ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে পতন হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এ সরকারকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করছেন সদ্য বিদায়ী সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের। খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপচারিতায় চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের নিজস্ব প্রতিবেদক জয়ন্ত সাহা
খবরের কাগজ: গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
জি এম কাদের: দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলতে চাই। এই বিপ্লব আমাকে অভিভূত করেছে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে প্রবীণ ও নবীনদের সমন্বয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে অভিনন্দন জানাই। একে ছাত্র-জনতার সমর্থনপুষ্ট বিপ্লবী সরকারও বলা যায়। আমাদের ইতিহাসে এরকম গৌরবময় অধ্যায় এর আগে দেখিনি। তরুণদের দেশাত্মবোধ ও জনগণের প্রতি অঙ্গীকার আমাকে মুগ্ধ করেছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে তারা এতদূর অগ্রসর হতে পারে- এটা আমার কাছে মনে হয়েছে বিশাল পাওয়া।
খবরের কাগজ: উপদেষ্টার দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এই ক্রান্তিকালে সংকট মোচনে তাদের ওপর কতটুকু ভরসা করা যায়?
জি এম কাদের: আগে আমরা সেনাশাসিত বা সেনাবাহিনী পরিচালিত সরকার দেখেছি। স্বাভাবিক সরকারও দেখেছি। এখন আরেকটা নতুন সরকার আমাদের সামনে। মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তারা যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন, আমরাও (জাপা) দীর্ঘদিন ধরে সেসব সমস্যা নিয়ে কথা বলছি। আমি মনে করি তারা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এখন এগুলো সমাধান করা দরকার। নবীনদের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা, কৌশলগত ধারণা অনেক সময় না-ও থাকতে পারে। সেখানে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। তারা চাইলে আমরা সেটুকু দেশের স্বার্থে কাজে লাগাব ইনশাআল্লাহ।
খবরের কাগজ: বৈষম্যের মূলে কুঠারাঘাত করে নতুন এক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে চান। তাদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
জি এম কাদের: তাদের প্রথম কাজটিই তো গেটওয়ে টু ডেমোক্র্যাসি। সেখান থেকেই প্রতিটি স্তরে সরকারের জবাবদিহি শুরু হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। সংসদীয় গণতন্ত্র সত্যিই যদি তারা রাখতে চান, তাহলে ইউনাইটেড কিংডমের মতো ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্ট করতে হবে। আমাদের এখানে না হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র, না হয়েছে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার। ইন বিটউইন সামথিং, ইট গোজ অ্যাগেইনস্ট দ্য পিপল, যাতে শাসককে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা থেকে উত্তরণ করা দরকার।
খবরের কাগজ: রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচনি কাঠামো সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কোনো পরামর্শ দেবেন কী? গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাদের কাছে কোনো দাবি রয়েছে আপনার?
জি এম কাদের: সবসময় বলে আসছি, দেশে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু থাকুক। এর প্রথম ধাপ হলো দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ধরনের নির্বাচন আয়োজন। আমরা সবসময় দেখেছি, যে-ই সরকারে এসেছে, সে-ই সম্পূর্ণ সময় ব্যয় করেছে পরবর্তী নির্বাচনে কীভাবে কারচুপি করে জেতা যায়, কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের করে নেওয়া যায়- তার ওপর। আমরা আশা করব, এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা নির্বাচন ম্যানিপুলেশন করতে দেবেন না কাউকে। তারাও যেন কোনোভাবে এমন পরিস্থিতিতে জড়িয়ে না পড়েন। টাকা-পয়সা আর অনিয়ম, দুর্নীতিতে নির্বাচন সয়লাব হয়ে যেত এত দিন। এ থেকে বের হতেই কিন্তু মানুষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে সাপোর্ট করেছে। দেশের মালিক জনগণ। প্রথম কথা হলো, জনগণকে তার মনের মতো প্রতিনিধি নির্বাচন করতে দিতে হবে; যাদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে।
খবরের কাগজ: সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী এনে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কথাও আপনি বারবার বলেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেটি আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছেন তরুণরা।
জি এম কাদের: রাষ্ট্রের পিলারগুলো যেন কোনোভাবেই আর এক ব্যক্তি, বা এককেন্দ্রিক পিলারে পরিণত হতে না পারে। এক ব্যক্তিকে বারবার ক্ষমতায় আনলে- যতই তিনি গণতান্ত্রিক হোন না কেন, সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার একটা প্রবণতা ঐতিহাসিকভাবে আমরা সেই ব্যক্তির মধ্যে লক্ষ্য করেছি। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডায় সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের বেশি এক ব্যক্তিকে চিফ এক্সিকিউটিভ করা হয় না। এ ধরনের সিস্টেম আমাদের এখানে চিন্তা করা যেতে পারে। পার্লামেন্টে জনগণের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মতো লোক থাকতে হবে।
একই সঙ্গে অ্যান্টি করাপশন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনকেও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। তারা সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবেন, কোনো দল বা ব্যক্তির জন্য নয়। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের শক্তিশালী করতে হবে।
খবরের কাগজ: সম্প্রতি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা উঠেছে। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে করণীয় কী?
জি এম কাদের: সরকারের সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে গেলে দ্বিতীয় ধাপে প্রয়োজন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। আমাদের কনস্টিটিউশনে কিছু কনট্রাডিকশন আছে। বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয়। এটি নিয়ন্ত্রণ করছেন এক্সিকিউটিভ, চিফ এক্সিকিউটিভ বা নির্বাহী বিভাগ। এটা থেকে উত্তরণ দরকার। বিচার বিভাগ হলো মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। লোক বিপদে পড়লে সেখানে গিয়ে যেন আশ্রয় নিতে পারে। তার জন্য বিচার বিভাগের সেই ভাবমূর্তি তৈরি করতে হবে। সেটা করতে গেলে সংবিধানের যে ধরনের সংশোধনী প্রয়োজন; এগুলো আনতে হবে।
খবরের কাগজ: সংবিধানে সংশোধনী আনতে গেলে প্রয়োজন জাতীয় সংসদ অধিবেশন। অন্তর্বর্তী সরকার কি সেটি পারবে?
জি এম কাদের: সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হলে সেটা কিভাবে করা হবে তা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। এটা তো বিপ্লবী সরকার; এখন যা হচ্ছে তার সবটা হচ্ছে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। জনগণ যদি চায় তবে যেকোনোভাবে নিয়ম তৈরি করা যেতে পারে। তবে জনগণের মতামত নিয়ে সব কিছু করতে হবে।
খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ- দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার। এ মুহূর্তে অর্থনীতির ঠিক কোথায় গুরুত্বারোপ করা উচিত?
জি এম কাদের: অর্থনীতি খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। রিজার্ভ দুর্বল অবস্থায়। প্রচুর দেনা আছে। সামনের দিকে যে আয় করার কথা আমাদের- সেটি অনিশ্চয়তায় পড়েছে। পোশাক খাত বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে; সেটা যত তাড়াতাড়ি চলে যায় তত ভালো। এখন অন্যান্য কল-কারখানা যেন উৎপাদনে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে- সেখান থেকে আয় করতে হবে। বাস্তবে আমাদের নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস একটাই, সেটি প্রবাসী আয়। এর বাইরে আয় করতে না পারলে ঋণের কিস্তি এবং সুদ পরিশোধ কঠিনতর হবে। তখন দেশ চালানো কঠিন হয়ে যাবে। প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে না পারলে মানবিক সমস্যার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। মানুষ চাকরি হারাবে, পণ্যমূল্যের দাম বাড়বে। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এগুলো সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে হবে। আরেকটা মন্ত্রণালয় নিয়ে আমি খুব চিন্তিত, সেটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। সেখানে প্রচুর অর্থ দেনা হয়েছে, প্রচুর অর্থ অপচয় হয়েছে। এগুলো কঠিন হাতে দমন করতে হবে। বিদ্যুৎ-গ্যাস যদি ঠিকমতো সরবরাহ করতে না পারি তবে দৈনন্দিন সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে।
খবরের কাগজ: দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনমনে অসন্তোষ রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। আপনার মতামত কী?
জি এম কাদের: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসা, তা নিয়মিত সরবরাহ করার কাজটি তাদের করতে হবে। ইকোনমিকসে একটা টার্ম আছে ‘প্রি মার্কেট’। এর মানে হলো- বায়ার্স থাকবে অনেক; ক্রেতা থাকবে অনেক, বিক্রেতাও থাকবে অনেক। ইকোনমিক থিওরিতে বায়ার্স আর সেলার্স যদি সাফিশিয়েন্ট থাকে, তাহলে অপটিমাম প্রাইস সবার জন্য কাজ করবে। ক্রেতা পর্যায়ে গিয়ে সেটা স্ট্যাবল হবে। ওই ধরনের পরিস্থিতি বাজারে সৃষ্টি করতে হবে যেন মার্কেটে যথেষ্ট সরবরাহ থাকে। তাহলে মার্কেটে ক্রেতা থাকবে, বিক্রেতাও থাকবে। বিক্রেতার সংখ্যা কমে গেলে মনোপলির দিকে চলে যায়। তখন সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণে নেয় একটি দল। বিগত সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাজারে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকারকে এ দিকে নজর দিতেই হবে।
খবরের কাগজ: নির্বাচন আয়োজনের জন্য এই সরকারকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে চান কি?
জি এম কাদের: না, আমরা কোনো সময়সীমা বেঁধে দিতে চাই না এখনই- ওয়েট অ্যান্ড সি। তারা কী করতে চাচ্ছেন, কতটুকু করতে চাচ্ছেন, তা দেখতে চাই। তারা সঠিক পথে থাকলে আমরা তাদের সবসময় সমর্থন দেব। আমি মনে করি, তারা তাদের কাজটি সঠিকভাবে করবেন। তারা দেশ ও জনগণের স্বার্থ দেখবেন। যখন নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হবে, তখন তারাই নির্বাচনের কথা বলবেন। নতুবা আমরা (রাজনৈতিক দলগুলো) সেটা বলব।