অবাক হয়ে আমার সামনে বসা ছেলেটার কাণ্ড দেখছি। এ সময় তার আমার পাশে বসে আমার ঘোমটা তোলার কথা। তার বদলে সে ল্যাপটপের সামনে গিয়ে বসেছে।
লজ্জা ভেঙে বলেই ফেললাম, আপনি কী করছেন?
সে উৎকণ্ঠার সঙ্গে জবাব দিল, দাঁড়াও দাঁড়াও! ‘ম্যারিড’ স্ট্যাটাসই তো এখনো দিইনি। ম্যারিড স্ট্যাটাস না দিলে বিয়ে হয় নাকি! ও হ্যাঁ! তোমাকে তো ট্যাগ করতে হবে। তুমি তোমার ফেসবুক আইডির নাম বলো, আমি রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি।
আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ম্যারিড স্ট্যাটাস না দিলে বিয়ে হয় না এটা আমার অজানা ছিল। পৃথিবীতে কত নতুন নতুন জিনিসই না আছে জানার!
আমি ফেসবুক আইডির নাম বলে তার রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করলাম। সে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিল। সেই ট্যাগ আবার আমাকে অ্যাক্সেপ্ট করতে হলো।
এতক্ষণে সে আনন্দিত গলায় বলল, বাহ! এইতো হয়েছে! আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো ততক্ষণে আমি কমেন্টগুলোর রিপ্লাই দিই।
আমি বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিতে দিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় বুঝে গেলাম। আমি একজন ফেসবুক সেলিব্রিটিকে বিয়ে করেছি। তার কাছে ভার্চুয়াল জগৎ আমার থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই রাতে সে আমার হাত ধরে অনেক রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলল। কথাগুলো ছিল এমন, জানো লাবণ্য! আমার অনেক দিনের শখ ছিল রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেব। বউকে নিয়ে কাপল পিক প্রোফাইলে দেব। ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে হবে কভার পিক। তুমি তো জানোই, কভার পিক ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে দিতে হয়। তুমি এই কয়দিন গুগলে কাপল পিকের পোজগুলো ভালোভাবে দেখবা। আমরা কয়দিন পর হানিমুনে যাব তো! তখন ভালো ভালো ছবি তুলতে হবে। প্রোফাইলের জন্য, কভারের জন্য, ইনস্টার জন্য। এ ছাড়া মাই ডে, মোবাইল আপলোডেও তো দিতে হবে! এক ড্রেস পরে দিলে হবে না। একেকটা ছবিতে একেক ড্রেসে বুঝলে!
সে চোখ বন্ধ করে আসন্ন কভার পিকের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল।
কিছুদিন কেটে গেল। বিয়ের পর প্রথম বাপের বাড়ি এসেছি। আব্বু জামাইয়ের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবা! কেমন আছ? সব খবর ভালো তো!
সে তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল, খুবই ভালো আব্বা! ২কে লাইক আর ৫৭০ কমেন্ট, সেই সঙ্গে ১১২টা শেয়ার।
আব্বু অবাক হয়ে বললেন, এগুলো কী বাবা!
সে হাসিমুখে বলল, আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার ম্যারিড স্ট্যাটাস।
আব্বু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই আম্মু খেতে ডাক দিলেন। খেতে বসে আম্মু প্লেটে খাবার বাড়তে যাবে, তার আগেই সে আম্মুর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল, আম্মা এক মিনিট! একটা ছবি তুলে নিই। জামাই আদর বলে কথা!
সবার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে সে ছবি তুলল। তারপর খেতে খেতেই তিন-চারটা ফিল্টার ইউজ করে এডিট করে মাই ডে দিতে দিতে ততক্ষণে আমাদের সবার খাওয়া শেষ।
আম্মু আর বড় খালা আমাকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন, ছেলের সমস্যা কী রে? কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের খুলে বল।
আমি সহজ গলায় বললাম, ছেলে ফেসবুক সেলিব্রিটি।
খালা অবাক হয়ে বললেন, সেটা আবার কী?
আমি আম্মু আর খালাকে বোঝাতে বসলাম। দুজনেই মোটামুটি ফেসবুক চেনে। ফেসবুক সেলিব্রিটি জিনিসটা ক্লিয়ার করে বোঝাতেই খালা চোখ কপালে তুলে বললেন, কী বলিস! আমাদের জ্ঞাতি-গুষ্টির ভেতরে এই রোগ তো কারও নেই! এটা কি ছোঁয়াচে? ভবিষ্যতে বাচ্চাকাচ্চাদেরও কি এই রোগ হতে পারে?
আমি দুখী গলায় বললাম, ছোঁয়াচে কি না জানি না! তবে বাচ্চাকাচ্চাদের এই রোগ অবশ্যই থাকবে।
খালা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই আম্মু কান্না জুড়ে দিলেন আর আমি আমার বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি চলে এলাম।
রাতে শ্বশুরবাড়িতে খেতে বসেছি। দেখলাম আমার বরের গলা দিয়ে খাবার নামছে না। সে ভাতের মধ্যে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে কিন্তু খাচ্ছে না। তাকে কখনো এত আপসেট দেখিনি। নিশ্চয়ই লাস্ট কোনো স্ট্যাটাসে মনমতো লাইক-কমেন্ট পায়নি।
খাওয়া শেষ করে ওঠার পর বেসিনের কাছ থেকে ফিসফিস করে বললাম, কী হয়েছে?
সে দুঃখভারাক্রান্ত গলায় বলল, বাড়িতে আব্বার সঙ্গে খেতে বসলে ছবি তুলতে দেয় না! এত খাবারদাবার এত আয়োজন একটা মাই ডে দিতে পারলাম না!
আহারে! খাবার আছে মাই ডে নেই! তার জন্য সত্যিই অনেক বড় দুঃখের খবর এটা। আমাদের হানিমুনে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত প্রায় হয়েই গেছে। এমন সময় আমার আম্মু, আব্বু আর বড় খালা ডিভোর্স পেপার রেডি করে আমাকে নিতে এলেন।
বড় খালা ছেলের মাকে রাগী গলায় বললেন, আপনাদের দোষ! বিয়ের আগে বলেননি কেন যে ছেলে ফেসবুক সেলিব্রিটি? এত বড় একটা রোগ নিয়ে আমাদের সরল সাদাসিধা মেয়েটার গলায় এই ছেলেকে ঝুলিয়ে দিলেন? আমরা মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
অনেক কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটির পর সিদ্ধান্ত হলো আমি চলেই যাব। যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় আমার বর মুখ খুলল। দুখী চোখে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি জানো না ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ‘সেপারেট’ দিলে সেটা টাইমলাইনে শেয়ার হয় না? ওইটা দিলে তো আমি লাইক কমেন্ট পাব না! এটা তুমি করতে পারলে আমার সঙ্গে?
কলি