সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি বড় মামলা এবং সম্প্রতি একাধিক আক্রমণাত্মক ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার পরও আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তার রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী থেকে গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও বিরোধীদের নানা বাধা সত্ত্বেও তিনি জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছেন।
নির্বাচনি হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক জালিয়াতি এবং নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের মুখোমুখি হলেও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা যেন কোনোভাবে কমছে না। এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক কৌশল ও প্রভাব তাকে মার্কিন রাজনীতিতে এখনো গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রেখেছে।
২০২৩ সালে মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি ফৌজদারি মামলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ২৩৪ বছরে কোনো প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ আনা হয়নি। এই মামলাগুলো তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগে, চলাকালীন ও পরবর্তী কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে। এর মধ্যে একটি মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। বাকি তিন মামলা এখনো বিচারাধীন।
অর্থ কেলেঙ্কারির মামলা
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে ঘুষ দেওয়া এবং সে তথ্য ধামাচাপা দিতে ব্যবসায়িক নথিপত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ আনা হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। গত ৩০ মে নিউইয়র্ক রাজ্য আদালতে এই অভিযোগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন।
অভিযোগে বলা হয়, নির্বাচনি প্রচারের সময় সম্ভাব্য যৌন কেলেঙ্কারি এড়াতে ট্রাম্পের অ্যাটর্নি মাইকেল কোহেন ২০১৬ সালে ড্যানিয়েলসকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার দেন। পরে ট্রাম্প সেই অর্থ বিভিন্ন কিস্তিতে কোহেনকে ফেরত দেন। যা করপোরেট খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। বিচারক জুয়ান মেরচান অভিযোগ বাতিলের আবেদনের বিপক্ষে রায় দেন এবং ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো বহাল রাখেন।
নিউইয়র্ক আইনে রেকর্ড জালিয়াতি ফৌজদারি অপরাধ এবং এটি বেআইনি কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে হলে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রসিকিউটররা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনেন যে, এটি নির্বাচনি আইন লঙ্ঘন করেছে। আর কোহেন ছিলেন এই মামলার প্রধান সাক্ষী।
তার দাবি, ট্রাম্প নিজেই এ অর্থ দেওয়ার পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে আর্থিক সুবিধার জন্য অন্যভাবে অবৈধ অর্থ দেওয়ার প্রমাণও আদালতে দেখানো হয়। তবে অভিযোগগুলোকে অপরাধ হিসেবে দেখা নিয়ে আইনি বিতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া, অ্যাটর্নি টড ব্লাঞ্চ ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এই অর্থ দেওয়ার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত বলে দাবি করেন।
২০২০ সালের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ মামলা:
ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনের দিন থেকে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির মধ্যে জো বাইডেনের বিজয় বাধাগ্রস্ত করতে একটি ব্যাপক প্রচারণা চালান। ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টারা ভুয়া ভোট জালিয়াতির তথ্য ছড়িয়ে দেন। রিপাবলিকান কর্মকর্তাদের ফলাফল বিপর্যস্ত করতে উৎসাহিত করেন। মিথ্যা নির্বাচক দলের তালিকা তৈরি করেন এবং তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে বৈধ ফলাফল বাতিলের জন্য চাপ দেন। এই ঘটনায় ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে মিথ্যা প্রচার চালানোর সময় সমর্থকদের আক্রমণের শিকার হন ট্রাম্প। পরে বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথের নেতৃত্বে ফেডারেল প্রসিকিউটররা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যাহত করার চেষ্টার জন্য চারটি অপরাধের অভিযোগ আনেন।
জানুয়ারি ৬-এর ঘটনা তদন্তে হাউস সিলেক্ট কমিটির সুপারিশে জ্যাক স্মিথ কার্যক্রম শুরু করেন। যেখানে ট্রাম্প ও তার আইনজীবী জন ইস্টম্যানকে বিচারকাজ পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়। ওয়াশিংটনের গ্র্যান্ড জুরি কয়েক মাস সাক্ষ্য গ্রহণ করেন এবং ২০২৩ সালের ১ আগস্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গুরুতর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন। আদালত বিষয়টি মীমাংসার জন্য মামলাটি বিচারক তানিয়া চাটকানের কাছে পাঠান। এই বিচারক প্রথমে এ বছরের ৪ মার্চ বিচার শুরু করার তারিখ নির্ধারণ করেন।
তবে ট্রাম্পের আইনজীবীরা যুক্তি দেন যে, সাবেক প্রেসিডেন্টদের অপরাধমূলক অভিযোগ থেকে সুরক্ষিত হওয়া উচিত, এতে করে মামলার তারিখ বিলম্বিত হয়। গত ১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট একটি ৬-৩ ভোটে ট্রাম্পের এই দাবি মেনে নেন এবং বিচার বিলম্বিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচন দিনের আগে বিচার শুরু হওয়া প্রায় অসম্ভব।
মামলায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে চারটি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে দুটি ৬ জানুয়ারির কংগ্রেস নির্বাচনের প্রত্যয়ন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করার সঙ্গে সম্পর্কিত। তৃতীয়টি নিজ দেশ আমেরিকার সঙ্গে প্রতারণা পরিকল্পনার অভিযোগ, যার মাধ্যমে ২০২০ সালের নির্বাচনে ভোট সংগ্রহ, গণনা এবং প্রত্যয়নে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। চতুর্থ অভিযোগটি ছিল নাগরিকদের ভোটাধিকার এবং তাদের ভোট গণনার অধিকার হরণে ষড়যন্ত্র, যা ফেডারেল আইনের অধীনে সুরক্ষিত।
যেহেতু এই মামলার সব অভিযোগই ফেডারেল অপরাধ, তাই যদি ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন তাহলে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নিজের জন্য ক্ষমা ঘোষণার বৈধতা নিয়ে এখনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেই।
জর্জিয়ার নির্বাচনি ফল পরিবর্তনের প্রচেষ্টা
২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় পরিবর্তনের জন্য ট্রাম্পের প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি তীব্র ছিল জর্জিয়ায়। একাধিক পুনর্গণনায় নিশ্চিত করা হয় যে, জো বাইডেন সামান্য ব্যবধানে রাজ্যের ১৬টি ইলেক্টোরাল ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হন। কিন্তু ট্রাম্প ও তার মিত্ররা ভোট জালিয়াতি নিয়ে মিথ্যা প্রচার করে। জর্জিয়ার কর্মকর্তাদের বাইডেনের বিজয় উল্টে দিতে চাপ দেন এবং ভুয়া নির্বাচকদের ওয়াশিংটনে পাঠানোর পরিকল্পনা করেন।
২০২১ সালের ২ জানুয়ারি ট্রাম্প জর্জিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেট ব্র্যাড রাফেনস্পার্জারকে কল করে ১১ হাজার ৭৮০ ভোট খুঁজে বের করতে বলেন, যাতে বাইডেনের বিজয়কে ট্রাম্প অতিক্রম করতে পারেন। ফুলটন কাউন্টির জেলা অ্যাটর্নি ফানি উইলিস এই চেষ্টাগুলোর জন্য ট্রাম্প ও তার ১৮ সহযোগীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন এবং একটি বিস্তৃত অপরাধমূলক চক্রান্তের অভিযোগ করেন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উইলিস এই ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেন। তিনি ট্রাম্পের শীর্ষ সহযোগীদের অনেককেই একটি বিশেষ গ্র্যান্ড জুরির সামনে ডেকে আনেন। যাদের তদন্তের ক্ষমতা ছিল কিন্তু অপরাধমূলক অভিযোগ অনুমোদনের অধিকার ছিল না। ২০২৩ সালের উইলিস তার প্রমাণাদি একটি নিয়মিত গ্র্যান্ড জুরির কাছে উপস্থাপন করেন, যা ওই বছরের ১৪ আগস্ট ৯৮-পৃষ্ঠার অভিযোগ অনুমোদন করে।
অভিযোগপত্রে ১৯ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এতে মোট ৪১টি রাজ্য আইনের অধীনে গুরুতর অপরাধের ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে ১৩টি অভিযোগ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ছিল। গত মার্চে বিচারক স্কট ম্যাকআফি অভিযোগগুলোর মধ্যে ছয়টি বাদ দেন, যেগুলোর মধ্যে তিনটি ছিল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। বিচারক অভিযোগগুলোর বিবরণ পর্যাপ্ত নয় বলে জানান। তবে প্রসিকিউটররা আরও তথ্যসহ এগুলো পুনরায় দায়ের করতে পারেন। এর মধ্যে রাজ্যের আইন লঙ্ঘনের সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি এখনো বহাল রয়েছে।
জর্জিয়ায় ক্ষমা বা দণ্ডমুক্তির অনুমতি প্রদানের একমাত্র ক্ষমতা রাজ্যের হাতে, যা পাঁচ সদস্যের একটি প্যানেল। তাদের নিয়োগ দেন রাজ্যের গভর্নর।
গোপন নথি সরানোর অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের ফেডারেল প্রসিকিউটররা বিশেষ কাউন্সেল জ্যাক স্মিথের নেতৃত্বে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউস ত্যাগের পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে গোপন জাতীয় নিরাপত্তা নথি সরানোর অভিযোগ আনেন। প্রসিকিউটরদের মতে, তিনি সেই নথিগুলো মার-এ-লাগো রিসোর্টে এলোমেলোভাবে রাখেন এবং সরকার বারবার তা ফেরত চাওয়ার পরও দিতে অস্বীকার করেন।
অন্তত দুবার ট্রাম্প অনুমোদনহীন ব্যক্তিদের কাছে গোপন নথি দেখান বলে অভিযোগ ওঠে। একটি ঘটনায় ট্রাম্প একটি অতি গোপন সামরিক আক্রমণ পরিকল্পনার অডিও রেকর্ড প্রদর্শন করেন এবং বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আমি এটি ডিক্লাসিফাই করতে পারতাম, কিন্তু এখন পারি না। তবে এটি এখনো গোপন।’
২০২২ সালের শুরুর দিকে বিচার বিভাগ ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পরবর্তী সময়ে গোপন নথি সংরক্ষণ সম্পর্কিত তদন্ত শুরু করে। জুনে ট্রাম্পের একজন আইনজীবী সব নথি ফেরত দেওয়া হয়েছে বলে জানান। কিন্তু আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই) মার-এ-লাগোতে অনুসন্ধান চালিয়ে গোপন চিহ্নিত ১০২টি নথি জব্দ করে। নভেম্বরে বিশেষ কাউন্সেল হিসেবে স্মিথকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ২০২৩ সালের জুনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ৩৭টি ফৌজদারি অপরাধ এবং তার দীর্ঘদিনের সহকারী ওয়াল্ট নাউটার বিরুদ্ধে ছয়টি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। যদিও ট্রাম্প নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, সংবেদনশীল জাতীয় নিরাপত্তা তথ্যসংবলিত নথি ব্যক্তিগত করে রাখা অপরাধ। প্রথম ৩২টি অভিযোগ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা হয় ৩২টি নির্দিষ্ট নথির জন্য। যেগুলো তিনি মার-এ-লাগোতে জমা রেখেছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট মেয়াদ শেষের পরও ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। এর মধ্যে ৩১টি নথি গোপন চিহ্নিত এবং বেশির ভাগই বিদেশি সামরিক ক্ষমতা, সামরিক কার্যক্রম বা পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত।
আজ (৫ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে জোরেশোরে প্রচার চালিয়ে গেছেন ট্রাম্প। এদিকে, নির্বাচনের প্রচারের সময় দুই মাসের ব্যবধানে এই রিপাবলিকান প্রার্থীকে দুবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। গত জুলাই মাসে পেনসিলভানিয়ায় একটি নির্বাচনি সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় বন্দুকধারীর হামলার শিকার হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ সময় একটি গুলি তার ডান কানের ওপরের অংশ ফুটো করে চলে যায়। ওই হামলায় আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
এর দুই মাস পর আবারও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে এফবিআই। গত সেপ্টেম্বরে ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের গলফ মাঠের কাছে গুলির ঘটনা ঘটে। সেখানে ঝোপের পাশে ওত পেতেছিলেন আঁততায়ী। পর পর দুটি হামলার জন্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে দায়ী করেছেন ট্রাম্প।
তবে ট্রাম্পের এমন প্রতিক্রিয়া নতুন কিছু নয় বলে মনে করছেন রিপাবলিকান কৌশলবিদ জেমস ডেভিস। সম্প্রতি আল-জাজিরার বিশ্লেষণণধর্মী এক প্রতিবেদনে এমনটি উঠে এসেছে। সেপ্টেম্বরের হামলার বিষয় টেনে তিনি বলেন, এই হামলার মাধ্যমে ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচার শিবির জুলাইয়ে ঘটা হামলার কথা ভোটারদের মনে করিয়ে দিতে চায়। সূত্র: পলিটিকো, আল-জাজিরা