
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন বছরের শুরুতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার-যাত্রায় পা ফেলতে যাচ্ছে। এভিয়েশন খাতেও এর প্রভাব পড়বে। নতুন অনেক কিছু দেখতে পাওয়া যাবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, বিমানের জন্য নতুন উড়োজাহাজ কেনাসহ বেশ কিছু বিষয় সারা বছর আলোচনায় ছিল। সেই সঙ্গে মেগা প্রজেক্ট থার্ড টার্মিনালকে ঘিরে দুর্নীতির কথাও শোনা গেছে।
তবে এই অভিযোগের পরেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনেই এভিয়েশন খাতে সংস্কার ও সংস্কারের নতুন তরঙ্গ দেখা গেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ঘিরে স্থানীয় যাত্রী ও প্রবাসী, উভয়ের জন্যই স্বপ্নময় প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সহায়ক হতে চলেছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটক মন্ত্রণালয়। প্রবাসীদের সেবার ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত সুবিধা, যাত্রী সুবিধা এবং পর্যটনসহ সামগ্রিক পরিষেবা বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দরের সেবার মান বৃদ্ধি
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ ১০০ দিনে সংস্কার ও সংস্কারের একটি নতুন ঢেউ দেখেছে। আগে বিমান থেকে অবতরণের পর লাগেজ পেতে কত সময় লাগবে, কেউ বলতে পারতেন না। এখন সেখানে যাত্রীরা ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই লাগেজ পাচ্ছেন। প্রবাসী ও নতুন যাত্রীদের সহযোগিতা করার জন্য চালু করা হয়েছে হেল্পডেস্ক। আছে ফ্রি কল করা এবং ওয়াইফাই ব্যবহারের সুবিধা। এ ছাড়া যাত্রীদের অভিযোগ জানানোর জন্য চালু আছে দুটি টেলিফোন হটলাইন- ১৩৬০০ ও ০৯৬১৪০১৩৬০০। ওয়েবসাইটে (www.hsia.gov.bd) গিয়েও অভিযোগ জানাতে পারছেন যাত্রীরা। বিমানযাত্রীদের জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
প্রবাসী লাউঞ্জ
আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর ঘোষণা আসে বিমানবন্দরে প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের সেবায় চালু হবে প্রবাসী লাউঞ্জ। প্রতিশ্রুত সেই লাউঞ্জ চালু হয়েছে। প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য বাংলাদেশে এই ধরনের লাউঞ্জ এই প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে প্রবাসীরা বিশ্রাম করতে পারছেন। মিলছে সুলভ মূল্যে খাবার। খাবারের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
চালু হয়নি শাহজালালের থার্ড টার্মিনাল
চলতি বছরের শুরুতে থার্ড টার্মিনালের কাজ শুরুর স্বপ্ন দেখিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার পতনের আগে জানানো হয়েছিল টার্মিনালটির কাজ অক্টোবরে শুরু হবে। কিন্তু সরকার পতনের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। শোনা যায় টার্মিনালকে ঘিরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কথা। পাশাপাশি জানানো হয় কাজ শেষ না হওয়া এবং অন্যান্য কারণে এ বছর চালু হচ্ছে না। তবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আগামী বছরের মাঝামাঝি চালু হতে পারে টার্মিনালটি।
সমালোচনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস
বছরের শুরু থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সমালোচনায় ছিল তাদের উড়োজাহাজ ড্রিমলাইনারের একের পর এক দুর্ঘটনায় পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়া নিয়ে। এ ছাড়া কখনো মালয়েশিয়ার টিকিট সিন্ডিকেট আবার কখনো গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনায় ছিল সংস্থাটি। তবে এসবের মাঝেও নতুন উড়োজাহাজ কেনা নিয়ে আলোচনায় ছিল বিমান। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেমে যায় সে তোড়জোড়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটে বিমানের পরিচালনা পর্ষদসহ সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। তবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে সমালোচিত হলেও আগামী দুই বছরের জন্য শর্তসাপেক্ষে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পেয়েছে সংস্থাটি। একে বড় সাফল্যের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিমান।
পর্যটন খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে বছরের শুরু থেকেই সংকটে ছিল দেশের পর্যটনশিল্প। বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনা, এরপর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জুলাই ছাত্র আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন, বন্যা, পাহাড়ের অস্থিরতা ও সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পর্যটন খাতে খারাপ সময় গেছে। চরম সংকটে পড়েছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তবে এই পর্যটন মৌসুমে বছরের ক্ষতি কিছুটা পুশিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেখছে। এ জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়ানোর।
পর্যটন খাতকে চাঙা করতে ‘খুলবে পর্যটনের দুয়ার- এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার ২০২৪। পর্যটন বিচিত্রার আয়োজনে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনায়, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, ট্যুরিস্ট পুলিশ বাংলাদেশের সহযোগিতায় এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় ছিল পর্যটনপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড়। এবারের মেলায় বাংলাদেশসহ মালদ্বীপ, চীন, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ভুটান, সিঙ্গাপুরের শতাধিক পর্যটন সংস্থা অংশগ্রহণ করে। মেলার বিভিন্ন স্টলে ছিল পর্যটন মৌসুমে দেশ-বিদেশে বেড়ানোর বিভিন্ন আকর্ষণীয় ভ্রমণ অফার। হোটেল, রিসোর্ট বা প্যাকেজ বুকিংসহ বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা। এ ছাড়া মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, ক্রুজলাইনস, এয়ারলাইনস ও থিমপার্কসহ বিনোদনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আয়োজকরা বলেছেন পর্যটনশিল্পে গতি ফেরাতে এরকম ট্যুরিজম ফেয়ার দারুণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী বাহারি স্বাদের খাবারকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে বছরের শেষ ভাগে বিজয় দিবসে শুরু হয় ‘টেস্ট অব বাংলাদেশ’ ফুড ফেস্টিভ্যাল। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগ বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবারের আয়োজনে অঞ্চলভিত্তিক ৬২টি স্টল অংশগ্রহণ করেছিল। চার দিনব্যাপী এ আয়োজনের মূল আকর্যণ ছিল ঢাকার লাচ্ছি, বাকরখানি ও কাবাব, কুমিল্লার রসমালাই, খুলনার চুইঝাল, শেরপুরের ছানার পায়েস ও তুলশীমালার চাল, বিখ্যাত রাজা-চা, ছোটন মামার ফায়ার পান, হাসের মাংস, ছিটারুটি, যশোরের জামতলার সাদেক গোল্লা, বগুড়ার দই, ক্ষীরসা, নাটোরের কাঁচাগোল্লা ও সন্দেশ, রাজশাহীর কালাইরুটি ইত্যাদি।
পর্যটনের বিকাশ ও বিমানের বিভিন্ন ভালো-মন্দ উদ্যোগের মধ্য দিয়েই কেটেছে বছরটি। আসন্ন বছরে আরও ভালো কিছুর অপেক্ষায় আছেন এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।