মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী—পেনফিল্ড পাবলিকেশনের প্রকাশক। নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে জন্ম। পড়াশোনার শুরু বসুরহাট এএইচসি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। লন্ডনের এংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে অনার্স এবং গ্রিনউইচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি কেন প্রকাশক হলেন, কোন ধরনের বই প্রকাশে তিনি আগ্রহী, ইসলামি প্রকাশনীর মান কতটা বেড়েছে, লেখক-প্রকাশকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রায়হান রাশেদ
খবরের কাগজ: আপনি প্রকাশক হলেন কেন?
মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী: লন্ডনে পড়াশোনা করছি তখন। জীবন চলছিল আর দশটা তরুণের মতোই। আল্লাহর রহমতে সেবার দ্বীনের বুঝ পেলাম। নিজের দ্বীনকে ভালোমতো জানলাম। ভাবলাম, দেশে ফিরে দ্বীনভোলা মানুষকে দ্বীনের পথে ডাকব। আমার মনে হলো, ইসলামি বইপত্র এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা মানুষের অন্তরে দ্বীনের আলো পৌঁছাতে এবং তাদের সঠিক জ্ঞানের দিকে আহ্বান করতে পারে। পাশাপাশি লন্ডনে অবস্থানকালে আমার ইচ্ছা ছিল, দেশে গিয়ে এমন একটি কাজ করা—যা নিজের জীবিকার ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। ইসলামি প্রকাশনা এই দুটো লক্ষ্যপূরণের একটি উপযুক্ত মাধ্যম বলে মনে হয়েছে। দ্বীনের খেদমতের এই মহৎ উদ্দেশ্য এবং মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রকাশক হয়েছি। এটি আমার কাছে শুধু পেশা নয়; বরং দ্বীনের পথে থেকে মানুষের সেবা করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
খবরের কাগজ: ইসলামি প্রকাশনার মান কতটা বেড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী: বাংলাদেশে প্রকাশনাশিল্প, বিশেষত ইসলামি প্রকাশনী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বর্তমানে অনেক ইসলামি প্রকাশনী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। বইয়ের ডিজাইন, ফরম্যাটিং এবং প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, যা বইয়ের মান উন্নত করেছে।
প্রকাশনীগুলো শুধু ধর্মীয় গ্রন্থ নয়; বরং জীবনধারা, সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ, ইসলামি ইতিহাস ও শিশুদের জন্য ইসলামি সাহিত্য প্রকাশে মনোযোগী হয়েছে। এর ফলে পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে।
গবেষণাভিত্তিক বই প্রকাশ করছে অনেকে। অনুবাদ, সম্পাদনা ও প্রুফ রিডিংয়ের ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল নিয়োগ করায় বইয়ের ভাষাগত ও বিষয়গত মান উন্নত হয়েছে। ইসলামি বই এখন সহজেই বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (যেমন- রকমারি, ওয়াফিলাইফ, জাজিরা) এবং প্রকাশনীর নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এতে পাঠক বই কিনতে এবং পড়তে আরও উৎসাহিত হচ্ছে। সর্বোপরি, ইসলামি প্রকাশনার মান বেড়েছে।
খবরের কাগজ: লেখক-প্রকাশকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী: লেখক ও প্রকাশকের সম্পর্ক একটি বই প্রকাশের প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়; বরং এটি সম্মান, সহযোগিতা এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা উচিত। লেখকের সৃজনশীলতা এবং প্রকাশকের পেশাদারিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। প্রকাশকের উচিত, লেখকের স্বাধীনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্মান করা। লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে স্পষ্ট যোগাযোগ থাকা জরুরি। লেখা, সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, বাজারজাতকরণ এবং রয়্যালটির বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত উভয়ের মাঝে। একটি সুস্পষ্ট ও উভয়পক্ষের জন্য ন্যায়সঙ্গত চুক্তি থাকা প্রয়োজন যেখানে লেখক ও প্রকাশকের দায়িত্ব, রয়্যালটির হার এবং কপিরাইটের বিষয় উল্লেখ থাকবে। লেখক ও প্রকাশক উভয়ের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব থাকা দরকার। লেখকের লেখা জমা দেওয়ার সময়সীমা এবং প্রকাশকের সম্পাদনা ও প্রকাশনার সময়সীমা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রয়্যালটি, অগ্রিম অর্থ এবং বিক্রির হিসাব নিয়ে স্বচ্ছ থাকা উচিত। নিয়মিত এবং সঠিক পদ্ধতিতে লেখককে অর্থ প্রদান করতে হবে।
খবরের কাগজ: আপনার প্রকাশনী সম্পর্কে কিছু বলুন। কী ধরনের বই প্রকাশে আপনারা আগ্রহী?
মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী: আমাদের প্রকাশিত বইগুলোর প্রথম ফ্ল্যাপে আমরা ছোট্ট একটি কলাম টাইপের লেখা দিয়ে থাকি। এর মাধ্যমে যেমন একজন পাঠক আমাদের চিন্তাচেতনা ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারবেন, তেমনই এর মাধ্যমে বেশ পরিষ্কারভাবেই জানতে পারবেন আমরা কী ধরনের বই প্রকাশে আগ্রহী। ধারণা পাবেন বইয়ের জগতে কোন কোন জায়গায় পেনফিল্ডের বিচরণ। তাই এখানেও সেই লেখাটি উল্লেখ করাই যথার্থ মনে করছি—‘স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ও জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর সংযোগ গড়ে তোলা বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়ের দাবি। এ দাবি পূরণের শতেক পথের একটি হলো বই। সেই প্যাপিরাসের যুগ থেকে আজ ই-বুকের যুগ পর্যন্ত, হাজার বছরের পরিক্রমায় আল্লাহর কালাম, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী, শরিয়তের বিধান, মানুষের চিন্তা, ইতিহাসের দলিল ইত্যাদির লিখিত রূপ আমাদের জীবনের প্রয়োজন। মননশীল মনের খোরাক।
প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময়ের নিরন্তর পরিবর্তনশীল ইতিহাস ও সমাজের যোগসূত্র গেঁথে দিতে, দ্বীন-ধর্মের জ্ঞান, সমাজ-সংসারের গল্প, নির্জলা ইতিহাস কিংবা উপাখ্যান-উপন্যাস, তাসাউফ তত্ত্ব থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, হার্দিক শিল্পের কথকতা, লাইফস্টাইল অথবা মোটিভেশন— হাজারো বিষয় নিয়ে সংবেদনশীল পাঠকের সঙ্গে অক্ষর-শব্দ-বাক্যের বাঁধনে জড়িয়ে, বই নামের এক অলৌকিক জগতে ডুব দিয়ে আলোকিত হতে, বিশ্বাস ও শুদ্ধতার আয়নায় দাঁড়িয়ে—পরিশীলিত ও শিল্পিত রূপে পাণ্ডুলিপির রূপায়ণ কল্পেই ‘পেনফিল্ড পাবলিকেশন’-এর পথচলা।’
খবরের কাগজ: ইসলামি বইয়ের জাগরণের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী: ইসলামি বইয়ের জাগরণের ক্ষেত্রে একটি সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন—যা পাঠকের চাহিদা, সময়ের প্রয়োজন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে কোরআন, হাদিস, ফিকহ, ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। সমকালীন চ্যালেঞ্জ (যেমন-জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মোন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতা) নিয়ে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হবে। সহজবোধ্য এবং রোমাঞ্চকর গল্প বা উপন্যাসে ইসলামি শিক্ষা তুলে ধরতে হবে। ইসলামি সাহিত্য তরুণদের জন্য উপযুক্তভাবে উপস্থাপন করতে হবে। শিশু ও কিশোরদের আকৃষ্ট করা যেতে পারে। ইসলামি লাইব্রেরি বা ইসলামিক লার্নিং অ্যাপ করা যেতে পারে। মোট কথা, ইসলামি বইয়ের জাগরণের জন্য সৃজনশীলতা, গবেষণা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সমন্বয় অপরিহার্য। পরিকল্পিত উদ্যোগ ও মানসম্পন্ন কাজের মাধ্যমে ইসলামি বইয়ের প্রসার বাড়িয়ে একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।