একবিংশ শতকের এই সময়ে এসে মানুষ সামাজিক, মানসিক ও পারিবারিকভাবে ক্রমেই নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হয়ে পড়ছে। এর কারণ নানাবিধ।
সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, তারুণ্যে একা থাকা, নিজের মতো জীবন কাটানো, অপার স্বাধীনতা, যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে খরচ করার ইচ্ছা মানুষকে উদ্দাম করে তোলে। এর মধ্যেই সংসার, সন্তানধারণ ও প্রতিপালন, প্রেম, বিয়ে, পার্টি, হুল্লোড়, ক্লাব, ফেসবুকিং, হোম অফিস, কর্মক্ষেত্রের হতাশা, প্রতিযোগিতা, আরও ভালো থাকার চেষ্টা, ডিভোর্স, সব কয়টি উপাদান যোগ হয় এবং এসব মানুষকে ক্রমেই অস্থির করে তোলে। একসময় মানুষ খেয়াল করে, সে বড্ড একা হয়ে পড়েছে।
২০২২ সালের ঘটনা। রাজধানীর মগবাজারের এক ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ইকবালউদ্দিন নামে এক ডাক্তারের গলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। যার দুই ছেলেমেয়ে, স্ত্রী দেশের বাইরে। অসুস্থ ইকবাল একা থাকতেন। পুলিশ ৯৯৯-এ কল পেয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। মরদেহ পচে গন্ধ বের হচ্ছিল।
২০২১ সালে উত্তরার বাসা থেকে পুলিশ অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমানের মরদেহ উদ্ধার করে। এই খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও একলা থাকতেন। তার পরিবারের সদস্যরা বিদেশের বাসিন্দা।
চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী আবু মোহসিন খান ২০২২ সালে ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দিয়ে পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। তিনিও নিঃসঙ্গ ছিলেন। তার ফেসবুক ফলোয়াররা ৯৯৯-এ ফোন দেন। একা থাকতেন তিনি। পুলিশ দেখতে পায় চেয়ারে মরদেহ আর পাশে তার বৈধ পিস্তলটি পড়ে আছে। তার স্ত্রী-সন্তান অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার বাশার মিয়া সৌদি আরবে ৪০ বছর প্রবাসী ছিলেন। চার সন্তানের বাবা। দেশে ফেরার পর স্ত্রী মারা যান। সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন নেই। তার সঙ্গে কথা বলারও কেউ নেই। যে সন্তানের বাসাতেই যান, সেখানে নাতি-নাতনি থাকলেও সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে- পড়াশোনা বা অবসরে অন্তর্জালে।
সমাজবিজ্ঞানী-মনোবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাশার মিয়া সন্তানদের ভালো রাখতে জীবনের সিংহভাগ পার করে দিয়েছেন প্রবাসে। কিন্তু তিনি সন্তানদের কোলেপিঠে করে মানুষ করতে পারেননি। আত্মিক সম্পর্ক গড়তে এটি খুব বেশি প্রয়োজন।
একাকিত্বও একধরনের মহামারি, বলছেন গবেষকরা। ১৯৮৫ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একাকী মানুষের সংখ্যা তিন গুণ হয়েছে, যাদের একজনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই। প্যারিসে ৫০ শতাংশ, স্টকহোমের ৬০ শতাংশ মানুষ একা। যুক্তরাজ্যে ৭৫-এর বেশি বয়সী মানুষের অর্ধেকই একা থাকেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা দুই ধরনের। পরিকল্পিত এবং আবেগতাড়িত হয়ে বা কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চরম বিষণ্ণতা বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে। সুইসাইড করার অর্ধেক কারণই হচ্ছে বিষণ্ণতা বা অবসাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. জিয়া রহমান খবরের কাগজকে বলেন, গবেষণা বলে, নগরায়ণ যত হয়েছে, হাউজিংয়ের ভাবনা থেকে মানুষের জন্মহার তত কমেছে। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে জন্মহার নেগেটিভও হয়েছে। মানে মানুষ একা হয়ে পড়ছে। আরেকটি সন্তান নিতে গেলে আরও বড় বাসা নেওয়ার বা তার পড়াশোনার কথা ভেবে আর এগোনো হয় না অনেকের।
তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে তারা শিশুদের জন্য বা বয়স্কদের জন্য বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ছে। আমাদেরও তা করতে হবে। তাদের দেশে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেওয়ামাত্র পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশেও ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেওয়ামাত্র পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেবে, এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাতে সমস্যা কমে নিরাপত্তা বাড়বে। বাড়ির বড়-ছোটরা পাশের বাড়িতে আসা-যাওয়া করবে। এতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধন বাড়বে। এতে একাকিত্ব কিছুটা হলেও কমবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, আগে আপন ভাইবোনের বাইরে পাড়া-মহল্লার সমবয়সীদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠত। এখন সেটা নেই। এখনকার শিশুরা তা পাচ্ছে না। মা-বাবারাও প্রতিযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থায় ব্যস্ত। এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও আছে। কেউ কারও প্রয়োজনে এগিয়ে আসে না। সামাজিক এই নিরাপত্তার অভাবে সবাই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। সে জন্য সম্পদ গড়তে ছুটতে থাকে। এতে মানুষ আরও একা হয়ে পড়ে। শিশুদের মধ্যে পরিবর্তন আনাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি। সে জন্য পাড়া-মহল্লায় ক্লাব-সংগঠন ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্লাব বলতে এখন যা বোঝায়, তা নয়। আগে যেমন ছিল কচিকাঁচার মেলা, চাঁদের হাট বা খেলাঘর, তেমন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ডাক্তার সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে প্রবীণরা শেষ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হন না, তাদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের নানা আয়োজন আছে। সেখানে দম্পতি একজন অপরজনের ওপর নির্ভরশীল নন। তারা প্রত্যেকেই স্বনির্ভর। সেখানেই দেখা যাচ্ছে মানুষ আলাদা হচ্ছে বেশি। একাকিত্ব বেশি। আমাদের দেশেও স্বনির্ভরতা যত বাড়ছে, একাকিত্বও সেভাবে বাড়ছে। এই প্রবণতা কমার কোনো কারণ তো দেখছি না।’
জাতীয় সংসদের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, নগর জীবনে বাচ্চারা একা বাসায় দিন কাটায়। হয়তো মা-বাবা দুজনই কাজের প্রয়োজনে রোজ বাইরে যান। কোনো কোনো শিশু বড় হচ্ছে ডে কেয়ার সেন্টারে। নিরাপত্তার কারণে তারা বাসার বাইরে বেরোতে পারে না। তাই বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠছে না। সবকিছু কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু অর্থনির্ভর হয়ে পড়ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. সরোজ কুমার দাশ খবরের কাগজকে বলেন, ‘পাঁচটি বিষয় এ জন্য দায়ী। সেগুলো হলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক। বৈশ্বিক বিবেচনায় বা পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভালো। এটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু নেতিবাচক দিক হচ্ছে, আমাদের অবস্থাও দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলো আলগা হয়ে যাচ্ছে। এটি রোধ করতে হবে।’
নাট্যকার, নির্দেশক ও জনপ্রিয় অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম বলেন, একজন মানুষের একা হয়ে যাওয়ার জন্য তিনি নিজেও দায়ী। তিনি কীভাবে সন্তানকে বড় করেছেন, সেটিও বড় বিষয়। আসলে মানুষ একটা রেসের মধ্যে আছে। সেখানে মানুষ সাকসেসের পেছনে দৌড়াচ্ছে। এটা হলে, ইন্টার অ্যাকশন না থাকলে তো মানুষ একা হবেই।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইন্ড, অ্যাডলসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ বলেন, দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের একাকিত্বও দ্রুত বাড়ছে। স্বাতন্ত্র্যবাদের কারণে মানুষের একাকিত্ব বাড়ছে। এর শুরু হতে পারে শিশু বয়সেই। যে বয়সে শিশু মাঠে খেলার দরকার, খেলার মাঠ তো নেই। মা-বাবা দুজনই হয়তো পেশাজীবী। বাসায় থাকেন না দাদা-দাদি বা নানা-নানি। তখন সে বাসায় প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মোবাইল ফোনসেট বা কম্পিউটার নিয়ে থাকছে। এই একাকিত্ব থেকে কেউ বিষণ্নতায় ভোগে, আবার কেউ কেউ এই একাকিত্বের সঙ্গে মানিয়ে চলে, তা উপভোগও করে। দুইটাই খারাপ। সংকট দূর করতে নানামুখী ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশুকাল থেকেই শিশুদের শরীরচর্চার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সেই দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহকারী অধ্যাপক তানভীর হাসান (জোহা) বলেন, ‘মানুষ দিন দিন ডিজিটাল বা ডিভাইস বেইজড হয়ে পড়ছে। এখন বন্ধুরা অনলাইনের আড্ডায় ভাবছে, আমরা একসঙ্গেই তো আছি। আসলে তো নেই। স্ক্রিনে একত্র হওয়া আসলে একসঙ্গে থাকা নয়।’
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান (জোহা) বলেন, অনলাইনে কারও সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া আর সামনাসামনি কথা হওয়া এক না। সামনাসামনি কথা হলে বাচনভঙ্গি বা শরীরী ভাষাও দেখা-বোঝা যায়, তাতে একজন সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ হয়। কিন্তু অনলাইন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা হয় না।
তিনি বলেন, দাম্পত্য জীবনের শুরুর দিকের কয়েক বছর গেলে কারও কারও মনে হয় যে, একজন অন্যজনকে অবজ্ঞা করছে। তখন অনলাইনে পরিচিত কাউকে বিকল্প ভাবতে শুরু করে। কখনো হয়তো ভেবেই বসে যে, আমার তো অপশন আছে। সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে না চাইলে ইতি টানার সিদ্ধান্তও নিয়ে নেয়। পরে দেখা যায়, অনলাইনে গড়া সম্পর্কটি টেকসই হলো না, কিন্তু তখন আর ফিরে আসার পথও থাকে না। এতে কেবল দম্পতি নয়, তাদের সন্তানরাও অনিশ্চিত-অনিরাপদ ভবিষ্যৎ সামনে রেখে বড় হয়। তাই ভার্চুয়াল নয়, অ্যাকচুয়াল সম্পর্ক গড়তে হবে।