ঢাকা ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
English

ট্রাম্প জিতলে ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী হবে?

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৬ পিএম
ট্রাম্প জিতলে ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী হবে?
ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে প্রায় আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির কিংবা যুদ্ধ বন্ধের কোনো কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় ইউক্রেন এখনো রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন ধরে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুদ্ধ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এখন প্রশ্ন উঠেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কি?

হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক ভালো ছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনে আক্রমণ করত না। যুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্ন সময় জো বাইডেনের কড়া সমালোচনা করেছিলেন ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায়। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে পারতেন। তবে তিনি তার যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা ফাঁস করতে রাজি নন। কারণ, তা ফাঁস করে দিলে পরবর্তী সময়ে ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। 

এবারের মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ হবে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ওয়েন। সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ডেভিড ওয়েন বলেন, ‘ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে এলে যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করবেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করবেন।’ 

ট্রাম্প কোন উপায়ে যুদ্ধ বন্ধ করবেন সে বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত না দিলেও তার নির্বাচিত রানিং মেট (ভাইস প্রেসিডেন্ট) জেডি ভান্স যুদ্ধ বন্ধের উপায় সম্পর্কে আভাস দিয়েছেন। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে জানা যায়, সম্প্রতি ভান্স বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে অবশ্যই ওই অঞ্চলগুলো ছেড়ে দিতে হবে যেগুলো রাশিয়া দখল করে রেখেছে। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অস্ত্র ও লোকবল কোনোটিই ইউক্রেনের নেই।’ এই বক্তব্য প্রচার হওয়ার পর ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যমগুলোয় এ বক্তব্যের সমালোচনা করতে দেখা যায়। 

ভান্স আরও বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। একই সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করে রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতময় সীমান্তে একটি নিরপেক্ষ অঞ্চল ঘোষণা করতে হবে এবং সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে, যাতে রাশিয়া পুনরায় ইউক্রেনে আক্রমণ চালাতে না পারে।’

রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে যেসব দাবি মেনে নিতে বলা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না এবং একটি সীমিত সামরিক শক্তি রাখবে, যা রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির কারণ হবে না। ট্রাম্পের রানিং মেটের অভিমত এদিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে। 

ইউক্রেনের দাবি উপেক্ষিত থেকেই যুদ্ধ বন্ধ হবে? 

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়াকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে এগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল রাশিয়ার দখল করা ভূমি ছেড়ে দিতে হবে এবং ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া অঞ্চল ফিরিয়ে দিতে হবে। 

সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘বিজয় পরিকল্পনা’ নিয়ে হাজির হয়েছেন পশ্চিমা নেতাদের সামনে। এই পরিকল্পনায় পাঁচটি দাবি জানিয়েছেন তিনি। এগুলো হলো- ১) আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে আমন্ত্রণ জানানো ২) পশ্চিমা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রুশ ভূখণ্ডে আঘাতের অনুমতি ৩) রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্রের হুমকি মোকাবিলায় ইউক্রেনকে পরমাণু অস্ত্র ধারণের বৈধতা দেওয়া ৪) ইউক্রেন সীমান্ত সংলগ্ন রুশ ভূখণ্ডে একটি বাফার জোন (নিরপেক্ষ অঞ্চল) তৈরি করা এবং ৫) ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলোর সুরক্ষা প্রদান। 

ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ইউক্রেনের এই পরিকল্পনা কাজে আসবে না বলে মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেডি ভান্স জানিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে ইউক্রেনকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করবে ট্রাম্প প্রশাসন। যদি তা-ই হয় তাহলে ইউরোপীয় অস্ত্র সহায়তায় ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারবে না। ফলে ইউক্রেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হবে। 

যদি কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় আসেন তাহলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে। কারণ, জব্দ করা রাশিয়ান বিদেশি সম্পদ থেকে সম্প্রতি ইউক্রেনকে ৫০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে জি সেভেন নেতাদের মধ্যে। ইতোমধ্যে শত বিলিয়ন ডলারের ওপর অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। 

ডেমোক্র্যাটরা জয়লাভ করলে যুদ্ধের পরিণতি কী হবে সেই সমীকরণ এখনই মিলানো যাবে না। তবে সম্প্রতি মস্কোয় ব্রিটিশ দূতাবাসের অর্থনৈতিক পরামর্শক প্রাউড এ বিষয়ে বলেন, ‘কমলা হ্যারিস মূলত বাইডেন প্রশাসনের নীতি অব্যাহত রাখবেন। অর্থাৎ ইউক্রেনের সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নে কোনো নমনীয়তা থাকবে না, যা মূলত মস্কোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় না বসা বোঝায়।’ অর্থাৎ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রকট। 

ইসরায়েলের যুদ্ধে কী প্রভাব ফেলবে?

এক বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা চলমান। এই যুদ্ধের মূল অস্ত্র জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল ও ইউক্রেন- এ দুই দেশকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া খুবই ব্যয়বহুল মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে। তাই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তিনি চাইবেন যুদ্ধের পরিধি কমিয়ে আনতে। তিনি রাশিয়া থেকে যুদ্ধ শেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে মনোযোগ দিতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক বৈরী। তাই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যাতে রাশিয়ার পক্ষে যেতে পারে যুদ্ধের ফলাফল। 

সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: মৌলিক প্রাধিকার বনাম সংস্কার

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৮ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: মৌলিক প্রাধিকার বনাম সংস্কার
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। সেই সরকার কয়েকদিন হলো তাদের ১০০ দিন পূর্ণ করেছে। অনেকেই এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন। সরকার কী অর্জন করল, কী কী সমস্যার সম্মুখীন হলো- সেসব নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্নরকম কথাবার্তা বলেছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন অগ্রগতি হলো ইত্যাদি। সেখানে প্রথম কথা হচ্ছে- আমাদের বৈদেশিক নীতি বা বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ যে অবস্থা তার থেকে বৈশ্বিক সম্পর্কগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো সবই আমাদের বহিঃসম্পর্ককে বড় আকারে প্রভাবিত করে। সেদিক থেকে আমাদের আগে বুঝতে হবে যে, আমাদের দেশের ভিতরে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে? আমরা আসলে কী চাচ্ছি? কারণ বৈদেশিক নীতিতে আমাদের বেশ কিছু চাহিদা আছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ আছে। বিভিন্ন বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে সেগুলোকে অর্জন করতে হবে। সে লক্ষ্যে সফলতা অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে হবে। সুতরাং, আগে আমাদের বুঝতে হবে দেশের ভিতরে কী হচ্ছে?

বর্তমান সরকার অনেককিছু করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলেছে। বস্তুত, যে বিষয়গুলো সরকারের সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত, সেখানে দৃশ্যত তাদের সাফল্য খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ছে। মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ছে। যারা সরকার চালাচ্ছেন তাদের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতা ও অস্থার অভাব বিরাজ করছে। তাদের কথাবার্তার ভিতর দিয়েও সেটা প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারের মূল শক্তি সাধারণ মানুষ এবং তারা গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের মূল শক্তি। সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশে একটি পরিবর্তন এসেছে। এখন পর্যন্ত জনগণের খুশি হওয়ার মতো তেমন কিছু হয়নি। তারা ক্রমাগত অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে- খাদ্যসামগ্রীসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। সেখানেও মানুষ ভীষণভাবে নিরাশ। বস্তুত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বরং অবনতি ঘটছে।

প্রশাসন পরিচালনায় নতুন গতির সঞ্চার হয়নি। সেখানে এক ধরনের স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অভ্যাসগতভাবে কিছু কিছু পরিষেবা হয়তো সরকার দিচ্ছে। এটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু যে গতি থাকার কথা, সেরকম কিছু কার্যত দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও নানান ধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। সেসব কারণে বর্তমান সরকার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে এগিয়ে যেতে পারছে না। ফলে, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অনেকেই মনে করছেন, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আসলে সরকার মৌলিক সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার না দিয়ে সংস্কার নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ সংস্কারই সময়সাপেক্ষ ও চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের মধ্যে কেবল মাত্র নির্বাচনব্যবস্থার উপযুক্ত সংস্কার প্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি এবং বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে এক ধরনের লোক দেখানো প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের সরকারপ্রধান বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। সরকারের বিভিন্ন স্তরের লোকজন যেমন- প্রধান উপদেষ্টা, পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা, আইনবিষয়ক উপদেষ্টা- এরা সবাই সম্প্রতি দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন সম্মেলনে যোগদান করেছেন। সেখানেও তাদের কথাবার্তা, তাদের পারফরমেন্স নতুন করে খুব একটা আশাব্যাঞ্জক কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না।

এখন খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে- সরকারকে ভালো করে আবার সব বিষয়ে চিন্তা করে দেখার! দেশের অভ্যন্তরীণ যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলোর প্রাধিকার নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাহলেই কেবল আমাদের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন গতি সঞ্চার হবে। তবে একটা কথা বলতেই হবে, আর তা হলো, আমাদের একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। তার ফলে আমাদের বৈশ্বিক সম্পর্কগুলোর মধ্যেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের নতুন সরকার আসার পরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে এক ধরনের নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এই নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন। এর ফলে আমাদের সম্পর্কে যে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছিল, সেই গতি কিছুটা স্থিমিত হতে পারে। অন্যদিকে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের মানোন্নয়নে সরকার চেষ্টা করছেন। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরপরই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। সেই টানাপোড়েনটা কমিয়ে ফেলা যায় কীভাবে, সরকার সেই চেষ্টা করছে এবং আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। ভারতের দিক থেকেও চেষ্টা হচ্ছে যে, এই সম্পর্কটা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা যায় কীভাবে? যদিও খুব বেশি অগ্রগতি এখনো হয়নি। তবে সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে মনে হয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে বড় রকমের কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। এই পরিবর্তনের ফলে বড় কোনো চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়নি- তবে সেখানে নতুন করে আবার উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপার আছে। আমাদের বড় রকমের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সবকিছুর মধ্যে নতুন করে শুরু করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

সে ক্ষেত্রে একইরকমভাবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার ব্যাপারেও আলাপ-আলোচনা করে সহযোগিতার কার্যক্রমগুলো নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। সেদিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারে আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যথেষ্ট সচেতন রয়েছেন এবং সেভাবেই চেষ্টা করছেন। মনে রাখতে হবে, এটা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমাদেরও কিছুটা সময় দিতে হবে। বিশেষ করে, অভ্যন্তরীণ যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলো সরকারকে মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করতে হবে। সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য সরকারকে প্রাধিকার ভিত্তিতে জনগণের মৌলিক চাহিদার বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসব অগ্রাধিকারগুলো মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। এসব বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ১০০ দিন মানে যে বিশাল একটা লম্বা সময়, তা না হলেও এটা খুব কম নয়। অনেকেই সময়টুকু মাইল ফলক হিসেবে ধরেন। সেজন্য এটা নিয়ে অনেক বেশি আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমাদের যে বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, তার ফলে সরকারকে সম্মিলিতভাবে আরও কিছুদিন সময় দিতেই পারি! সরকার যেন তাদের রোডম্যাপটা ঠিক করতে পারে এবং সে ব্যাপারে ঘোষণা দিতে পারে। তাহলে মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করবে। সে দিনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং আমরা অপেক্ষা করে আছি! ১০০ দিন পার হওয়ার পর আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি কিছুটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, আমরা কোন দিকে যাচ্ছি। বর্তমানে সরকার কীভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে। তিনি যেমন আশার বাণী শুনিয়েছেন, তেমন নিজেরাও যথেষ্ট সন্তুষ্ট মনে হয়। তার এবং অন্যান্য উপদেষ্টার কথায় প্রায়ই নৈরাজ্য, অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে। এ ইতিবাচক দিক হচ্ছে নিজেদের দুর্বলতা সম্বন্ধে সরকারের সচেতনতা। সে জন্য আমরা আশান্বিত হতে পারি। সরকার তাদের সমস্যাগুলো বুঝতে পারছে এবং তা সমাধানে সচেষ্ট থাকবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. সদরুল আমিন শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২২ পিএম
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশের শিক্ষা সংস্কারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী- এসব বিষয় নিয়ে খবরের কাগজকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র সহসম্পাদক সানজিদ সকাল

খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের বড় একটি সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। শিক্ষা সংস্কারে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? 

ড. সদরুল আমিন: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শিক্ষা সংস্কার অবশ্যই জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভিসি ছিলেন তাদের স্থলে নতুন করে যোগ্য ভিসি নিয়োগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাদের হওয়া উচিত যারা অত্যন্ত মেধাবী, কর্মঠ এবং দক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার ভিত্তিতে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। যেসব শিক্ষক রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের পুনরায় উপযুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধা যাচাই করে নির্বাচন করা উচিত। সবচেয়ে বড় যে বিষয় তা হলো- শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যদি ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া না হয়, তাহলে মেধাবীরা এই মহৎ পেশায় আসতে চাইবে না। তবে শিক্ষকদের জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।  

খবরের কাগজ: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ জরুরি হয়ে উঠেছে, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।  

ড. সদরুল আমিন: বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণা ও আর্টিকেলগুলো প্রকাশ করা হয়, যা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি বিশেষ করে পিএইচডি ও এমফিল-এর যত গবেষণা ও আর্টিকেল আছে তা সংরক্ষণ করা উচিত। কেউ যদি দেশের বাইরে গিয়েও গবেষণা করতে চায় সরকারের উচিত তাদের সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।  
 
খবরের কাগজ: শিক্ষা-সংস্কার ও কমিশন গঠন কেন জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

ড. সদরুল আমিন: শিক্ষাব্যবস্থা একদম ভেঙে পড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের শিক্ষানীতি এমনভাবে করতে হবে যাতে সবাই তা দেখতে ও বুঝতে পারে। সেখানে রাজনীতির কোনো বিষয় থাকবে না। মেধার বিকাশ ঘটানোর জন্যই শিক্ষা সংস্কার করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগও মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক আছেন তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক উচ্চতর গবেষণার জন্য বিদেশে গেছেন তাদের পর্যাপ্ত সুবিধা দিয়ে দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে দেশের মানুষের উপকার হবে। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বিদেশে গবেষণা করতে গিয়ে আর দেশে ফিরে আসেন না। এটা মোটেও ঠিক না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চতর গবেষণা শেষে তাদের অর্জিত জ্ঞান দেশের তরুণদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। অনেক শিক্ষক বিদেশে যেসব বিষয়ে গবেষণা করছেন এবং তদের সেই থিসিস আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জমা দেন না। ফলে এ দেশের শিক্ষার্থীরা জানতে পারে না তাদের গবেষণার বিষয় কী ছিল। তাই বিদেশে যারা গবেষণা করছেন তাদের প্রকাশনা অবশ্যই দেশে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।  

খবরের কাগজ: ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? সাম্প্রতিককালে আপনি মানবিক অবক্ষয় লক্ষ্য করছেন কিনা?
 
ড. সদরুল আমিন: শিক্ষক হিসেবে আমি সব সময় ছাত্রদের পাশে থেকেছি। শিক্ষকদের অবশ্যই সব ছাত্রকে একনজরে দেখা উচিত। ছাত্রদের প্রতি কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করা উচিত নয়। শিক্ষকদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিলে অবশ্যই তারা ক্লাসে মনোযোগ দেবেন। শিক্ষকরা যখন ছাত্রদের সঙ্গে সময় দেবেন, তখন  ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি ব্যাংকের চাইতেও খারাপ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা আজ ভালো নেই। যারা সিভিল সার্ভিসে চাকরি করছেন, সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে আছেন তাদের সঙ্গে তুলনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মান ও আর্থিক সুবিধা কোনোটায় নেই। যে কোনো সার্ভিসেই শিক্ষক থাকুক না কেন, তাকে অবশ্যই সর্বোচ্চ সম্মানি ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিটি যেন শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী হয়ে ওঠে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। 

খবরের কাগজ: শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে মানবিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? 

ড. সদরুল আমিন: ছাত্ররা কোনো শিক্ষককে প্রকৃত শিক্ষক মনে করলে সেই ছাত্ররা কখনোই তার স্যারের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে পারে না। কোনো ছাত্রই খারাপ নয়। সব ছাত্রই শিক্ষককে সম্মান করে। কোনো ছাত্রই শিক্ষককে অসম্মান ও অমর্যাদা করতে পারে না। যদি কোনো ছাত্র শিক্ষককে অসম্মান করে তাহলে বুঝতে হবে তার পেছনে কোনো রাজনীতি নিহিত আছে। এখানে আমি ছাত্রের মধ্যে তেমন দোষ খুঁজে পাই না। দোষ রাজনীতির, দোষ সমাজের। বাংলাদেশে এমন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ছাত্রদের কেউ খারাপ কাজে ব্যবহার করতে না পারে। 

খবরের কাগজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি কতটুকু প্রয়োজন বলে আপনি মনে করছেন? 

ড. সদরুল আমিন: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতি অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি করার মতো সুস্থ পরিবেশ থাকা দরকার। রাজনীতিকে অপব্যবহার করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পরিবর্তন আনা দরকার। যদি আবাসিক হলগুলোতে পুরনো ধারাই অব্যাহত থাকে, তাহলে আবারও ছাত্ররা রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে খারাপভাবে ব্যবহার করবে। সবকিছু গণতান্ত্রিকভাবে হওয়া উচিত। ছাত্ররা রাজনীতি না করলে দেশে রাজনীতিবিদ কারা হবে? কিন্তু রাজনীতিরও একটা সীমা থাকা উচিত। ছাত্ররাই তো সবকিছু করবে। ছাত্ররা হলে মারামারি করবে, হল দখল করবে এগুলো ছাত্ররাজনীতির মধ্যে পড়ে না। ছাত্ররা সেমিনার করবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরবে- এমন রাজনীতি হওয়া উচিত। ছাত্ররাজনীতির  দরকার আছে। অনেক সময় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার সময়ও ছাত্ররা উচ্চ শব্দে মিছিল করেছে ও গান বাজিয়েছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। ছাত্রদের অবশ্যই সহনশীল হতে হবে। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ছবি নিয়ে আগে অনেক গণ্ডগোল হতো, আমরা উদ্যোগ নিয়ে সেগুলো বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। অবশেষে মারামারি বন্ধ হয়েছে। আমি ছাত্রদের যা বলেছি ওরা সব শুনেছে, কোনোদিন আমার অবাধ্য হয়নি ছাত্ররা। আমি যদি পরীক্ষার হলে থাকি কোনো ছাত্রনেতাও নকল করবে না, চুপচাপ পরীক্ষা দেবে। সেটাই আমি দেখেছি। শিক্ষকরা  যদি পরীক্ষার হলে বসে থাকে, ছাত্রদের সুযোগ তৈরি করে দেয়, তাহলে ছাত্ররা সুযোগ তো নেবেই। আমরা মানুষ, ফেরেস্তা না, সুযোগ দিলে সবাই সুযোগ নিতে চায়। শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে, যাতে তারা অনৈতিক কোনো কাজ না করে।

খবরের কাগজ: বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে মাঠে আন্দোলনে নেমেছে, এই বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন? 

ড. সদরুল আমিন: বর্তমানে দেশে যে আন্দোলনগুলো হচ্ছে তার উৎস কোথায় আমাদের বুঝতে হবে। দেশে এখন যত আন্দোলন হচ্ছে তার বেশির ভাগই রাজনৈতিক। আন্দোলনগুলো হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য। যারা কোনোদিন দাবি তোলেনি, তারাও এখন দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। এসব আন্দোলন আইনশৃঙ্খলা বাহিহীকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা মোটেও ঠিক হয়নি। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি অবশ্যই ক্ষুণ্ন হয়েছে। সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় জরিপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং অনেকটা নিচের দিকে নেমে গেছে। যে সরকার সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করেছে তারা যে কেন করেছে তার কারণ আমি আজও খুঁজে পাই না। বর্তমানে যেসব কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি উঠেছে, সরকারের সেসব কলেজ নিয়ে চিন্তা করা উচিত। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তুললেই হবে না। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অবকাঠামোর দরকার হয়। দেশে এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে তেমন অবকাঠামো নেই। এমন বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে দরকার নেই। তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দেশের পুরাতন ভালো কলেজ ও অন্যান্য কলেজ নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। সাত কলেজের জন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। ইডেন কলেজ, হোম ইকোনোমিক্স,বদরুন্নেসা ও অন্যান্য কলেজ নিয়ে মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। অন্যদিকে ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ অন্যান্য কলেজ নিয়ে ছেলেদের জন্য স্বতন্ত্র কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় করতে হলে অনেক জায়গার প্রয়োজন হয়। ঢাকার মধ্যে সুন্দর জায়গা নির্বাচন করাটাও বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোকে নিয়ে পুনরায় ভাবা উচিত। 

খবরের কাগজ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ড. সদরুল আমিন: খবরের কাগজকেও ধন্যবাদ।

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১২ পিএম
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার বিপ্লব এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এই বিপ্লব প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে আকস্মিক বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছরের ইতিহাসে শেখ হাসিনার শাসনামলকে নজিরবিহীন স্বৈরতন্ত্র চর্চার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। বিশেষ করে হাসিনা সরকারের শাসনামল মৌলিকভাবে বিপরীত দিকে চলে গিয়েছিল। গুম, খুন, হত্যা, গায়েবি হামলা, নির্যাতন  প্রতিদিনের বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সর্বত্র নানারকম অত্যাচার হয়েছে। মানুষকে ন্যায়নীতিহীন দুঃসহ যাতনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। কোথাও কোনো নিয়মনীতি ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষ মুখ বুজে সহ্য করছিল। কিন্তু আর নিতে পারছিল না। অনেকদিন থেকেই সাধারণ মানুষের মনের কথা ছিল যে, মানুষ পরিবর্তন চায়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নানারকম আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথ আন্দোলন সংগঠিত করতে পারছিল না। রাজনৈতিক দলগুলো যা দেখাতে পারেনি ছাত্ররা বেপরোয়া সাহস দেখিয়ে মানুষকে সাহসী করে তুলেছিল। সে কারণে জনগণ তাদের সঙ্গে মাঠে নেমে এসেছিল। একপেশে পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভর করে এতদিন শেখ হাসিনার শাসন টিকে ছিল। সেই স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে ভেঙে পড়ায় দ্রুত সরকারের পতন হয়। আবু সাঈদ এবং অন্য অনেকের আত্মত্যাগ ও সাহস সেই ভয়কে ভেঙে দেয়। ভয় ভেঙে যাওয়ার এই মনস্তাত্ত্বিক উত্তরণ সরকারের পতন ঘটায়। ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয় জনতা। সরকার এতদিন তাসের ঘরের মধ্যে ছিল। শুরুতে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যদিয়ে সরকারকে যেতে হয়েছে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। একই সঙ্গে তা কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারের প্রধান কাজ ছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া। সরকারের উচিত ছিল মানুষের সঙ্গে কথা বলা। জনগণের কাছে যাওয়া। তাদের কথা শোনা অর্থাৎ ব্যাপকভাবে জনবান্ধবমূলক উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। জনগণের আস্থাভাজন হতে এই কাজগুলো করা দরকার ছিল। এটা একটা রাজনৈতিক কাজ। একথা সত্যি যে, এই সরকার প্রচলিতভাবে রাজনৈতিক সরকার না হলেও তাদের কাজটা রাজনৈতিক। যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই পরিবর্তন নেতারা আনেননি। এই পরিবর্তন দেশের আমজনতা এনেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ জরুরি ছিল। 

পতিত স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে আমলাতন্ত্র- সবখানেই তাদের সহচর রয়ে গেছে। তাদের পাল্টা আঘাত হানা এবং বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করা আমরা দেখেছি। কাজেই সেটি মোকাবিলা করাও একটি বড় কাজ ছিল; যা সরকার মোকাবিলা করেছে। কিন্তু গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগানোর বৃহত্তর কাজটি হলো কিনা, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের অর্থনীতি মূলত চলে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। তারা সক্রিয় হবে কিনা, তা নির্ভর করবে তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে কিনা, তার ওপরে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খোলামেলা এনগেজমেন্ট কোথায়? ব্যবসায়ী মানে শুধু এফবিসিসিআই নয়। সাধারণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের উদ্যোগ তো দেখছি না। সংকট সামাল দেওয়া একটা প্রায়োগিক কাজ। এটা তাদের করতে হবে। অর্থনীতির মূল কাজ আস্থা তৈরি ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি। বিবেচনা করতে হবে সরকার কাজটি করছে কিনা। দেশের মানুষ নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে চাইছে। তাদের নিয়ে আমরা কীভাবে এগোব, সেই কার্যকর উদ্যোগ দরকার ছিল। উপদেষ্টাদের মাঠে-ময়দানে বেশি করে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের দেখতে পেলে বুঝতে পারবে, সরকার কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে সেটা দেখা যাচ্ছে না। 

এখন মূল সমস্যা হচ্ছে, এই সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার স্টাইলে। সবার আগে সরকারের নিজেকেই একটা বড় ঝাঁকুনি দিতে হবে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। জনগণের কাছে যাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এটা সাধারণ মানুষের বড় উদ্বেগ। কোটা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান; কিন্তু কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করলে আমরা কী উত্তর দেব জানি না। এ ব্যাপারে মনোযোগ কোথায়, উদ্যোগ কোথায়? সরকারকে অনেক দ্রুততার সঙ্গে কাজটি করতে হবে। বন্যার পর সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমলাতান্ত্রিকভাবে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে দুই বছর বসে থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের এখনই কৃষকদের বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ দিয়ে দিতে হবে। আমাদের দেরি করার সময় নেই। 

দুর্নীতি ও নিষ্ঠুরতা, মানুষের প্রতি অত্যাচার, সীমাহীন পর্যায়ে গিয়েছিল। তিনটি আকাঙ্ক্ষা এখানে সর্বজনীন। প্রথমত, দৈনন্দিন সমস্যার সহনীয় সমাধান ও সমাধানের দৃশ্যমান ও কার্যকর চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, স্থিতিশীল পরিবেশ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অন বোর্ড রাখতে কার্যকর বয়ান নির্মাণ। তৃতীয়ত, টেকসই ও নৈতিকতার ছাপ আছে এমন রাজনৈতিক উত্তরণের রোডম্যাপ তৈরি। অন্তর্বর্তী সরকার আলাদা আলাদা অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে; কিন্তু এসব উদ্যোগ সামগ্রিক কোনো আস্থার পরিবেশ তৈরি করছে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের স্টাইল দৃশ্যত আমলা, বিশেষজ্ঞ ও ছাত্রদের ওপর অতি নির্ভরশীলতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে। শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি; কিন্তু অনেক ছোটখাটো দুর্নীতির বিষয় নিয়ে সরকারকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।

রাজনৈতিক উত্তরণের টেকসই ও কার্যকারিতার বিবেচনায় এ মুহূর্তে পদে আসীন ব্যক্তির যোগ্যতার চেয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বহু গুণ বেশি বিবেচ্য বিষয়। তবে পদে আসীন ব্যক্তির কোনো হঠকারী প্রচেষ্টার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখাও জরুরি। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি একটি লক্ষ্য হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার ভারসাম্য। যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি পদটির দায়িত্ব ও ক্ষমতার একটি কার্যকর পর্যালোচনা ও সঠিক করণীয় নির্ধারণ। এটি গভীর মনোযোগের দাবি রাখে। সংবিধান সংস্কার নিয়ে একটি কেতাবি আলোচনা বেশ বেগবান হয়েছে। শূন্য থেকে শুরু করা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। সাংবিধানিক শূন্যতা রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য মারাত্মক হুমকি। মানুষের মর্যাদার অধিকারগুলো সংজ্ঞায়িত ও যুক্ত করে সংবিধানের ধারাগুলো সাজাতে হবে। ৫ আগস্টের পর যে শব্দটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে ন্যায়বিচার বা জাস্টিস। সর্বোতভাবে এটি নিশ্চিত করতে হবে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার পাশাপাশি একই সঙ্গে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে সমন্বয় করে আমাদের কাজ করতে হবে। 

সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য ফেরানো একটি জরুরি কাজ হলেও বৃহত্তর কাজ হচ্ছে অর্থনীতির চাকাকে আরও চাঙা অবস্থায় ফেরানো। যাতে কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত হতে পারে। বিনিয়োগ বাড়তে পারে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় করার জন্য বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি হতে পারে। আইএমএফের কয়েক বিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ শত শত বিলিয়নের সম্ভাবনার দিকেই নজর দিতে হবে। তা দিতে হবে কার্যকরভাবে, শুধু ঘোষণা ও আমলাতান্ত্রিক আশ্বাসের মধ্যদিয়ে নয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি থেকে সহায়তা পাওয়া অবশ্যই স্বস্তির জায়গা। বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রকট দুর্বলতাগুলো কাটাতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে মনে হয়।  

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কীভাবে সংশোধন করবে, বাংলাদেশকে নিজের জন্য একটি মানসিক রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম বার্তা হচ্ছে- বাংলাদেশ কোনো ধরনের আধিপত্যবাদী চাপ বরদাশত করবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক আর আধিপত্যবাদী চাপকে রুখে দাঁড়ানো- এ দুটি আলাদা বিষয়। আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অবশ্যই সুসম্পর্ক রক্ষা করব এবং একই সঙ্গে কোনো আধিপত্যবাদী মনোভাবকে মেনে নেব না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরা এবং এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আমাদের ঠিক করতে হবে বাংলাদেশকে আমরা কোথায় নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতীকে পরিণত হওয়া কোনো অলীক কল্পনা নয়। তৃতীয়ত, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সংকীর্ণ মাইন্ডসেটআপে আবদ্ধ রয়েছি। এই মানসিক পরিসর বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের মানসিক শক্তির যে বিকাশ ঘটেছে, এখন থেকে বৈশ্বিক দক্ষিণকেও আমাদের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং ধাপে ধাপে বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্যতম জাতিরাষ্ট্রে উন্নীত করতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে জনগণের মনে অনেক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে সুযোগও তৈরি হয়েছে। সরকার যাতে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালোমতো সেই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারে, আমাদের সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে চেষ্টা করে যেতে হবে। 

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি

স্থিতিশীল রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে হবে

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম
স্থিতিশীল রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে হবে
প্রচ্ছদ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

যেকোনো দেশে নতুন সরকার যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন তিন মাস বা ১০০ দিনের মাথায় তার সাফল্য-ব্যর্থতার একটা মূল্যায়ন করা হয়। সরকার চমৎকার কোনো কাজ করেছে কিনা, সে ব্যাপারে সবার জানার আগ্রহ থাকে। বিশেষ করে, এ ব্যাপারে মিডিয়ার এক ধরনের কৌতূহল আছে। সরকারের কর্মতৎপরতা কেমন সেটা অনেকেই চিন্তা করে এবং বুঝতে চায়। এর ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের দিনগুলো কেমন হবে, সে সম্পর্কে আন্দাজ বা অনুমান করতে চায়। বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের চরিত্র, ম্যান্ডেট, তার কর্মকাণ্ড সাধারণ সময়ে ইলেকশনের পর যে সরকার গঠিত হয় তার সঙ্গে তুলনা চলে না। এই সরকার যখন দায়িত্বগ্রহণ করে তখন বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদ্যমান ছিল এবং এখনো আছে আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচারবিভাগ, বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক বাহিনী। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথাও ভাবতে হবে। ইউজিসির কথা ভাবতে হবে। এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং যেগুলোর শক্তির ওপরে একটা রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে। বিগত শেখ হাসিনার স্বেচ্ছাচারী এবং ফ্যাসিস্ট সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যেমন- ৫ আগস্টের পর পুলিশ প্রশাসনের সবাই পালিয়ে গেল। মুষ্টিমেয় সদস্য ছাড়া তাদের কোথাও কর্মস্থলে পাওয়া গেল না। পুলিশের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারাও এই আন্দোলনের সময় ছাত্রহত্যা-জনহত্যার জন্য দায়ী- এরকম অনেকেই আছে। সাধারণ যারা পুলিশ অফিসার, তারাও আছে এবং তারা এসব কর্মকাণ্ড করার ফলে তাদের মনোবল সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে। ফলে ডিউটি করতে আসার ব্যাপারে তাদের অনীহা ছিল- শুরুতেই  তারা পালিয়েছিল। যাই হোক, সরকার তাদের ফিরিয়ে আসার আহ্বান জানালে একই সঙ্গে অভয় দিলে তাদের একাংশ কাজে যোগ দিয়েছে। যতদূর জানি, অনেক পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি। পুলিশ বাহিনী বিধ্বস্ত হয়েছে। ফলে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার যে রাস্তা, সেই কাজটা হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে।

আমলাতান্ত্রিক হাসিনা সরকার দলীয়করণ করার জন্য তার প্রতি, তার আদর্শের প্রতি, তার রাজনীতির প্রতি কারও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়নি, যেটা আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পেয়েছি। তিনি তার অনুগতদের পদায়ন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। ফলে এখানে একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই দলের লোকেরা এসেছে। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এই বিপ্লবের বা এই পরিবর্তনের বিরোধী লোক যারা তারা আছে। এবং তারা সরকারের কাজকে সফল হতে নানারকম সমস্যা অর্থাৎ বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। এটা হচ্ছে আমলাতন্ত্রের ব্যাপার। যেখানে আবার তাদের বাদ দিয়ে নতুন মুখ বসানো, নতুন ব্যক্তিকে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া- এটাও একটা বিরাট সমস্যা। এই সমস্যার কিছুটা অর্থাৎ ২০ শতাংশ বা ৩০ শতাংশ তারা পরিবর্তন করতে পেরেছে। কিন্তু পুরাটা এখনো পারেনি। এজন্য সময় লাগবে। ফলে, সব সময় শঙ্কা লেগে থাকে। এই সরকার ইতোমধ্যেই সম্মুখীন হচ্ছে ছোট ছোট বিক্ষোভ, আন্দোলন ইত্যাদি নানারকম অস্থির পরিবেশের। এটা দুই কারণে হচ্ছে- একটা কারণ হলো, এখন মানুষ অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছে। আগে, কেউ কথা বলতে, বিক্ষোভ বা রাস্তায় মিছিল করতে পারত না। যেটা বিগত শেখ হাসিনার আমলে ছিল। পাশাপাশি যেটা হচ্ছে, তা হলো এ ধরনের ঘটনার কারণে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে মানুষ মনে করছে, সরকার মনে হয় ঠিকমতো দেশ চালাতে পারছে না। ব্যাপারটা এমন নয়। আমরা উল্লেখ করতে পারি, যেমন- ঢাকা শহরে সাতটি বড় কলেজের ছাত্ররা আন্দোলন করল। তারা চাইল যে, তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক। যেহেতু তাদের পরীক্ষা সময়মতো হয় না। ফলাফল ঠিকমতো হয় না বলেই তারা একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চায়। তারা এখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে সেই বিশ্ববিদ্যাল কাজ শুরু করবে কয়েক বছর পর। সুতরাং, এই দাবিগুলো উঠেছে দাবির যথার্থতা বিচার না করেই। এ ছাড়া আমরা দেখলাম আনসারদের একটা দল, তারা গোলোযোগ সৃষ্টি করল। এরকম উল্লেখ করলে ছোট ছোট বহু ঘটনা আছে যা ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা। যেমন- গার্মেন্টশিল্পে অশান্তি লেগেই আছে। এই সরকার নিষ্ঠুর আচরণ করতে চায় না বলেই এই আন্দোলনগুলো হচ্ছে। এটার প্রভাব সমাজের বিভিন্ন স্তরে, দেশের বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে। তার পরও এই সরকার যে কাজগুলো করেছে বা করছে, তার ফলে মোটামুটি এবং ধীরে ধীরে প্রশাসনব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এই ১০০ দিনে আমরা সরকারের কাছ থেকে অন্তত নতুন ধরনের কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সহসা আশা করি না। আমরা যেটা আশা করি, সেটা হচ্ছে, একটা রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রযন্ত্র অ্যাটাক্ট করতে শুরু করেছে। এটাই হলো সরকারের সাফল্য। তারা অ্যাটাক্ট করতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে তারা সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করে। আমি জানি, বিগত সরকারের উচ্চতর পদে যারা আসীন ছিলেন তাদের  অনেকের পলায়ন করেছেন। পদগুলো শূন্য হয়ে পড়ে আছে। এমনিতে বাহ্যিকভাবে মনে হয় সরকারের গতিটা খুবই ধীর। এই গতিটা বাড়ানো দরকার। গতিটা বাড়াতে পারলে কাজের গতিও অনেক বাড়বে এবং কর্মকাণ্ড ভালোভাবে হবে। এ ছাড়া দু-তিনটি মন্ত্রণালয় তারা বেশ ভালো করছে তাদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে। যেমন- এনার্জি সেন্টারে ভালো হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আসার যে লক্ষণ সেগুলো ভালোই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাচ্ছে বলে আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়ছে। এর ফলে রিজার্ভের যে সংকট ছিল সেটা কিছুটা হলেও কেটেছে। সামনে যদি এই ধারাটা অব্যাহত থাকে, আশা করা যায় আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভালো হবে। বিশেষ করে ফরেন রিজার্ভ মসৃণ হবে। দ্রব্যমূল্য বা যেসব সমস্যা দিন দিন প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে, এই সমস্যার শুরু তো বর্তমান সরকারের আমলে হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঊর্ধ্বমুখী দাম আওয়ামী লীগের আমল থেকেই শুরু হয়েছে। চার-পাঁচ বছর ধরেই এই মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা ঘটছে। আশা করি, তারা এদিকে নজর দেবেন। বিশেষ করে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ যাতে ভালো থাকে সেটার জন্য তারা যেসব ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব সেগুলো নেবে- এটাই দেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া।

সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যেমন- সম্প্রতি যাদের উপদেষ্টা হিসেবে নেওয়া হলো তাদের নিয়ে নানারকম কথাবার্থা হচ্ছে। বিশেষ করে দুজন উপদেষ্টা সম্পর্কে যথেষ্ট আপত্তি গণমাধ্যমে দেখা গেছে। এই অভিযোগগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সরকারকে এজন্য সাবধান হতে হবে। কাকে কী দায়িত্ব দিচ্ছে, কেমন ধরনের লোককে দায়িত্ব দিচ্ছে, তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অনুভূতিটা কেমন? সাধারণ মানুষ বিষয়গুলো কী চোখে দেখছে। এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। উপদেষ্টা পরিষদ যে দায়িত্ব নিয়েছে তা সংস্কার করা প্রয়োজন। একটা ভালো নির্বাচন করতে গেলেও যে সংস্কারগুলো তারা করতে চায়, এ সংস্কারগুলো করা প্রয়োজন। সংস্কারমূলক কাজের জন্য যে কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে তারা কাজকর্ম শুরু করেছে, আমরা আশা করব, এগুলো খুব দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হবে। একই সঙ্গে একটা নির্বাচন সামনে হবে। সেই নির্বাচনের আগেই যদি সংস্কারগুলো হয়ে যায় তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও ভালো হবে। অন্তর্বর্তী সরকার মানেই হচ্ছে খুব বেশি সময় তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকবে না। তারা একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। নির্বাচিত সরকারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাবে। তারও আগে সংস্কারের মাধ্যমে একটা স্থিতিশীল রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করবে- এটাই হচ্ছে তাদের সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা। 

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

গণপরিষদ নির্বাচন করে রাষ্ট্র গঠন করুন

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৩ পিএম
আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
গণপরিষদ নির্বাচন করে রাষ্ট্র গঠন করুন
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

‘জুলাই বিপ্লব’ বা ‘আগস্ট বিপ্লব’ ইত্যাদি নানা নামে বলা হচ্ছে বটে, তবে এর রাজনৈতিক চরিত্রটা বোঝা আমাদের বিশেষভাবে জরুরি। এই বিপ্লব মর্মের দিক থেকে ব্যক্তির স্বাধীন সত্তা এবং রাজনৈতিক আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। ব্যক্তির অধিকার ও পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যই এই অভ্যুত্থান। এটা কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নয়। কীভাবে ‘রাজাকার’ বলায় তরুণরা অপমানিত বোধ করেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা অভ্যুত্থানটা করে ফেলতে পেরেছে। এটা দেখে আমি অভিভূত।

প্রথমত, এটা অসাধারণ ঘটনা। অভূতপূর্ব, সব অর্থেই। ভূ-রাজনীতি, বিশ্ব ইতিহাস, স্থানীয় রাজনীতি- সবদিক থেকেই এটা একেবারে নতুন ধরনের ঘটনা। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব হয়েছে। যেখানে ফিউডাল শ্রেণিকে পরাস্ত করে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছে। এখানে কিন্তু আরও বড় ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়েছিল। নিউ লিবারেল ইকোনমিক অর্ডারের মাধ্যমে একে গড়ে তোলা হয়েছে। সিকিউরিটির অজুহাতে একটা হিংস্র রাষ্ট্র আমরা দেখেছি, র‍্যাব তৈরি করা হয়েছে, নির্যাতনের বহুরকম পদ্ধতি বের করা হয়েছে। ফলে এই গণ-অভ্যুত্থান তো হওয়ারই কথা!

বিএনপিকে বোঝানো দরকার, জনগণ মৌলিক পরিবর্তনের জন্য তৈরি। বিএনপি বারবার ভুল করছিল এবং বারবার পিছিয়ে পড়ছিল। তারা কখনো রাজনীতিকে- অর্থাৎ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দেয়নি। তারা সব সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে। জনগণ যে মৌলিক পরিবর্তন চায়, এটা কেন তারা বোঝেনি, সেটা এখনো আমার কাছে রহস্য।

এখন আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই অভ্যুত্থানের শুরুতে বিএনপি কিছুটা বিভ্রান্ত থাকলেও পরে তারা বিচক্ষণ একটা পজিশন নিয়েছে। এখন তারা বর্তমান সরকারকে সময় দিতে চেয়েছে। তারা যদি ভিন্ন অবস্থান নেয় তাহলে প্রতিবিপ্লবীরা শক্তিশালী হতে পারে। আমি দীর্ঘদিন খালেদা জিয়ার কাছাকাছি থাকায় তার রাজনৈতিক বাসনা বা ইচ্ছা বুঝতে পারতাম। তিনি কী চাইছেন, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটা আবারও প্রমাণ হলো।

জনগণ যখন একটা দেশ স্বাধীন করেছে তখন আপনি জনগণকে বলবেন, তোমরাই এমন একটা গণপরিষদ নির্বাচিত কর যাতে তোমরা তোমাদের রাষ্ট্র গঠন করতে পার। যেখানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে নতুনভাবে ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করব।

আমাদের জনগণ কোথায় বলেছে যে, তারা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ চায়? কোথায় বলেছে তারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ চায়? কোথায় বলেছে যে তারা ‘সমাজতন্ত্র’ চায়? শেখ মুজিবের ছয় দফার মধ্যে এসব ছিল? কী এগুলো? ’৭২-এর সংবিধান ছিল একদিকে প্রণয়ন প্রক্রিয়ার দিক থেকে পাকিস্তানিদের রচিত সংবিধান। কারণ, পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্যই তাদের নির্বাচিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে সেটা ছিল ইন্ডিয়ানদের বাংলাদেশে শাসন করার কলোনিয়াল হাতিয়ার। লিগ্যালি ছিল পাকিস্তানিদের আর পলিটিক্যালি ছিল ইন্ডিয়ানদের সংবিধান। এই সংবিধানকে তো অবশ্যই ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। এত বছর পর যখন সুযোগ এসেছে এখনো কেন তারা এটি ছিঁড়ে ফেলেনি, সেটাই সন্দেহের।

ড. ইউনূস হচ্ছেন পিপলের সভারেন পাওয়ার বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি। অতএব, তিনি এখন যা কিছু বলেন বা আদেশ দেন, সেটাই কিন্তু আইন-লিগ্যালি এবং পলিটিক্যালি। এখন উকিলরা প্রতিবিপ্লব করার জন্য যে তর্কটা করে সেটা হলো সংবিধান ছাড়া কি দেশ চলবে? ইংল্যান্ড কীভাবে চলে? সেখানে তো কোনো লিখিত সংবিধান নেই। বাংলাদেশের যেসব উকিল এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদের আমি সাবধান করে দিচ্ছি, আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, ইউকে সংবিধান ছাড়া কীভাবে চলে? বিশ্বের বহু দেশ আছে সংবিধানই নেই। আসলে সংবিধান বা তথাকথিত আইন সব সময়ই সমাজে থাকে। সেটা লিখিত থাকতে হবে তার কোনো যুক্তি নেই। এই অভিপ্রায়েরই নির্বাচিত প্রতিনিধি হচ্ছেন ড. ইউনূস। তাকে ঘিরে জনগণের ইচ্ছাটা অলিখিত রূপে আছে। এটাকে এখন লিখিত রূপ দিতে হবে। এটাই মূল ব্যাপার।

আমি জনগণের পক্ষে কথা বলব। আমি সরকারের প্রতিনিধি নই। ড. ইউনূস শুধু ঘোষণা দিয়ে বলবেন, এখন যা কিছু আইন আমাদের সমাজে আছে বা চলে আসছে তাদের সব আইনই নতুন বাংলাদেশ বহাল থাকবে। যেসব আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং সাংঘর্ষিক- সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে বিচারপতিরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন অবধি বিচার চালাবেন, আদালত চলবে, সব প্রশাসন চলবে।

যে তরুণরা বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে সামনে নিয়ে এসেছেন, তাদের বিপ্লবী গার্ড হিসেবে রাখা যেতে পারে- যেন কেউ প্রতিবিপ্লব করতে না পারে। প্রতিবিপ্লব যদি আমরা ঠেকাতে চাই তাহলে দ্রুত ড. ইউনূসের হাতে সব ক্ষমতা দিতে হবে। এটা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। বাংলাদেশের তরুণরা তো একটা অ্যান্টি কলোনিয়াল অ্যান্টি ইম্পেরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘকাল তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। জেন-জিদের পক্ষে এই ধরনের বিপ্লব ঘটানো অসম্ভব। বিপ্লব করেছে তারাই, যারা সমাজ, ইতিহাস ও বস্তবতা সম্পর্কে জানে।
 
বিএনপি এবং জামায়াত অত্যন্ত ভালো পজিশন নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর পজিশন আরও ভালো। তারা বলছে, আমরা জনগণের জন্য কাজ করি, তাদের ভালোর জন্য কাজ করি। ফলে এ সরকার যতদিন ভালো কাজ করবে আমরা তাদের সঙ্গে থাকব। আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাইনি। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, যেভাবেই হোক এই সরকারকে রক্ষা করতে হবে।

প্রথমত চাই, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করার অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে না, ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত চাই, মানুষের জানমাল, জীবিকা রক্ষা করবে রাষ্ট্র। তৃতীয়ত চাই, আমাদের প্রাকৃতিক যত সম্পদ আছে, জনগণ সেই সম্পদের মালিক। এই সম্পদ যেন কোনোভাবে বিষাক্ত না হয়, বিদেশি শক্তি লুট করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এই সম্পদকে একটা শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে রূপান্তর করাই এখনকার কাজ। এর পর আদালত, প্রশাসন কীভাবে চলবে ঠিক করতে হবে।

গণভবন থেকে পাহারা তুলে নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এটা কেন তুলে নেওয়া হলো? আমার প্রশ্ন আছে এখানে। গণভবন, বঙ্গভবন বা আমাদের আরও যত রাষ্ট্রীয় স্থাপনা আছে সেখান থেকে কি পাহারা তুলে নেওয়া যায়? মব তৈরি করা হয়েছে। এটা যারা আমাদের শত্রু হয়তো তারা করতে পারে। শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের মিউজিয়াম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবের প্রতি ঘৃণা থাকতে পারে, কিন্তু তার ওখানে মিউজিয়াম থাকলে সমস্যা কী? পোড়ানো হলো কেন?

ডক্টর ইউনূস ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে কী সুন্দর একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সবার আগে আমরা মানুষ। আপনারা কে হিন্দু কে মুসলমান, কেন ভাগ হয়ে যান? আমরা তো একটা পরিবার। এই পরিবারটা রক্ষা করতে হবে। এই পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ থাকতে পারে। এই বোধটুকু আমাদের জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের বুকের ক্ষত বিশাল, এটা সহজে শুকাবে না। এই সময়টায় আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।

আমরা দীর্ঘকাল থেকে এই ফ্যাসিজমের সমালোচনা করছি, বাকশাল থেকে এই হাসিনা সরকার পর্যন্ত। ধীরে ধীরে পিপলকে এডুকেট করেছি। পলিটিক্যাল এডুকেশন যে এরকম একটা পরিস্থিতিতে যেতে পারে, এটা তিনি অনুমান করতে পারেননি। তিনি আমাদের অপমান করেছেন।

কিন্তু পলিটিক্যাল এডুকেশন তো সমাজের বিশাল একটা অংশ পেয়ে গেছে। এটা তিনি ধরতে পারেননি।

আমি একতরফা বিচারের পক্ষে নই। আমি নেলসন ম্যান্ডেলার লোক। ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনের সবচেয়ে ভালো দিকটা হচ্ছে আমরা সত্যটা জানব। সত্য যখন আমরা জানি, তখনই কিন্তু জাস্টিস হয়। সত্য যখন আমরা জানি না, তখন আপনাকে আমি যতই শাস্তি দিলাম, তখন মনে হয় শাস্তিটা ঠিক হয়নি। ডক্টর ইউনূস বা আমাদের ছাত্ররা যদি তাকে চান আমার তো কিছু বলার নেই।

লেখক: কবি, মানবাধিকার কর্মী ও পরিবেশবাদী