আলেম উদ্যোক্তা তৈরির প্ল্যাটফর্ম ‘কওমি উদ্যোক্তা। আলেমদের উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ করেন তারা। বুদ্ধি দেন। প্রশিক্ষণ করান। পণ্য কেনাবেচায় সহযোগিতা করেন। ফেসবুকে আছে ‘কওমি উদ্যোক্তা’ গ্রুপ।
যেভাবে শুরু হলো
কওমি উদ্যোক্তার ফাউন্ডার রোকন রাইয়ান এক সময় সংবাদপত্রে কাজ করতেন। একবার আলেম ব্যবসায়ী খুঁজতে গিয়ে বলার মতো কিছুই পেলেন না। কারণ মসজিদ-মাদরাসার বাইরে তাদের কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। আলেমদের কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। এর মধ্যে চলে এলো কোভিড-১৯। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ। চতুর্দিকে হাহাকার। সবার মতো আলেমরাও পড়লেন বিপাকে। রোকনও তখন গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। আলেমদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারটি তীব্রভাবে নাড়া দিল তাকে। বেশ কয়েকজন বন্ধুকে শেয়ার করলেন বিষয়টি। অবশেষে মুমিনুল ইসলামকে নিয়ে ফেসবুকে খুললেন ‘কওমি উদ্যোক্তা’ গ্রুপ। সময়টা ২০২০ সালের জুনের ২ তারিখ।
বহু আলেমের অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘুচল
অল্প দিনের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলল কওমি উদ্যোক্তা। সদস্য বাড়তে থাকল। উদ্যোক্তা তৈরি হলো। বেচাকেনা বাড়ল। চাপ বাড়তে থাকল রোকন ও মুমিনুলের ওপর। গ্রুপের জন্য নিলেন এডমিন ও মডারেটর। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হলো এ গ্রুপে। এভাবেই দাঁড়িয়ে গেল কওমি উদ্যোক্তা। আলেমরা বললেন, ‘কওমি উদ্যোক্তার কল্যাণে বহু আলেমের অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘুচেছে।’
বেদনা ছুঁয়েছিল
শুরুর ৩ মাসে ৫০ হাজার সদস্য যুক্ত হলো। দেড় বছরে এ সংখ্যা পৌঁছল ৩ লাখে। এত মানুষের যুক্ত হওয়া যারপরনাই আনন্দিত করল রোকন-মুমিনুলদের। শুভকামনা ও ভালোবাসা পেলেন বহু মানুষের। হঠাৎ বেদনা ছুঁয়ে গেল। ফেসবুক থেকে কিছু বাধার সম্মুখীন হলেন। গ্রুপটি ডিজেবল করে দিল ফেসবুক। প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন তারা। ‘গ্রুপ নষ্ট হলেও আলেম উদ্যোক্তাদের মাঝে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি। সবাই আমাদের সঙ্গেই ছিল।’ বললেন, রোকন।
‘আলেমরা সত্যিকার অর্থে নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে যাবে, তাদের সততা, আমানতদারিতা দিয়ে সর্ব ক্ষেত্রে মানুষকে উপকৃত করবে, আমাদের কাজ এ জন্যেই।’
—রোকন রাইয়ান, ফাউন্ডার, কউ
‘আলেম প্রজন্মের জন্য আমরা ভালো কর্মসংস্থান ও জনশক্তি করে গড়ে তুলতে চাই। আলেম উদ্যোক্তাদের জন্য ইনস্টিটিউশন করতে চায় কওমি উদ্যোক্তা।’
—মুমিনুল ইসলাম, কো-ফাউন্ডার, কউ
নতুন পথচলা…
কওমি উদ্যোক্তা পাবলিক গ্রুপটি নষ্ট হলে নতুন গ্রুপ খোলেন তারা। নাম রাখেন কওমি উদ্যোক্তা-ই। অল্প দিনে ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায় সদস্যসংখ্যা। ফেক কাস্টমার ও ফেক সেলারদের আটকানোর নানা ফিল্টার বসান তারা। মুমিনুল বললেন, ‘এখন সদস্যসংখ্যা কম হলেও, প্রতারণা তেমন হচ্ছে না এবং গ্রুপ চলছে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে।’
এ গ্রুপে পণ্য বিক্রির নানা নিয়ম আছে। বিক্রেতাকে সৎ ও আমানতদার হতে হয়। পণ্যের কোয়ালিটিও যাচাই করা হয়। পণ্য কেনাবেচায় কেউ প্রতারণার শিকার বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কওমি উদ্যোক্তা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন। বর্তমানে কওমি উদ্যোক্তাতে মডারেটর ও এডমিন আছে ২০ জন। উপদেষ্টা আছেন কয়েকজন। ঢাকার শনির আখড়াতে আছে অফিসও।
কী করে কওমি উদ্যোক্তা
এ গ্রুপের উদ্যোক্তারা বেশির ভাগই আলেম ও ব্যবসায় নতুন। ব্যবসাসংক্রান্ত একাডেমিক পড়াশোনাও নেই তেমন। তাদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়াটা মুশকিল। কিন্তু ছায়া হয়ে আছে কওমি উদ্যোক্তা। অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের বিনামূল্যে লাইভ ক্লাস করাচ্ছে গ্রুপটি। প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পরামর্শ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাদের গল্পও শেয়ার করছে। বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে হচ্ছে সম্মেলন। ঢাকায় প্রতি বছর জাতীয় সম্মেলন করছে। সফল উদ্যোক্তা ও প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সেখানে। এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার আলেম উদ্যোক্তা তৈরি করেছে কওমি উদ্যোক্তা। মুমিনুল বললেন, ‘আলেমদের সব সময় উদ্যোক্তা হওয়া থেকে বিমুখ করা হতো। কওমি উদ্যোক্তা আলেমদের ভেতর উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব তৈরি করেছে। ব্যবসাবিমুখ করার ট্যাবু ভেঙেছে।’
সফলতার গল্প
কওমি উদ্যোক্তার মাধ্যমে আলেমদের ব্যবসাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। যেখানে মসজিদ-মাদরাসার বাইরে আলেমরা ভিন্ন কর্মসংস্থানের চিন্তাও করতেন না, সেখানে এখন হাজারো উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। আলেমরা এখন ই-কমার্স সাইটও পরিচালনা করছেন। ‘অনলাইনে ম্যাক্সিমাম ব্যবসায় করছে আলেমরা। জানালেন, রোকন ও মুমিনুল।
স্বপ্ন
আলেম উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগ চান কওমি উদ্যোক্তা। শতভাগ হালাল পণ্যের বাজার তৈরি করতে চান তারা। তারা চান আলেমরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হোক। অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী হোক। রোকন জানান, ‘আলেম উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়ী সংগঠন গড়ার স্বপ্নও দেখি আমরা।’
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক