উন্নত চিকিৎসায় নভেম্বরের শুরুতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। সে জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। খালেদা জিয়াও আগের চেয়ে সুস্থ। তবে দিন-ক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। কী কারণে লন্ডনযাত্রায় বিলম্ব হচ্ছে তা স্পষ্ট করতে নারাজ খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা।
মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) রাতে খবরের কাগজকে জানান, ‘ম্যাডামের বিদেশযাত্রায় দেরি হবে। আগামী সপ্তাহেও হতে পারে, বা আরও পরে। বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর বাইরে কিছু বলা যাচ্ছে না। ম্যাডাম আগের চেয়ে সুস্থ আছেন। বাসায় তার চিকিৎসা চলবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের সঙ্গে তার ছোট পুত্রবধূ গুলশানে আছেন। এবার ম্যাডাম ও তার ছেলে তারেক রহমানের একসঙ্গে হজ পালন করার কথা রয়েছে। সেটা বিদেশ যাওয়ার সময়ও হতে পারে, আবার দেশে ফেরার পথেও হতে পারে।’ সবশেষ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হজ পালন করেন বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা গতকাল বলেন, ম্যাডাম বিদেশে যেতে প্রস্তুত। যাবতীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন। তবে রাজনৈতিক কারণে যেতে বিলম্ব হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। লন্ডন থেকেই গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল বলা যায় না। এই মুহূর্তে বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা দেশে না থাকাটা একটু ঝুঁকি তো বটেই। তারেক রহমানও মামলার কারণে দেশে আসতে পারছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল বোর্ডের আরেক সদস্য বলেন, ম্যাডামের লন্ডনের ভিসা আজ (বৃহস্পতিবার) হাতে পেয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রক্রিয়াধীন। আমরা পৃথিবীর সেরা চিকিৎসা নিশ্চিত করতে চাই। এ জন্য দুই দেশের ভিসা একসঙ্গে নিচ্ছি। পরিস্থিতি বলে দেবে আমাদের কী করতে হবে। উন্নত চিকিৎসায় প্রয়োজনে লন্ডন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। সব মিলিয়ে ম্যাডামের বিদেশে যেতে একটু সময় লাগছে। যাত্রার নির্দিষ্ট তারিখ বলা যাচ্ছে না। মেডিকেল বোর্ড সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ম্যাডাম এখন বিমানে ভ্রমণ করতে পারবেন। মানে ভ্রমণ করার মতো ফিট আছেন। কখন কী হয়, সেটা তো আর কেউ বলতে পারবে না। আমরা ৬ জন চিকিৎসক সঙ্গে যাচ্ছি। সবমিলিয়ে হয়তো ১৬ জনের মতো সফরসঙ্গী থাকতে পারে।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডন যাওয়ার কথা রয়েছে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ডা. শাহাবুদ্দিন, ডা. শামসুল আরেফিন, ডা. নূর উদ্দিন, ডা. এফ এম সিদ্দিক ও ডা. আল মামুনের। এ ছাড়া দুই নার্স ও তিন সহকারীসহ ১৬ জন সফরসঙ্গী থাকবেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি ডা. জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে প্রথমে লং ডিসটেন্স স্পেশালাইজড এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডন নেওয়া হবে। সেখান থেকে তাকে তৃতীয় একটি দেশে মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হবে। তিনি জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। অতিদ্রুত তাকে বিদেশে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি হাসপাতালে নিতে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। তার অংশ হিসেবে আমরা লং ডিসটেন্স স্পেশালাইজড এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করার জন্য কাজ শুরু করেছি, যোগাযোগ চলছে। তিনি আশা করেন, প্রক্রিয়া শেষ করে অতিদ্রুতই খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে পারবেন।
তিনি জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারণ ম্যাডামের সঙ্গে চিকিৎসক-নার্সসহ আত্মীয়-স্বজন যারা যাবেন তা জানানো হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। এই চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে দুই-একটি সেন্টার রয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।
উল্লেখ ৭৯ বছর বয়সী সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, আর্থ্রাইটিস, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে আইসিইউতে রেখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে তাকে দীর্ঘ সময়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। ওই বছর অক্টোবরে হাইকোর্টে আপিল শুনানি শেষে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় বিএনপি নেত্রীর।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে খালেদার দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। ওই বছরের ২৫ মার্চ সাময়িক মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফেরেন খালেদা। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন। সাময়িক মুক্তির পর তাকে কয়েক দফা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পরিবারের তরফ থেকে বেশ কয়েকবার আবেদন করা হলেও শর্তের যুক্তি দিয়ে বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেছে সাবেক শেখ হাসিনার সরকার।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসাধীন থেকে সর্বশেষ ২১ আগস্ট গুলশানের বাসায় ফেরেন বিএনপি প্রধান।
বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে।