দলের শৃঙ্খলা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নীতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে বিএনপি। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতা-কর্মীদের যেভাবে শাস্তি দিতেন, সেই পথই অনুসরণ করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পাশাপাশি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দেখানো পথও অনুসরণ করছেন তিনি। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নেতা-কর্মীদের শাস্তি দেওয়ার একই নিয়ম অব্যাহত রাখতে চান তারেক রহমান।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, দলের শৃঙ্খলা ফেরানোর ব্যাপারে তিনি কোনো ছাড় দেবেন না। কে কত বড় নেতা, তার কতটা ঘনিষ্ঠ এসব বিষয় আমলে নিচ্ছেন না। দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে বদ্ধপরিকর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা দলকে বিব্রত করবেন যত বড় নেতাই হোন, তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেন, “শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আমলে এমন ঘটনা ঘটেনি। গত ১৫ বছরের ক্ষোভ, আক্রোশ বা ক্রোধ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। কিন্তু মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হচ্ছে। আবার প্রকৃত ঘটনার আংশিক ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। বিএনপির নামে ‘ট্যাগ’ দিয়ে একশ্রেণির নেতা-কর্মীকে কালার করার চেষ্টা চালাচ্ছে।”
তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে যেসব জায়গায় অভিযোগ করা হচ্ছে, খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগই আগে ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল।’
দলীয় সূত্রমতে, জিয়াউর রহমান দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন দুই পদ্ধতিতে। প্রথমত, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসত, ঘটনার তদন্তে নিজস্ব সোর্স দিয়ে গোপন রিপোর্ট সংগ্রহ করতেন। দ্বিতীয়ত, দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট সংগ্রহ করতেন। এরপর এই দুই রিপোর্ট যাচাই-বাছাই করতেন। তারপর অভিযুক্তদের নিয়ে একসঙ্গে বসতেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সবার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেন। গুরুতর অপরাধ হলে বহিষ্কার, অপরাধ কম হলে লঘুদণ্ড দিতেন।
যত বড় নেতা হোক না কেন, তাকে ছাড় দিতেন না। জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার দেখানো পথে হাঁটছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি চাঁদাবাজি, জায়গা-জমি দখলসহ দলকে যারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছেন তাদের বিরুদ্ধে এই দুই নীতি অবলম্বন করে শাস্তি দিচ্ছেন। এই ধারা আগামী দিনেও দলে অব্যাহত থাকবে। বিএনপি সঠিক পথেই আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের কিছু অতি উৎসাহী, বেয়াদব ও উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মী সারা দেশে চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছিলেন। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যারা দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন বা আগামী দিনেও ফেলবেন তাদের আজীবন বহিষ্কার বা অব্যাহতি দেওয়া হবে। শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং বিতর্কিত নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাইকমান্ড ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবং দলের শৃঙ্খলা ফেরাতে আগামী দিনেও জিয়াউর রহমানের নীতি বাস্তবায়নে কঠোর থাকবে বিএনপি।’
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতিতে ছিলেন এমন দুজন সিনিয়র নেতা খবরের কাগজকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান সব সময় অপরাধ দমনে কঠোর নীতি অবলম্বন করতেন। তার আমলে চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি ও দখলদারত্ব ছিল না। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি মেধাবীদের স্থান দিয়ে ছাত্রদলের প্রথম কমিটি গঠন করেন তিনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মী মিলে ‘গ্রুপ অব বয়েজ’ নামে পৃথক গ্রুপ গঠন করেন। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
তাদের দমন করতে জিয়াউর রহমান গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসেন। আবার অনেকে ভয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হন এবং কাউকে কাউকে বিদেশেও পাঠিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে এমন ঘৃণিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর সাহস দেখাননি দলের কেউই। খালেদা জিয়ার আমলেও যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি ছিল না। সেই সময়ে যাদের নামে চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগ উঠেছিল, তাদের বিরুদ্ধেও বহিষ্কার করার মতো কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তারেক রহমানও একই পথ অনুসরণ করছেন।
বিএনপির সূত্রমতে, জিয়াউর রহমান মেধাবী ও যোগ্যদের সব সময় মূল্যায়ন করতেন। রাষ্ট্রপতি থাকার সময় থেকেই তিনি শহর-গ্রামগঞ্জে সব সময় ছুটে বেড়িয়েছেন। যার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতেন তাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে কাছে টেনে নিতেন। তার পথ অনুসরণ করে তারেক রহমানও বর্তমানে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। অভিযোগ উঠলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার নিজস্ব সোর্স দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। ফলে দলের কেউ নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়ালে তাকে সরাসরি বহিষ্কার করছেন।
জানা গেছে, তৃণমূল তো বটেই, কেন্দ্রীয় নেতারাও মানছেন না দলীয় শৃঙ্খলা। দলের নীতিনির্ধারকদের কড়া হুঁশিয়ারি ও নির্দেশনার পরও থামছে না অপকর্ম। বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। দলের চেইন অব কমান্ড তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পৃথক দুটি ঘটনায় ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকনকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
সরাসরি বহিষ্কার করার চেয়েও তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বেশি কার্যকর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দলের শৃঙ্খলার ব্যাপারে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল, চাঁদাবাজি এবং সরকারদলীয় নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের যোগসাজশের কারণে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটি বাতিল এবং শীর্ষ নেতা আবু সুফিয়ানসহ তিন নেতার সব পদ স্থগিত করা হয়েছে। সম্প্রতি চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদ আহমেদ মানিক ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে বাড়িঘর দখলের অভিযোগ উঠেছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নানা অভিযোগে এখন পর্যন্ত বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের দেড় শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার ও পদ স্থগিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছাত্রদলের ৩০ ও যুবদলের ৫৩ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া যুবদলের চারজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শাস্তি দেওয়া নেতাদের বেশির ভাগই হচ্ছেন ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম, বগুড়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, পঞ্চগড়, গাজীপুর, নরসিংদী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলার।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পত্রিকায় ভুল নিউজের ওপর ভিত্তি করে তার পদ স্থগিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দলের হাইকমান্ডের কাছে একটি লিখিত আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বিশৃঙ্খলা যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। দীর্ঘ ১৬ বছরের দমবন্ধকর পরিবেশ থেকে নেতা-কর্মীরা মুক্তি পেয়ে হয়তো কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বা পড়ছেন। তবে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ করে যাচ্ছি।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলকে যারা বিব্রত করছেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, দ্রুতই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও এদের দ্রুত বিচার করা হবে। দলের যতই বড় নেতা হোক না কেন, অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান।’
তিনি বলেন, ‘অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ক্ষমতা ছাড়াই ১৭ বছর বিএনপির হাল ধরেছেন তারেক রহমান। দল চালানোর ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার পথ অনুসরণ করছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। রাজনীতির বর্তমান ধারায় সফলও তিনি।’