২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে প্রায় আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির কিংবা যুদ্ধ বন্ধের কোনো কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় ইউক্রেন এখনো রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন ধরে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুদ্ধ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এখন প্রশ্ন উঠেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কি?
হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক ভালো ছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনে আক্রমণ করত না। যুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্ন সময় জো বাইডেনের কড়া সমালোচনা করেছিলেন ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায়। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে পারতেন। তবে তিনি তার যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা ফাঁস করতে রাজি নন। কারণ, তা ফাঁস করে দিলে পরবর্তী সময়ে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে।
এবারের মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ হবে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ওয়েন। সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ডেভিড ওয়েন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে এলে যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করবেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করবেন।’
ট্রাম্প কোন উপায়ে যুদ্ধ বন্ধ করবেন সে বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত না দিলেও তার নির্বাচিত রানিং মেট (ভাইস প্রেসিডেন্ট) জেডি ভান্স যুদ্ধ বন্ধের উপায় সম্পর্কে আভাস দিয়েছেন। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে জানা যায়, সম্প্রতি ভান্স বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে অবশ্যই ওই অঞ্চলগুলো ছেড়ে দিতে হবে যেগুলো রাশিয়া দখল করে রেখেছে। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অস্ত্র ও লোকবল কোনোটিই ইউক্রেনের নেই।’ এই বক্তব্য প্রচার হওয়ার পর ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যমগুলোয় এ বক্তব্যের সমালোচনা করতে দেখা যায়।
ভান্স আরও বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। একই সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করে রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতময় সীমান্তে একটি নিরপেক্ষ অঞ্চল ঘোষণা করতে হবে এবং সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে, যাতে রাশিয়া পুনরায় ইউক্রেনে আক্রমণ চালাতে না পারে।’
রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে যেসব দাবি মেনে নিতে বলা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না এবং একটি সীমিত সামরিক শক্তি রাখবে, যা রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির কারণ হবে না। ট্রাম্পের রানিং মেটের অভিমত এদিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে।
ইউক্রেনের দাবি উপেক্ষিত থেকেই যুদ্ধ বন্ধ হবে?
ইউক্রেনের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়াকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে এগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল রাশিয়ার দখল করা ভূমি ছেড়ে দিতে হবে এবং ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া অঞ্চল ফিরিয়ে দিতে হবে।
সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘বিজয় পরিকল্পনা’ নিয়ে হাজির হয়েছেন পশ্চিমা নেতাদের সামনে। এই পরিকল্পনায় পাঁচটি দাবি জানিয়েছেন তিনি। এগুলো হলো- ১) আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে আমন্ত্রণ জানানো ২) পশ্চিমা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রুশ ভূখণ্ডে আঘাতের অনুমতি ৩) রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্রের হুমকি মোকাবিলায় ইউক্রেনকে পরমাণু অস্ত্র ধারণের বৈধতা দেওয়া ৪) ইউক্রেন সীমান্ত সংলগ্ন রুশ ভূখণ্ডে একটি বাফার জোন (নিরপেক্ষ অঞ্চল) তৈরি করা এবং ৫) ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলোর সুরক্ষা প্রদান।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ইউক্রেনের এই পরিকল্পনা কাজে আসবে না বলে মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেডি ভান্স জানিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে ইউক্রেনকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করবে ট্রাম্প প্রশাসন। যদি তা-ই হয় তাহলে ইউরোপীয় অস্ত্র সহায়তায় ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারবে না। ফলে ইউক্রেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হবে।
যদি কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় আসেন তাহলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে। কারণ, জব্দ করা রাশিয়ান বিদেশি সম্পদ থেকে সম্প্রতি ইউক্রেনকে ৫০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে জি সেভেন নেতাদের মধ্যে। ইতোমধ্যে শত বিলিয়ন ডলারের ওপর অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো।
ডেমোক্র্যাটরা জয়লাভ করলে যুদ্ধের পরিণতি কী হবে সেই সমীকরণ এখনই মিলানো যাবে না। তবে সম্প্রতি মস্কোয় ব্রিটিশ দূতাবাসের অর্থনৈতিক পরামর্শক প্রাউড এ বিষয়ে বলেন, ‘কমলা হ্যারিস মূলত বাইডেন প্রশাসনের নীতি অব্যাহত রাখবেন। অর্থাৎ ইউক্রেনের সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নে কোনো নমনীয়তা থাকবে না, যা মূলত মস্কোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় না বসা বোঝায়।’ অর্থাৎ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রকট।
ইসরায়েলের যুদ্ধে কী প্রভাব ফেলবে?
এক বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা চলমান। এই যুদ্ধের মূল অস্ত্র জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল ও ইউক্রেন- এ দুই দেশকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া খুবই ব্যয়বহুল মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে। তাই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তিনি চাইবেন যুদ্ধের পরিধি কমিয়ে আনতে। তিনি রাশিয়া থেকে যুদ্ধ শেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে মনোযোগ দিতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক বৈরী। তাই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যাতে রাশিয়ার পক্ষে যেতে পারে যুদ্ধের ফলাফল।
সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা