আওয়ামী লীগ প্রায় ১৬ বছর টানা ক্ষমতায় আছে। দলের সাংগঠনিক শক্তি নিয়েও নেতা-কর্মীরা বেশ স্বস্তিতে ছিলেন। কিন্তু এ অবস্থার মধ্যেই কোটা আন্দোলনকে সামাল দিতে রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থতার বিষয়টি এখন বেশ আলোচনায়। কিন্তু কেন ‘কোটা আন্দোলন’ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, সে প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে উঠছে। ফলে এ ঘটনায় সব ব্যর্থতার কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক যৌথ সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এসব ‘কারণ’ খোঁজার চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে। সভায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, রাজধানীর সব এমপি, মেয়র, কাউন্সিলরসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যৌথ সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একই কথা বলেছেন। দলের অন্য নেতারা কথা বলতে চাইলেও তিনি নিষেধ করেন। উপস্থিত নেতাদের তিনি সাংগঠনিক নির্দেশনা দেন। বিশেষ করে তৃণমূল নেতাদের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দেন।
এ সময় দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা,যাত্রাবাড়ীর মতো স্থানে যেখানে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল হলে হাজার হাজার নেতা জড়ো হন। নেতাদের সমাগমের মাধ্যমে সমাবেশ হয়ে যায়-কোটা আন্দোলনের সময় এই লোকগুলো কোথায় ছিলেন? মাঝে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। পাড়া-মহল্লায় ঢুকে অগ্নিসংযোগ করেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এত এত নেতা কোথায় ছিলেন? এ সময় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড ও থানা কমিটি না হওয়ার ব্যর্থতার কথা ওঠে। নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার কারণও খোঁজা হয়।
সূত্র জানায়, উপস্থিত একাধিক নেতা অর্থের বিনিময়ে ও ‘মাইম্যান’দের দিয়ে খসড়া কমিটি করার অভিযোগ তোলেন। এর জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ঢাকা মহানগরের ওয়ার্ড ও থানা কমিটির কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্রুতই কমিটি দেওয়া হবে। আন্দোলনের এই সময় কমিটিগুলো প্রকাশ করা হলে বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের মধ্যে বড় ঝামেলা হতে পারে।
সভায় কোটা আন্দোলন প্রতিরোধে ছাত্রলীগের কার্যক্রম নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলন কেন রাজধানীসহ পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ল? এ জন্য রাতের আঁধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন চলে এসেছে ছাত্রলীগ? এ জন্য ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগ নেতাদের বিভিন্ন হল রুমে হামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তাদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ছাত্রলীগ কেন বেলুনের মতো চুপসে গেল? আর নেতারা যদি হল ছেড়ে না আসত তাহলে হয়তো এই অবস্থা হতো না। এত বছরেও কেন ছাত্রলীগ নেতারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগের কমিটি নেই। নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আওয়ামী লীগের নেতাদের মতে, ছাত্রলীগের নেতারা বিশেষ করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখা এবং হল কমিটির নেতারা যদি ঐক্যবদ্ধ থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাখত, তা হলে হয়তো আন্দোলন সারা দেশে ছড়াত না।
সভা শেষে ঢাকা ১৫ আসনের এমপি কামাল মজুমদার ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেন ‘কই ছিলে’? এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এমপি কামাল মজুমদারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন মিজান। এমপির উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি (কামাল মজুমদার) কই ছিলেন এত দিন? এত দিন আন্দোলন হলো; আপনাকে তো দেখা যায়নি! ফোন দিলে ধরেননি, মেসেজ দিলেও রিপ্লাই দেননি! ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। এখন উল্টো জিজ্ঞেস করেন কই ছিলে? এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাদের থামিয়ে বলেন, এমপির বয়স হয়েছে! এগুলো এখানে বলার বিষয় না। তখন পেছন থেকে এক নেতা (মহানগর উত্তর) বলে উঠেন- আপনাদের কারণে এই এমপিরা প্রশ্রয় পাচ্ছেন! এর আগে দলের সাংগঠনিক একাধিক বিষয়ে নির্দেশনা দেন ওবায়দুল কাদের।
যৌথ সভার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার একাধিক নির্দেশনা দিয়েছেন। রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কোথাও কোনো অচেনা ও সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে নেতারা প্রশাসনের কাছে তুলে দেবেন। কারফিউর কারণে যারা কাজ করতে পারছেন না- তাদের এবং দিনমজুর মানুষের কাছে খাবার বিতরণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কোটা আন্দোলন ইস্যুতে গত কয়েক দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটে। এ সময় দফায় দফায় হামলা আর সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোটা আন্দোলনকারীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজধানীতে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ১০ নম্বরসহ একাধিক স্থানে আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়তে হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ভাঙচুর ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সারা দেশে কারফিউ জারি করে প্রশাসন।