ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কথা বলতে হবে মুখ মেপে

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৪, ১১:২৪ এএম
আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
কথা বলতে হবে মুখ মেপে
অমিয় দত্ত ভৌমিক

‘ও মানুষ মানুষ, দুডো চোখ দুডো কান, দ্যাখবা আর শুনবা, কিন্তু এট্টা মুখ তো, কতা কম কবা, তোমার ম্যালা ঝামেলা কমে যাবে কলাম...’ গানটি হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। এর মর্মার্থ উপলব্ধি করাটা  খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার দাদি মারা গেছেন ১৯৯০ সালে ৭৯ বছর বয়সে। তিনি বলতেন, কথায় কথা বাড়ে, ভোজনে বাড়ে পেট’। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে গ্রামে। বলতে গেলে শৈশবের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা বা কথাবার্তাই আমার মনে পড়ে। তখন গ্রামের মানুষ এই কথা কম বলা নিয়ে একটা বাক্য বলতেন, ‘মুখ ছিনালের চেয়ে... ছিনাল ভালো’। এমন বহু প্রবাদ আছে যা ব্যবহৃত হয়ে আসছে কথা বলা নিয়ে সতর্ক করতে। প্রবাদ বহমান! এসব অলিখিত প্রবাদ মুখে মুখে বয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

তবে ‘…কতা কম কবা’ গানটি খুব বেশি পুরনো নয়। গীতিকার কোন প্রেক্ষাপটে এই গানটি লিখেছিলেন তা উনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে গানের কথাগুলো যথার্থ।

আমরা আজ যে প্রসঙ্গ নিয়ে বলব সেটা কোনো এক দেশের কাল্পনিক গল্প। গল্প তো গল্পই, যদি মিলে যায় তাহলে কাকতাল বলতে হবে।

এক দেশে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী এক রাজা ছিলেন। বলতে পারেন, রাজা তো সবসময়ই প্রতাপশালী হয়। এ ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম হলো, তার পূর্বসূরি এই সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং দেশবাসীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। বর্তমান রাজা দেশবাসীর প্রতি যথেষ্ট যত্নবান। দেশ পরিচালনার জন একটি সুন্দর মন্ত্রিসভা করেছেন। যারা রাজার মতো দেশের কথা ভাবেন। মন্ত্রিসভায় বড় মন্ত্রী, ছোট মন্ত্রী, উজির, নাজির সবই হলো। রাজ্যবাসীও সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল!

তো, একসময় হলোটা কী; দীর্ঘদিন দেশ চালাতে চালাতে এক ‘বুড়ো’ মন্ত্রী খানিকটা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়লেন! অবস্থাটা ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, তিনি কী বলবেন বা বলছেন তা ভাবতে পারতেন না। আবল-তাবল কথা বলা, অমুক-তমুককে দোষী করা এসবের মধ্যেই ডুবে থাকতেন। আর ধীরে ধীরে এর প্রভাব পড়তে থাকল রাজার মধ্যেও।

এই দেশে ছিল রাজার বিরোধী কিছু মানুষ। তারা আলাদা আলাদা রাজার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরোধিতা করতেন। কিন্তু রাজাকে কোনোভাবেই টলাতে পারতেন না। এভাবে চলতে চলতে এক সময় বিরোধী লোকজন একসঙ্গে জোট বাঁধল প্রতিবাদ জানাতে। তখন থেকেই তারা সুযোগ খুঁজতে লাগল। রাজা বুঝতেন যে, এই জোট ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু কোনো সাবধানতা অবলম্বন করতেন না। তিনি তার মন্ত্রীদের কথায় খুব বিশ্বাস করতেন। প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করার শক্তিও এক সময় তাদের লোপ পেতে শুরু করল।

অতীতে রাজা অনেক বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি প্রজাদের দুঃখকে নিজের দুঃখ ভাবতেন। নিজে খোঁজখবর নিতেন। অন্যদেরও খোঁজখবর রাখার কথা বলতেন। প্রজারাও তাদের সমস্যার কথা রাজাকে জানাতে পারতেন। কিন্তু বিশাল এই দেশ তো আর একার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়, এজন্যই তিনি বিজ্ঞ বিজ্ঞদের মন্ত্রিসভায় বসিয়েছিলেন তাকে সাহায্য করতে। প্রথম প্রথম তারা বেশ কর্মঠ এবং নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে সিংহাসন যত পুরনো হতে লাগল, তাদের আলসেমি, খামখেয়ালিপনাও বাড়তে লাগল। শেষে অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গেল যে, মুড়ি আর মিছরিকে সমান ভাবতে শুরু করল।

রাজা তার রাজ্যের হিরের খনিগুলোতে লোক নিয়োগ করার জন্য একটা নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। খনির শ্রমিক থেকে শুরু করে ভাণ্ডাররক্ষক পর্যন্ত সবার জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য। এভাবেই চলছিল সব। দেশের নিয়ম অনুযায়ী, এই দেশ জয়ে যারা ভূমিকা রেখেছেন তারা ইতিহাসের সূর্যসন্তান। তাদের জন্য সব ক্ষেত্রে সবসময় বিশেষ সম্মান থাকবে। এভাবেই চলতে থাকল দীর্ঘ সময়। বেশ কিছু বছর এভাবেই কাটল। বহু বছর পর রাজার দেশে শুরু হলো নিয়ম বদলানোর প্রতিবাদ। এটি চলতে থাকল দীর্ঘ সময়। কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছিল না। ফলে কিছুদিন পর পর থেমে থেমে আন্দোলন হয়। আবার বিভিন্ন কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।

এই রাজার এক মন্ত্রির জিভ ছিল জাদুকরী ও সোনায় মোড়ানো। এই জিভ দিয়েই তিনি সবকিছু ‘ডলে’ দিতেন। সব বিষয়েই তার অসীম চতুরতা। আর তাই তো স্বাভাবিক! কারণ তিনি হলেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তিনি যা বলেন তাই ঠিক। ‘জিভ’ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েই আজ তিনি এই অবস্থানে।

এক সময় দেশে কর্মঠ যুবকের সংখ্য বেড়ে গেল। কাজ চাই, কর্ম চাই... এমন একটা স্লোগান নিয়ে তারা প্রথা ভাঙার আন্দোলন শুরু করল। খনির কাজে বিশেষ সুবিধা রদ করতে মরিয়া হয়ে উঠল তারা। তাদের আন্দোলন এবার খুবই বেগবান। সবাই কর্মঠ যুবক। অনেকেই কাজের অভাবে পছন্দের মানুষকে ঘরে তুলতে পারছে না। সবার এক শপথ, প্রথা ভেঙে কাজ পাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু রাজাকে এ বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা করা হলো! এর মধ্যে দুমুখোরা দিল রাজাকে উসকে। রাষ্ট্রের বুড়ো মন্ত্রী আরও এক কাঠি সরেস। তিনি বরাবরের মতো সোনার জিভে ‘ঘষা’ দিলেন। কিন্তু সফল হলেন না। ফল হলো উল্টো। দেশজুড়ে শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড। আর সুযোগ বুঝে এতে ঢুকে পড়ল রাজার বিরোধীরা। রাজা আর মন্ত্রীর কথায় শুরু হলো লঙ্কাকাণ্ড। প্রাণ গেল শয়ে শয়ে। কিন্তু কোনো কিছুতেই আর আন্দোলন থামানো যাচ্ছিল না। এর পর সেই রাজার পতন হয়েছিল। আর রাজাসহ পরামর্শকরাও হয়েছিলেন দেশান্তরী। আর রোষানলে পড়তে হয়েছিল চাটুকারদের।

একটা জিনিস আমরা হয়তো আমলেই নিই না যে, কথা বলতে হয় নিজের অবস্থানকে চিন্তা করে। এটা মনে রাখা দরকার, আমি কে এবং আমার অবস্থান অনুযায়ী কথাবার্তা কেমন হওয়া উচিত। একটা রাজনীতিবিদ বা বিশিষ্টজনের কথা আর সাধারণ মানুষের কথাবার্তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে বসে দেশ নিয়ে কথাবার্তা বলা লোকদের মতো একজন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল লোকের কথা বলার ধরন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সবার ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার সংজ্ঞা একরকম নয়! কী বলব তা চিন্তা করা যেমন জরুরি, কী বলা যাবে না তা চিন্তা করা আরও বেশি জরুরি। চিন্তাভাবনা করে কথা বলা ব্যক্তিত্বেরও বহিঃপ্রকাশ। কী বললে ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন হয়; মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় বা হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হই- সেটি ভাবনায় রাখতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা খুশি তা-ই লেখাকে বাকস্বাধীনতা বলে মনে করেন অনেকেই। আমি এটা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জিভ যে ক্রমশ ধারালো হয়ে গেছে, তা বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিত কিন্তু মজবুত হয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমেই। আমি, আপনি বা আপনারারা যা কিছু বলছেন তা নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছে লাখো মানুষের কাছে। এই কোটা আন্দোলনটা ইচ্ছে করলে শুরুতেই সমাধান করা যেতে। কিন্তু বিষয়টিকে ওই রাজার দেশের মন্ত্রীর মতো কেউ আমলেই নেয়নি। 

ধরুন, আমি জানি যে, আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে। আর যেহেতু মাঝেমধ্যেই এই সমস্যা হয় তাহলে গ্যাসের ট্যাবলেটও সঙ্গে রাখা জরুরি। আর যেহেতু আশঙ্কা ছিল, এ ধরনের আন্দোলনকে পুঁজি করে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা নিতে পারে, তাহলে শুরুতেই আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে বসে গ্যাসের ট্যাবলেটটি খেয়ে নেওয়াটা খুবই জরুরি ছিল। তা না করে এটাকে অবহেলা করা হলো। অন্যের সম্পর্কে বিষোদগার; ভিন্নমতের মানুষকে কটাক্ষ করা; সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করার মতো প্রবণতা শুরু হলো। আর এর সুযোগ নিল তৃতীয় পক্ষ। তাতে দেখা গেল, তখন যেটা ট্যাবলেটে সেরে যেতে এখন এটা সার্জারিতেও আর সারছে না।

এ জন্যই দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে কথা বলার সময় আমাদের সবার সবদিক বিবেচনা করে কথা বলা উচিত। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের ওপর সরকারের আস্থা বাড়ানো উচিত। গোয়েন্দার মাধ্যমে খবরদারির চেয়ে নজরদারি বাড়ানো উচিত। আর সর্বোপরি যেটা উচিত সেটা হলো- কী বলা যাবে না, তা চর্চা করা।

অমিয় দত্ত ভৌমিক
সহকারী বার্তা সম্পাদক, খবরের কাগজ

এখন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোই জরুরি

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৪ পিএম
এখন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোই জরুরি
অরূপ তালুকদার

নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ হয়েও এবারে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের কমপক্ষে ১১টি জেলা; যার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের ৭৭ উপজেলা; বিগত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল এবং ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে যেভাবে প্লাবিত হয়েছে তা রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ এবারের মতো বন্যা বিগত দুই যুগেও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

দক্ষিণবঙ্গের মানুষ আমরা। আমাদের জল-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে কম-বেশি রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় প্রতিবছর। আমাদের জন্য এসব এখন আর নতুন কিছু নয়। 

বরিশাল বিভাগের যেমন বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার শহর এলাকার নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানের কাছাকাছি কোনো নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠে গেলে এবং জোয়ারের পানির চাপে প্লাবিত হলেও  দুই-একদিনের মধ্যেই সে পানি আবার নেমে যায়। এখন যেমন দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ফলে পানির চাপে কোনো কোনো স্থান প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এবারের অস্বাভাবিক প্লাবনের ফলে ইতোমধ্যে যেভাবে ডুবে গেছে অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ট্রেন লাইন; বিপর্যস্ত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা- তার কোনো তুলনা হয় না। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। 

কোথাও কোথাও পানির প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে গৃহপালিত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ বাড়িঘরের আসবাবপত্র, মাছের ঘের; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। ভাঙন শুরু হয়েছে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোয়। 

পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কমপক্ষে প্রায় ৬ লাখ পরিবারের প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ, জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তারা দিনাতিপাত করছে মহাদুর্ভোগের মধ্যে। অনেক পরিবারেই খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে দুর্যোগকবলিত এসব এলাকার অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। যে কারণে এসব অঞ্চলে বসবাসকারীদের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য স্থানের মানুষজনের যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। 

তবে ইতোমধ্যে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা, যারা ইতোমধ্যেই বন্যাদুর্গত অঞ্চল থেকে উদ্ধার করেছে পানিবন্দি থাকা শিশুসহ ২৭২ জনক।

এদিকে আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানির ন্যায্য হিসাব পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুরের বেগম রোকেয়া এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

তারা বলেছেন, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর কুমিল্লা ও ফেনী প্লাবিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর যোগাযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টি নদীতে তারা বাঁধ দিয়েছে।

তারা অভিযোগ করেন, ভারত গ্রীষ্ম মৌসুমে বাঁধ বন্ধ রাখে, আবার বর্ষা মৌসুমে খুলে দেয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভারতের আধিপত্য প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও ভয়াবহ বন্যার কারণে রাজ্যের কমপক্ষে আটটি জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। 

এনডিটিভির খবরসূত্রে জানা যায়, এসব জেলার প্রায় ৭ হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছে। মৃত্যু হয়েছে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২২ জনের। উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ত্রিপুরার ‘ডুম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট’-এর গেট খুলে দিয়েছেন রাজ্যটির প্রশাসক। 

ত্রিপুরার জেলা শাসক তড়িৎ কান্তি চাকমা জানিয়েছেন, গোমতী নদীতে জলসীমা বেড়ে যাওয়ায় ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জলস্তর বিপৎসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। সেক্ষেত্রে বাঁধ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে গেট খুলে পানি ছেড়ে দিতে হয়েছে। তিনি জানান, ভয়াবহ এই বন্যায় রাজ্যটিতে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে।’ 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আমরা উল্লেখ করতে চাই যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছরের সবচাইতে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে এই বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকে বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলোতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি একটি যৌথ সমস্যা। এটা উভয় দেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগের জন্ম দেয়। এ সমস্যার সমাধানে ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।’

এদিকে সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম সম্প্রতি সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বন্যায় জনগণের জানমাল রক্ষায় সার্বিকভাবে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার প্রস্তুত রয়েছে।

সম্প্রতি হবিগঞ্জে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘পানি ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে জানানোর বিষয়টি ভারত প্রতিপালন করেনি।’

বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিয়োজিত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। এই সময় প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার কারণ জানতে চাইলে হাইকমিশনার জানান, ত্রিপুরার বন্যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এর ফলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৈঠকে বাংলাদেশকে সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেন হাইকমিশনার।  

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের বন্যা মোকাবিলার প্রয়োজনে দুপক্ষেরই সহযোগিতা এবং উভয় দেশের সরকার এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়ভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, এবারের বন্যা একেবারে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে দেশের কমপক্ষে ১১টি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। বন্যার পানি এখনো নামতে শুরু করেনি। আশা করা যাচ্ছে, বৃষ্টি থেমে গেলে পানির চাপ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।

তবে বন্যার কারণে এসব জেলায় কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা বোঝা যাবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর। তখন শুরু হবে আসল কাজ। বন্যার্তদের পুনর্বাসন ও তাদের বাড়িঘর পুনঃনির্মাণসহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের প্রয়োজনীয় মেরামত এবং ক্ষতিগ্রস্ত খেত-খামারের তদারকি বাড়িয়ে তা আবার পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে তখন শুরু হবে বিরাট এক কর্মযজ্ঞ। 

তবে এখন সবার জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, বন্যা-উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর ইতোমধ্যেই দুর্গত এলাকার সেই লাখ লাখ অসহায় পানিবন্দি মানুষের পাশে মানবিক সাহায্যের হাত নিয়ে দাঁড়িয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দেখা গেছে, প্রতিদিন তাদের কাছে ত্রাণ দিতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে।

শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও নানা সংস্থাসহ সাধারণ মানুষ নানাভাবে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ জেলার কমপক্ষে ৪৫ লাখ মানুষ। গত মঙ্গলবার থেকে এ পর্যন্ত শিশুসহ প্রাণহানি ঘটেছে অন্তত ১৫ জনের। বন্যায় প্লাবিত ৭৭টি উপজেলার ৫৮৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদ্ভূত সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে উপদ্রুত এলাকায় ৩১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ জন আশ্রয়হীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি বন্যাকবলিত এলাকায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দানের লক্ষ্যে ৬৩৭টি মেডিকেল টিম কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, দুর্গত এলাকার মানুষদের সহায়তা দিতে ইতোমধ্যে নগদ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দসহ খাদ্য সহায়তা বাবদ ১৫০ টন চাল এবং ১৫০০০ খাদ্যের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।

এদিকে বন্যাদুর্গত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সকল স্তরের মানুষ প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে অনুদান প্রদান করতে পারবেন। যেভাবে দিতে হবে : সোনালী ব্যাংক, কর্পোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, হিসাব  নম্বর : ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩।

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব পদবির সেনাসদস্যদের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সাহায্য-সহযোগিতার  নিমিত্তে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হয়েছে।

একইভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ( বিজিবি)-এর সব সদস্যের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সহায়তায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব এক নির্মম অভিশাপ
সংগীত কুমার

বেকারত্ব আমাদের দেশের সামাজিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিগত কয়েক বছর ধরে বেকারত্বের কশাঘাতে জর্জরিত আমাদের তরুণ সমাজ। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের পরিসংখ্যান যদি তুলে ধরি, তাহলে দেখতে পাবো ২০১৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ছিল ৪ লাখ। ২০২২ সালের শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ লাখে (সূত্র : বিবিএস)। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। 

দেশে বর্তমানে প্রতি তিনজন বেকারের মধ্যে একজন উচ্চশিক্ষিত। তারা বিএ কিংবা এমএ ডিগ্রি নিয়েও শোভন চাকরি পাচ্ছে না। ফলে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে টিউশনি, পাঠাও-উবারে ভেলিভারিম্যান, বিক্রয়কর্মী এবং কেউ কেউ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিগুলোতেও যোগ দিচ্ছেন। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সর্বশেষ রেলের পরিচ্ছতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সবাই স্নাতক ডিগ্রিধারী। বিভিন্ন জরিপ মতে দেশের ৭৮ শতাংশ তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবন ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্নতা বিরাজ করছে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘন্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়ম অনুসারেই বেকারত্বের হিসাব দিয়েছে। কোভিড মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি শ্লথগতি হয়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করে ফেলে। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। 

দীর্ঘ দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষকে গড় আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করতে হয় খাবার ক্রয়ে। বৈদেশিক মুদ্রায় সংকট চলছে, যথেষ্ট দেশি বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি বিনিয়োগ গত এক দশক ধরে জিডিপির ২২-২৩ শতাংশে আটকে আছে। ফলে বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না এবং বেকারত্ব বাড়ছে। 

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৭ লাখ ৯৯ হাজার। অর্থাৎ মোট বেকারের ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। তাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। অর্থাৎ তরুণদের সংখ্যাটাই বেশি। বেকারদের মধ্যে ৫১ শতাংশ আবার উচ্চমাধ্যমিক পাস। 

বিবিএসের আরেকটি সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ অনুসারে বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনায় নাই, কর্মসংস্থানে নাই, এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০-২২ লাখ তরুণ গোষ্ঠী নতুন করে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে ১২-১৩ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু তাদের ৮৫ শতাংশ মজুরিভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা শোভন চাকরি পায়। আর বাকি ৮-৯ লাখ জনগোষ্ঠী প্রবাসে যান চাকরির খোঁজে। 

দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৭টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৭১ হাজারের কিছু বেশি সরকারি চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছর যত শোভন কর্মসংস্থান বা চাকরি সৃষ্টি হয়, তার চার ভাগের তিন ভাগই হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাহিদার তুলনায় সরকারি চাকরি সৃষ্টি খুবই কম হচ্ছে।

আরও ভয়াবহ চিত্র পাবো যদি গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করি। দেখা যাবে যতগুলো পদের জন্য আবেদন আহ্বান করা হচ্ছে তার চেয়ে ২০০ গুন বেশি আবেদন জমা পড়েছে। সর্বশেষ ৪৬ তম বিসিএস পরীক্ষায় পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৪০ টি। প্রাথমিকভাবে আবেদন জমা পড়ে ৩ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। ৪৫ তম বিসিএসে ২ হাজার ৩০৯টি পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার। ৪৪তম বিসিএসে আবেদন জমা পড়ে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬০টি। পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭১০টি।

বাংলাদেশে তরুণেরা যে ধরনের শিক্ষা পাচ্ছেন এবং তারা যে কাজ করতে পারেন সেই ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার যে ধরনের কাজ সৃষ্টি হচ্ছে, এখনকার শিক্ষিত তরুণেরা সেই ধরনের কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, ‘লোকে বলে চাকরি কই, চাকরি বলে লোক কই’! ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব তরুণদের জন্য নির্মম অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এই অভিশাপ থেকে নিস্তারের চ্যালেঞ্জগুলো আলোচনা করা করা যাক। শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রে সামঞ্জস্যহীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাস্তবমুখী দক্ষতা তৈরির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

তথ্য প্রযুক্তি এবং ই-কমার্সের ঘাটতি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি ও ই-কমার্সের দিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় উচ্চশিক্ষিতদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে না। ডিজিটাল দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার অভাব রয়েছে, যা উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। উদ্যোক্তা সৃষ্টির অনুপ্রেরণার অভাবও ভীষণভাবে পরিলক্ষিত। ফলে দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহের অভাব দৃশ্যমান। এর মূল কারণগুলো হলো পুঁজিবাজারের অভাব, বিনিয়োগের সুযোগ কম এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান ও নেতৃত্বের অভাব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এখনও শ্রমবাজারে তরুণদের সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যার্থ হচ্ছে। সামাজিকভাবে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা বেশি। এবার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া যেতে পারে তা আলোচনা করা যাক: 

শিক্ষা ব্যবস্থার পুর্নগঠন এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক এবং কর্মমুখী করতে হবে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা, সফট স্কিল এবং ভোকেশনাল ট্রেনিংকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জন করতে পারে। উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাংকিং এবং মাইক্রোফিন্যান্স ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করতে হবে। যাতে উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো সহজে পুঁজি পেতে পারে। উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শের সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির প্রসার বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আইটি ও সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট, ফিন্যান্সিং এবং ই-কমার্সের বিকাশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি নীতিমালা ও আর্থিক সহায়তা আরো জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের জন্য ট্যাক্স ছাড়, ঋণ সুবিধা এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। বৈশ্বিক মানের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম এমন দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশন প্রসার বাড়াতে হবে। 

গত কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগের পরিস্থিতি অনেকটা স্থবির। নতুন বিনিয়োগ না হলে শিক্ষিত যুবকদের জন্য চাকরির বাজার সৃষ্টি হবে না। তাই আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। অন্যদিকে পরিবর্তিত চাকরির বাজারের উপযোগী দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৩ এএম
ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান
ফখরুল ইসলাম নোমানী

ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। ইসলাম পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীকে পুরুষের সমান অধিকারী করেছে ও অত্যন্ত সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছে। নবী করিম (সা.) স্বয়ং নারীদের শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। 

সমাজসভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ সমান। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নর-নারী, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব অথবা সাদা-কলোর কোনো পার্থক্য নেই। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলাম নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান।

আদিম যুগ থেকেই নারী অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। সবদিক দেশে তার অধিকার আদায়ে তার মর্যাদায় তার স্বাধীনতা ও তার ক্ষমতায়নে। ইসলাম পূর্ব-যুগে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত উপেক্ষিত ও শোচনীয়। সমাজে নারীরা ছিল অপাঙ্‌ক্তেয়। তাদের মানুষরূপেই ভাবা হতো না। নারীরা ছিল পুরুষের লালসার শিকার, ভোগ্যপণ্য হিসেবে তাদের ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় পৌত্তলিক আরবে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। হিন্দুরা নারীকে সব পাপ, অন্যায় ও অপবিত্রতার কেন্দ্র বলে ঘৃণা করত। ইহুদিরা নারীকে সব পাপের মূল হিসেবে জানত। খ্রিষ্টানরা নারীকে নরকের কীট ও অকল্যাণের উৎস মনে করত। চীনে নারীদের দ্বারা লাঙল টানাতো। পাশের দেশ ভারতে হিন্দুরা নারীদের দাসীর মতো ব্যবহার করত এবং সতীদাহের মতো ঘৃণা প্রথা প্রচলিত ছিল। ঘোড়ার লোজের অগ্রভাগ নারীর চুল বেঁধে তাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো। ইসলাম পৃথিবীর বুক থেকে যাবতীয় অত্যাচার নির্যাতন ও অসমতা দূর করে। নারীকে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়েছে।

মানব জাতির ওইসব ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মুক্তির দিশারি ও শান্তির দূত হিসেবে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন। নারী জাতির ওপর অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, শোচনীয় ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে পরিত্রাণ দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সমাজে নারী জাতির অবস্থান নিরূপণের জন্য পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন সুরা আননিসা। উক্ত সুরার প্রথমেই আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ জাতি তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের দুজন থেকে অসংখ্য নর-নারী পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ শুধু সূরা আননিসা নয়। পবিত্র কোরানের অনেক সুরায় নারীর অধিকার ও নারীর মর্যাদা সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে। 

আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের যেমন অংশ রয়েছে তেমনি নারীরও অংশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় বিভিন্নভাবে নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং নারীর মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি অধিকার দিয়েছেন। 

আল্লাহ্ বলেন, আমি তোমাদের কোনো কর্মী বা সহপাঠীর কাজ নষ্ট করি না। সে নারী হোক বা পুরুষ হোক। তোমরা পরস্পর এক। অন্য এক আয়াতে বলা হয়। ঈমানদার পুরুষ ও রমনীরা একে অপরের সহায়ক ও বন্ধু। তারা একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজের নিষেধ করবে। ইসলাম ধর্মে নারীর জীবনব্যবস্থা ও সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্ত্রী কন্যা মাতা ও ভগ্নী হিসেবে তার ব্যক্তিগত মর্যাদা অধিকার ও স্বাধীনতার সঙ্গে সামগ্রিক সব বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়ার কথাও বলেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিটি বিষয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও উৎসাহিত করেছে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, বিশ্বে বহু অমূল্য সম্পদ রয়েছে। আর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে নেককার নারী। তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। ইসলাম স্ত্রী হিসেবে নারীকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। আল্লাহ্ বলেন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ করো। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যে বিয়ে করে সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে। ইসলাম নারীকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান দিয়েছে মা হিসেবে। মা হিসেবে ইসলাম নারীকে যে মহান মর্যাদায় আসীন করেছে তার নজির আর কোথাও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। 

তিনি আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। ঐতিহাসিক হজের ভাষণে তিনি বলেছেন ভ্রাতৃগণ শ্রবণ করো ইসলামে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। নারীদের প্রতি তোমরা সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমরা অন্যায় আচরণ করবে না।

ইসলাম ধর্ম প্রথম নারীর স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্পত্তির মালিকানা এবং ভোগ-দখলের অখণ্ড অধিকার দিয়েছে নারীকে। মাবন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে অর্থনৈতিক অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কন্যা, স্ত্রী, বোন ও মাতা হিসেবে মুসলিম নারীর মিরাস বা উত্তরাধিকার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক পিতা ও স্বামী উভয়দিক থেকে উত্তরাধিকার লাভ করে তারা পেয়েছে মালিকানাস্বত্ব এবং তা স্বাধীনভাবে ব্যয় করার পূর্ণ অধিকার। ইসলাম নারীকে পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার দিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে মতামত প্রকাশ ও সমাজকল্যাণের যেকোনো কর্মকাণ্ডে নারীরা পুরুষের মতোই অংশগ্রহণ করতে পারবে। এই মর্মে হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, যোগ্যতানুসারে নারীরা প্রধান বিচারপতির পদও অলংকৃত করতে পারবে।

ইসলামে আরও উল্লেখ আছে নারীর ব্যক্তিগত সম্পদ অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োগ করা সম্পদ এবং লাভ একমাত্র তারই আওতাধীন। স্বামী কিংবা অভিভাবকদের এক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ চলবে না। যদি না স্বেচ্ছায় তা দান না করে। সুরা আন নিসার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম। একজন পুরুষের যেমন অধিকার আছে নিজের পছন্দের কাউকে বেছে নেওয়ার তেমনটি নারীর জন্যও রয়েছে। ইসলাম বলেছে কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ দেওয়া আইনগত অপরাধ। বিবাহবিচ্ছেদ ও তালাকের ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন স্বামী তার অবাধ্য স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি অত্যাচারী অযোগ্য অকর্মন্য স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য একজন স্ত্রীরও তালাক দেওয়ার অধিকার আছে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মর্যাদা ও পারিবারিক সামাজিকভাবে বিশেষ মর্যাদা লাভে সহায়তা করেছে ইসলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান সমাজব্যবস্থা নারীদের ইসলামের চোখে যেমন দেখে না তেমনি নারীকে বাজারের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যে কর্তব্য তা পালন করা হচ্ছে না। তাকে তার অধিকার দিচ্ছে না। দিন দিন প্রতিযোগিতা দিয়ে বেড়ে চলছে আমাদের গণমাধ্যমের সংখ্যা।

ইসলাম নারীকে সব ধরনের মর্যাদা যেমন দিয়েছে তেমনি দিয়েছে সংযত হওয়ার নির্দেশগুলো। কর্মক্ষেত্রে নারীর বাধা নেই ইসলামে তবে সেখানে তাকে চলতে হবে পর্দার মাঝে। রাস্তাঘাটে নারীকে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে উপস্থাপন করছে। এমনভাবে করছে যেন পণ্যের গুরুত্বের সঙ্গে নারীকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। যেখানে নারীর কোনো প্রয়োজন নেই সেখানেও নারীকে দেখাচ্ছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক পোশাকের ব্যবস্থা করছে যা আমাদের মুসলিম নারীদের জন্য শোভা পায় না। ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছে তবে পণ্য করেনি। বর্তমানে স্বাধীনতার নামে নারীকে পণ্যই বানাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো উপস্থাপক হিসেবে নারীকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। 

এটা নারীর জন্য ভালো। নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে কিন্তু তাই বলে সে উপস্থাপনায় অমুসলিম দেশকে অনুকরণ করা নারীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক ছাড়া চাকরি করা যাবে না বলে অনেক নারীকে চাকরি হারাতে হয় আবার অনেক নারী বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয় ইসলামের মর্যাদাকে ভুলে যেতে। নারীদের পর্দা নিয়ে কিছু বললেই বলা হয় নারীকে নারী ঘরে তুলতে বলা হচ্ছে। আসলে তা কিন্তু নয়। নারীকে কাজ করতে হবে তবে সেই ইসলামের পথ নির্দেশনা মেনে চলে। বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীর সাফল্য আসছে। তাই বলে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারও বেড়ে চলছে।

মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত ঘোষণা করে ইসলাম নারী জাতিকে সর্বোত্তম মর্যাদায় ভূষিত করেছে। যে মর্যাদা পুরুষকে দেওয়া হয়নি। ইসলামে একজন নারী একজন পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ও মর্যাদার অধিকারী। নারী তার নারীত্বের মর্যাদা বজায় রেখেই সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন ও রাখছেন। নারী ছাড়া অন্য কেউই মাতৃত্বের সেবা ও সহধর্মিণীর গঠনমূলক সহযোগী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়। মায়েদের ত্যাগ ও ভালোবাসা ছাড়া মানবীয় প্রতিভার বিকাশ ও সমাজের স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মায়েরাই সমাজের প্রধান ভিত্তি তথা পরিবারের প্রশান্তির উৎস। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলাম দিক-নির্দেশক। ইসলামই নারী মুক্তির একমাত্র সমাধান। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করে সেটি রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]

শিক্ষাপদ্ধতি হোক সেশনজটমুক্ত

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
শিক্ষাপদ্ধতি হোক সেশনজটমুক্ত
আরিফা সেতু

সেশনজট বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি জটিল সমস্যা। শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের শিক্ষা সমাপ্ত করতে না পারার অর্থ সেশনজট। যার ফলে তাদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হয়। যা শিক্ষার্থীদের মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপের পাশাপাশি তাদের পেশাগত জীবনে প্রবেশেও বিলম্ব ঘটায়।

একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে, ডানা মেলে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছায়। পাশাপাশি বাবা-মা আর পরিবারের মানুষগুলোও এক নিদারুণ বুক স্বপ্ন বোনে। স্বপ্ন, আশা সব যখন সেশনজটের মতো কালো ছায়া গ্রাস করে, তখন শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। যার একটি অনন্য উদাহরণ সেশনজট। 

দীর্ঘ প্রায় এক মাসের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা, নয় দফা এবং সর্বশেষ এক দফা। দেশ থেকে স্বৈরাশাসক হটানোর পর নতুন উদ্যমে দেশ গড়ার লক্ষ্যে নিয়োজিত হাজারও তরুণ-তরুণী। ঠিক এমন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা দিয়েছে চরম অস্থিরতা। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন শেষ হওয়া এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর ক্যাম্পাস খোলা এবং ক্লাস, পরীক্ষা শুরুর বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পরপরই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য থেকে শুরু করে কোষাধ্যক্ষ, এমনকি হল প্রভোস্টরাও পদত্যাগ করছেন। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়ে পড়েছেন অভিভাবকহীন। নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষার্থীদের একাংশ ক্যাম্পাসে ফিরলেও নেই কোনো ক্লাস, পরীক্ষা শুরু হওয়ার তৎপরতা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কমিটি সমন্বয়ক এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে কয়েক দফায় মিটিংয়ে বসলেও উল্লেখযোগ্য কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। তারই রেশ ধরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন নতুন আতঙ্ক- সেশনজট। 

একদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগ পূর্ব থেকেই সেশনজটের কবলে রয়েছে; অন্যদিকে বিভাগগুলোর পরিকল্পনাবিহীন কার্যক্রম, ক্লাসরুম সংকট, শিক্ষকদের অপর্যাপ্ততা, অতিরিক্ত একাডেমিক ছুটি, শিক্ষকদের আন্দোলন ও কর্মবিরতি, প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতাসহ নানাবিধ বিষয়কে সেশনজটের জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। উপরন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরবর্তী সময় শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে উঠেছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! যেখানে প্রশাসনিকভাবে স্নাতক শেষ করার জন্য চার বছর সময় নির্ধারিত থাকলেও, কিছু কিছু  বিভাগে ছয়, এমনকি আট বছরও সময় লেগে যায়। 

শিক্ষাজীবনের অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ ও হতাশা বাড়ে। তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে। যা একাডেমিক পারফরম্যান্সকেও প্রভাবিত করে। অতিরিক্ত টিউশন ফি, আবাসন ও অন্যান্য খরচের কারণে শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নিজেদের আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলাফলস্বরূপ অনেক শিক্ষার্থীই এই অবস্থা মেনে নিতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নেন অনেকেই। অনেক বিশ্লেষক উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সুইসাইডের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে এটিকে আখ্যায়িত করে থাকেন। 

এসব সমস্যা নিরসনের জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি, শিক্ষকদের সাথে সমঝোতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ক্যালেন্ডার সংস্কার এবং কঠোরভাবে তা অনুসরণের পাশাপাশি পর্যাপ্ত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত, অনতিবিলম্বে পূর্বের সেশনজট নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সক্রিয় করে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা। তবেই এই নতুন স্বাধীনতায় শিক্ষার্থীরা নতুন উদ্যমে স্বপ্ন বুনতে পারবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া 
[email protected]

কথা বলতে হবে মুখ মেপে

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৪, ১১:২৪ এএম
আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
কথা বলতে হবে মুখ মেপে
অমিয় দত্ত ভৌমিক

‘ও মানুষ মানুষ, দুডো চোখ দুডো কান, দ্যাখবা আর শুনবা, কিন্তু এট্টা মুখ তো, কতা কম কবা, তোমার ম্যালা ঝামেলা কমে যাবে কলাম...’ গানটি হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। এর মর্মার্থ উপলব্ধি করাটা  খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার দাদি মারা গেছেন ১৯৯০ সালে ৭৯ বছর বয়সে। তিনি বলতেন, কথায় কথা বাড়ে, ভোজনে বাড়ে পেট’। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে গ্রামে। বলতে গেলে শৈশবের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা বা কথাবার্তাই আমার মনে পড়ে। তখন গ্রামের মানুষ এই কথা কম বলা নিয়ে একটা বাক্য বলতেন, ‘মুখ ছিনালের চেয়ে... ছিনাল ভালো’। এমন বহু প্রবাদ আছে যা ব্যবহৃত হয়ে আসছে কথা বলা নিয়ে সতর্ক করতে। প্রবাদ বহমান! এসব অলিখিত প্রবাদ মুখে মুখে বয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

তবে ‘…কতা কম কবা’ গানটি খুব বেশি পুরনো নয়। গীতিকার কোন প্রেক্ষাপটে এই গানটি লিখেছিলেন তা উনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে গানের কথাগুলো যথার্থ।

আমরা আজ যে প্রসঙ্গ নিয়ে বলব সেটা কোনো এক দেশের কাল্পনিক গল্প। গল্প তো গল্পই, যদি মিলে যায় তাহলে কাকতাল বলতে হবে।

এক দেশে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী এক রাজা ছিলেন। বলতে পারেন, রাজা তো সবসময়ই প্রতাপশালী হয়। এ ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম হলো, তার পূর্বসূরি এই সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং দেশবাসীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। বর্তমান রাজা দেশবাসীর প্রতি যথেষ্ট যত্নবান। দেশ পরিচালনার জন একটি সুন্দর মন্ত্রিসভা করেছেন। যারা রাজার মতো দেশের কথা ভাবেন। মন্ত্রিসভায় বড় মন্ত্রী, ছোট মন্ত্রী, উজির, নাজির সবই হলো। রাজ্যবাসীও সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল!

তো, একসময় হলোটা কী; দীর্ঘদিন দেশ চালাতে চালাতে এক ‘বুড়ো’ মন্ত্রী খানিকটা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়লেন! অবস্থাটা ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, তিনি কী বলবেন বা বলছেন তা ভাবতে পারতেন না। আবল-তাবল কথা বলা, অমুক-তমুককে দোষী করা এসবের মধ্যেই ডুবে থাকতেন। আর ধীরে ধীরে এর প্রভাব পড়তে থাকল রাজার মধ্যেও।

এই দেশে ছিল রাজার বিরোধী কিছু মানুষ। তারা আলাদা আলাদা রাজার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরোধিতা করতেন। কিন্তু রাজাকে কোনোভাবেই টলাতে পারতেন না। এভাবে চলতে চলতে এক সময় বিরোধী লোকজন একসঙ্গে জোট বাঁধল প্রতিবাদ জানাতে। তখন থেকেই তারা সুযোগ খুঁজতে লাগল। রাজা বুঝতেন যে, এই জোট ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু কোনো সাবধানতা অবলম্বন করতেন না। তিনি তার মন্ত্রীদের কথায় খুব বিশ্বাস করতেন। প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করার শক্তিও এক সময় তাদের লোপ পেতে শুরু করল।

অতীতে রাজা অনেক বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি প্রজাদের দুঃখকে নিজের দুঃখ ভাবতেন। নিজে খোঁজখবর নিতেন। অন্যদেরও খোঁজখবর রাখার কথা বলতেন। প্রজারাও তাদের সমস্যার কথা রাজাকে জানাতে পারতেন। কিন্তু বিশাল এই দেশ তো আর একার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়, এজন্যই তিনি বিজ্ঞ বিজ্ঞদের মন্ত্রিসভায় বসিয়েছিলেন তাকে সাহায্য করতে। প্রথম প্রথম তারা বেশ কর্মঠ এবং নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে সিংহাসন যত পুরনো হতে লাগল, তাদের আলসেমি, খামখেয়ালিপনাও বাড়তে লাগল। শেষে অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গেল যে, মুড়ি আর মিছরিকে সমান ভাবতে শুরু করল।

রাজা তার রাজ্যের হিরের খনিগুলোতে লোক নিয়োগ করার জন্য একটা নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। খনির শ্রমিক থেকে শুরু করে ভাণ্ডাররক্ষক পর্যন্ত সবার জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য। এভাবেই চলছিল সব। দেশের নিয়ম অনুযায়ী, এই দেশ জয়ে যারা ভূমিকা রেখেছেন তারা ইতিহাসের সূর্যসন্তান। তাদের জন্য সব ক্ষেত্রে সবসময় বিশেষ সম্মান থাকবে। এভাবেই চলতে থাকল দীর্ঘ সময়। বেশ কিছু বছর এভাবেই কাটল। বহু বছর পর রাজার দেশে শুরু হলো নিয়ম বদলানোর প্রতিবাদ। এটি চলতে থাকল দীর্ঘ সময়। কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছিল না। ফলে কিছুদিন পর পর থেমে থেমে আন্দোলন হয়। আবার বিভিন্ন কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।

এই রাজার এক মন্ত্রির জিভ ছিল জাদুকরী ও সোনায় মোড়ানো। এই জিভ দিয়েই তিনি সবকিছু ‘ডলে’ দিতেন। সব বিষয়েই তার অসীম চতুরতা। আর তাই তো স্বাভাবিক! কারণ তিনি হলেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তিনি যা বলেন তাই ঠিক। ‘জিভ’ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েই আজ তিনি এই অবস্থানে।

এক সময় দেশে কর্মঠ যুবকের সংখ্য বেড়ে গেল। কাজ চাই, কর্ম চাই... এমন একটা স্লোগান নিয়ে তারা প্রথা ভাঙার আন্দোলন শুরু করল। খনির কাজে বিশেষ সুবিধা রদ করতে মরিয়া হয়ে উঠল তারা। তাদের আন্দোলন এবার খুবই বেগবান। সবাই কর্মঠ যুবক। অনেকেই কাজের অভাবে পছন্দের মানুষকে ঘরে তুলতে পারছে না। সবার এক শপথ, প্রথা ভেঙে কাজ পাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু রাজাকে এ বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা করা হলো! এর মধ্যে দুমুখোরা দিল রাজাকে উসকে। রাষ্ট্রের বুড়ো মন্ত্রী আরও এক কাঠি সরেস। তিনি বরাবরের মতো সোনার জিভে ‘ঘষা’ দিলেন। কিন্তু সফল হলেন না। ফল হলো উল্টো। দেশজুড়ে শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড। আর সুযোগ বুঝে এতে ঢুকে পড়ল রাজার বিরোধীরা। রাজা আর মন্ত্রীর কথায় শুরু হলো লঙ্কাকাণ্ড। প্রাণ গেল শয়ে শয়ে। কিন্তু কোনো কিছুতেই আর আন্দোলন থামানো যাচ্ছিল না। এর পর সেই রাজার পতন হয়েছিল। আর রাজাসহ পরামর্শকরাও হয়েছিলেন দেশান্তরী। আর রোষানলে পড়তে হয়েছিল চাটুকারদের।

একটা জিনিস আমরা হয়তো আমলেই নিই না যে, কথা বলতে হয় নিজের অবস্থানকে চিন্তা করে। এটা মনে রাখা দরকার, আমি কে এবং আমার অবস্থান অনুযায়ী কথাবার্তা কেমন হওয়া উচিত। একটা রাজনীতিবিদ বা বিশিষ্টজনের কথা আর সাধারণ মানুষের কথাবার্তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে বসে দেশ নিয়ে কথাবার্তা বলা লোকদের মতো একজন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল লোকের কথা বলার ধরন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সবার ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার সংজ্ঞা একরকম নয়! কী বলব তা চিন্তা করা যেমন জরুরি, কী বলা যাবে না তা চিন্তা করা আরও বেশি জরুরি। চিন্তাভাবনা করে কথা বলা ব্যক্তিত্বেরও বহিঃপ্রকাশ। কী বললে ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন হয়; মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় বা হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হই- সেটি ভাবনায় রাখতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা খুশি তা-ই লেখাকে বাকস্বাধীনতা বলে মনে করেন অনেকেই। আমি এটা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জিভ যে ক্রমশ ধারালো হয়ে গেছে, তা বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিত কিন্তু মজবুত হয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমেই। আমি, আপনি বা আপনারারা যা কিছু বলছেন তা নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছে লাখো মানুষের কাছে। এই কোটা আন্দোলনটা ইচ্ছে করলে শুরুতেই সমাধান করা যেতে। কিন্তু বিষয়টিকে ওই রাজার দেশের মন্ত্রীর মতো কেউ আমলেই নেয়নি। 

ধরুন, আমি জানি যে, আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে। আর যেহেতু মাঝেমধ্যেই এই সমস্যা হয় তাহলে গ্যাসের ট্যাবলেটও সঙ্গে রাখা জরুরি। আর যেহেতু আশঙ্কা ছিল, এ ধরনের আন্দোলনকে পুঁজি করে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা নিতে পারে, তাহলে শুরুতেই আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে বসে গ্যাসের ট্যাবলেটটি খেয়ে নেওয়াটা খুবই জরুরি ছিল। তা না করে এটাকে অবহেলা করা হলো। অন্যের সম্পর্কে বিষোদগার; ভিন্নমতের মানুষকে কটাক্ষ করা; সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করার মতো প্রবণতা শুরু হলো। আর এর সুযোগ নিল তৃতীয় পক্ষ। তাতে দেখা গেল, তখন যেটা ট্যাবলেটে সেরে যেতে এখন এটা সার্জারিতেও আর সারছে না।

এ জন্যই দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে কথা বলার সময় আমাদের সবার সবদিক বিবেচনা করে কথা বলা উচিত। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের ওপর সরকারের আস্থা বাড়ানো উচিত। গোয়েন্দার মাধ্যমে খবরদারির চেয়ে নজরদারি বাড়ানো উচিত। আর সর্বোপরি যেটা উচিত সেটা হলো- কী বলা যাবে না, তা চর্চা করা।

অমিয় দত্ত ভৌমিক
সহকারী বার্তা সম্পাদক, খবরের কাগজ