বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে সেই সম্ভাবনা দেখা যায়নি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং তা চরম আকার ধারণ করেছে। মূলত ব্যবসায়ীরাই বাজার পরিস্থিতি অস্থির করে তোলেন এবং সেখানে যথাযথ মনিটরিং না থাকার কারণেই সমস্যা হয়।...
বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে খুবই অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এই অস্থিতিশীল অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ মূল্যস্ফীতি। এই মুহূর্তে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া। এ পরিস্থিতি সহসা মোকাবিলা করা না গেলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। পণ্যের মূল্য যাতে না বাড়ে, সেজন্য প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যেতে পারে। ডলারসংকটসহ যেসব কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে, সেসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকেই পণ্যের মূল্যের জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন। দেশে বিদ্যমান যেসব আইন আছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবশ্যই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং তা করা উচিত। মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা খুবই চতুর ও সংঘবদ্ধ। তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। কালক্ষেপণ না করে এখনই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সে লক্ষ্যে অর্থনীতির নানামুখী সংস্কার আবশ্যক।
বর্তমানে দেশে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকার কারণে উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে এবং হচ্ছে। হঠাৎ পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এ দেশের সাধারণ মানুষ দিন আনে দিন খায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। যদিও মূল্যস্ফীতির বর্তমান অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। ব্যবসায়ীদের মধ্যকার সিন্ডিকেট মূল্যস্ফীতিকে আরও অসহনীয় করে তুলছে। বিশ্ববাজারে যখন পণ্যের দাম বেড়েছিল তখন বাংলাদেশেও বেড়েছিল। বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে সেই সম্ভাবনা দেখা যায়নি অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং তা চরম আকার ধারণ করেছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববাজার থেকে আমদানি ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলে কিছুটা কাজে দেবে। সমস্যাটি ব্যাপক আকার নিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। এখন ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা হয়তো চাপে পড়বে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। দেরিতে হলেও আংশিকভাবে আমরা সেই পথে হাঁটছি। বিদ্যমান নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা যেন মেন্যুপুলেশন করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।
একই সঙ্গে উৎপাদনসক্ষমতা বাড়ানো খুবই দরকার। মূলত ব্যবসায়ীরাই বাজার পরিস্থিতি অস্থির করে তোলেন এবং সেখানে যথাযথ মনিটরিং না থাকার কারণেই সমস্যা হয়। মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। কত লোক নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে পড়লে অস্থিরতা আরও বাড়বে। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে বা সিন্ডিকেট না ভেঙে সরাসরি আমদানি করতে চাইলে কৃষক বা উৎপাদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা বাজার মেন্যুপুলেশন করার জন্য সাধারণত কৃষক বা উৎপাদনকারী দায়ী নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়িক শ্রেণি। এরা সিন্ডিকেট করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে থাকে। কৃষক উৎপাদন করে কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই কৃষক বা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। দেশের কৃষক উৎপাদনের প্রকৃত সুফল ভোগ করতে পারে না। এটা চলে যায় মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর হাতে। কাজেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগের প্রতি বিশেষ জোর দিতে হবে। এর বাইরে প্রবাসী আয়, খেলাপি ঋণ, রপ্তানি আয়, লেনদেন ভারসাম্যসহ অর্থনীতির সূচকগুলোও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই।
দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার দরকার। এই খাতটিতে সুশাসনের অভাব আছে। বিগত সরকারের আমলে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এই খাতকে সুশাসনের ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ব্যাংকিং খাতে যেসব সংস্কার হয়েছে সেগুলো যথাযথ হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগও শ্লথগতিতে আছে। অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বেঁধে দেওয়ার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। একইভাবে আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় ব্যাংকের আমানতেও টান পড়েছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বিবেচনা করলে ব্যাংকে আমানত রেখে গ্রাহকরা যে সুদ পাচ্ছেন, তা মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংক আমানতসংকটে পড়েছে। একই সঙ্গে ভোক্তাঋণের সুদহারও বাড়িয়েছে।
দেশে সরবরাহব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হারের অঙ্কটি অনেক বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আগের বিভিন্ন সময়ের মন্দা আমাদের দেখিয়েছে- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেওয়া ঝুঁকি তৈরি করে। নীতিনির্ধারকদের এমন সব মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছে এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট ব্যর্থতা আছে। মূল্যস্ফীতির ফলে আমাদের রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রমগুলো ব্যাহত হলে, একই সঙ্গে বিনিয়োগ ব্যাহত হলে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান আরও কঠিন হয়ে যাবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি উন্নত এবং অনুকূল করতে হবে। পরস্পরকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে দেশের স্বার্থ দেখতে হবে সবার আগে। কাজেই অর্থনীতির চলমান সমস্যাগুলো সমাধান করতে হলে জোরালো ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাতারাতি কেউ এটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে, তা বাস্তবসম্মত নয়।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সংঘাতময় পরিবেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। এমনকি স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও বৈরী পরিবেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেকদিন ধরে অর্থনীতি একটা বড় সমস্যার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আইনি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। আইনগুলো শক্তিশালী হওয়া দরকার ছিল, কিন্তু তা হয়নি। এসব বিষয় অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও বেশি দুর্বল করেছে। ফলে অর্থনীতি একটা বড় রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি না হয়ে আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা আছে। যা মানুষের জীবনযাত্রার মানকে অনেক বেশি নিচের দিকে নামিয়ে এনেছে। এমতাবস্থায়, জনসচেতনতার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংস্কার ও সমাধানে গুরুত্ব বুঝে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতির অবস্থা আরও বেশি সমস্যাসংকুল হবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা