা দরকার ছিল সেগুলো কতটুকু এগোচ্ছে তাও ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। যেমন- জুলাই আন্দোলনকালে নিহত-আহতদের একটি সুস্পষ্ট সঠিক তালিকা প্রণয়ন, চিকিৎসা প্রদান এবং পুনর্বাসন। যেসব পুলিশ, শিক্ষা কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য কমবেশি অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদের এখন নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ন করে এদের মধ্যে যারা নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়েছিলেন অথবা যাদের অপরাধ লঘু, তাদের শনাক্ত করে মব জাস্টিসের মধ্যে ফেলে না দিয়ে একটি সুষ্ঠু, ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে।

ব্যক্তি বা দলীয় গ্রুপের হাতে, রাস্তাঘাটের শক্তির হাতে আইন না তুলে দিয়ে সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ নিতে পারলে দেশে কিছুটা শৃঙ্খলা এরই মধ্যে ফিরে আসত। পুলিশও আস্থা নিয়ে কাজে ফিরে আসতে সক্ষম হতো বলে মনে হয়। প্রথম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হঠাৎ বদল কেন হলেন সেটা স্পষ্ট নয়। সংবিধান কমিশনে কেন একজনকে বদলে বিদেশ থেকে আগত একজনকে নিয়োগ দেওয়া হলো তাও বোধগম্য নয়। কেন ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে তাও বোঝা মুশকিল। মূলধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের শক্তিশালী ভূমিকা তৈরি না করে নতুন পার্টি তৈরি করতে চাইলে সেটাও কাম্য নয়। 

অনেক ক্ষেত্রেই বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে বিভাজনের দাগ ক্রমেই মোটা করে চলেছে। প্রজাতন্ত্রের মালিক যদি জনগণই হয়ে থাকেন তাহলে আমলারা জনগণের স্বার্থ যেভাবে আমলে নেওয়ার কথা, সেভাবে নেন না কেন? কারণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমলারাই মূলত অনেক কিছুর কারিগর এবং যুথবদ্ধ। তারা শাসক-প্রশাসক। সাম্প্রতিক আলোচিত সংস্কার প্রশ্নে এসে তারা সেই হিম্মত আবারও দেখিয়ে দিচ্ছেন। কাজকর্মে শাসনের মনোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তারা অন্যদের সংস্কার করতে চান।

 নিজেরা সংস্কার হতে চান না। তাদেরই একটা বিশেষ গ্রুপ বিগত স্বৈরাচারকে শক্তি জজোগান দিয়েছে। দানবীয় ফ্যাসিস্ট করে তুলেছে। টানা দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রেখেছে। শেষতক ছাত্র-জনতার চরম ধাক্কা খেয়েছে। সরকার বিদায় নিয়েছে। দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সেবার পরিবর্তে শোষণের শিকারই হন বেশি। যদিও আমলা বা প্রশাসন বাদ দিলে দেশ চলবে না। বখে যাওয়া, বেপরোয়া হয়ে ওঠার লাগাম টেনে একটা বন্দোবস্তে আসা এখন সময়ের দাবি। এ সরকার তা না পারলে ভবিষ্যতে আর পারার আশা থাকবে না। কারণ এমন সুযোগ সব সময় আসে না। এ সরকার প্রশাসনকে একটা বন্দোবস্তের জায়গায় এনে দিতে পারলে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার সেটাকে একটা কাঠমোতে আনতে পারবে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

ইউরোপ সহজেই ইউক্রেনকে সুরক্ষিত করতে পারবে

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০২:২২ পিএম
ইউরোপ সহজেই ইউক্রেনকে সুরক্ষিত করতে পারবে
ড্যানিয়েল গ্রোস

ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাওয়ার মতো ইউরোপের যথেষ্ট আর্থিক ও সামরিক সম্পদ রয়েছে, এমনকি মার্কিন সমর্থন ছাড়াই। তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী বিমান বাহিনী এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ-পরীক্ষিত সামরিক বাহিনী প্রশংসাযোগ্য। ইইউ, যুক্তরাজ্য এবং নরওয়ে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ শক্তিশালী। 

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে বিভাজনটা হলো সবচেয়ে বড়। ন্যাটো আর রাশিয়ার পুনর্গঠনবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা নষ্ট করতে প্রতিশ্রুতিশীল ঐক্যবদ্ধ ব্লক গঠন করে না।

অন্যদিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির মতো হয়ে গেছে। তারা মনে করে পরাশক্তিদের প্রভাবের ক্ষেত্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব দাবি করার স্বাভাবিক অধিকার তাদের রয়েছে। ছোট ও দুর্বল দেশগুলো তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশীদের বশ্যতা স্বীকার করে। এখন ইউরোপে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়ানো ইউরোপের ওপর নির্ভর করে এবং ইউক্রেনকে রক্ষা করাও তাদের দায়িত্ব।

ইউরোপীয় নেতারা সামনের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে। লন্ডনের এক সমাবেশে তারা ইউক্রেনকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং সেখানে যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। যদি ইউরোপীয় শান্তি পরিকল্পনার সুযোগ তৈরি করতে হয়, তাহলে পুতিনকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ইউক্রেনের ওপর অব্যাহত আক্রমণের মূল্য রাশিয়ার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠবে।
সামগ্রিকভাবে, ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সহায়তা বছরে প্রায় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার অর্ধেকেরও বেশি ইউরোপ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য) থেকে আসছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সাল থেকে প্রায় ৬৭ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা প্রদানের তালিকা রয়েছে যা প্রতি বছর ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিমাণ অর্থ প্রতিস্থাপন করতে ইউরোপের খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয় যা ইউরোপের জিডিপির ০.২% এরও কম।

এই তহবিল নিয়মিত ইইউ বাজেট থেকে আসা সম্ভব না, কারণ এটি খুবই কম (জিডিপির মাত্র ১%) এবং বেশির ভাগ রাজস্ব এক বছর আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু ‘নেক্সট জেনারেশন ইইউ’ মহামারি-পুনরুদ্ধার তহবিলে যথেষ্ট অব্যয়িত অর্থ রয়েছে যা ইউক্রেনের দিকে পুনর্নির্দেশিত হতে পারে।
আরেকটি বিকল্প হতে পারে ইউরোপীয় দেশগুলোর একটি গ্রুপ, যেমন- বৃহৎ ইইউ সদস্য রাষ্ট্র, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য- একটি নতুন অর্থায়ন বলয় তৈরি করা যা ইউক্রেনের সাহায্যের জন্য ঋণ প্রদান করবে। এই পদ্ধতির একটি স্বতন্ত্র সুবিধা রয়েছে: এর জন্য ইইউ সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে না। তাই ট্রাম্পের মিত্র হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের মতো বা আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ ইইউ সদস্য যেমন অস্ট্রিয়া এবং আয়ারল্যান্ডের মতো দেশের বিরোধিতার মাধ্যমে এর কোনো বাধাগ্রস্ত হবে না।
নিশ্চিতভাবেই কেবল ‘স্থগিত’ মার্কিন সাহায্য প্রতিস্থাপন করা যথেষ্ট হবে না। সর্বোপরি, ইউক্রেন এতদিন পর্যন্ত যে সমর্থন পেয়েছে তা কেবলমাত্র রাশিয়ার অগ্রগতিকে ধীর করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের জোয়ার ঘুরিয়ে দিতে পারেনি। তার পরও, ইউরোপ প্রয়োজনীয় তহবিল নিয়ে আসতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

অর্থায়নের বাইরেও ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ সামরিক সরবরাহ যেমন ট্যাংক, বন্দুক এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য ইউরোপ প্রস্তুত। বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শূন্যস্থান পূরণ করতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। কারণ ইউক্রেন বর্তমানে মার্কিন-নির্মিত প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করছে। তার পরও ইউরোপীয় বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন- ফ্রাঙ্কো-ইতালীয় SAMP/T (Sol-Air Moyenne Portée/Terrestre), সেই সঙ্গে নরওয়ের স্বল্প-পাল্লার NASAMS (ন্যাশনাল অ্যাডভান্সড সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম) এবং জার্মানির IRIS-T (ইনফ্রারেড ইমেজিং সিস্টেম টেল/থ্রাস্ট ভেক্টর-নিয়ন্ত্রিত)। এই সিস্টেমগুলো এখন যুদ্ধ-পরীক্ষিত হয়েছে এবং প্যাট্রিয়টের তুলনায় কিছুটা কম ব্যয়বহুল বলে মনে হচ্ছে।

ইউরোপ যে ক্ষেত্রগুলোতে সহজেই আমেরিকার স্থান নিতে পারবে না তা হলো স্যাটেলাইট এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা। এই কারণেই ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগিতে ট্রাম্পের স্থগিতাদেশ দেশটির সেনাবাহিনীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ এরা রাশিয়ান সম্পদ লক্ষ্যবস্তু করার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আশা করা যায় যে, ট্রাম্প প্রশাসন শিগগিরই এই ধরনের বিনিময় পুনরায় শুরু করবে- যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তেমন কোনো মূল্য দিতে হবে না- যেমনটি তারা পরামর্শ দিয়েছে।

সরাসরি সামরিক সাহায্যের বাইরে গিয়েও ইউরোপের উচিত ইউক্রেনীয় ড্রোন উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের দক্ষতা- ড্রোন ডেভেলপারদের ছোট দলগুলো স্থলভাগে যোদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে উদ্ভাবনী, প্রায়শই কম খরচে সমাধান তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে এটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

সম্ভবত সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ প্রশ্ন হলো পুতিন যদি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন, তবে ইউরোপ কি ইউক্রেনকে বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে পারবে? মার্কিন সমর্থন ছাড়া কেবল ইউক্রেন নয়, সমগ্র ন্যাটো ভূখণ্ড রক্ষার জন্য ইউরোপকে লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েনের প্রয়োজন হবে।

এই বিষয়টি মাথায় রেখে ইইউ নেতারা সম্প্রতি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছেন। ইইউ মন্ত্রীরা এখন ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাব বিবেচনা করছেন, যাতে দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের জন্য আরও আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়। প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ইউরো (১৬০ বিলিয়ন ডলার) পর্যন্ত যৌথ ঋণ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া যায় যা ইইউ সরকারগুলোকে তাদের সামরিক সক্ষমতা জোরদার করার জন্য ধার দেওয়া হবে।

অনুমান করা যায়, এটিও যথেষ্ট হবে না। সাম্প্রতিক এক অনুমান মতে, ইউরোপীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বার্ষিক ব্যয় কমপক্ষে ২৫০ বিলিয়ন ইউরো বৃদ্ধি করতে হবে- যা জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ। তাছাড়া প্রয়োজনীয় কাঠামো এবং যুদ্ধ ইউনিট তৈরি করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে।
কিন্তু এই মাত্রায় পুনঃসজ্জিতকরণ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রধান শক্তিতে রূপান্তরিত করবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর অসাধারণ শক্তি রয়েছে তাদের জন্য এটা পর্যাপ্ত নয়। দেশের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ইউক্রেনের অভিজ্ঞ সামরিক বাহিনীর একটি বড় অংশকে একত্রিত রাখার খরচ এমন শক্তিশালী ইউরোপীয় বাহিনী তৈরির তুলনায় অনেক কম হবে। এদিকে, রাশিয়ার হাত থেকে আকাশপথ রক্ষা করার জন্য ইউরোপ সুসজ্জিত। ইউক্রেন মাত্র কয়েক ডজন পুরানো পশ্চিমা যুদ্ধ বিমান দিয়ে রাশিয়ার আকাশপথের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রায় ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইউরোপীয় বিমান বাহিনী তাদের শত শত উন্নত যুদ্ধবিমান নিয়ে গর্ব করে।

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ইউরোপকে যা করতে হবে তা হলো পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। ইউক্রেন যাতে স্থায়ী শক্তিশালী সেনাবাহিনী বজায় রাখতে পারে। স্পষ্ট করে বলা যায় যে, যেকোনো রাশিয়ান আক্রমণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইউক্রেনের ওপর নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। লাখ লাখ সৈন্য নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় যুদ্ধ বাহিনী তৈরির চেয়ে এটা অনেক দ্রুত করা সম্ভব এবং খরচও কম হবে। 

আজ রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে ধরে রাখার এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইউরোপের কাছে যথেষ্ঠ সম্পদ আছে। তাদের অবশ্যই সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।

লেখক: জার্মান অর্থনীতিবিদ এবং বোকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপীয় পলিসি মেকিং (IEP)-এর পরিচালক
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত 
অনুবাদ: িসানজিদ সকাল

মব ভায়োলেন্স: এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া জরুরি

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
মব ভায়োলেন্স: এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া জরুরি
অরূপ তালুকদার

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন তখন গুজব ছড়িয়ে বা কোনো না কোনো অজুহাতে দলবদ্ধভাবে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলার মতো সহিংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। যদিও উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বারবার জনগণকে এ ধরনের সহিংস তথা অমানবিক ঘটনা ঘটানো থেকে বিরত থাকার জন্য হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। তার পরও এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। 
গত বছর আগস্ট মাসের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার এক অভাবিত অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে স্বৈরাচারী তথা কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের। আওয়ামী সরকারের পতনের পর সর্বসম্মতিক্রমে গঠিত হয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এবং সেই সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কার্যক্রম শুরু করা হয়, যা এখনো চলমান।

দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যেও কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ নানা ধরনের দুষ্কর্ম ও অপরাধমূলক কাজের সুযোগ তৈরির কাজে লিপ্ত রয়েছে। সামাজিক স্থিতিশীলতার কথা বিবেচনায় নিয়ে এসব অপরাধপ্রবণ সুযোগসন্ধানীদের নিবৃত্ত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে ব্যক্তিগতভাবে অথবা দল তৈরি করে কিছু মানুষের নানা ধরনের জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম চালাতে আমরা দেখছি, যা দেশের সাধারণ জনগণের কষ্ট ও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। 

‘মব জাস্টিস’ এখন বহুল আলোচিত একটি শব্দ। যখন একজন ব্যক্তিকে অপরাধী বলে সন্দেহ করে একদল লোক যেকোনো সময়ে ভিড়ের মধ্যে মারধর বা হত্যা করে তাকে ‘মব জাস্টিস’ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটি ঘটে ‘মব ভায়োলেন্স-এর আদলে, প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা থেকে। এবং পরে এই অমানবিক তথা বেআইনি ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য বলা হয় ‘মব জাস্টিস’। সভ্য সমাজে যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন এ ধরনের প্রবণতা সমাজে বেড়ে চলেছে? মানুষ কেনই বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন তুলে নিচ্ছে নিজের হাতে? এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। যদিও বেশির ভাগ মানুষ এই প্রশ্নের উত্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে নানামুখী শৈথিল্যকেই দায়ী করে থাকেন। 

কেউ কেউ বলেন, দেশে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে জড়িত হলো পুলিশ বাহিনী। কারণ তারা দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে। কিন্তু পুলিশ বাহিনী এখনো নানা কারণে একটা ট্রমার মধ্যে আছে, যা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। আসলে তাদের মানসিক জোর ফিরিয়ে আনতে হবে। 
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, পুলিশ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন হামলা, হুমকি ও আসামি ছিনতাই ইত্যাদি ঘটনা বাহিনীটিকে নতুন সংকটে ফেলছে। পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার না করে পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে আরও কঠোর হতে হবে।

সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, নাগরিক সমাজের প্রতি আমার অনুরোধ, পুলিশকে আপনারা আবার কাছে টেনে নিন। পুলিশকে তার কাজ করতে সহায়তা করেন। আমরা চেষ্টা করছি যারা অপরাধী (পুলিশ) তাদের বিচারের আওতায় এনে ও সরিয়ে দিয়ে পুলিশকে আবার সগৌরবে ফিরিয়ে আনতে এবং কর্মক্ষম করে গড়ে তুলে পুনরায় মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে। 

তিনি আরও বলেন, এক হাজার শহিদ ও কয়েক সহস্র আহত ছাত্র-জনতা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, ৫ আগস্টের আগে ১৫ বছর আমরা কীভাবে অসহনীয় পরিস্থিতিতে কাটিয়েছি। 
বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে এমন ধরনের ঘটনা সম্পূর্ণটাই আসলে ‘ভায়োলেন্স’। কখনো কখনো ব্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষের সদস্যরা প্রতিপক্ষের কোনো কোনো কাজের প্রতিশোধস্বরূপ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে প্রচলিত কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে। এর সঙ্গে সাধারণত যুক্তি বা ন্যায়বিচারের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই মব বা দলবদ্ধ মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাদের পরিচয় সহজে পাওয়া যায় না। বিষয়টা এমনও হতে পারে যে, এসব ব্যক্তি তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং নিজেদের ব্যক্তিগত পরিচিতি আড়াল করে আইনের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার জন্যই এই পথকে বেছে নেয়। এর পাশাপাশি কাজ করে মানুষের সহজাত কিছু মানসিক প্রবণতা। যার মধ্যে রয়েছে আর পাঁচজন চেনা-অচেনা মানুষের চোখে নিজেকে ‘হিরো’ হিসেবে জাহির করার গোপন ইচ্ছা। 

এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের অপরাধমূলক তথা অমানবিক ভয়ংকর কার্যকলাপ বন্ধ করার কী উপায়? আরও গভীরভাবে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কারণ স্বাভাবিকভাবে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার গ্যারান্টি চায়। এখানে আরেকটা ভেবে দেখার বিষয় আছে, সেটি হলো একসঙ্গে বেশ কিছু মানুষ দলবদ্ধভাবে এ ধরনের অপরাধ করার পর দলের মধ্য থেকে কেউ আইনের আওতা এড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে সহজেই সে পালিয়ে যেতে পারে। এবং পালিয়ে গিয়ে পরে তার আরও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। 

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন সময়মাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। 
সম্প্রতি রাজধানীর তোপখানা রোডে টুরিস্ট পুলিশের সদর দপ্তর পরিদর্শন শেষে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, মব নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করলেও সব সময় বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। 

মব জাস্টিসের মতো ঘটনা কমছে না, তা স্বীকার করে গণমাধ্যমের কাছে তিনি আরও বলেছেন, আমি দ্বিমত করব না, এমন ঘটনা হচ্ছে। তবে যেখানেই হচ্ছে সেখান থেকে সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অন্যদিকে, পুলিশের ওপরেও হামলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করতে হবে। জনগণ এমনভাবে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেলে অনেক সময় সমস্যা হয়। তবু ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও একসময় নিজের ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলেও মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাহলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট করা হবে।’ এদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গণপিটুনির অন্তত ৩০টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছেন। এই সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গণপিটুনির ১১৪টি ঘটনায় কমপক্ষে ১১৬ জন নিহত হয়েছেন এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। 
পুলিশের সদর দপ্তর বলেছে, গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের ওপর কমপক্ষে ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনাও রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে সরকারের উপদেষ্টা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বারবার মবের নামে এই ধরনের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ঘটনা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এত হুঁশিয়ারিতেও তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। বাস্তব অবস্থা এটাই। এ ক্ষেত্রে আর একটা কথা বলা দরকার, সেটা হলো, দেশের বিদ্যমান আইনব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে এ ধরনের অমানবিক তথা বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা একান্ত প্রয়োজন। 

বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে যেভাবে কিছু কিছু মানুষ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে, উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে সাধারণ মানুষকে নানাভাবে প্ররোচিত করছে, তাদের দমন করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা কখনো কখনো আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো সাহসও দেখাচ্ছে। তাদের এ ধরনের ধারণা পাল্টে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হতে পারে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ তথা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। 

বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করলে কখনো কখনো মনে হতে পারে, দীর্ঘ ১৫ বছরের একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের কুফল এভাবেই দৃশ্যমান হচ্ছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর সেটা আরও প্রকট হয়েছে। 
এসব ঘটনা এবং পরিস্থিতি নিরপেক্ষভাবে মনোযোগসহকারে পর্যবেক্ষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিগত স্বৈরাচারী শাসন আমলে দেশের জনগণের একটা অংশ দিনের পর দিন এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে কীভাবে নানা কারণে অসহিষ্ণুতার একেবারে চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল, যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল নানাভাবে, বিভিন্ন ঘটনার মধ্যদিয়ে। যেমন- একদিকে ছিল দৈনন্দিন জীবনে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ, অন্যদিকে ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব। সবমিলিয়ে একটা পরিবর্তন চাইছিল দেশের সাধারণ মানুষ, যা পরবর্তীকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শরিক হতে তাদের নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিল। 

লেখক: শব্দসৈনিক ও বরিশাল বিভাগীয় উপদেষ্টা খবরের কাগজ
[email protected]

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৭:২৬ পিএম
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি
ড. মোস্তাফিজুর রহমান

যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল অনুঘটক হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হয় না। আমাদের দেশে যেটা দেখছি, ২৪-২৫ শতাংশের মধ্যে বিনিয়োগ থমকে আছে কয়েক বছর। ক্রেডিট নেওয়া হয় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগের জন্য, এখানেও স্থবিরতা দেখছি। আমরা দেখছি যে, আমদানি ক্রেডিটের মেশিনারি আমদানির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি এনে যে বিনিয়োগ করা হয়, সেই আমদানি নিয়েও একটা স্থবিরতা আছে। 

সবটা মিলিয়ে বিনিয়োগে একটা বড় ধরনের স্থবিরতা আছে। সুতরাং, আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনতে হবে। আর দ্বিতীয় কথা হলো, আমি কত ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি। আমি যদি রেশিও কমাতে পারি, তার মানে হলো- আমার উৎপাদনশীলতা ভালো। আমি যদি ৪ ইউনিট দিয়ে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথের পরিবর্তে ৩ ইউনিট বিনিয়োগ করে ১ শতাংশ জিডিপি গ্রোথ করতে পারি, এটাই উৎপাদনশীলতা। এই উৎপাদনশীলতাটুকু জরুরি। 

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কমিটি করেছে। সেই সংস্কার কমিশন কাজ করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। আমার মনে হয় যে, একটা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ত হতে হবে প্রযুক্তির বাস্তবায়ন। প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এখন যে সিস্টেম আছে, এটাতে বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হবে। এনবিআরের নিজস্ব যে জনশক্তি আছে, তা দিয়েই কাজ পরিচালনা করতে হবে। এনবিআরের নীতিমালা প্রণয়ন এবং নীতিমালা বাস্তবায়ন দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। এনবিআরে যারা কাজ করেন তাদের ওপরের দিকে ওঠার রাস্তা যাতে রাখা হয়, এমন ধরনের সংস্কার করতে হবে। এটার একটা দিক আছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। প্রযুক্তিকে যত বেশি কাজে লাগানো যাবে তত বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা ইতিবাচক একটা দিক দেখলাম যে, এবার ই-সাবমিশন বা ইলেকট্রনিক সাবমিশন অনেক ভালো হয়েছে। 

করপোরেটের ক্ষেত্রে, ব্যক্তি খাতের ক্ষেত্রে এগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। ডিজিটাল প্রস্তুতিটা রাখতে হবে। আমাদের কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স- এগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় করতে হবে। যে সফটওয়্যারগুলো তারা ব্যবহার করেন সে ক্ষেত্রে ইন্টার অপারেবিলিটি থাকে। একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ একই সঙ্গে সমন্বয় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও  অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে থাকে- যাতে ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম আমরা করতে পারি। আমাদের প্রত্যক্ষ কর মাত্র ৩২-৩৩ শতাংশ। এটাকে আরও কীভাবে বাড়ানো যায় তা ভাবতে হবে। সেটা করতে গেলে ইন্টার-অপারেবিলিটি অব দ্য সিস্টেমস অর্থাৎ কাস্টমস, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স- এগুলোর সমন্বয় করতে হবে। বেশি বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইনকাম ট্যাক্সের কাজকে কেন্দ্রীয়ভাবে করতে হবে। এটা বিভিন্ন দেশে আছে। ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর বিশাল সুযোগ আমাদের আছে। সাধারণ জনগণের ওপর অপ্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে নয়, প্রত্যক্ষ কর কীভাবে আমরা বাড়াতে পারি সেই চিন্তা করতে হবে।

 যাদের কর দেওয়ার শক্তি আছে, কিন্তু দেন না, যাদের বিভিন্ন সময় শুল্ককর ১০ শতাংশ দিলেই সব সাদা করা যাবে, রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ করলে সাদা করা যাবে- এ ধরনের যারা আছেন, তাদের প্রণোদনা দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। তা থেকে সরে এসে ডিজিটালাইজেশনে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং এনবিআরের মধ্যে জবাবদিহি এবং প্রণোদনা দুটির সমন্বয় করে আমাদের এগুলো মোকাবিলা করতে হবে। কারণ দেখা যাচ্ছে যে, রাজস্ব যা আহরণ করি, রাজস্ব ব্যয়ে তা চলে যায়। পুরো উন্নয়ন ব্যয়টা হয়ে গেছে ঋণনির্ভর। হয় অভ্যন্তরীণ, নয় বৈদেশিক। এটা টেকসই হবে না। যার ফলে বিনিয়োগ পরিষেবার ভার ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। আমরা যদি রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারি, তাহলে উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিয়েও উন্নয়ন ব্যয়ের একটা অংশ মেটাতে পারব। ঋণনির্ভরতা এবং সুদাসলের কারণে বড় ধরনের একটা অঙ্ক আমাদের বাজেটে রাখতে হচ্ছে; যা রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এটা টেকসই হয় না এবং এটা থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে।

আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা ভালো করতে হবে। এসব জায়গায় আমাদের বড় ধরনের একটা দুর্বলতা রয়েছে। এটাকে মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমান সরকার ১০০টা প্ল্যানের জায়গা থেকে সরে এসে ১০টা স্পেশাল জোনকে ভালোভাবে চালু করতে চাচ্ছে। আমরা কিন্তু আগেই বলেছিলাম, ১০০টা স্পেশাল জোন করার জন্য জমি অধিগ্রহণ না করে ১০ থেকে ১২টা করে ভালোভাবে চালান। বর্তমান সরকার এ পদক্ষেপগুলোই এখন নিচ্ছে। আমার মনে হয় এটা খুব ভালো যে, তারা এটা করতে চাচ্ছে। এটা হলে বিনিয়োগে চাঙাভাব আসবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ যদি বাড়ানো যায় তাহলে রপ্তানি বাজারে একটা ভালো সংযোগ থাকে। আমাদের রপ্তানিও বাড়ে। 

সুতরাং যারা আমদানি করবে, রপ্তানি করবে এবং স্পেশাল জোনগুলো ব্যবহার করবে, তাদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসের ক্ষেত্রে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সেন্ট্রাল প্ল্যান, দক্ষ জনশক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে হবে। শুধু জোন করলেই হবে না। আরও অনেক সমান্তরাল কাজ আমাদের করতে হবে। সেসব জায়গায় এখনো অনেক দুর্বলতা আছে। যা এখন উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক একটা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন ধরনের পলিসিগত পরিবর্তনও আনার চেষ্টা চলছে এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও চলছে। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমান উন্নত হবে না। সেই বিনিয়োগ মূলত ব্যক্তি খাতেই করতে হবে।
 
শুধু শিল্পোদ্যোক্তা নয়, সার্ভিসেস সেক্টর, ই-সার্ভিস, আইটি অ্যানাবল সার্ভিসেও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। যারা আসতে চাচ্ছেন তাদের জন্য দেশের শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য আমাদের ইনসেনটিভ আছে। সেবা খাতে যে উদ্যোক্তা ইয়াং জেনারেশন, তাদের জন্য স্পেশাল উইনডো সৃষ্টি করা দরকার। এগুলোতে আরও উদ্যোগ-উদ্যম নিয়ে কাজ করতে হবে। ইন্টারনেটের স্পিড বাড়ানো, তার খরচ কমানো- আইটি অ্যানাবল সার্ভিসে যারা আসে তাদের জন্য এ সুযোগগুলো অবারিত করতে হবে। নতুন নতুন খাতে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের যে প্রণোদনা কাঠামো আছে, তার পরিবর্তন লাগবে। রেডিমেট গার্মেন্টসের ভেতরেও অনেক সম্ভাবনা আছে। 

আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশও ভিয়েতনামের মতো বড় রপ্তানিকারক দেশ হতে পারবে। রপ্তানির ভেতরে টেকনোলজিক্যাল যে কম্পোনেন্ট, আমাদের দেশে উচ্চ টেকনোলজি কম্পোনেন্ট ১ শতাংশেরও কম আর ভিয়েতনামে ৪৩ শতাংশের বেশি। সেই রকম একটা টেকনোলজিক্যাল রেডিয়েশন করে আমাদের কিন্তু তুলনামূলক যে সুবিধাগুলো আছে, তাকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় রূপান্তরিত করার একটা সুযোগ আছে। আগামীতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হচ্ছে, তখন অনেক রেফারেন্স সুবিধা, বাজারসুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধা, কোটামুক্ত সুবিধা চলে যাবে। সেখানেও আমাদের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। যাতে করে এই বাজার সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে তারা দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় উত্তীর্ণ হতে পারে।

লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

সাহিত্যপাঠের সঙ্গী

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৭:১২ পিএম
সাহিত্যপাঠের সঙ্গী
ড. পবিত্র সরকার

 এবারের ‘ত্রৈলোক্য’তে একটু বিদ্যাজগতের কথা বলি, সাধারণ পাঠকের কাছে মাপ চেয়ে। মাস্টার তো, তাই মাঝে-মধ্যে ওখানে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে, কিছু খবর দিতে ইচ্ছে করে। সবাই না হলেও, বেশ কিছু লোক এই ধরনের কিছু খবরের জন্য প্রতীক্ষা করি।
ব্যাপারটা একটু গোড়া থেকে বলি। সম্প্রতি স্নেহাস্পদ অধ্যাপক বরুণকুমার চক্রবর্তী তাদের বাংলা বিদ্যা-সমিতির পক্ষ থেকে বাংলা আকাদেমিতে আমাকে (আমাদের প্রয়াত শিক্ষক) অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মারকবক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ করেছিলেন।

বক্তৃতা এমন কিছু আহামরি দিয়েছি বলে আমার মনে হয় না, কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলাম যে, আমাদের মাস্টারমশাইরা যেমন বিশাল বিশাল মহাকাব্যের মতো বই লিখে গেছেন একার চেষ্টায়, এখন সে রকম বিশাল কাজ করার উদ্যোগ দেখি না কেন? মোটা নোটবই হয়তো হয়, কিন্তু মৌলিক কাজ? সাহিত্যের, ইতিহাসের, বা তার কোনো একটা ভাগ- নাটক, কবিতা, উপন্যাস, ইত্যাদির ইতিহাসের? তারা কোনো ডিগ্রি বা পুরস্কারের কথা ভেবে এ কাজ করেননি, চাকরিতে প্রমোশনের জন্যও না- নিছক বিদ্যাভূমিগত তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বিপুল অনুসন্ধান আর কঠোর আত্মপীড়দনমূলক পরিশ্রম করে ওই সব মহাগ্রন্থ রচনা করেছেন। 

আমি কেন দেখি না, তার কারণগুলো জানি না, তা নয়, তার কিছু আলোচনাও করলাম।
সেই সভাতেই তারা একজন গবেষককে ‘আচার্য সুকুমার সেন স্মৃতি পুরস্কার’ দিল তার রচিত ‘ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাস’ (এবং মুশায়েরা) বইটির জন্য। এই গবেষক অধ্যাপক উদয়সংকর বর্মা, সরকারি কলেজের অধ্যাপনা থেকে সদ্য অবসর নিয়েছেন। বইটি প্রায় চার শ পৃষ্ঠার, এটিই সম্ভবত বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাস। 

এ বইটির খবর নিয়ে লেখার কথা ভাবলাম কেন? ভাবলাম এই জন্য যে, বাঙালি বহুদিন ধরে ইংরেজিতেই পৃথিবীর নানা সাহিত্য পড়ছে, বাংলা অনুবাদেও কিছু পড়ছে। বাংলা অনুবাদও বেশির ভাগই ইংরেজি থেকে, তাতে মূলের কতটা নষ্ট হয়েছে কে জানে? গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে তবু এক কথা, গল্পের ছাঁচটা ধরা যায়। কবিতার বেলায় সমস্যা হয়, জানা কথা। গল্প-উপন্যাসেও অনুবাদে বা অনুবাদের অনুবাদে লেখকের শৈলী, ভাষার কারিকুরি কতটা বজায় থাকে সন্দেহ। কবিতায় তো শৈলীই বারোআনা কথা বলে।

এর পাশাপাশি, এটাও ঠিক যে, বাঙালি অনেকদিন ধরে বাইরের পৃথিবীর নানা ভাষা শিখছে। ইংরেজি ছাড়া সবচেয়ে জনপ্রিয় বিদেশি ভাষা তার কাছে ছিল ফরাসি, এক সময় রুশ ভাষা ফরাসিকে হারিয়ে দিয়েছিল বোধ হয়, এখন তার জৌলুশ কমেছে। জাপানি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে নানা কারণে। চীনা, স্প্যানিশ ইত্যাদিরও চর্চা প্রচুর হয়। আমাদের বন্ধু তরুণ ঘটক মূল স্প্যানিশ থেকে সেরভেন্তেস-এর ‘দোন কিখোতে’ বা ডন কুইক্সোট অনুবাদ করে আমাদের চমকে দিয়েছেন। চীনা, জাপানি থেকেও অনুবাদ হয়েছে, বন্ধুবর অরুণ সোম রুশ থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপে অনুবাদ করে চলেছেন। বাংলাদেশেও এই কাজ প্রচুর হচ্ছে জানি, হয়তো পরিমাণে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হারে। সব খবর যে আমি রাখতে পারি না, তা আমারই ব্যর্থতা।

এটা ঠিক যে, সবাই সাহিত্য পড়ার জন্য অন্য ভাষা শেখে না, শেখে নানা লক্ষ্য থেকে- ভাষার দেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, অনুবাদক বা দোভাষীর চাকরি, ব্যবসা- এমনকি অন্য ভাষার স্বামী, বধূ বা প্রেমিক-প্রেমিকার তাগিদে। তবে সাহিত্য পড়ার সুযোগ তার একটা বড় পার্শ্বিক লাভ বা উপকার। আর যারা সাহিত্য পড়েন, তারা সে ভাষার উন্নত বা জনপ্রিয় সাহিত্যের অনুবাদ করে নিজেদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতেই পারেন, অনেক বাঙালি যেমন করেছেন। মূল ভাষা থেকে অনুবাদ, ইংরেজি থেকে নয়। 

আমি আগেও লিখেছি যে, ঔপনিবেশিকতা এক সময় আমাদের এমনই আচ্ছন্ন করেছিল যে, আমরা এক সময় ইংরেজিকেই মূল ভাষা ভাবতাম। আমাদের এক বন্ধু বোরিস পাস্তেরনাকের একটা ছোট উপন্যাসের অনুবাদ পড়ে খুব খুশি। বইটির বাংলা নাম ‘শেষ গ্রীষ্ম’- ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সে সেটা নিয়ে কফি হাউসে ঢুকছিল, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ায় একটু বাহাদুরি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা পড়েছিস?’ বন্ধুটি দেখে একটু উন্নাসিকভাবে বলল, ‘ওহ, বাংলা! আমি অরিজিনালটা পড়েছি- দ্য লাস্ট সামার!’ সে বোঝাতে চেয়েছিল, সে ইংরেজিটা পড়েছে। বলা বাহুল্য, মূল রুশটা সে পড়েনি।

যাই হোক, এখন মূল ভাষা থেকে প্রচুর না হলেও বেশ কিছু বই মূল ভাষা থেকে অনুবাদ হচ্ছে। স্মৃতি এখন বিশ্বস্ত নয়, কিন্তু আবছা মনে পড়ছে প্রাচীন গ্রিক থেকে মোহিনী মোহন চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ, জার্মান থেকে কানাইলাল মুখোপাধ্যায় বা সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদের কথা। আগে লোকনাথ ভট্টাচার্য করেছেন ফরাসি থেকে, পরে চিন্ময় গুহ করেছেন। আগে ননী ভৌমিক করে গেছেন, আর এখন আমার সহপাঠী বন্ধু অরুণ সোমের নিরলস কাজের কথা তো বলেইছি, বলেছি স্প্যানিশ থেকে তরুণ ঘটকের অনুবাদের কথা। জাপানি থেকে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, নির্মল দাশ অনুবাদে ব্যস্ত আছেন। বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই এই রকম মূল থেকে অনুবাদের একটি বাহিনী গড়ে উঠেছে। সব খবর আমি রাখতেও পারি না।

এবার বাঙালি সাহিত্যপাঠকদের কথায় আসি। তারা পৃথিবীর যেকোনো সাহিত্য বাংলায় পড়ুন বা ইংরেজিতে পড়ুন বা সেই মূল ভাষায় পড়ুন- সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো- এই পড়াটা অনেকটা ফলদায়ক হয় যদি সেই সাহিত্যের একটা ইতিহাস পাশে রেখে সে ভাষার কোনো রচনা পড়তে পারি। তা হলে লেখক সম্বন্ধে, রচনাটা সম্বন্ধে, রচনার গুণাগুণ বা ওই সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় তার অবস্থান সম্বন্ধে অনেক কিছু আমরা জানতে পারি, যাতে রচনাটি পড়ার কাজটা নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অবশ্যই নিছক বিনোদনসন্ধানী পাঠক হিসেবে আমরা এভাবে কোনো বই বা রচনা পড়ি না, হাতের কাছে পাই বলে পড়ে ফেলি। কিন্তু যদি মননশীল পাঠক হিসেবে নিজেকে নির্মাণ করতে চাই, তা হলে সাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে বইটি পড়ার বিকল্প আর কিছু নেই। 

এতকাল আমরা সাধারণভাবে ইংরেজি ভাষায় লেখা নানা ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর এই কাজের জন্য নির্ভর করেছি, যদি মূল ভাষায় আমাদের ততটা প্রবেশ না থাকে। কিন্তু এটাই আনন্দের কথা যে, বাংলাভাষাতেও এখন বিদেশি সাহিত্যের ইতিহাস কিছু রচিত হচ্ছে, যেমন অধ্যাপক বর্মার বইটি। ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস এক সময় সিলেবাসে ছিল বলে একাধিক বেরিয়েছিল, গুরুস্থানীয় শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য প্রভৃতি অনেকেই লিখেছিলেন। বন্ধুবর রামবহাল তেওয়ারী লিখেছিলেন হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাস। সহপাঠী অরুণ লিখেছেন রুশ সাহিত্যের ইতিহাস। এবারে আমরা পেলাম ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাস। বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই এ ধরনের কাজ প্রচুর হয়েছে।
এই বইগুলো আমাদের সচেতন ও মনস্ক সাহিত্যপাঠের সঙ্গী হোক।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

বিজেপির দৃষ্টি এবার পশ্চিমবঙ্গে

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৫, ০৪:১৭ পিএম
বিজেপির দৃষ্টি এবার পশ্চিমবঙ্গে

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা বঙ্গেশ্বরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় মেয়াদের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় টুঁ শব্দও করেননি। মমতার সাম্প্রতিক আন্দোলন কর্মসূচি ভোটার তালিকায় কমিশনের কারচুপি রোখাকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন ঠিক না ভুল এ প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলেন। এসব ইঙ্গিত দেখে ওয়াকিবহাল মহলের স্পষ্ট ধারণা, নতুন দলের দিকেই পদক্ষেপ রাখছেন তিনি। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই এই দল ঘোষিত হবে। সেই দলের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে বিজেপি। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নেমে পড়বেন ভাইপো অভিষেক। সেই লক্ষ্যে তিনি নাকি ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে নিজের নামে একটি নতুন দল নথিভুক্ত করেছেন।

আহ্বান নেই, বিসর্জনও নেই। যা রাজ্য রাজনীতি তো বটেই, তৃণমূলের মধ্যেও নতুন করে কৌতূহল বাড়িয়েছে। এ-ও কৌতূহল যে, দিদিই অভিষেককে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে বারণ করে দিয়েছেন, নাকি অভিষেক নিজে থেকেই নীরব। বরং বিধানসভায় বাজেট পেশ হওয়ায় দেখা গেল, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সেবার আশ্রয়েই রয়েছেন। তার নির্বাচন কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে বিপুল মানুষকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরিষেবা দেওয়ার জন্য অভিষেক যে স্বল্প মেয়াদের শিবির গড়েছেন, তার সাফল্যতেই মজে রয়েছেন সাংসদ। সেবাশ্রয় শিবিরে নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ছুঁতে চলেছে। বাংলায় যা বেনজির বইকি। বিস্ময় শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নেই। আবাস যোজনায় কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ করার পর পাল্টা জেদ দেখিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই।

 সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষমেশ সবটাই তার অগ্রাধিকার, তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে, তারই সিদ্ধান্ত। কিন্তু গত বছর একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই প্রথমে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, আবাস যোজনায় কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ করলেও পরোয়া নেই, তৃণমূল সরকার রাজ্যের কোষাগার থেকেই বাংলার মানুষকে বাড়ি বানানোর জন্য টাকা দেবে। এবং তা দেওয়া হবে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। দেখা গিয়াছিল, সেই ডেডলাইন ফেল করেনি সরকার। ৩১ ডিসেম্বরের আগেই ১২ লাখ পরিবারকে প্রথম কিস্তির ৬০ হাজার টাকা সরাসরি উপভোক্তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে শুরু করেছিল নবান্ন। শুধু তা নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডিসেম্বরে এ-ও ঘোষণা করেন যে,  আরও ১৬ লাখ পরিবারকে আগামী অর্থবর্ষে বাড়ি বানানোর টাকা দেওয়া হবে। অনেকের মতে, সেদিক থেকে এদিনের বাজেট এক প্রকার উদ্‌যাপন করার কথা ছিল অভিষেকের। কারণ, তার মুখরক্ষা হয়েছে। একুশের মঞ্চে তিনি যে ঘোষণা করেছিলেন, তাকে ছাপিয়ে সরকার বৃহত্তর লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে চাইছে। কিন্তু তার পরও দেখা গেল, অভিষেক কোনো শব্দই খরচ করলেন না বাজেট নিয়ে। সংবাদমাধ্যমে সরাসরি কোনো বিবৃতি তিনি দেননি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও কোনো পোস্ট করেননি। অথচ ২০২৪ সালে রাজ্য বাজেটের দিন তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন অভিষেক। বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা হয়েছিল। তা নিয়েই সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।

অভিষেক অঙ্গীকার করেছিলেন যে, উত্তরবঙ্গের ধূপগুড়ি এলাকা মহকুমা হবে। সরকার যেদিন সেই মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, সেদিন এক্স হ্যান্ডেলে বড় পোস্ট করেছিলেন অভিষেক। আবার কদিন আগে নির্মলা সীতারামন সাধারণ বাজেট পেশ করার পর তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূল সরকারের বাজেট নিয়ে দলের অলিখিত নম্বর টু তথা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক যে কিছু বললেন না, তা অনেকেরই নজর কেড়ে নিল। অনেকেরই মনে হলো, এক নম্বর ও দুই নম্বরের মধ্যে কোথাও একটা মতান্তর হচ্ছে। কোথাও একটা আড়ষ্টতা তৈরি হয়েছে।

দলীয় কর্মীদের বক্তব্য, বিষয়টা এখন আর আড়ষ্টতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন স্পষ্ট দূরত্বই তৈরি হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। সেই দূরত্ব এখন আর ঘোচানো সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো ঠিক কখন নতুন দল তৈরি করবেন অভিষেক। ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, পুজোর আগেই নতুন দলের কথা ঘোষণা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মমতা কি আবার নতুন করে দলীয় সংগঠন গোছাবেন? নাকি এখন থেকেই সেই লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন।

২০২৬-এর লক্ষ্যে অবিলম্বে মাঠে নামতে চাইছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দল ছেড়ে নতুন দল গঠন করে তিনি যে আগামী দিনে নির্বাচনে লড়বেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই লক্ষ্যে তলায় তলায় বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার বৈঠকও শুরু হয়েছে। তার দলের সঙ্গে সরাসরি আঁতাত হতে পারে বিজেপির। সে ক্ষেত্রে অভিষেককেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে নতুন করে রাজ্যে এনডিএ জোট গঠিত হতে পারে। এই জোট গঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি। বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সব দায়িত্ব অমিত শাহর ওপরই অর্পিত। তিনি দোলের পরেই পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন। সেই সময় দুই পক্ষের মধ্যে গোপন বৈঠক হতে পারে।

অমিত শাহর এক নম্বর পছন্দের নেতা হলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তার সঙ্গে ইতোমধ্যে অমিত শাহর কথা হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণে ইদানীং শুভেন্দু কোনো সভাতেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলছেন না। সম্প্রতি তিনি সন্দেশখালীতে বিজেপির একটি দলীয় সভায় যোগ দেন। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। তাৎপর্যপূর্ণভাবে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নিয়েও মুখ খুলছেন না অভিষেক। আগে তিনি রাজ্য বিজেপিকে তুলাধোনা করতে ছাড়তেন না। ইদানীং কিন্তু তিনি কেন্দ্রীয় বিষয় নিয়েই বেশি ব্যস্ত।

জেলা সফরের লক্ষ্যে অভিষেক প্রথমে নিজের জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা দিয়েই শুরু করতে চান। এই জেলায় চারটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৩১টি বিধানসভা কেন্দ্র আছে। দক্ষিণবঙ্গের রাজনীতিতে এই জেলার গুরুত্ব অসীম। তাই নিজের ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে যে সেবাশ্রয় প্রকল্প করে জনগণকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া শুরু করেছেন অভিষেক তা জেলার প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে দিতে চান। তিনি বোঝাতে চান, তাকে ক্ষমতায় আনলে আগামী দিনে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ হয় এমন নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলা সফর ও কনভেনশনের পর অভিষেক নজর দেবেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে। এই জেলার ১৫টি বিধানসভা আসন তার পরবর্তী লক্ষ্য। পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে নজর দেওয়ার কারণ ঘাটাল কেন্দ্রের লোকসভা সাংসদদের সঙ্গে অভিষেকের সুসম্পর্ক এবং সার্বিকভাবে জেলার তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতির ব্যাপারে মানুষের ক্ষোভ।

জানা গেছে, ২১ জুলাইয়ের আগে চার মাসে তিনি রাজ্যের সব জেলা চষে বেড়াতে চান। তার পর ২১ জুলাইয়ের আশপাশের দিন দেখে নতুন দল করার কথা ঘোষণা হতে পারে। শহিদ দিবসকে বেছে নেওয়ার একমাত্র কারণ ওই দিনের জমায়েতকে ফ্লপ শোয়ে পরিণত করা। বিশেষ করে মঞ্চে বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার দিকেই তার অন্যতম লক্ষ্য। তার জন্য এই বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সময়মতো যোগাযোগ করা হবে।

এদিকে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুতি শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। বাংলায় নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে এখন থেকেই বিভিন্ন পরিকল্পনা করে নিতে চাইছে তারা। চলতি মাসেই কলকাতা সফরে আসছেন অমিত শাহ। তিনি রণকৌশল নিয়ে কথা বলতে পারেন বঙ্গ বিজেপির সঙ্গে। হয়তো এই বৈঠকগুলোতেই অভিষেক সম্পর্কে দলের কী পদক্ষেপ হবে তা ব্যাখ্যা করা হতে পারে। জনসমক্ষে এই কৌশল ব্যক্ত না করে আপাতত নেতাদের মধ্যে তা গোপন রাখা হবে। নেতারা সুকৌশলে পরবর্তী স্তরের কার্যকর্তাদের যা নির্দেশ দেওয়ার দেবেন।

গত বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় পদ্ম ফোটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল বিজেপি। একাধিক নেতা, মন্ত্রী রাজ্যে এসেছেন। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন কর্মী-সমর্থকরা। প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার বাংলায় এসে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাতে খুব একটা লাভ হয়নি এবং ২০২১ সালে তৃণমূল ১১৪ আসন পেয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসে। গেরুয়া ঝড় উঠলেও তার প্রতিফলন ভোটের রেজাল্টে দেখা যায়নি। তাই ২০২৬ সালের নির্বাচনে তৃণমূলকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে প্রস্তুত নয় বিজেপি নেতৃত্ব। চলতি মাসেই কলকাতায় আসছেন অমিত শাহ। সফরের নির্দিষ্ট দিন এখনো জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছে, এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, দলের ভিতর অভিষেকের সঙ্গে আঁতাত কি সদস্য-সমর্থকরা মেনে নেবেন? তাদের বোঝানো গেলেও শুভেন্দু অধিকারী নিজে কী অবস্থান নেবেন? গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের সামনের সারিতে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরাই ছিলেন। তা সত্ত্বেও ভোটারদের কাছে বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল যে, জিতলে শুভেন্দু অধিকারীই হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষ করে নন্দীগ্রামে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাস্ত করে তিনি তার ক্ষমতা দেখানোর পর পরবর্তীকালেও রাজ্যের এক নম্বর নেতা হিসেবে তার নামই উঠে এসেছে। 

বিজেপির একাংশ আবার চান, মিঠুন চক্রবর্তীকে কোনো একটি কেন্দ্রে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনে মুখ্যমন্ত্রী করতে। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ীকেও অনেকে সামনের সারিতে রেখেছেন। তাদের কাছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল কি আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে? কেন্দ্রীয় নেতারা অবশ্য বোঝাচ্ছেন রাজ্যের ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটকে ভাগ করার এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। এই ভোট ভাগ না করলে বিজেপির এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসা মুশকিল। তাদের আশা, দলীয় নেতারা এই যুক্তি মানবেন।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক