মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন—সুপ্রসিদ্ধ আলেম, গবেষক, লেখক ও কথাসাহিত্যিক। আশিটির বেশি মৌলিক ও অনূদিত বইয়ের কারিগর তিনি। যুক্ত রয়েছেন মাদরাসার পরিচালক ও মসজিদের খতিব হিসেবেও। রবিউল আউয়াল মাস উপলক্ষে সিরাতে রাসুল (সা.) পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা, কোন কোন গ্রন্থ পাঠ করার মাধ্যমে সঠিকভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জানা যাবে এবং পাঠের ক্ষেত্রে কি কি সতর্কতা বা নিয়ম অনুসরণ করা উচিত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা হয়েছে তার সঙ্গে। আলোচনার চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: মুসলমানের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী পাঠ করা জরুরি কেন?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: ইসলামকে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে তুলনা করে বুঝতে চাইলে, একটি প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত সৌন্দর্য সামনে চলে আসবে, তা হলো—ইসলাম বলতে আমরা যে জীবনদর্শনকে বলি বা বুঝি, তার একটা বাস্তব আদর্শ রয়েছে এবং সেটি হলেন আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদ (সা.)। কোনো দর্শন যতক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবে চিত্রিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য সেটা অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠে না।
কোনো জীবনদর্শন বা চিন্তা মানুষের জীবনে সফলতা বয়ে আনার জন্য সেখানে যেমন সহজ বিষয় থাকবে, কঠিন বিষয় থাকবে এবং দৃশ্যত এমন কিছু বিষয় সামনে আসবে—মনে হবে যেন এ কাজগুলো করা ঠিক সম্ভব নয়। একাধারে ত্রিশ দিন রোজা রাখা—নির্দিষ্ট ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম মেনে ইফতার করাকে যে কেউ অসম্ভব মনে করতে পারেন। কিন্তু ইসলামের পক্ষ থেকে যিনি এ দাওয়াতটা দিচ্ছেন, তিনি রমজানসহ সারা বছর এভাবে রোজা রেখে, ইফতার করে যখন দেখিয়েছেন—তখন আর কারও এ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না, ভাবতে হয় না বা শয়তান তাকে প্ররোচিত করতে পারে না যে, এটা অসম্ভব।
এটা সম্ভব, তার কারণ যিনি এ দাওয়াতটা দিয়েছেন, তিনি আমাদের কাছে যা চেয়েছেন, এর চেয়ে বেশি কিছু করে দেখিয়েছেন। ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এটি।
মুসলমানদের জাকাত দিতে বলেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। আর দান করার ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন—তাঁর ওপর জীবনে কখনো জাকাত ফরজ হওয়ার সুযোগই হয়নি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সবটা বিলিয়ে দিয়ে অন্যদের বলেছেন, তোমরা ৪০ ভাগের এক ভাগ দাও। ফলে সবার কাছে সহজ মনে হয়েছে।
মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনী জানা, তাঁর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোখের সামনে রাখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য জরুরি। কারণ এটাকে বাদ দিয়ে ইসলামকে যথাযথভাবে বোঝা এবং সেটাকে জীবনে প্রয়োগ করা, চর্চা করা, অনুসরণ করা কোনো ব্যক্তির পক্ষে যথাযথভাবে সম্ভব নয়। মুহাম্মাদ (সা.)-কে পাঠ করা ছাড়া এবং তাঁকে সঠিকভাবে জানা ছাড়া পরিপূর্ণরূপে ইসলাম অনুসরণ করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী পাঠ করার ক্ষেত্রে কোন কোন বইগুলো পড়া যেতে পারে?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: কোনো শিক্ষিত মুসলিম পরিবার এমন হওয়া উচিত নয়, যে ঘরে পবিত্র কোরআন, কোরআনের সরল অনুবাদ এবং সহজ কোনো ব্যাখ্যাগ্রন্থ থাকবে না এবং যেখানে প্রিয়তম নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর কোনো জীবনীগ্রন্থ থাকবে না। মুহাম্মাদ (সা.)-কে জানার মাধ্যম দুটি—এক. শুনে জানা। দুই. পড়ে জানা। দুই জানার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। পড়ে জানার মাধ্যমটি তুলনামূলক নিরাপদ ও উত্তম।
প্রত্যেক মানুষের অবশ্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থাবলি পাঠ করা কর্তব্য। মুসলমান হিসেবে আমাদের জন্য এটা অনেক বড় আনন্দের বিষয়, মুহাম্মাদ (সা.) যেহেতু ইসলামের সচিত্র রূপ, তাই ইসলামের সূচনাকাল থেকে মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনচিত্রকে সনদসহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাঁকে জানার ক্ষেত্রে সমাজে একটা অসম্পূর্ণ ধারণা প্রচলিত রয়েছে। মনে করা হয়—জীবনীমূলক গ্রন্থ থেকেই তাঁকে জানতে হবে। অথচ তাঁকে জানার প্রথম এবং সবচেয়ে শক্তিমান মাধ্যম হলো পবিত্র কোরআন। দ্বিতীয় মাধ্যম হাদিস। তৃতীয় মাধ্যম হলো তাঁকে নিয়ে লিখিত জীবনীগ্রন্থ।
এই জায়গাতেও আমাদের জন্য একটা সম্মানের অবস্থা হলো, বাংলা ভাষাটা চর্চার দিক থেকে যতটা পুরোনো, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত চর্চা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ততটাই পুরোনো। পুঁথি সাহিত্য যখন থেকে শুরু, তখন থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) পুঁথি সাহিত্যে আলোচিত। এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়—আমরা আমাদের বিশ্বাসটাকে চর্চায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।
বাংলা ভাষায় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম শেখ আব্দুর রহিম (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে লিখেছেন। এর আগে অন্য ধর্মের তিনজন লিখেছেন তাঁকে নিয়ে। সম্ভবত ১৮৮৬ বা ৮৭ সালে শেখ আব্দুর রহিমের বই প্রকাশিত হয়েছে।
সিরাত বিষয়ে খুব আলোচিত গ্রন্থ কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’। তিনি ছিলেন মাদরাসাপড়ুয়া মানুষ। মৌলবি কবি গোলাম মোস্তফা। আরও একটি সিরাতগ্রন্থ খুব বেশি আলোচিত হয়েছে, সেটা হলো মওলানা আকরম খাঁর মোস্তফাচরিত। তবে আকরম খাঁ তার বইয়ে বিজ্ঞানকে মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুজেঝার মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় ছেড়ে দিয়েছেন। যা একজন ধর্মপরায়ণ পাঠক আশা করে না। সে জায়গায় কবি গোলাম মোস্তফা এমন একটা গ্রন্থ রচনা করলেন—বিশেষ করে সাহিত্য ও ভক্তিপূর্ণ উপস্থাপনায়, সেটা কালোত্তীর্ণ। পরবর্তী সময়ে ঢাকার বড় কাটারা মাদরাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা তফাজ্জুল হোসাইনের ‘হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সমকালীন পরিবেশ ও জীবন’; মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ‘স্বপ্নযোগে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ ও ‘রওজা শরীফের ইতিহাস’—এগুলো অনন্য কাজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এ ছাড়া আরবি ও উর্দু ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত সিরাতগ্রন্থের মধ্যে সামগ্রিক বিবেচনায় যে কাজগুলো অনন্য সেগুলো হলো—ইবনে হিশাম (রহ.) রচিত ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’; ইবনে কাসির (রহ.) রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’; হাফেজ জাহাবি (রহ.) রচিত সিয়ারের প্রথম তিন খণ্ড; ইবনে কাসির (রহ.) রচিত ‘আলফুসুল ফি ইখতিসারি সিরাতে রাসুল’; সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি (রহ.) রচিত ‘আস-সিরাতুন নববিইয়া’ ও ‘রহমতে আলম’; মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলভি (রহ.) রচিত ‘সিরাতুল মোস্তফা’; সাইয়েদ সুলায়মান নদভি (রহ.) রচিত ‘খুতুবাতে মাদরাজ’; মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি (রহ.) রচিত ‘পয়গাম্বরে ইনসানিইয়াত’ এবং জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) রচিত ‘খাসায়েসে কুবরা’ উল্লেখযোগ্য।
প্রশ্ন: সিরাত পাঠের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সতর্কতা বা নিয়ম মানা আবশ্যকীয় কি না?
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন: রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে প্রথমে সতর্কতার সঙ্গে বুঝতে হয়, কাদের লেখা পড়ব? কারণ, তাঁর জীবনী পড়া মানে ইসলাম পড়া। তিনিই ইসলাম। এ জায়গায় এসে আমাদের মানতেই হয়— যেহেতু বিষয়টি ইসলাম, এ চর্চার জায়গায় মূলধারাটা হলো আলেমসমাজ। তারাই শেকড় থেকে ইসলাম পড়েন, শেকড় থেকে জানেন, বোঝেন, সত্যিকার বুঝটা বিচার করার ক্ষমতা রাখেন এবং সত্যিকারের বুঝটার প্রচার করেন। এ জন্য আলেমদের লেখা সিরাতগ্রন্থগেুলো বেছে বেছে পাঠ করতে হবে। যার লেখা পড়ছি, তার সম্পর্কেও জানতে হবে—তিনি কতটা নির্ভরযোগ্য।
আর অনুবাদগ্রন্থ পড়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা জরুরি। কারণ অনুবাদে সামান্য ভুল করার কারণে ইতিহাস পাল্টে যায়! অনেক সময় বড় রকমের বিতর্কের জন্ম হয়। সর্বোপরি কথা হলো, ইসলাম সম্পর্কে যিনি বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ যিনি কোরআনকে উৎস থেকে বোঝেন, হাদিসকে উৎস থেকে বোঝেন এবং ফিকাহ বোঝেন—এমন তিনটি গুণ বা শক্তি যার মধ্যে রয়েছে; এমন ব্যক্তি যদি নবিজীবনী লেখেন, তার বই যে কেউ চোখ বন্ধ করে পড়লে, তার হাত ধরে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। অন্যথা বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা প্রকট।