বিয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক পবিত্র বন্ধন। বিয়েতে আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশের অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ধর্মীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বিয়ে আমার সুন্নত (আদর্শ)। আর যে আমার সুন্নতের অনুসরণ করে না, সে আমার দলভুক্ত (মুসলমান) নয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৯৪৬)
কাদের বিয়ে করা যাবে আর কাদের যাবে না—এ নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে। পাঁচ প্রকার সম্পর্কের কারণে অনেক নারীকে বিয়ে করা যায় না। যেমন- বংশীয় সম্পর্ক, শ্বশুরালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, দুধ সম্পর্কীয়, রক্তের কারণে দুজন একই সম্পর্কে যুক্ত হওয়া ও ধর্মের ভিন্নতার কারণে।
ইসলামে ধর্মের ভিন্নতার কারণে বিয়ে শুদ্ধ হয় না। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একই ধর্মের হওয়া জরুরি। সে হিসেবে যেকোনো বিধর্মী নারীকে বিয়ে করা ইসলামে নিষেধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইমান না আনা পর্যন্ত তোমরা মুশরিক (বহু স্রষ্টায় বিশ্বাসী) নারীকে বিয়ে করো না, যদিও মুশরিক নারী তোমাদের মুগ্ধ করে...। ইমান না আনা পর্যন্ত তোমরা মুশরিক পুরুষের সঙ্গে (তোমাদের নারীদের) বিয়ে দিয়ো না, যদিও মুশরিক পুরুষ তোমাদের মুগ্ধ করে...।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২১)। আরেক আয়াতে আছে, ‘তোমরা কাফের নারীদের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না...।’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত: ১০)
মুসলিম নারীর জন্য অন্য ধর্মাবলম্বী পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণের সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, যখন তোমাদের কাছে মুমিন নারীরা হিজরত করে আসে, তখন তোমরা তাদের পরীক্ষা করে নাও, তাদের ইমান সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। অতঃপর যদি তাদের মুমিন বলে জানতে পারো, তাহলে তাদের কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। মুমিন নারীরা কাফেরদের জন্য হালাল নয়। আর কাফেররাও তাদের জন্য হালাল নয়...।’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত: ১০)। তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে আহলে কিতাবদের বিয়ের সুযোগ দিয়েছে ইসলাম। কোরআনে আছে, ‘মুমিন সতীসাধ্বী নারী ও আহলে কিতাবের সতীসাধ্বী নারী তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো...।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৫)
আহলে কিতাবি বলতে সেসব ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বোঝায়, যারা প্রকৃতপক্ষে আসমানি কিতাবে বিশ্বাসী। কখনো প্রয়োজন পড়লে তাদের বিয়ে করা যাবে। তবে দুটি শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এক. প্রচলিত ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো নামসর্বস্ব হলে হবে না। পরিপূর্ণভাবে সব আসমানি কিতাবের ওপর বিশ্বাসী হতে হবে। দুই. প্রকৃতই ইহুদি-খ্রিষ্টান হতে হবে। ইসলাম থেকে মুরতাদ হয়ে ইহুদি-খ্রিষ্টান হলে হবে না। এ দুই শর্ত কোনো আহলে কিতাবি নারীর মধ্যে পাওয়া গেলে তাদের একান্ত প্রয়োজনসাপেক্ষে বিয়ের অবকাশ রয়েছে। তবে বর্তমানে এমন আহলে কিতাব নেই। কোনো প্রয়োজন ছাড়া বিয়ে করলে তা মাকরুহ ও অনেক দ্বীনি ক্ষতির কারণ হবে। উমর (রা.) তার সময়ে আহলে কিতাব নারীদের সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
কেন এমন বিধান? কেন মুসলিম নারীকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি?
এর জবাবে উপমহাদেশের আলেম মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি (রহ.) বলেন, ‘এ বিধানের ভিত্তি দুটি মূলনীতির ওপর। এক. নারীরা পুরুষের অধীনে হয়ে থাকে। ফলে কোনো মুসলিম নারী কোনো কাফের বা আহলে কিতাবি পুরুষের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলে তার ধর্ম ঠিক থাকবে না। দুই. আহলে কিতাবিদের কুফরি মুশরিক ও অগ্নিপূজকদের কুফরি থেকে বেশি সূক্ষ্ম।’ এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভি (রহ.) লিখেছেন, ‘বিয়ের মাধ্যমে জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে কুফর (ইসলামবিরোধী বিশ্বাস ও রীতিনীতি) অন্তরে প্রবেশ করে (তাই আহলে কিতাব ছাড়া অন্যদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ নয়)। কিন্তু আহলে কিতাব বা ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা আসমানি শরিয়তে (ধর্মীয় বিধান) বিশ্বাসী। তারা শরিয়তের মৌলিক বিষয় (একত্ববাদ, নবুওয়াত ও আখেরাত) স্বীকার করে। ফলে তাদের সংস্পর্শে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিনষ্ট হওয়ার বিষয়টি অন্য ধর্মের তুলনায় কম ক্ষতিকর। কিন্তু অগ্নিপূজারি, মূর্তিপূজারি ও মুশরিকদের বিষয়টি এর ব্যতিক্রম (মৌলিক, শাখাগত ও সংস্কৃতিগত সব বিষয়ে তাদের সঙ্গে বিরোধ থাকায় তাদের সঙ্গে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা এটি জীবনাচারে আমূল প্রভাব বিস্তার করতে পারে)।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, ২/১৩৩, তাফসিরে হেদায়েতুল কোরআন, ১/২৬৬)
কুয়েতের ওয়াকফ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ইসলামি আইন বিশ্বকোষে আছে, ‘মুসলমানের জন্য এমন নারীকে বিয়ে করা হারাম, যার কোনো কিতাব নেই (যেকোনো আসমানি গ্রন্থে বিশ্বাসী নয়)।’ (আল মাওসুআতুল ফিকহিইয়া আল কুয়েতিইয়া, ৩৫/২৬)
প্রচলিত হিন্দু, বৌদ্ধ, বাহায়ি, শিখ ও কনফুসীয় ধর্মের অনুসারীরাদের কারও সঙ্গে কোনো মুসলিমের বিয়ে বৈধ নয়। কেউ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেলে, তার বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। মুসলমানদের জন্য কোনো মুরতাদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ নয়। চার মাজহাবের ওপর লিখিত গ্রন্থ আল ফিকহ আলাল মাজাহিবিল আরবাআয় রয়েছে, ‘মুরতাদের পাঁচটি বিষয় সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল। তার প্রধান ও প্রথম বিধান হলো, মুরতাদের বিয়ে নিঃশর্তভাবে বাতিল।’
কোনো মুসলিম নারীর বিধর্মী স্বামী থাকলে তাকে মুসলমান বানিয়ে নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। সম্ভব না হলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। ইসলাম অনুমোদিত নয়, এমন বিয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্ম নিলে, সন্তান যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়, তাহলেই সে মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫৬; ফাতাওয়া উসমানি, ২/২৫৭; হেদায়া, ২/৩৪৬; ফতোয়া মাহমুদিয়া, ১৭/৮২)
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া কাসেম নানুতবী, ঢাকা