‘ও মানুষ মানুষ, দুডো চোখ দুডো কান, দ্যাখবা আর শুনবা, কিন্তু এট্টা মুখ তো, কতা কম কবা, তোমার ম্যালা ঝামেলা কমে যাবে কলাম...’ গানটি হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। এর মর্মার্থ উপলব্ধি করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার দাদি মারা গেছেন ১৯৯০ সালে ৭৯ বছর বয়সে। তিনি বলতেন, কথায় কথা বাড়ে, ভোজনে বাড়ে পেট’। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে গ্রামে। বলতে গেলে শৈশবের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা বা কথাবার্তাই আমার মনে পড়ে। তখন গ্রামের মানুষ এই কথা কম বলা নিয়ে একটা বাক্য বলতেন, ‘মুখ ছিনালের চেয়ে... ছিনাল ভালো’। এমন বহু প্রবাদ আছে যা ব্যবহৃত হয়ে আসছে কথা বলা নিয়ে সতর্ক করতে। প্রবাদ বহমান! এসব অলিখিত প্রবাদ মুখে মুখে বয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
তবে ‘…কতা কম কবা’ গানটি খুব বেশি পুরনো নয়। গীতিকার কোন প্রেক্ষাপটে এই গানটি লিখেছিলেন তা উনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে গানের কথাগুলো যথার্থ।
আমরা আজ যে প্রসঙ্গ নিয়ে বলব সেটা কোনো এক দেশের কাল্পনিক গল্প। গল্প তো গল্পই, যদি মিলে যায় তাহলে কাকতাল বলতে হবে।
এক দেশে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী এক রাজা ছিলেন। বলতে পারেন, রাজা তো সবসময়ই প্রতাপশালী হয়। এ ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম হলো, তার পূর্বসূরি এই সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং দেশবাসীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। বর্তমান রাজা দেশবাসীর প্রতি যথেষ্ট যত্নবান। দেশ পরিচালনার জন একটি সুন্দর মন্ত্রিসভা করেছেন। যারা রাজার মতো দেশের কথা ভাবেন। মন্ত্রিসভায় বড় মন্ত্রী, ছোট মন্ত্রী, উজির, নাজির সবই হলো। রাজ্যবাসীও সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল!
তো, একসময় হলোটা কী; দীর্ঘদিন দেশ চালাতে চালাতে এক ‘বুড়ো’ মন্ত্রী খানিকটা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়লেন! অবস্থাটা ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, তিনি কী বলবেন বা বলছেন তা ভাবতে পারতেন না। আবল-তাবল কথা বলা, অমুক-তমুককে দোষী করা এসবের মধ্যেই ডুবে থাকতেন। আর ধীরে ধীরে এর প্রভাব পড়তে থাকল রাজার মধ্যেও।
এই দেশে ছিল রাজার বিরোধী কিছু মানুষ। তারা আলাদা আলাদা রাজার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরোধিতা করতেন। কিন্তু রাজাকে কোনোভাবেই টলাতে পারতেন না। এভাবে চলতে চলতে এক সময় বিরোধী লোকজন একসঙ্গে জোট বাঁধল প্রতিবাদ জানাতে। তখন থেকেই তারা সুযোগ খুঁজতে লাগল। রাজা বুঝতেন যে, এই জোট ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু কোনো সাবধানতা অবলম্বন করতেন না। তিনি তার মন্ত্রীদের কথায় খুব বিশ্বাস করতেন। প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করার শক্তিও এক সময় তাদের লোপ পেতে শুরু করল।
অতীতে রাজা অনেক বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি প্রজাদের দুঃখকে নিজের দুঃখ ভাবতেন। নিজে খোঁজখবর নিতেন। অন্যদেরও খোঁজখবর রাখার কথা বলতেন। প্রজারাও তাদের সমস্যার কথা রাজাকে জানাতে পারতেন। কিন্তু বিশাল এই দেশ তো আর একার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়, এজন্যই তিনি বিজ্ঞ বিজ্ঞদের মন্ত্রিসভায় বসিয়েছিলেন তাকে সাহায্য করতে। প্রথম প্রথম তারা বেশ কর্মঠ এবং নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে সিংহাসন যত পুরনো হতে লাগল, তাদের আলসেমি, খামখেয়ালিপনাও বাড়তে লাগল। শেষে অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গেল যে, মুড়ি আর মিছরিকে সমান ভাবতে শুরু করল।
রাজা তার রাজ্যের হিরের খনিগুলোতে লোক নিয়োগ করার জন্য একটা নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। খনির শ্রমিক থেকে শুরু করে ভাণ্ডাররক্ষক পর্যন্ত সবার জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য। এভাবেই চলছিল সব। দেশের নিয়ম অনুযায়ী, এই দেশ জয়ে যারা ভূমিকা রেখেছেন তারা ইতিহাসের সূর্যসন্তান। তাদের জন্য সব ক্ষেত্রে সবসময় বিশেষ সম্মান থাকবে। এভাবেই চলতে থাকল দীর্ঘ সময়। বেশ কিছু বছর এভাবেই কাটল। বহু বছর পর রাজার দেশে শুরু হলো নিয়ম বদলানোর প্রতিবাদ। এটি চলতে থাকল দীর্ঘ সময়। কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছিল না। ফলে কিছুদিন পর পর থেমে থেমে আন্দোলন হয়। আবার বিভিন্ন কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
এই রাজার এক মন্ত্রির জিভ ছিল জাদুকরী ও সোনায় মোড়ানো। এই জিভ দিয়েই তিনি সবকিছু ‘ডলে’ দিতেন। সব বিষয়েই তার অসীম চতুরতা। আর তাই তো স্বাভাবিক! কারণ তিনি হলেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তিনি যা বলেন তাই ঠিক। ‘জিভ’ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েই আজ তিনি এই অবস্থানে।
এক সময় দেশে কর্মঠ যুবকের সংখ্য বেড়ে গেল। কাজ চাই, কর্ম চাই... এমন একটা স্লোগান নিয়ে তারা প্রথা ভাঙার আন্দোলন শুরু করল। খনির কাজে বিশেষ সুবিধা রদ করতে মরিয়া হয়ে উঠল তারা। তাদের আন্দোলন এবার খুবই বেগবান। সবাই কর্মঠ যুবক। অনেকেই কাজের অভাবে পছন্দের মানুষকে ঘরে তুলতে পারছে না। সবার এক শপথ, প্রথা ভেঙে কাজ পাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু রাজাকে এ বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা করা হলো! এর মধ্যে দুমুখোরা দিল রাজাকে উসকে। রাষ্ট্রের বুড়ো মন্ত্রী আরও এক কাঠি সরেস। তিনি বরাবরের মতো সোনার জিভে ‘ঘষা’ দিলেন। কিন্তু সফল হলেন না। ফল হলো উল্টো। দেশজুড়ে শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড। আর সুযোগ বুঝে এতে ঢুকে পড়ল রাজার বিরোধীরা। রাজা আর মন্ত্রীর কথায় শুরু হলো লঙ্কাকাণ্ড। প্রাণ গেল শয়ে শয়ে। কিন্তু কোনো কিছুতেই আর আন্দোলন থামানো যাচ্ছিল না। এর পর সেই রাজার পতন হয়েছিল। আর রাজাসহ পরামর্শকরাও হয়েছিলেন দেশান্তরী। আর রোষানলে পড়তে হয়েছিল চাটুকারদের।
একটা জিনিস আমরা হয়তো আমলেই নিই না যে, কথা বলতে হয় নিজের অবস্থানকে চিন্তা করে। এটা মনে রাখা দরকার, আমি কে এবং আমার অবস্থান অনুযায়ী কথাবার্তা কেমন হওয়া উচিত। একটা রাজনীতিবিদ বা বিশিষ্টজনের কথা আর সাধারণ মানুষের কথাবার্তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে বসে দেশ নিয়ে কথাবার্তা বলা লোকদের মতো একজন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল লোকের কথা বলার ধরন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সবার ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার সংজ্ঞা একরকম নয়! কী বলব তা চিন্তা করা যেমন জরুরি, কী বলা যাবে না তা চিন্তা করা আরও বেশি জরুরি। চিন্তাভাবনা করে কথা বলা ব্যক্তিত্বেরও বহিঃপ্রকাশ। কী বললে ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন হয়; মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় বা হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হই- সেটি ভাবনায় রাখতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা খুশি তা-ই লেখাকে বাকস্বাধীনতা বলে মনে করেন অনেকেই। আমি এটা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জিভ যে ক্রমশ ধারালো হয়ে গেছে, তা বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিত কিন্তু মজবুত হয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমেই। আমি, আপনি বা আপনারারা যা কিছু বলছেন তা নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছে লাখো মানুষের কাছে। এই কোটা আন্দোলনটা ইচ্ছে করলে শুরুতেই সমাধান করা যেতে। কিন্তু বিষয়টিকে ওই রাজার দেশের মন্ত্রীর মতো কেউ আমলেই নেয়নি।
ধরুন, আমি জানি যে, আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে। আর যেহেতু মাঝেমধ্যেই এই সমস্যা হয় তাহলে গ্যাসের ট্যাবলেটও সঙ্গে রাখা জরুরি। আর যেহেতু আশঙ্কা ছিল, এ ধরনের আন্দোলনকে পুঁজি করে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা নিতে পারে, তাহলে শুরুতেই আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে বসে গ্যাসের ট্যাবলেটটি খেয়ে নেওয়াটা খুবই জরুরি ছিল। তা না করে এটাকে অবহেলা করা হলো। অন্যের সম্পর্কে বিষোদগার; ভিন্নমতের মানুষকে কটাক্ষ করা; সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করার মতো প্রবণতা শুরু হলো। আর এর সুযোগ নিল তৃতীয় পক্ষ। তাতে দেখা গেল, তখন যেটা ট্যাবলেটে সেরে যেতে এখন এটা সার্জারিতেও আর সারছে না।
এ জন্যই দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে কথা বলার সময় আমাদের সবার সবদিক বিবেচনা করে কথা বলা উচিত। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের ওপর সরকারের আস্থা বাড়ানো উচিত। গোয়েন্দার মাধ্যমে খবরদারির চেয়ে নজরদারি বাড়ানো উচিত। আর সর্বোপরি যেটা উচিত সেটা হলো- কী বলা যাবে না, তা চর্চা করা।
অমিয় দত্ত ভৌমিক
সহকারী বার্তা সম্পাদক, খবরের কাগজ