রাসুলুল্লাহ (সা.) সব নবি-রাসুল থেকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তাঁর মতো মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ জগতে আগমন করেননি, ভবিষ্যতেও করবেন না। তার আগে কোনো নবির দ্বীন পূর্ণাঙ্গ ছিল না, একমাত্র তাঁর দ্বীন পূর্ণাঙ্গ। তিনি জগতের শেষ নবি। তার পরে কোনো নবির আগমন হবে না। এটা মহান অধিশ্বর আল্লাহর শাশ্বত বিধান। তার ওপর অর্পিত রিসালাত বা আল্লাহর বার্তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রিসালাত। তার রিসালাতের বৈশিষ্ট্য অন্যান্য নবি-রাসুলের রিসালাত থেকে অনন্য। তার রিসালাতের সংক্ষিপ্ত কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হলো—
আদম (আ.) সৃষ্টির আগেই তিনি নবি
পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আ.)-এর সৃষ্টির আগেই মহানবি (সা.) নবি ছিলেন। যখন আদম (আ.) পানি ও মাটির সংমিশ্রণে ছিলেন, তখন তিনি নবি ছিলেন। সৃষ্টির প্রথম ভোরেই আল্লাহ তার আত্মা পরম যত্ন সৃষ্টি করেন। আদম (আ.) মানুষের অস্তিত্বে আসার পরই মোহাম্মদ (সা.)-এর নামের ঝলক দেখতে পান। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তখনো নবি ছিলাম, যখন আদম আত্মা ও শরীরের মধ্যে অবস্থান করছিলেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬০৯)
পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থে সত্যায়ন ও সুসংবাদ
মুহাম্মাদ (সা.) নবি হবেন, মানুষকে হেদায়াতের দ্যুতিময় পথ দেখাবেন। তার আবির্ভাবে তার আনীত ধর্ম পালন করাই হবে একমাত্র সফলতা; আল্লাহতায়ালা এ ঘোষণা পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিলে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন তাওরাত কিতাবেও। একজন নবির আগমন অপর একজন নবির মাধ্যমে তাঁর ওপর অবতীর্ণ কিতাবের ইশতেহার প্রমাণ করে মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাতের শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা অনুসরণ করে রাসুলের, যে উম্মি নবি; যার গুণাবলি তারা নিজেদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৫৭)
কোরআনের আরেক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা (আ.) বলেছিলেন, হে বনি ইসরাইল, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসুল। আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং একজন রাসুলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন যার নাম আহমদ।’ (সুরা সফ, আয়াত : ০৬)
রহমতের নবি
আল্লাহতায়ালা ইসলামের নবি মোহাম্মদ (সা.)-কে সমগ্র জগতের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেন। বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ কল্যাণের জন্যই তাঁকে পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মহান পুরুষ। যিনি পুরো দুনিয়ার মানুষের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। মানুষের মুক্তির জন্য আগমন করেছেন। শান্তি-সম্প্রীতি ও সুখের বাতাস বইয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর ঘরে ঘরে। তার আগে কেউ ব্যাপক বিপুল রহমত নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেননি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবি, আমি তোমাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)
আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত আছে, ‘একবার কিছুসংখ্যক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করার জন্য আবেদন করল! তাদের আবদার রাসুলুল্লাহ (সা.) অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি অভিসম্পাতকারী হিসেবে প্রেরিত হইনি, আমি রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৮৩২)
বিশ্ববাসীর নবি
আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে আগত নবিদের শুধু নির্দিষ্ট গোত্র জাতিকে কেন্দ্র করে পাঠিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ (সা.) কোনো বিশেষ জাতি ও গোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি, কোনো বিশেষ দেশ ও অঞ্চলের জন্য প্রেরিত হননি, তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য। তিনি আরব ও অনারবের নবি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ২৮)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনাকে পাঠিয়েছি মানুষের প্রতি আমার পয়গামের বাহক হিসেবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৭৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে লাল ও কালো জাতির কাছে পাঠানো হয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৩২)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘জিন ও মানুষের কাছে’। আল্লামা ইবনে আসির (রহ.) বলেন, ‘আরব ও আজমের দিকে পাঠানো হয়েছে’। (শরহে তাহাবি, ১৫/১৭)
স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন
পৃথিবীতে কোনো নবির দ্বীন পূর্ণাঙ্গ ছিল না। একজন নবি এক অঞ্চলের পথপ্রদর্শক হিসেবে আগমন করতেন। অন্য অঞ্চলের জন্য আগমন করতেন আরেকজন। দুজনের দ্বীন ও শরিয়ত বা বিধিবিধান ছিল ভিন্ন রকম। কারও শরিয়ত পূর্ণাঙ্গ ছিল না। মুহাম্মাদ (সা.)-এর দ্বীন একমাত্র পরিপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে পছন্দ করলাম।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ০৩)
হাউজে কাওসারের অধিপতি
কিয়ামতের দিন হাউজে কাওসারের পানি পান করে মুমিনরা পরিতৃপ্ত হবে। জান্নাতে পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের আর কোনো তৃষ্ণা আসবে না। হাউজে কাওসারের পানি পানকারী আল্লাহর পছন্দের বান্দা হবে। আল্লাহতায়ালা মুহাম্মাদ (সা.)-কে হাশরের দিন হাউজে কাওসার দান করবেন, যা অন্য কোনো নবিকে দান করবেন না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনাকে হাউজে কাওসার দান করেছি।’ (সুরা কাওসার, আয়াত : ০১)
এ ছাড়া বিভিন্ন হাদিসে হাউজে কাওসারের বর্ণনা এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি হাউজের পাশে তোমাদের আগে থাকব।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬১০৬)
পাঁচটি বিশেষ অধিকার
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এমন পাঁচটি বিশেষ জিনিস দান করা হয়েছে, যা অন্য কোনো নবিকে দান করা হয়নি। পাঁচটি বিষয়ের অধিকার একমাত্র তাঁকেই দান করা হয়েছে। জাবের (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমাকে পাঁচটি জিনিস দান করা হয়েছে, যা আমার আগের অন্য কোনো নবিকে দান করা হয়নি—
- আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যে, এক মাস দূরত্বেও তা প্রতিফলিত হয়।
- সমস্ত জমিন আমার জন্য পবিত্র ও নামাজ আদায়ের উপযোগী করা হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের যে কেউ ওয়াক্ত হলেই (পবিত্র জায়গায়) নামাজ আদায় করতে পারবে।
- আমার জন্য গনিমতের সম্পদ হালাল করে দেওয়া হয়েছে, যা আমার আগে আর কারও জন্য হালাল করা হয়নি।
- আমাকে (ব্যাপক) শাফায়াতের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
- সব নবি প্রেরিত হতেন শুধু তাদের সম্প্রদায়ের জন্য, আর আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য।’ ( বুখারি, হাদিস : ৩৩৫)
সর্বশেষ নবি
মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনের আগে প্রত্যেক নবির পর নবি আগমন করেছেন। মুহাম্মাদ (সা.) হলেন শেষ নবি। তারপর আর কোনো নবি পৃথিবীতে আগমন করবেন না। তার মাধ্যমে রিসালাতের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুহাম্মদ তোমাদের কোনো ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল ও শেষ নবি।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৪০)। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রিসালাত ও অন্য নবির রিসালাতের পার্থক্য বিধান তৈরি করতে গিয়ে এভাবে উপমা দেন যে, ‘এক ব্যক্তি অনেক সুন্দর করে একটি ঘর নির্মাণ করল। তবে একটি স্বর্ণের পরিমাণ জায়গা খালি রাখল। মানুষ তা দেখে আশ্চর্যবোধ করল এবং বলল, কেন এ ইটটি বসানো হলো না? তিনি বলেন, আমি হলাম সেই ইট এবং আমি হলাম সর্বশেষ নবি।’ ( বুখারির সূত্রে মিশকাতুল মাসাবিহ)
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক