চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি। মূলত জুলাই-আগস্টে নির্বাচন আয়োজনের কথা কৌশলগত কারণ এবং সরকারকে চাপে রাখার জন্যই বলছে দলটি। বিএনপির নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র খবরের কাগজকে এ তথ্য জানিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা বলেন, বাস্তব কারণেই আগামী জুলাই-আগস্টের মধ্যে সরকারের পক্ষে জাতীয় নির্বাচন দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সংশ্লিষ্ট নানা মহল নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য বিভিন্ন ইস্যু তুলছে বলে তারা সন্দেহ করছে। রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার চেষ্টাসহ নানা কারণে নির্বাচন পিছিয়ে যায় কি না, তা নিয়ে বিএনপির মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন’ এমন বক্তব্য দেওয়ায় বিএনপির ওই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বশেষ গত সোমবার দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনার পরই কৌশলগত কারণেই জুলাই-আগস্টে নির্বাচনের দাবি সামনে আনা হয়।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপির বিশ্বাস আগামী জুলাই-আগস্টে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য খুব সময় লাগার কথা নয়।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে আগস্ট মাসেই নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। এই সরকার সম্মানের সঙ্গে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে বিদায় না নিলে আগামীতে দেশ ও জনগণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, ততই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাবে।’ তিনি বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয়ে গেলে জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে। তখন দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের সংকটও কেটে যাবে।
বিএনপি মনে করছে, নির্বাচনের সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা না করা, নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র বিনির্মাণে ঠিক কতটা সংস্কার হবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা, ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন (ঘোষণাপত্র), সংবিধান বাতিল বা পুনর্লিখন- এসব ইস্যু সামনে এনে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে সরকারের একটি মহল। এ ছাড়া ছাত্রদের দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন উপদেষ্টাদের কেউ কেউ। সংবিধান বাতিলের দাবিতে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ কয়েকটি দল। সব মিলিয়ে সরকার ও ছাত্ররা নানা দিক থেকে নানাভাবে জাতীয় নির্বাচন প্রলম্বিত করার আশঙ্কা করছে বলে মনে করে বিএনপির হাইকমান্ড। দলটির নেতাদের মতে, এসব ইস্যুতে নানামুখী বক্তব্য ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন সামনে চলে আসবে এবং যথাসময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনে করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা হলে তা হবে আত্মঘাতী। এর মধ্যে আবারও ফ্যাসিবাদ সরকার ফিরে আসার পথ সুগম হবে বলেও তারা মনে করে। তাই আগে সংস্কার ও পরে নির্বাচন চায় দলটি। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নির্বাচনের অনেক কাজ এখনো বাকি। তবে জুলাই-আগস্টে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব কি না, এটা সরকার ও নির্বাচন কমিশন বলবে, এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের খুব প্রয়োজনীয় সংস্কার হওয়া দরকার। তাই নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ দেওয়া জরুরি। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে ২০২৫ সালে সরকারের সুবিধাজনক সময়ে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। নির্বাচিত সরকার ও পার্লামেন্ট গঠন হলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
১২-দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার খবরের কাগজকে বলেন, ‘চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। এই দাবি আমরা শুরু থেকে জানিয়ে আসছি। কারণ এর থেকে এক দিন পিছিয়ে নির্বাচন দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। নির্বাচন আয়োজনে সরকারের জন্য এটাই পর্যাপ্ত সময়।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, জুলাই-আগস্টে নির্বাচন হলে তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। তখন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বা কার্যকর করা কঠিন হবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আগামী দিনে সরকারকে চলতে খুব বেশি সমস্যা হবে না বলেও মনে করি।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা হবে গোঁজামিলের নির্বাচন। কারণ প্রশাসনসহ অনেক জায়গায় ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপসারণ করা দরকার। তা না হলে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চাহিদা সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে না। আমরা মনে করি, জুলাই-আগস্টে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হবে না। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী দিনে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রেখে দেশ পরিচালনা করবে।’
তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের দোসরদের বিচার শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে। তাই সংস্কার ও বিচারকাজে গতি বাড়াতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই নির্বাচন দেওয়া উচিত হবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা না হলে আবারও যেনতেন নির্বাচন হলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন হবে না। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আসনের সীমানা নির্ধারণ ও চারটি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের পরই নির্বাচন দেওয়া জরুরি। আমরা মনে করি, সংস্কার মাঝামাঝি রেখে নির্বাচন হলে যেনতেন নির্বাচন হবে। সরকারের ঘোষিত রোডম্যাপ ২০২৫ সালের শেষে বা ২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন হলে কোনো সমস্যা হবে না।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আমরা চাই চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। জুলাই-আগস্টের মধ্যে হলে আরও ভালো। সরকারের কাজ হবে অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া। এটা না করলে মানুষ মনে করবে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের মতো এই সরকারও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়।’
বিএনপি আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানালেও তা বাস্তবে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। গত শুক্রবার তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এত বড় অভ্যুত্থান, এত রক্ত, এত জীবন সামগ্রিক সবকিছুর যে চাওয়া, তা কেবল একটি নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের যারা প্রতিনিধি হবেন, স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের কাছে ক্ষমতা যাবে, এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এটা তো এক কথায় অবাস্তব এবং অসম্ভব যে ছয় মাসের মধ্যে নতুন একটি ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, নির্বাচন কমিশনকে ঠিক করা, বিচারব্যবস্থা সংস্কার করা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের মূল ভূমিকায় ফিরিয়ে আনা।’
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ৫ মাস ১১ দিন। শুরুর দিকে সরকারকে সবাই স্বাগত জানালেও এখন তাদের ওপর নির্বাচনের চাপ বাড়ছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের ঘোষণার আওয়াজ তুলছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলও। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বর ধরে নিয়েই এগোচ্ছে সরকার। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের করণীয় এবং সংস্কার বিষয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন চীন ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত।