মো. সবুজ উদ্দিন খান ছিলেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে তিনি ‘ছোট মন্ত্রী’ বলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সওজের কর্মকর্তাদের মধ্যে গাড়িতে মন্ত্রীর পাশে একমাত্র তিনিই বসতে পারতেন।
শুধু তাই নয়, সওজের যেকোনো কাজে কারও তদবিরের প্রয়োজন হলে সবুজই ছিলেন ভরসা। মন্ত্রী কাদের তার কথার বাইরে কিছুই করতেন না। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীদের তদবিরও মন্ত্রীর কাছে ছিল তুচ্ছ। সবুজ খানের সিদ্ধান্তই ছিল শেষ কথা। এ কারণে সওজের কমকর্তা-কর্মচারীরা আড়ালে তাকে ‘ছোট মন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করতেন।
অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলোচিত এই সবুজকে এখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে সরিয়ে জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর বাইপাস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১১ সালে সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ওবায়দুল কাদেরের আনুগত্য লাভের আশায় মরিয়া হয়ে ওঠেন চতুর প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান। সেই লক্ষ্যে কাদেরকে দামি উপহার দেওয়া শুরু করেন। কাদের তার ওপর সন্তুষ্ট- এটি বুঝতে পেরেই সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সবুজ চলতেন রাজনৈতিক নেতাদের মতো।
আওয়ামী লীগের আমলে সড়কে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে, তবে ঢাকা বিভাগে সড়কে যত মেগা প্রকল্প হয়েছে, সেখানেই মেগা দুর্নীতি করেছেন প্রকৌশলী সবুজ। শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া সবুজ নিজের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার পান্নাকে নৌকার মনোনয়নে এমপি বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। সেই লক্ষ্যে কাদেরের প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকা পাবনায় একক বলয় তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি।
সরকারি কর্মকর্তা হয়েও মন্ত্রীর এতই আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন যে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে একই গাড়িতে যাতায়াত করতেন সবুজ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা কাদের তার আস্থাভাজন সবুজের গ্রামের বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন।
কাদেরের আমলে ঘুরে-ফিরে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ঢাকা সার্কেলে সংযুক্ত থাকতেন দাপুটে প্রকৌশলী সবুজ। কিন্তু সরকার পতনের পর সবুজের রাজত্বে ভাটা পড়ে।
ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের এক নেতা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা (নেতা-কর্মীরা) যখন মন্ত্রীর (কাদের) কাছে কাজের জন্য যেতাম তখন তিনি প্রকৌশলী সবুজের সঙ্গে দেখা করতে বলতেন। কিন্তু সবুজ দলীয় নেতা-কর্মীদের কাজ না দিয়ে নিজের পছন্দের লোকদের সড়কের কাজ দিতেন। কারণ বাইরের লোকদের দেওয়া হলে পার্সেন্টেজও বেশি পেতেন। ওবায়দুল কাদেরের কাছে তার বিরুদ্ধে বিচার দিলেও কোনো লাভ হতো না। কারণ সবুজ মন্ত্রীর কাছে নেতা-কর্মীদের চেয়েও আস্থাভাজন ছিলেন। ঢাকার বিভিন্ন সড়কের প্রকল্প পরিদর্শনে মন্ত্রীর সঙ্গে গাড়িতে যেতেন সবুজ। নামে-বেনামে মন্ত্রীকে দিয়ে নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নিতেন সবুজ। আর নতুন প্রকল্প মানেই সবুজের টাকা আসার রাস্তা।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সড়ক বিভাগে কোনো প্রকল্প অনুমোদন করাতে পারলেই তৎকালীন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরর জন্য বিদেশ থেকে উপহার আনাতেন সবুজ। এর মধ্যে ছিল কাদেরের পছন্দের হাতের ঘড়ি, জুতা, কোট পিন, চশমা ও কটি ইত্যাদি। একেকটা উপহারের দাম সাত লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত বলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রীকেও বিদেশি উপহার পাঠাতেন সরকারি এই কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়কে সরকারি কাজের বরাদ্দকৃত অর্থের মন্ত্রী কাদেরের পার্সেন্টেজ জমা থাকত সবুজের কাছে। বিশ্বস্ত হওয়ায় সবুজের মাধ্যমে ওবায়দুল কাদের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। সরকার পতনের পরে সবুজের গ্রামের বাড়ি পাবনার বেড়া উপজেলার কোনো একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন কাদের। এলাকাবাসী ও কাদেরের ঘনিষ্ঠরা এমনটাই জানিয়েছেন।
নিজে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় পাবনা-২ আসন থেকে নির্বাচনের ইচ্ছা থাকলেও করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আসনটিতে স্ত্রীকে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচন করানোর পরিকল্পনা ছিল সবুজের। এই লক্ষ্যে জনসংযোগও শুরু করেছিলেন এই দম্পতি। এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন, সাংবাদিকদের মাসিক ভিত্তিতে ও বিভিন্ন উৎসবে নগদ অর্থসহ বিভিন্ন উপহার পাঠাতেন তারা।
জানা গেছে, অবৈধ ঘুষের টাকা জায়েজ করতে স্ত্রীকে দিয়ে সমাজসেবার নাটক করতেন সবুজ। ফেসবুকে ‘১০০+’ নামে একটি গ্রুপ চালান সবুজের স্ত্রী। অভিযোগ আছে, সেই গ্রুপের মাধ্যমে সবুজের পরিবারকে মহৎ ও দানশীল হিসেবে প্রচার চালানো হয়। এসব প্রচারে শতাধিক কর্মী নিয়োগ দেওয়া ছিল তাদের। এদের প্রতিজনকে মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হতো। এই ‘বাহিনী দিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে সবুজের পরিবার। এই প্রভাবশালীদের মতের বাইরে কেউ গেলে কাদেরের প্রভাব খাটিয়ে ম্যানেজ করা হতো। আর দুর্বল কেউ হলে এই বাহিনী দিয়ে লাঞ্ছিত করা হতো। সবুজের পরিবারের এই বিশাল বাহিনীর ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেত না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে প্রায় আট বছর সড়ক বিভাগে যুক্ত ছিলেন প্রকৌশলী সবুজ খান। এই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠায় একপর্যায়ে সবুজের হাতের ইশারায় চলতে শুরু করে সড়ক বিভাগ।
অনেকের মতে, কাদেরের ব্যক্তিগত ও গোপন বিষয় যা কিছু আছে সবই সবুজের জানা। এই গোপনীয়তা জানায় সবুজকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস করেননি। দূরে সরাতে পারেননি মন্ত্রী নিজেও। আর এই সুযোগ সরকার পতনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছেন সবুজ।
মন্ত্রীকে নিয়ে একের পর এক প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে সবুজ টেন্ডারের কাজ দিতেন তার পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। আর এসব প্রকল্পের পার্সেন্টেজ দিয়েই কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। অবৈধ এ অর্থ দিয়ে নিজের পরিবারের নামে গড়েছেন বিপুল সম্পত্তি। রাজধানীর উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে সবুজের রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। যদিও বাড়িটি স্ত্রী পান্না ও দুই শ্যালিকা নুরজাহান আক্তার ও নারগিস আক্তার হীরার নামে লেখা। বাড়িটিতে সবুজ খান নিজে না থাকলেও তার শ্যালিকা সপরিবারে বসবাস করেন। আর সবুজ থাকেন রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে তার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট।
উত্তরায় সবুজের একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে, যা পরিচালনা করেন তার বোনের ছেলে (ভাগনে) সুরুজ। এ ছাড়া কক্সবাজারের প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে সবুজের বিলাসবহুল দুটি রিসোর্ট রয়েছে। পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর ইউনিয়নের মীরপুর চরে ১০০ বিঘা জমি রয়েছে সবুজের পরিবারের। জাতসাখিনী ইউনিয়নের নান্দিয়ারা ও গাজানার বিলে স্ত্রীর নামে ৮০ বিঘা জমি রয়েছে।
গ্রামে ২০ বিঘা জমির ওপর সবুজের রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। যার বর্তমান মূল্য অন্তত ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। এর পাশে স্ত্রীর নামে ৫০ বিঘা জমির ওপর স্কুল ও গরুর ফার্ম করেছেন সবুজ। এর মধ্যে অন্তত ৪০ বিঘা জমিই প্রভাব খাটিয়ে দখলের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্ত্রীর নামে ‘সিনথি চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের’ জন্য চাঁদা তুলতেন সবুজ। সেই টাকা দিয়ে এলাকায় সমাজসেবা করতেন স্বামী-স্ত্রী। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে পাবনায় যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন সবুজ দম্পতি।