শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন সফল পরিণতিকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর ইতোমধ্যে প্রখ্যাত নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। দেশের ক্রান্তিকালে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলন তাদের আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বারবার যে বিষয়টি জাতির কাছে উপস্থাপন করেছেন সেটি হলো রাষ্ট্র সংস্কার। বৈষম্য ও অনিয়ম রাষ্ট্রের রন্দ্রে রন্দ্রে এভাবে বাসা বেঁধেছে, যার কারণে স্বৈরাচারের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটতে বাধ্য। যার চূড়ান্ত পরিণতি একটি পরীক্ষিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত পরিণতিতে তার প্রধানকে ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হতে হলো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় সরকার গঠনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও নিজ নিজ দক্ষ এবং অভিজ্ঞদের হাতে দায়িত্ব প্রদান করার দাবি উঠেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বিভিন্ন খাতের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছিল যেখানে বেসরকারি ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ পেয়েছিল। কিন্তু দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী ১৮ কোটি ‘ভোক্তাদের’ স্বার্থকে বারবার উপেক্ষা করা হয়েছিল। যদিও সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৯৯ জন সদস্যই ব্যবসায়ী। বাকি ১০১ জনও কোনো না কোনোভাবে ব্যবসার সঙ্গে ছিলেন। যদিও স্বার্থের বেলায় বা সুবিধা ভোগের কথা উঠলেই দল-মতাদর্শ ভুলে সবাই নিজেদের ভোক্তা হিসেবে দাবি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
তবে ভোক্তা বা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় হলে তারা আবার ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নেন। সে কারণে ভোক্তাদের পক্ষে সরাসরি কথা বলা ও তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে হলে ভোক্তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি দরকার। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরসহ সরকারের অনেক নীতি নির্ধারণী কর্তৃপক্ষে ভোক্তাদের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব না থাকার কারণে যখনই কোনো নীতি বা নির্দেশনা প্রণয়ন করা হয়, তখনই গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর স্বার্থকে বড় করে দেখে। ফলশ্রুতিতে ভোক্তা স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যায়।
ছাত্ররা তাদের নিরপেক্ষ জ্ঞানভিত্তিক জায়গা থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী সমাজ প্রবর্তনের দাবিটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিগত ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে ১৮ কোটি দেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক নাগরিক মর্যাদা উপভোগ করতে পারেনি।
দেশের যাবতীয় আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিনিয়ত নানা কৃত্রিম সংকট তৈরি নতুনভাবে বারবার আগুন লাগিয়েছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের নীরবতায় নিত্যপণ্যের বাজার, অত্যাবশ্যকীয় সেবা সার্ভিসের ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনগণের বিপুল অর্থ পকেটস্থ করে আবার দেশ-বিদেশে পাচার করেন। সে কারণে সর্বজনীন বৈষম্যের দ্রুত বিস্তার ও সম্প্রসারণের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষার জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করে আসছে। কারণ ঐতিহাসিকভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান ভূমিকা ও কাজ হলো ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষা দেওয়া। দেশে শিল্প বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানির যারা চালিকা শক্তি, তাদের প্রতি অধিকতর সহানুভূতিশীল থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য স্বাভাবিক বিষয়। দেশে ন্যায্য ব্যবসার চর্চা থাকলে হয়তো ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম অংশীজন ভোক্তাদের বিষয়টি বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি হতো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করে সব পরিস্থিতিতে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।
দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমামত সিন্ডিকেট ও অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের কারণে বড় ব্যবসায়ীরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে কীভাবে ঠকানো যায়, সেটাই মুখ্য বিষয় হয়ে যায়, সেখানে একটা স্বার্থের বড় সংঘাত থাকে। তবে আশার কথা, প্রশাসনিক বিন্যাসের বেলায় আমরা যদি উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলেও একটি মৌলিক ভিন্নতা লক্ষ করি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত উত্তরাধিকার বহন করে চলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতকে নয়, পাকিস্তানকেই বেশি অনুসরণ করেছে।
স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানি আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে পুরোপুরি গ্রহণ করে যাবতীয় প্রশাসনিক বিন্যাস ও কাঠামো পুনঃগঠন করা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। পাকিস্তানি কাঠামোর বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা দরকার ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি আমরা অনেক ক্ষেত্রে আজও দেখাতে পারিনি। ক্যাব ভোক্তা সংক্রান্ত পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি তুলে আমাদের অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকানোর একটি সুযোগ করে দিয়েছেন।
দেশের ১৮ কোটি মানুষই ক্রেতা-ভোক্তা হলেও তাদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষায় কোনো পৃথক মন্ত্রণালয় নেই। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ক্ষুদ্র অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও এটিও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। আর ভোক্তাদের অধিকার ও সুবিধা প্রদানের জন্য সবকিছুর ভার দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের ওপর।
ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোক্তা স্বার্থের বিষয়টি দেখভাল করার কারণে ভোক্তা স্বার্থ বারবার উপেক্ষিত ও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বিষয়গুলো অনেকটাই বিড়ালকে মাছ পাহারা দেওয়ার মতো। ফলে ব্যবসায়ীরা মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে একবার পেঁয়াজ, একবার চাল, একবার মসলা, একবার সয়াবিন এভাবে পুরো বছর নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনগণের পকেট কাটছে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ হলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ। সে কারণে দেশের ভোক্তাদের নিত্যপণ্যের বার্ষিক চাহিদা নিরুপণ, উৎপাদন, জোগান, বাজারজাতকরণে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অনুসন্ধান, ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে চিন্তা করার সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের থাকে না।
এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হলেও জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা দিয়ে কোনো প্রকার লজিস্টিক সুবিধা ছাড়াই তারা কাজ করছেন। আর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। যদিও সরকার ভোক্তা সংরক্ষণ আইন, নিরাপদ খাদ্য আইনসহ নানা উদ্যোগ নিলেও তার সুফল জনগণ পাচ্ছে না। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত ও ভোক্তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হলে আইন প্রয়োগে সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী ‘ভোক্তাদের’ জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় না থাকায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন, গণমাধ্যমসহ সব মহলের কাছে ভোক্তাদের বেদনা, ভোগান্তি পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা ভোক্তাদের কথা শোনার চেয়ে ব্যবসায়ীদের কথা শুনতে আগ্রহী। কারণ ভোক্তারা অসংগঠিত, তাদের সংগঠন শক্তিশালী নয়। আর ব্যবসায়ীদের কথা শুনলে তার বিপরীতে প্রতিদান দেওয়ার সক্ষমতাও তাদের আছে। ফলশ্রুতিতে ভোক্তাদের হয়রানি, ভোগান্তির চেয়ে ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো সমাধানে সরকার যেরকম গুরুত্ব দিচ্ছে তেমনি গণমাধ্যমগুলোও বেশি করে প্রচারিত হচ্ছে। যার অন্যতম দৃষ্টান্ত পেঁয়াজ, চাল ও আলুর মূল্যের সেঞ্চুরি। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজ মজুত করে দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটলেও সরকার জনগণের কষ্ট লাগবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হচ্ছে না।
দেশের ‘ভোক্তারা’ সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী হলেও সরকার প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ একেবারেই নগণ্য। ভোক্তারা সুসংগঠিত নয় ও তাদের সংগঠন শক্তিশালী না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে সে বিবেচনায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বারবার। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য, জ্বালানিসহ বিভিন্ন উপদেষ্টা ছিলেন। তারা সরকার প্রধানকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ দিতেন এবং জনগণের সমস্যাগুলোও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হতেন।
এ অবস্থায় দেশের ভোক্তাস্বার্থ বিবেচনা, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের বিষয়টি তুলে ধরা, ভোক্তাস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন, চাহিদা, উৎপাদন, আমদানির সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণ; সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে দরিদ্র, স্বল্প আয় ও নিম্নমধ্যবিত্তের ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হয় সে লক্ষ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় রাখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ভোক্তাদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি করা দরকার। যার মাধ্যমে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারক মহলে ভোক্তাস্বার্থের বিষয়গুলো দ্রুত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনা সম্ভব হবে।
তাই এ মুহূর্তে গঠিতব্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ভোক্তাদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করে জন প্রত্যাশা পূরণে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়করাসহ রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এগিয়ে আসবেন এ প্রত্যাশা করি।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
[email protected]