গণপরিবহনে সংরক্ষিত মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধী আসনগুলো শুধুই তাদের জন্য। তবে সংরক্ষিত ছাড়া বাকি আসনগুলোতে আপনি, আমি, শিশু, প্রতিবন্ধী সবারই বসার সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে আইনও ও জরিমানার কথা বলা আছে। নারী, শিশু কিংবা প্রতিবন্ধীরা দাঁড়িয়ে না থাকলে যদি সংরক্ষিত আসনগুলো খালি থাকে তখন পুরুষ যাত্রীরা নিশ্চই সেখানে বসতে পারেন। তবে বিপত্তিটা তখনই ঘটে, যখন বাসভর্তি পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে নারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও তাদের জন্য নির্ধারিত আসনে পুরুষরা বসে থাকেন।…
অফিস শেষে বাংলামোটর মোড় থেকে দ্রুত বাসে উঠে পড়লাম। গন্তব্য বাড়ি। বাসের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম বাসের একটি আসনও খালি নেই। বাসের পেছন থেকে দরজা পর্যন্ত গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন পুরুষযাত্রীরা। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করলাম নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত ছয়টি আসনের (বাস ভেদে ৯ থেকে ১৫টি আসন সংরক্ষিত খাকে) চারটিতেই বসে আছেন পুরুষ যাত্রী। তাদেরকে কিছু বলতে গিয়েও আর বললাম না।
এর মধ্যেই আরও কিছু পুরুষ যাত্রী হুড়মুড়িয়ে বাসে ওঠার চেষ্টা করলেন। তবে বাস ভর্তি থাকায় এবং আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় তারাও কোনোমতে দরজা ধরে দাঁড়ালেন। সেখান থেকে এক ভাই হঠাৎ আমাকে বলে উঠলেন, ‘আপা, মহিলাদের সিটে বেডারা বইয়া আছে। উঠে আপনারে জায়গা দিতে কন।’ আমিও সভয়ে নারীদের আসনে বসে থাকা একজনকে বললাম, ভাই এগুলোতো সংরক্ষিত আসন। এখানে বসেছেন কেন?
সেখান থেকে এক ভাই আমার দিকে একনজর তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর মগ্ন হলেন জানালা দিয়ে রাস্তার যানজটের দৃশ্য উপভোগ করতে। তার পাশের যাত্রীও মনে হলো জানালা দিয়ে তাকিয়ে আকাশের বিশালতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন! তাদের আচরণে মনে ব্যথা অনুভব করলাম। আস্তে আস্তে বললাম ‘এতগুলো ছেলের মধ্যে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছি তাও উনাদের একটু বিবেকবোধ কাজ করছে না।’
কথাগুলো সে দুই যাত্রীর কান পর্যন্ত না পৌঁছালেও চালকের ঠিক পেছনের আসনে বসা আরেকজনের অহংবোধকে বেশ জোরেশোরে নাড়া দিল! তাই আমাকে বসতে না দিয়ে (আমার ওপর কিছুটা ক্ষোভ থেকে ও ছোট করার উদ্দেশ্যে) আমার পেছনে থাকা এক যাত্রীকে ডেকে বললেন, ‘ভাই আমি কারওয়ার বাজার নেমে যাব, আসেন আসেন আপনি আমার সিটে এসে বসেন।’ আমার পেছনের যাত্রীটি বললেন, ‘না আমি বসবো না। আপাকে বসতে দেন।’ পরে তিনি (চালকের পেছনে বসা সেই যাত্রী) আমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে আপনিই বসেন।’ আমি বললাম, ‘এতক্ষণ আমার পেছনের ভাইকে ডেকে এখন আমাকে বসতে বলছেন কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আপনারা যখন পুরুষদের সিটে বসেন তখন তো আপনাদের উঠিয়ে দিই না আমরা।’ একথা বলেই তিনি বিজয়ের হাসি দিলেন। আমাকে এ কথা শোনাতে পেরে যেন গর্ববোধ করলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাসে কি আদৌ পুরুষ আসন আছে? আমি তাকে বললাম, আপনার হয়তো জানা নেই আপনি যেগুলোকে ‘পুরুষ সিট’ বলছেন সেগুলো আসলে ‘জেনারেল সিট’ অর্থাৎ নারী-পুরুষসহ সবার। এ তো গেল সাধারণ একটি ঘটনা। প্রতিটি পাবলিক বাসে লুকিয়ে আছে হাজারো নারীর ভিন্ন ভিন্ন অসহায়ত্বের গল্প।
ঢাকা শহরের হাজারো সমস্যার মধ্যে পাবলিক বাস নারীদের জন্য একটি আতঙ্কের নাম। কারণ এসব বাসগুলোতে বুলিং থেকে শুরু করে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে।
এদের মধ্যে সংরক্ষিত আসন নিয়ে ঝামেলা তো নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিনই কিছু যাত্রীর কমন ডায়ালগ থাকে। যেমন- ‘বাসে টাকা দিয়ে উঠেছি সিট ছড়বো কেন? জায়গা নাই তো বাসে উঠছেন কেন? সব জায়গায় নারী-পুরুষ সমান অধিকার তাহলে বাসে উঠলে কেন বাড়তি সুবিধা চান?’ আমিও বলতে চাই, বাসে কেন বাড়তি সুবিধা চাইব আমরা? উত্তরটা সহজ। কিছু সংখ্যক পুরুষের তৈরি বাড়তি কিছু অসুবিধার কারণেই আমরা সুবিধা চাইব।
বাসের সংরক্ষিত মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধী আসনগুলো শুধুই তাদের জন্য। আপনি পুরুষ চাইলেই সেখানে বসার দাবি করতে পারবেন না। তবে সংরক্ষিত ছাড়া বাকি আসনগুলোতে আপনি, আমি, শিশু, প্রতিবন্ধী সবাই বসতে পারি। এ নিয়ে আইন পাশ হয়েছে, জরিমানার কথা বলা আছে। থাক... সে প্রসঙ্গে গেলাম না। নারী, শিশু কিংবা প্রতিবন্ধীরা দাড়িয়ে না থাকলে যদি সংরক্ষিত আসনগুলো খালি থাকে তখন পুরুষ যাত্রীরা নিশ্চই সেখানে বসতে পারেন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে বিপত্তিটা তখনই ঘটে, যখন বাসভর্তি পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে নারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও তাদের জন্য নির্ধারিত আসনে পুরুষেরা বসে থাকেন।
বিষয়টা একটু উল্টো করে দেখুন তো। যদি আপনার মা-মেয়ে, স্ত্রী কিংবা বোন পুরুষ যাত্রীদের মাঝে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতো। কিছু পুরুষ যদি নানা বাহানায় তাদের স্পর্শকাতর স্থানগুলো ছুয়ে দিত। তখনও কি আপনি সংরক্ষিত আসনে পুরুষদের বসে থাকতে বলতেন? কাউকে জানালা দিয়ে আকাশের বিশালতায় হারিয়ে যেতে দেখে কিংবা ঢাকা শহরের যানজটকেও দুনিয়ার সবচেয়ে উপভোগ্য দৃশ্য মনে করা যাত্রীর আচরণে তৃপ্তির হাসি দিতেন। আপনি কি বলতেন টাকা দিয়ে উঠেছেন ভাই সিট ছাড়বেন না? মা, মহিলা সিট বলে হৈ চৈ করতেন? উত্তারটা আমি জানি। নিসন্দেহে ‘না’। কারণ আপনি আপনার মা, বোন, সন্তানকে শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে সহানুভূতির এত অভাব কেন?
তবে এর ব্যতিক্রম চিত্রও আছে। বাসে নারীদের বেহাল দশা দেখে কিছু যাত্রীভাইকে জেনারেল আসন ছেড়ে দিতে দেখেছি। দেখেছি সিটের মাঝে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসতে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা।
এ তো গেল পুরুষের কথা। আমরা নারীরাও কিন্তু মাঝে মাঝে পুরুষের চেয়ে কম তা নয়। প্রতিটি পাবলিক বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাস ভেদে ৯ থেকে ১৩টি পর্যন্ত সংরক্ষিত আসন রয়েছে। অর্থাৎ তিন ধরনের মানুষের জন্য আসনগুলো সংরক্ষিত। তবে নির্দিষ্ট করে যেহেতু স্টিকার দেওয়া বা লেখা থাকে না কোন আসনগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য, তাই সবাই বিশেষ করে নারীরা ভেবেই নেন এগুলো শুধু তাদের জন্য সংরক্ষিত। এতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যাত্রীরা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের জন্য আসন ছেড়ে দেন না। চালক বা তার সহকারীও প্রতিবন্ধী যাত্রীদের আসনগুলো ছাড়তে বললে নারীরা তা ছাড়েন না। এই ধরণের নারীরা যেন কারো কথা গায়েই মাখেন না। গায়ে মাখাবেনই বা কেন? দেখতে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও তারা হয়তো মনে মনে নিজেদের প্রতিবন্ধীই ভাবেন!
আসলে আমরা দিনে দিনে সামান্য সহানুভূতির জায়গাটুকুও বিসর্জন দিয়ে ফেলছি। সভা-সেমিনারে বড় বড় কথা বলছি, মানবিকতার মহান বুলি আওড়াচ্ছি। তবে কাজের বেলায় তার কোনো প্রতিফলন নেই। বিবেকবোধটা আসলে কোথায়? যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক থেকে আধুনিকতর হওয়ার প্রতিযোগিতা করছি। কিন্তু মানুষ কোথায় হচ্ছি?
জীবন সে তো দূর্বা ঘাসের উপর জমে থাকা দুফোটা শিশির বিন্দু। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই যা বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তাই চলুন না ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে আমারা এক অন্যের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হই। নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে, একে অন্যের সহযোগী হই। সম্মান করি প্রতিটি মা-বাবা-ভাই-বোনকে। সহজ করে দেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষগুলোর চলার পথকে। শুরুটা হোক পাবলিক বাস থেকেই।
লেখক: সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]