
রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের সংস্কার নিয়ে সাতটি ছোট রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আজ আবারও সংলাপে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সংলাপে আমন্ত্রিত দলগুলোর নেতারা বলেছেন, প্রথমত তারা প্রধান উপদেষ্টার কথা শুনবেন। পরে তারা রাষ্ট্র সংস্কারকাজের অগ্রগতি, সংস্কার কমিশন কীভাবে কাজ করবে, কবে নাগাদ শেষ হবে এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে সরকারের মনোভাব জানতেন চাইবেন। এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়ানো, জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ না জানানোসহ প্রধান উপদেষ্টার কাছে আরও কিছু দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানাবেন তারা।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় আজ শনিবার বেলা ৩টায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সঙ্গে বৈঠক দিয়ে শুরু হবে সংলাপ। এরপর পর্যায়ক্রমে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও লেবার পার্টির সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের কোনো দল এবারও সংলাপে আমন্ত্রণ পায়নি বলে জানা গেছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এটি হবে চতুর্থ দফার সংলাপ। এর আগে গত ৫ অক্টোবর বিএনপিসহ ১৯টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গণফোরাম
গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেবে। জানা গেছে, সংলাপে সংস্কারসহ নানা বিষয়ে এ সরকারকে সহযোগিতার কথা জানাবেন প্রতিনিধিরা। এরপর সংবিধান সংস্কারে স্থায়ী কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেবেন। নির্বাচন কমিশন দ্রুত সংস্কারসহ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তি দিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরার কথাও রয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়ানো, সংস্কার কমিশনের মেয়াদ তিন মাস থেকে কমিয়ে দুই মাস করারও প্রস্তাব তুলে ধরবেন নেতারা।
গণফোরামের কো-চেয়ারম্যান সুব্রত চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়ানোর কথা তুলে ধরব। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংস্কারকাজে ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। উপদেষ্টার আকার বাড়ালে কিছুটা হলেও গতিশীলতা বাড়বে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার কথাও বলা হবে। কারণ উপদেষ্টাদের অনেকের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)
আজ বেলা সাড়ে ৩টায় দলের প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুল আলম তালুকদার অংশ নেবেন। জানা গেছে, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে দৃশ্যমান করা, স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ না জানানো ও তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, আওয়ামী লীগের সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনা এবং উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়ানোর দাবি নিয়ে তাদের যুক্তি তুলে ধরবেন।
ড. রেদোয়ান আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দুই মাসের বেশি হয়েছে। তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু তার পরও সব জায়গা থেকে ফ্যাসিবাদীদের দোসর আবর্জনা সরাতে পারছে না। নির্বাচিত সরকার এলে এসব আবর্জনা দূর করা সম্ভব হবে। তাই তড়িৎগতিতে রাষ্ট্র সংস্কার করে নির্দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
১২-দলীয় জোট
বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বসবে ১২-দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। বৈঠকে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে জোট নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরবেন। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের জেসমিন টুলীসহ প্রশাসন ও সচিবালয়ে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের অপসারণ, জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট শরিকদের কেন বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না, এসব বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ধরা হবে। শেখ হাসিনাসহ সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা কীভাবে বিদেশ পালালেন ও তাদের সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করা এবং শেখ হাসিনাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হবে কি না, ছাত্র-জনতার হত্যার বিচারে দেরি হচ্ছে কেন, কী কী রাষ্ট্র সংস্কার হবে, নির্বাচনের রোডম্যাপ- এসব বিষয়ে সরকারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা হবে সংলাপে। এরপর নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন সংস্কারসহ জোটের ১৪ দফা প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরবেন নেতারা।
জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারকে আরও কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কার্যক্রম গতিশীল করার বিষয়ে কথা বলব। নির্বাচনের রোডম্যাপ দ্রুত দিয়ে রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, বিশেষ করে আরেকটি আগস্ট আসার আগেই নির্বাচন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে আরও সক্রিয় এবং দেশে অস্থিতিশীল সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করছে, ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নষ্ট করতে চাইছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাব।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট
জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং জাগপা সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বিকেল ৫টায় বৈঠকে অংশ নেবে। জানা গেছে, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপের দিনক্ষণ ঘোষণা, প্রশাসন ও সচিবালয়ে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসরদের অপসারণ, ওষুধসহ দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের দাবি জানাবে জোটটি।
খন্দকার লুৎফর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারকাজ শেষ করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলব। যাতে জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন। এখনো বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজন ঘাপটি মেরে বসে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছে। তাদের চিহ্নিত করার কথা বলব।’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাড়ে ৫টায় সাক্ষাৎ করবেন (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ও মহাসচিব আব্দুল মতিন সাউথ নেতৃত্বের একটি প্রতিনিধিদল। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করবে। এ বিষয়ে আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার কথা আমরা শুনব। পরে আমাদের প্রস্তাব তুলে ধরা হবে।’
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
বিকেল ৪টায় জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেবে। জানা গেছে, ছাত্র-শ্রমিক গণহত্যার হুকুমদাতা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত আনা ও তার সহযোগী এমপি-মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের দ্রুত বিচারে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন, ৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত হাসিনা-মনমোহন, হাসিনা-মোদি প্রতিটি অসম চুক্তি বাতিল করা, আর্থসামাজিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে ‘জাতিসত্তা কমিশন’ গঠন, ১৫ বছরের প্রতিটি গুম-খুনের বিচার ও মামলা প্রত্যাহার করাসহ দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তারা কথা বলবেন।
লেবার পার্টি
দলটির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান খবরের কাগজকে জানান, নির্বাচনি রোডম্যাপ ও নির্বাচন সংস্কৃতির পরিবর্তন বিষয়ে তারা মতামত দেবেন। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, ভোটার তালিকার হালনাগাদ, জনগণের চাহিদা প্রধান্য দিয়ে সংবিধান সংশোধন এবং কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, মনোনয়ন ফরম ফি ৫ হাজার টাকা করার যুক্তিসহ প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হবে।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে পেশিশক্তি ও আধিপত্য বিস্তার রোধ, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের সংস্কৃতি বন্ধ করা, পোস্টার-ব্যানার সাঁটানো, সভা-সমাবেশ আয়োজনের নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখার কথা বলব। প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় সভা-সমাবেশে সব রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তব্য রাখবেন। নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বা পরে তিন মাস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থায়ী রূপ দিতে প্রস্তাব দেওয়া হবে।’