ঢাকা ৩০ কার্তিক ১৪৩১, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

উচ্চ পদে ঢালাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা হতাশ-ক্ষুব্ধ

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪, ০৯:১২ এএম
আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৪, ০৯:২৪ এএম
উচ্চ পদে ঢালাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা হতাশ-ক্ষুব্ধ

প্রশাসনের শীর্ষ পদে একের পর এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আগে বিশেষজ্ঞদের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার নজির থাকলেও এখন ‘ঢালাওভাবে’ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৮৩ সচিবের মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ দুই পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবসহ ২০ জনই চুক্তিতে কর্মরত। ফলে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা যথাসময়ে সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এ ধরনের নিয়োগ নিয়ে খোদ সরকার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যেই ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে। 

তাদের মতে, একজন কর্মকর্তা চাকরির মেয়াদ শেষে অবসরে গেলে সেই পদ খালি হয়। ওই পদে নতুন একজন কর্মকর্তার পদোন্নতি বা পদায়ন হয়। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে বঞ্চিত হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এতে সরকার যতটা না উপকৃত হয়, তার চেয়ে বেশি লাভ হয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের। 

অতীতে কোনো প্রকল্প বা বিশেষ কারণে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের এক বছর চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হতো। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। ব্যক্তিগত সখ্য ও রাজনৈতিক বিশেষ তদবিরের কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগে একাধিক সচিবকে এক বা দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মেয়াদ শেষে কারও কারও চুক্তির মেয়াদ আরও বেড়েছে।

বিএনপির আমলেও রেকর্ডসংখ্যক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়। অনেকে মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে রেকর্ড গড়ে, তার জন্য অন্যতম প্রধান দায়ী এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত আমলারাই। দুর্নীতি করতে তারা কোনো রকম রাখঢাক করেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় একটি প্রভাবশালী মহল ভুল বুঝিয়ে একের পর এক চুক্তির সুযোগ নিচ্ছে। তবে সরকার যদি কাউকে কোনো মন্ত্রণালয়ে অপরিহার্য মনে করে, সে ক্ষেত্রে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া স্বাভাবিক। তবে ঢালাওভাবে নিয়োগ দেওয়া অনুচিত। সাম্প্রতিক সময়ে সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হওয়ায় পদোন্নতিযোগ্য ও সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।

এদিকে বিগত কয়েক বছর জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কমেছিল। বিশেষ করে নিয়মিত পদগুলোতে চুক্তিতে কম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছু আগে থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়া শুরু হয়। সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত কাউকে চুক্তিতে নিয়োগের ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ কমে যায়। সে জন্য শীর্ষ পদ পাওয়ার প্রত্যাশায় থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। 

অন্যদিকে চুক্তিতে নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিতে সরকারের বাড়তি ব্যয়ও হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে অবসর নিতে হয় ৫৯ বছর বয়সে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরও এক বছর বেশি চাকরি করার সুযোগ পান। 

বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জনপ্রশাসনে শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের অবসরের সময় এগিয়ে আসছে, এখন তাদের অনেকেই চুক্তিতে নিয়োগ পেতে চেষ্টা-তদবির করছেন। জনপ্রশাসনে এখন সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে কর্মকর্তা রয়েছেন ৮৩ জন।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সচিব-পদ শূন্য হয়। যেহেতু নির্বাচন ও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেই কারণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে নিরুৎসাহিত করেন। সে ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে সরকার। বর্তমানে যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন, তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষে সেখানে নতুন অনেককে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রী বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সব সময় নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনও রয়েছে। কারণ একজনকে নিয়োগ দিলে এ ক্ষেত্রে যার সুযোগ ছিল তিনি বঞ্চিত হন। প্রধানমন্ত্রী সব সময় বিষয়টি খেয়াল রাখেন। 

অপর এক প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রী বলেন, বিশেষ কারণে ওই সময়ে (সংসদ নির্বাচনের আগে) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হয়েছিল। তার মতে, এটা করা হয়েছিল দেশের স্বার্থে ও কল্যাণে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম শহিদ খান বলেন, তারা চাকরিতে থাকাকালে যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিতেন। কারণ পদোন্নতিযোগ্যদের বঞ্চিত করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে প্রশাসনে নানামুখী সমস্যা তৈরি হয়। পদোন্নতিপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৪ সালে কমিশনের সুপারিশ ছিল শুধু কারিগরি কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন, তাকে ছাড়া মন্ত্রণালয়ে গতি আসবে না -এমন অপরিহার্য হলে সেই ধরনের কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ঢালাওভাবে শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে তা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে দেয়। তাই যারা পদোন্নতির যোগ্য, তাদেরই পদোন্নতি দেওয়া উচিত।’

সূত্র বলছে, প্রশাসনে অতীতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের লাগাম টেনে ধরতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পরিহার করার জন্য ২০১৪ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত ইসমাত আরা সাদেকের উদ্দেশ্যে একটি আধা সরকারিপত্রও (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন তিনি। 

লিখেছিলেন, ‘অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে সরকার কাউকে যদি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে, সে ক্ষেত্রে ক্যাডারবহির্ভূত বিশেষ পদে তাদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এটি কার্যকর হলে নিয়মিত পদোন্নতিপ্রত্যাশী  কর্মকর্তারা শীর্ষ পদে আসীন হতে পারবেন। কোনো পক্ষের আর হতাশা ও ক্ষোভ থাকবে না।’ 

তার প্রস্তাবটিও আমলে নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৪ সালে দেওয়া পে-কমিশনের সুপারিশে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। সেটিও আমলে নেওয়া হয়নি। বরং পরবর্তী সময়ে চুক্তিতে নিয়োগ বেড়েছে।

জনপ্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন। এর মধ্যে মো. মাহবুব হোসেন গত বছরের (২০২৩) ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করে গত বছরের ১৩ অক্টোবর থেকে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তার। নিয়ম অনুযায়ী তাকে অবসর দিয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর পৃথক আরেকটি প্রজ্ঞাপনে ১৪ অক্টোবর থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য তাকে এ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা জানানো হয়। 

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব থাকাকালে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর মুখ্যসচিব হিসেবে নিয়োগ পান তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করে গত বছরের (২০২৩) ৪ জুলাই তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই বছরের (২০২৩) ২৫ জুন অবসরোত্তর ছুটি এবং এ-সংক্রান্ত সুবিধা স্থগিতের শর্তে ৫ জুলাই থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। 

এদিকে আরও এক বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব হিসেবে ইতোমধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী এক বছর মেয়াদে এ পদে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে গত ২৬ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স নির্বাহী কমিটির প্রধান পরামর্শক পদে মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আলী হোসেন, জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সিনিয়র সচিব) মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আব্দুস সালাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক (সিনিয়র সচিব) মো. আখতার হোসেন, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার চুক্তিতে কর্মরত আছেন। 

তালিকায় আরও আছেন, জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব) শাহাবুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগের সচিব মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব) মো. ফজলুল বারী, বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক (লিয়েনে কর্মরত) বেগম শরিফা খান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম। 

বর্তমানে ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের সচিব হিসেবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। এর ফাঁকেও প্রশাসনের শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদোন্নতিপ্রত্যাশী  বিসিএস ১৫তম ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে খবরের কাগজকে বলেন, সচিব পদোন্নতি পাওয়ার সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। একের পর এক চুক্তি দেওয়ায় তারা কবে সচিব পদোন্নতি পাবেন তা নিয়ে হতাশায় রয়েছেন। কারণ একজনকে চুক্তিতে দিলে আরও ৫ জনের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে তারাও পদোন্নতির আগে মনোকষ্ট নিয়ে অবসরে চলে যাবেন। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তার পরও সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় আনেন না। সুবিধাভোগী আমলারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুল বুঝিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে প্রভাবিত করছেন। এটি প্রশাসনের জন্য আদৌ কাম্য নয়।

তাদের অভিমত, নিয়মানুযায়ী সচিবের পদ শূন্য হওয়ার পর যোগ্য কর্মকর্তারাই ওই পদে পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু তা যেন অধরাই থাকছে। উল্টো ওই পদে থাকা সেই কর্মকর্তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনায় সচিব পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

কুমিল্লায় ছিল বাহারের ‘বাহারি রাজত্ব’

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪০ এএম
কুমিল্লায় ছিল বাহারের ‘বাহারি রাজত্ব’
কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার। ছবি: খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দখলদারি, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ এবং বিরোধী পক্ষকে দমিয়ে রেখে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার। ‘কুমিল্লার দানব’ হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া বাহার নিজের নামের মতোই বাহারি অপকর্মের মাধ্যমে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একক রাজত্ব। কুমিল্লা নগরীতে যা ‘বাহারি রাজত্ব’ নামে পরিচিত ছিল। নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সব সময় পাশে রাখতেন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, খুনের মামলার আসামি এবং তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিদের। এমনকি নিজের ভাতিজার হত্যাকারীকে সঙ্গে নিয়েই মাঠের রাজনীতি দখলে রাখতেন। আত্মীয় স্বজনদের দলীয় বিভিন্ন পদে বসিয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গায় অপকর্ম করতেন তিনি। 

শুধু কুমিল্লা সদরেই নয়, বাহার রাম-রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছেন আশপাশের কয়েকটি সংসদীয় এলাকায়ও। দলের সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে নিজের মেয়েকে সিটি করপোরেশনের মেয়র বানানোর পাশাপাশি গত সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। অপকর্মে তার অনুসারী আরও অন্তত তিনজনকে কৌশলে এমপি বানাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন বাহার। এ ছাড়া গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিভিন্ন উপজেলায় তার সমর্থিত অন্তত ৬ জন প্রার্থীকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করিয়েছেন তিনি। নির্বাচন ঘিরে এসব উপজেলায় মহড়া দিয়েছিল বাহারের ক্যাডার বাহিনী। এসব অপকর্ম করে বাহার গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। অভিযোগ রয়েছে তিনি দেশে ও বিদেশে গড়েছেন বেশ কয়েকটি বাড়ি। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে বাহার ও তার ক্যাডাররা আত্মগোপনে চলে যায়। শোনা যাচ্ছে বাহার ভারতে চলে গেছেন। এরপর একের পর এক অপকর্মের তথ্য বের হয়ে আসে। মুখ খুলতে শুরু করেছেন বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষ এবং আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর গত ১৫ বছর সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, ফ্যাসিলিটিস ডিপার্টমেন্ট, সিটি করপোরেশন, জনস্বাস্থ্যসহ কুমিল্লার সব বিভাগ ছিল বাহারের দখলে। এসব স্থানে তার লোকজন ছাড়া অন্য কোনো ঠিকাদার দরপত্র দাখিল করার সাহস পেতেন না। নিজেকে ‘কুমিল্লার অভিভাবক’ দাবি করা বাহার এতটাই বেপরোয়া ছিলেন, তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে নিজ দলের নেতা-কর্মীদেরও তিনি কোণঠাসা করে রাখতেন।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই অভিযোগ করছেন, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর কুমিল্লায় ঠিকাদারি, দখলবাজি থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপকর্ম করেছেন বাহার। তার বিরোধিতা করায় নিজ দলের এবং বিরোধী মতবাদের অনেক নেতা-কর্মীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কয়েকজন খুনও হয়েছেন। কেউ কেউ পঙ্গু হয়েছেন। এসব ঘটনার পেছনের লোকটি সাবেক সংসদ সদস্য বাহার। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা কুমিল্লা শহরের মুন্সেফবাড়ি এলাকায় বাহারের বাড়িতে এবং গ্যারেজে থাকা কয়েকটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আগুন দেওয়া হয় কুমিল্লা শহরের রামঘাট এলাকায় আওয়ামী লীগের নতুন কার্যালয়েও (১০ তলা ভবন)। এ ছাড়াও ওই দিন কুমিল্লা ক্লাব ও টাউন হলেও আগুন দেওয়া হয়। কুমিল্লা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণও বাহারের কাছে ছিল। তার সম্মতি ছাড়া কেউ কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন না। আর ঐতিহ্যবাহী টাউন হল ভেঙে বাহার বহুতল বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন। এ নিয়েও স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন। ফলে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন এসব স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছেন।

জানা গেছে, ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বাহার ব্যাংক ঋণের কারণে নির্বাচন করতে পারছিলেন না। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চাঁদা তুলে বাহারের ব্যাংকঋণ পুনঃতফসিল করে তাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি ও দখলদারির রাজনীতি করে বাহার আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, খুনের মামলার আসামি ও তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি- এই তিন শ্রেণির মানুষকে সব সময় নিজের আশপাশে রাখতেন। যে কারণে মানুষ তাকে ভয় পেত। এর মধ্য দিয়ে কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকার রাজনীতি ও অপরাধ- দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। তার দাপট এতটাই ছিল যে আওয়ামী লীগের নেতারাও এখন বলছেন, তিনি যেন কুমিল্লায় দুর্বৃত্তায়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, সাবেক এমপি বাহারের দুর্বৃত্তায়নের কথা বলে শেষ করা যাবে না। হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। রাতের আঁধারে রেজিস্ট্রি অফিসে লোক ঢুকিয়ে বালাম বই ঘষামাজা করেছেন, কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী লিবার্টি হল- হিন্দুদের সম্পত্তি নিয়ে গেছেন, হিন্দুদের আরেকটা সম্পত্তিতে বিশাল সোনালী স্কয়ার, টাউন হলের জায়গায় মার্কেট করে ফেলেছেন। তার অপকর্মের ফিরিস্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না।

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, কুমিল্লায় ঠিকাদারি, দখলবাজি থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপকর্ম করেছেন বাহার। তার বিরোধিতা করায় দলের অনেক নেতা-কর্মীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে গেছেন। কয়েকজন খুনও হয়েছেন। 

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন বলেন, বিগত দিনে কুমিল্লা শহরে চাঁদাবাজি, রাহাজানি, দখলদারত্ব একটা নরমাল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাহার আত্মগোপনে যাওয়ার পর কুমিল্লার মানুষ এখন স্বস্তিতে আছে।

কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহিনুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর সাবেক এমপি বাহারের বিরুদ্ধে থানায় অন্তত ১৫টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া বিগত দিনের অনেক ভুক্তভোগী আদালতেও মামলা করেছেন। এসব মামলায় পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর অভিযানে বাহারের অনেক ক্যাডার গ্রেপ্তার হয়েছে। পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।

নির্বাচনে ‘শ্যাডো বাহার’ স্টাইল

আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার সদর আসনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার এলাকায় নির্বাচনের ধরন বদলে যেতে থাকে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন- সবখানেই নিজের পছন্দের প্রার্থী দিতেন। নিজস্ব স্টাইলে নিজের প্রার্থীদের কৌশলে বিজয়ী করে আনতেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আরফানুল হক রিফাতের বিজয় ছিনিয়ে আনেন। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে বাহারকন্যা সূচনাকে একই কায়দায় বিজয়ী করে আনেন তিনি। রিফাতের নির্বাচনের সময় ভোট দিয়ে এসে গণমাধ্যমকে বাহার বলেছিলেন, তার প্রার্থীদের বিজয়ী করে আনতে ‘শ্যাডো বাহার’ই যথেষ্ট। মূলত এরপর থেকে কুমিল্লা সদরের বিভিন্ন নির্বাচনে ‘শ্যাডো বাহার’ স্টাইল পরিচিতি পেতে থাকে। এসব নির্বাচনে নিজের প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনতে একাট্টা ও একরোখা ছিলেন বাহার। তার পছন্দের বাইরে কেউ নৌকার মনোনয়ন পেলেও (যখন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছিল) তাকে নির্বাচন করতে দেওয়া হতো না। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুমিল্লা সদর উপজেলার পাঁচথুবি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন বাহালুল আওয়ামী লীগের সমর্থনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পান। কিন্তু তাকে নির্বাচন করতে দেননি বাহার। তার পছন্দের প্রার্থী হাসান রাফি রাজুকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান বানিয়েছেন তিনি। 

পরবর্তী সময়ে বাহারের এই নির্বাচনি স্টাইল ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বিভিন্ন সংসদীয় এলাকা ও উপজেলায়। সেসব এলাকাগুলোতেও নিজের পছন্দের প্রার্থীদের বিজয়ী করে আনতে ‘ভূমিকা’ রাখতেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে গত সংসদ নির্বাচন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ‘শ্যাডো বাহার’ স্টাইল প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে তার অনুসারী আরও অন্তত তিনজনকে এমপি বানাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন বাহার। নির্বাচনের পর অনুগত এই তিন এমপিকে নিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন তিনি। আর নতুন এই তিন এমপিও তাকে ‘গুরু’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে চলতেন। এরপর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিভিন্ন উপজেলায় তার সমর্থিত অন্তত ৬ জনকে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী করেন তিনি। নির্বাচন ঘিরে কুমিল্লার সদর দক্ষিণ, নাঙ্গলকোট, বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়াসহ ৬টি উপজেলায় মহড়া দিয়েছিল বাহারের ক্যাডার বাহিনী। বিজয়ী হওয়ার পর ওই ৬ উপজেলার চেয়ারম্যান ‘কৃতজ্ঞতার ফুল’ নিয়ে এসেছিলেন বাহারের কাছে।

পাড়ায় পাড়ায় ক্যাডার বাহিনী

আ ক ম বাহাউদ্দী ন বাহার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলেছিলেন ক্যাডার বাহিনী। বিশেষ করে তার অনুসারী সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলররাই এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। আর যেসব ওয়ার্ডে তার অনুসারীরা কাউন্সিলর হতে পারেননি, সেখানে দলীয় পদধারীরাই চালাতেন সন্ত্রাসী কার্যক্রম। এরই জের ধরে ২০০৮ সালের পর থেকে গত ১৬ বছরে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে বাহারের সহযোগীদের সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দখলদারত্বের অসংখ্য ঘটনা তো আছেই। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর খুন হন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, দেলোয়ার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বাহারের ঘনিষ্ঠ অনুসারী কুমিল্লা সিটির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. আবদুস সাত্তার। তিনি কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি। ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর শহরের চৌয়ারা এলাকায় যুবলীগের কর্মী জিল্লুর রহমান চৌধুরীকে হত্যা করে বাহারের ক্যাডাররা। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, এই খুনের পরিকল্পনাকারী ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. আবুল হাসান। তিনিও বাহারের ঘনিষ্ঠ অনুসারী এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। এ ছাড়া নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বাহারের অন্যতম ক্যাডার আলমগীর ও তার ভাইয়েরা মিলে ২০২০ সলের ১০ জুলাই পূর্বশত্রুতার জের ধরে চাঙ্গিনী এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মী আক্তার হোসেনকে (৫৫) মসজিদ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে ও দা দিয়ে কুপিয়ে শত শত মানুষের সামনে হত্যা করে। 

চোখের বালি সাংবাদিকরা

গত ১৬ বছরে বাহারের একের পর এক অপকর্ম বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর তার চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন সাংবাদিকরা। বিভিন্ন সময় বাহার ও তার বাহিনীর হাতে নাজেহাল ও মারধরের শিকার হতে হয়েছে অনেক সাংবাদিককে। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম ও কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। এমনকি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যে বিভিন্ন সাংবাদিকের নাম ধরে গালাগাল করতেন বাহার। বিশেষ করে বিভিন্ন নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের কালো তালিকায় রাখতেন, তিনি হুমকি দিতেন এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। সর্বশেষ গত সংসদ নির্বাচনে ৭১ টিভির কুমিল্লা প্রতিনিধি কাজী এনামুল হক ফারুককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন তিনি ও তার দেহরক্ষী ইকবালসহ নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে নির্বাচন কমিশনে ক্ষমা চেয়ে লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যান বাহার। এর আগে কুমিল্লা শহরে সময় টিভির সাংবাদিক রায়হানের ওপর হামলা চালান বাহারের কর্মীরা। এ ঘটনায় সম্প্রতি আদালতে মামলা হয়েছে। এরও আগে তৎকালীন কালের কণ্ঠের কুমিল্লার প্রতিবেদক আবুল কাশেম হৃদয়সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে মিথ্যা মামলা করেন বাহার। সম্প্রতি আদালত থেকে ওই মিথ্যা মামলায় অব্যাহতি পান সাংবাদিক আবুল কাশেম হৃদয়। এ ছাড়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের বিরুদ্ধেও একবার মানহানির মামলা করেছিলেন বাহার।

 

৩ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পুলিশকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৯ পিএম
৩ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পুলিশকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ
খবরের কাগজ ডেস্ক

গত জুলাই ও আগস্টে আন্দোলনে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে দেশে এবং বিদেশে সমালোচনার শিকার হয় পুলিশ। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে আতঙ্কে পুলিশ পালিয়ে যাওয়ায় থানাগুলো কয়েক দিন ফাঁকা পড়ে থাকে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটে। ফলে আন্দোলন পরবর্তীকালে সতর্কভাবে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে পুলিশকে। 

এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সরকার পুলিশকে গণবান্ধব করার জন্য একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, পুলিশ আপাতত ৩টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। 

এক. পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে যোগ্যদের মনোনীত ও পদায়ন করা। দুই. আন্দোলনে ভিকটিমদের মামলাগুলো যথাযথ তদন্ত করা এবং দ্রুতই চার্জশিট দেওয়া। তিন. থানাকেন্দ্রিক সেবার মান বাড়ানো। পুলিশকে ঢেলে সাজানোর ক্ষেত্রেও এই তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে অতি উৎসাহী কিছু পুলিশের জন্য গোটা বাহিনীর ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তির দায় গোটা বাহিনীর নেওয়া উচিত নয় বলে মনে করে পুলিশ। ফলে মহাজোট সরকারের আমলে যেসব পুলিশ কর্মকর্তার জন্য পুলিশের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তাদের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের অনেককেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কেউ কেউ বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন। আবার অনেকে পলাতক অবস্থায় রয়েছেন। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন যে, ‘যেসব পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক অবস্থায় রয়েছেন তারা সন্ত্রাসী। দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ 

আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম খবরের কাগজকে জানান, ‘জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য তারা কাজ করছেন।’

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পুলিশে পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বিশেষ কয়েকটি জেলার বাসিন্দা ও ছাত্রজীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হতো। শুধু পদোন্নতি নয়, বদলির ক্ষেত্রেও এই দুইটি বিষয় বিবেচনা করা হতো। 

এতে অনেক যোগ্য পুলিশ কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে গেছে। অনেকে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে বদলি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের এ বিষয়ে ক্ষোভ ছিল। কিন্তু চাকরি রক্ষার স্বার্থে তারা কিছু বলেননি। যোগ্য ও কর্মদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর তাদের পুলিশের গুরুত্বহীন ইউনিটে কাজ করতে হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পুলিশের সব বিভাগে। 

সূত্র জানায়, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পদোন্নতি ও বদলিতে যোগ্য কর্মকর্তাদের মনোনয়ন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিগত প্রায় ১৬ বছরে যারা যোগ্য হওয়ার পরও পদোন্নতি পাননি তাদের এখন পদায়ন করা হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপিতে ৩০টির বেশি পদে বদলি ও পদোন্নতির আদেশ হয়। 

সূত্র জানায়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছেন বিসিএস ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এই দুটি ব্যাচের অনেকেই অতিরিক্ত আইজিপি হয়ে গেলেও কেউ কেউ এসপির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। যাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি তাদের কাউকে-কাউকে আওয়ামী সরকারবিরোধী বলে অ্যাখায়িত করেছিল। গত ২৬ সেপ্টেম্বর দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত থাকা ৪৭ জন এসপিকে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। 

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, থানা এবং আদালতে যেসব ভিকটিম মামলা করছেন সেই সব মামলা যথাযথ তদন্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে পুলিশ। মামলার আগে পুলিশ যাতে প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি অবগত হন সেই বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের হয়রানি কমবে এবং মামলার তদন্ত যথাযথ হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়াও থানাকেন্দ্রিক যেসব জিডি (সাধারণ ডায়েরি) হয়েছে বা হচ্ছে সেগুলো তদন্ত করে ভিকটিমের আস্থা অর্জনের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। 

সূত্র জানায়, ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে পুলিশ থানাকেন্দ্রিক সেবার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে থানায় আসা মানুষ যাতে যথাযথ সেবা এবং পুলিশি দিক-নির্দেশনা পান তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে রাজধানীর পল্টন থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের রুমে ৪ জন বসে আছেন। ৪ জন চার ধরনের অভিযোগ নিয়ে এসেছেন। সুমন নামে একজন জানালেন, পুরানা পল্টনে তিনি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। সেই কোম্পানির আইডি কার্ড হারিয়ে গেছে। এ জন্য তিনি জিডি করতে এসেছেন। 

এ বিষয়ে ডিউটি অফিসার দীপঙ্কর খবরের কাগজকে জানান, আমরা মানুষকে যথাযথ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। মানুষের অভিযোগ শুনে জিডি নেওয়া হচ্ছে। 

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে জানান, জুলাই ও আগস্টে পুলিশ আন্দোলন দমনে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। পুলিশের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ফেরাতে হলে পুলিশকে জনমুখী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন: হতাহতের মামলা তদন্তে বিশেষায়িত দুই ইউনিট

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন: হতাহতের মামলা তদন্তে বিশেষায়িত দুই ইউনিট
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের করা মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিআইডি ও পিআইবিকে। ছবি: খবরের কাগজ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের মামলাগুলো তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিশের বিশেষায়িত দুই ইউনিটকে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এসব মামলা অধিকতর তদন্ত করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেবে। যার প্রাথমিক কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। সিআইডি ও পিবিআইয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা মহানগর তথা রাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া হত্যাসহ গুরুতর অভিযোগের ৮৭টি মামলা তদন্তের জন্য এরই মধ্যে ওই দুটি সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে পিবিআইকে ৪০টি ও সিআইডিকে ৪৭টি মামলা তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে। এ দুটি ইউনিটে এরই মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে তদন্তের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। 

সংস্থা দুটির কর্মকর্তারা জানান, গত জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডব চালানো হয়, সেগুলোর বিষয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন থানায় পর্যায়ক্রমে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু মামলা হয়েছে আদালতে। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক মামলার তদন্ত শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশ। কিছু মামলায় আসামিও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে মামলাগুলো সঠিকভাবে আরও নিবিড়িভাবে তদন্তের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সিআইডি ও পিবিআইকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সিআইডির ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি (ঢাকা মেট্রো) জিয়াউল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে হতাহতসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা তদন্তের জন্য আমাদের কাছে এসেছে। এসব মামলা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।’

একই প্রসঙ্গে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া) আবু ইউছুফ খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ওই সময়ের (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন) ৪০টি মামলা তদন্তের জন্য পিবিআই দায়িত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরের বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের হওয়া ওই জাতীয় আরও কিছু মামলা পিবিআইয়ের কাছে আসছে। পিবিআই সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের সঙ্গে মামলাগুলোর তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে।’

সিআইডি ও পিবিআইয়ের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর ছাড়াও সারা দেশ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনায় করা ওই সব গুরুত্বপূর্ণ মামলা পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে পিবিআই ও সিআইডির কাছে পাঠানো হয়েছে। সংস্থা দুটি এসব মামলার মধ্য থেকে যেগুলো বেশি স্পর্শকাতর বা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো নিয়ে এর মধ্যে কাজ শুরু করেছে। 

এসব মামলায় আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলেছেন, বেশ কিছু আসামি ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ দুটি ইউনিট মামলাগুলো গোড়া থেকে তদন্ত শুরু করে প্রকৃতপক্ষে যারা জড়িত তাদের কেবল আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান চালাতে গেলে অনেক সময় বেগ পেতে হচ্ছে। যার অন্যতম সমস্যা হচ্ছে- পর্যাপ্ত জনবল না থাকা, ‘মব জাস্টিস’, যানবাহনের সংকট অন্যতম। তা সত্ত্বেও অধিক গুরুত্ব দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের মামলাগুলোর তদন্তকাজ শুরু করা হয়েছে।

টিসিবির ট্রাকসেল: লজ্জা ভুলে লাইনে মধ্যবিত্তরা

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ এএম
আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ এএম
টিসিবির ট্রাকসেল: লজ্জা ভুলে লাইনে মধ্যবিত্তরা
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে এখন নিম্নবৃত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাদেরও ভরসার জায়গা টিসিবি। ছবি: খবরের কাগজ

‘এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার পরও সিরিয়াল পাচ্ছিলাম না। এদিকে অফিসের সময় ঘনিয়ে আসছিল। পরে বেলা ৩টায় পাই কম দামের টিসিবির পণ্য। চাল, ভোজ্যতেল ও ডালের ৪৮০ টাকার প্যাকেজ। ভালোই লাগছে। তবে পরিমাণে বেশি হলে আরও ভালো লাগত।’

টিসিবির ট্রাকসেলের সামনে দাঁড়িয়ে কম দামে পণ্য পেয়ে এভাবেই একাধারে ভোগান্তি ও সন্তুষ্টির কথা জানান আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশনে কর্মরত নাজমুল হাসান।

নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের জন্য কম মূল্যে এই পণ্য বিক্রি করছে সরকার। তবে মধ্যবিত্তরাও লজ্জা ভুলে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। ভোক্তাদের অভিযোগ, অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর যা পাওয়া যাচ্ছে তা সামান্যই। আবার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে একই পরিবারের কয়েকজন লুফে নিচ্ছেন কম দামের এসব পণ্য। ডিলাররাও বলছেন, কর্তৃপক্ষের সঠিক নির্দেশনার অভাবে শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না। 

বুধবার (১৩ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁও পরিকল্পনা কমিশন চত্বরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকসেলে এই চিত্র দেখা গেছে। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ট্রাকসেলেও একই চিত্র দেখা গেছে।

টিসিবির তেজগাঁও অঞ্চলের কর্মকর্তা ও মুখপাত্র হুমায়ুন কবির খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারকে ডিলারের মাধ্যমে দোকান থেকে আমরা তিনটি পণ্য দিচ্ছি। অক্টোবর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে প্রতিদিন ৫০টি ট্রাকে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে।’

ট্রাকে পণ্য বিক্রির সময় ছোটখাটো ভুলত্রুটির কথা স্বীকার করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশৃঙ্খলার কারণে গতকাল দয়াগঞ্জ মোড়, যাত্রাবাড়ী বউবাজার ও গেন্ডারিয়া থানার পাশে পাঠিয়েও গাড়ি ফেরত আনা হয়েছে। আগে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বিশৃঙ্খলার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। ডিলারদের টোকেনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করতে বলা হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ৩০০ টোকেন দেওয়ার পর যেন পণ্য বিক্রি শুরু করা হয়। নিজ এলাকায় পণ্য বিক্রির সুযোগ দিলে ডিলাররা পরিচিত লোকজনের কাছে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ আসে। তাই তাদের ভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য বলা হয়েছে।’

মূল্যস্ফীতির কারণে কয়েক মাস ধরে পণ্যমূল্য সাধারণের লাগামের বাইরে। অন্তর্বর্তী সরকার নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারের জন্য ঢাকা মহানগরে টিসিবির মাধ্যমে ৫০টি ট্রাকে তেল, ডাল ও চাল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভর্তুকি মূল্যে এই তিন পণ্যের বিক্রি ২৩ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে।

টিসিবি থেকে জানানো হয়, ১০০ টাকায় এক লিটার ভোজ্যতেল, ৬০ টাকায় এক কেজি মসুর ডাল এবং ৩০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল ও পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারছেন। 

অন্যদিনের মতো গতকালও টিসিবি রাজধানীর ৫০টি স্থানে ট্রাকসেলের মাধ্যমে এসব পণ্য সুলভ মূল্যে বিক্রি করেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে দেখা যায়, মেসার্স চাঁদপুর জেনারেল স্টোর নামের ডিলারের ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ লাইন। দুপুর ১২টার দিকে ৩০০ জন ক্রেতার জন্য ৭০০ কেজি ডাল, ৭০০ লিটার তেল ও ১ হাজার ৭৫০ কেজি চাল আনা হয়। পণ্য কম দামের হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও আলাদাভাবে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ান। চাঁদপুর জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. তরিকুল ইসলাম এসব পণ্য বিক্রি শুরু করলে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।

লাইনে দাঁড়ানো মেট্রোরেল-৬-এ কর্মরত নিজামুল হোসেন বলেন, ‘আমরা ছয়জন এসেছি। কম দামে এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে জেনে ভালোই লাগছে। কিন্তু পরিমাণে বেশি হলে আরও ভালো লাগত। কারণ একবারে নেওয়া পণ্যে সংসারের সারা মাস চলে না। বারবার লাইনে দাঁড়াতে মানসম্মানে লাগে।’

একই কথা বলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফানসুরও। তিনি বলেন, ‘লাইনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগে। তাই একবার এসে বেশি পণ্য নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।’ এ সময় সুমনা নামে এক গৃহিণী বলেন, ‘স্বামী ড্রাইভার। তার আয়ে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে চলা মুশকিল হয়ে গেছে। তাই লজ্জা ঠেলেই লাইনে দাঁড়িয়েছি। ৪৮০ টাকায় চাল, ডাল ও তেল নিলাম। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে পাওয়ার পর ভালো লাগছে।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান ও প্রেসক্লাবের সামনেও দেখা গেছে একই চিত্র। ডিলাররা ট্রাক আনার আগে থেকেই কম দামে পণ্য পাওয়ার আশায় দীর্ঘ লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকেন ভোক্তারা। দুপুর ১২টার দিকে ট্রাকভর্তি পণ্য এলেই শুরু হয়ে যায় হুড়োহুড়ি। সবার চেষ্টা থাকে কে কার আগে পাবেন।

শুধু টিসিবির ট্রাকসেলেই নয়, কৃষি বিপণন অধিপ্তরের ট্রাকসেলেও দেখা গেছে মধ্যবিত্তসহ নিম্ন আয়ের মানুষের দীর্ঘ লাইন। তারা ১০ অক্টোবর থেকে রাজধানীতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, পেঁপে, লাউ, কাঁচা মরিচ ২০টি এলাকায় খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) করছে। নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গতকাল বেলা ১১টায় মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের পাশে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র সোহান আলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অবশেষে টিপসই দিয়ে ৪৮০ টাকার প্যাকেজে এক কেজি পটোল, এক ডজন ডিম, পাঁচ কেজি আলু, দুই কেজি পেঁয়াজ ও এক কেজি কচু পেলাম। ভালোই লাগল।’ এ সময় সুমা নামে এক গৃহিণী বলেন, ‘স্বামী বেকার। আয়-রোজগার নেই। বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কম দামে ডিমসহ কয়েক পদের পণ্য পেলাম। বাচ্চাদের নিয়ে কয়েক দিন খাওয়া যাবে।’

এ সময় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা টি এম মাহবুব হাসান বলেন, ‘৯৭ হাজার ৯৫০ টাকার পণ্য আনা হয়েছে। ৩০০ পরিবারের কাছে বিক্রি করা হবে। কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন এভাবে পণ্য সরবরাহ করে। আমরা একেক দিন একেক স্পটে বিক্রি করি।’

কাদেরের আশকারায় বেপরোয়া ছিলেন বদি

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ পিএম
কাদেরের আশকারায় বেপরোয়া ছিলেন বদি
সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি। ছবি: খবরের কাগজ গ্রাফিকস

উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪ আসনের গডফাদার ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি। শুধু টেকনাফবাসী নয়, গোটা দেশবাসী তাকে ইয়াবা বদি হিসেবে জানে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, অনেক বিতর্কিত হওয়ার পরও বদি টিকে থাকতে পেরেছিলেন শুধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আশকারার কারণে। দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বেশ কয়েকবার বদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও কাদেরের বাধার কারণে তা সফল হয়নি। ফলে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন বদি।

দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় ইয়াবা ব্যবসার পাশাপাশি কর ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি, মাদক-স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডির ব্যবসা, মানব পাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা সমানতালে করতে পেরেছেন বদি। তার অবৈধ ব্যবসার কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদিকে বাদ দিয়ে স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নে শাহীন আক্তার এমপি হলেও তিনি ছিলেন স্বামীর কাঠের পুতুল। স্থানীয় প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনে এমপির কাছে না গিয়ে বদির কাছে যেতেন। কারণ, এলাকায় অঘোষিত এমপি ও নিয়ন্ত্রক ছিলেন আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদি।

ওবায়দুল কাদেরের প্রশ্রয়ে লাগামহীন বদি: এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল বদির পরিবার। বদির বাবা বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ সালের আগ থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ান বদি। ২০০৮ সালে নৌকার মনোনয়নে এমপি হয়ে এলাকায় গড়ে তোলেন মাদকের সাম্রাজ্য। ওবায়দুল কাদের যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন, তখন তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন বদি। ওবায়দুল কাদেরের আস্থাভাজন পরিচয় দিয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তার কুকীর্তি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে টেকনাফে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেন বদি। অবৈধ পথে উপার্জিত মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করেন ওবায়দুল কাদেরের পেছনে। গত প্রায় ১৬ বছরে উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে (ইউনিয়ন-উপজেলা-মেম্বার) বদি তার মাদক সিন্ডিকেটের লোকদের জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন। বিনিময়ে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বদির শাসনের অবসান চেয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তরে একাধিক অভিযোগও দিয়েছেন। কিন্তু বদি দুই হাতে টাকা ছিটিয়ে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরও নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে অনেক অভিযোগই দলের হাইকমান্ডের কাছে পৌঁছতো না। তার আগেই দপ্তর থেকে অভিযোগ সরিয়ে ফেলা হতো। সারা দেশে ইয়াবা বদি ও তার পরিবারকে নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠলেও অবস্থার কোনো হয়নি। বরং ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদে বদির পরিবর্তে তার স্ত্রী নৌকার মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। ফলে এই এলাকা ঘুরে-ফিরে বদির কথাই ছিল শেষ কথা।

কক্সবাজার জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মো. আব্দুল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বদির বাবা একসময় জাতীয় পার্টি করেছেন। এরপর বিএনপির রাজনীতি করে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছেন। আসলে এরা হচ্ছেন মাফিয়া। নির্দিষ্ট কোনো দলের রাজনীতি তাদের জন্য না। যে সময় যারা ক্ষমতায় থাকে এই পরিবারও সেদিকে চলে। তিনি বলেন, ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হলে বদি তার সঙ্গে সখ্য বাড়ান। এতে করে টেকনাফে তার অবৈধ ব্যবসা আরও বাড়তে থাকে। কাউকেই তোয়াক্কা করতেন না বদি।

টেকনাফের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজারের এই এলাকায় ইয়াবাসহ সব অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বদি ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত। টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা পাচারের সূত্রপাত হয় বদির পরিবারের হাত ধরেই। বিভিন্ন চোরাকারবারে অঘোষিত অনুমতি দিতেন বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান। বদির ছেলে শাওন আরমানও এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। বদির ভগ্নিপতি কথিত সিআইপি ফারুকও সমানতালে মাদকের কারবার করতেন। তার মাধ্যমে নতুন ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, স্বর্ণ চোরাচালানসহ অবৈধভাবে মায়ানমারে পণ্য আদান প্রদানের সিন্ডিকেট পরিচালিত হতো। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে গত প্রায় ১৬ বছর ধরে চলা তাদের মাদকের কারবারে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে আড়ালে থেকে ভিন্ন লোকদের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বদির সিন্ডিকেট।

স্ত্রী এমপি হওয়ার সুবাদে বদির দাপট: স্ত্রী এমপি হওয়ায় বদি দাপট দেখাতেন। তার দাপটে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ ছিলেন। সংসদ সদস্য স্টিকারযুক্ত গাড়ি করে তিনি চট্টগ্রাম-ঢাকা শহরের বিভিন্ন বিভাগে স্বর্ণসহ অবৈধ পণ্য সরবরাহ করতেন। তার একটি বড় মাফিয়া সিন্ডিকেট ছিল। তারা প্রশাসনকে হুমকি দিত। সাধারণ লোকজন বদির ভয়ে মুখ খুলতেন না। তার পছন্দমতো কাউন্সিলর, ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান বানিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করে এলাকায় অপকর্ম করতেন। নিজের টাকা খরচ করে ভালো মানুষকে অবৈধ কাজে ফাঁসানোর অনেক অভিযোগ রয়েছে বদির বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা বলেন, তার জন্য আজ পুরো টেকনাফ কলঙ্কিত হয়ে গেছে।

বেপরোয়া ভাই মুজিবুর: বদির বাবা টেকনাফের বহুল আলোচিত এজাহার মিয়া ওরফে এজাহার কোম্পানি। অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও তিনি ছিলেন টেকনাফের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। বাবার প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম শুরু করেন বদি। এমপি হওয়ার পরে নিজেই গড়ে তোলেন মাদক চোরাচালানের সিন্ডিকেট। মাথার ওপরে বদির ছায়া থাকায় উখিয়া ও টেকনাফে লাগামহীন ছিলেন তার ভাই মুজিবুর। মুজিবুর রহমান বদির সৎভাই। তার নানার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি মায়ানমারের মংডু শহরে। এর ফলে টেকনাফ এবং মায়ানমারে গত ১৬ বছর ধরে সীমান্ত চোরাচালান ও মাদক কারবারের স্বর্গরাজ্য গড়েছেন দুই ভাই। সকলের নাগের ডগায় এসব অপকর্ম চললেও অদৃশ্য কারণে নীরব ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়াও সরকারি খাস জায়গা দখল, বিচারের নামে সাধারণ লোকদের হয়রানি, দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে-বেনামে মামলা দিয়ে ঘরছাড়াও করেন এই মুজিবুর।

নাফ নদের প্রধানমুখ টেকনাফের কায়ুকখালী খাল দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেন মুজিবুর। খরস্রোতা খালটি বদি ও মুজিবুর সিন্ডিকেট সদস্যদের কারণে এখন কোথাও নিশ্চিহ্ন আবার কোথাও সরু নালায় পরিণত হয়েছে। খালের ৩ শতক জায়গার ওপর মার্কেট নির্মাণ করেছেন মুজিবুর। টেকনাফের সরকারি ১নং খাস খতিয়ানের খালের জায়গা ও খালের মুখ পৌরসভার বর্জ্য ফেলে বাকি অংশটুকুও ভরাট করে মার্কেট নির্মাণের কাজ চলছে।

অর্থপাচার ও চোরাচালানের রুট: টেকনাফে স্থলবন্দর থাকা সত্ত্বেও শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্য মায়ানমার থেকে আসা মাদক, রিচ কফি, বিভিন্ন রকমের ক্যালসিয়াম, কসমেটিক্স পণ্য রাতের আঁধারে চোরাই পথ দিয়ে টেকনাফে আসত। এসব দেশে আনার জন্য ব্যবহার হতো জালিয়াপাড়ার জেটিঘাট (বদির জেটি), মুজিবের নিজস্ব ঘাট (২ বিজিবি বিউপি ১০০ মিটার পরে), টেকনাফ স্থলবন্দর, কায়ুকখালী খাল, বড়ই তুলি ঘাট, নাইট্যংপাড়ার ঘাট ও মেরিন ড্রাইভসহ বিভিন্ন রুট। এসব পথে প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকার দেশীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী পাচার হতো মুজিবুরের শ্বশুরের এলাকা মায়ানমারের মংডুতে। আর বিনিময়ে ওপার (মায়ানমার) থেকে নিয়ে আসা হতো বিদেশি অস্ত্র, মাদক, স্বর্ণ, কফি ও রোহিঙ্গা।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, এ মাদকগুলো বিক্রি করে মায়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠনের সদস্যরা। তাদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় এ পারের মাদক কারবারিরা হুন্ডি ও সিঅ্যান্ডএফ ড্রাফটের মাধ্যমে লেনদেন করত। এক্ষেত্রে সুকৌশলে মায়ানমারে বছরে পাচার হতো প্রায় কয়েক লাখ কোটি টাকা। এসব কিছু্র মূল হোতা ইয়াবা বদি।

সিন্ডিকেটের অবৈধ টাকা হুন্ডিতে লেনদেন করতেন আব্দুর রহমান বদির পার্টনার ও হিসাবরক্ষক ব্যবসায়ী ফারুক ও সজিব। বদির সিন্ডিকেটের কালো টাকা সাদা করার জন্য সিঅ্যান্ডএফের ড্রাফট ব্যবহার করে মায়ানমারে টাকা পাচার হতো। গত ১৬ বছর স্থানীয় এবি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক তারাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে অর্থ লেনদেনের সব কিছুই ধামাচাপা পড়ে যেত। গেল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বদির স্ত্রী শাহিনা আক্তার নমিনেশন পাওয়ার পর তাকে ২ কোটি টাকা উপহারও দিয়েছিলেন তারা।

নাফ নদেও একক প্রভাব: স্থানীয় জেলেরা জানান, দীর্ঘ ৮ বছর নাফ নদে মাছ ধরায় সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ইয়াবা পাচারের পাশাপাশি অবাধে মাছ ধরত মুজিবুরের লোকেরা। বদির ক্ষমতার দাপটকে কাজে লাগিয়ে মুজিবুরের ২০টির বেশি ট্রলার মায়ানমার সীমান্তে মাছ শিকার করে। যদিও নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে টেকনাফের ১০ হাজারের বেশি জেলে পরিবার মাছ ধরতে পারছে না। কিন্তু বদি ও তার ভাইয়ের জেলেরা নির্বিঘ্নে মাছ শিকারের পাশাপাশি মায়ানমার নাগরিক পারাপার, ইয়াবা পাচার, স্বর্ণ ও অস্ত্র পাচার করে যাচ্ছিলেন।

এসব বিষয়ে মুজিবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি সব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি কোনো চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত না। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না, রাতের আঁধারে কে বা কারা কী করে আমি জানি না।

বদির ব্যবসায়ী গ্যাং ও নিকটাত্মীয়: ইয়াবা বদির ম্যানেজার জাফর আহমেদকে সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে আটক করেছে র‌্যাব। তিনি টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিদের একজন। বদি জাফরকে দিয়ে টেকনাফকে পরিণত করেছিলেন মাদক, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যার স্বর্গরাজ্যে। বদির অপরাধ জগতের বিশ্বস্ত সহচর জাফর একসময় ছিলেন পান বাজারের শ্রমিক। সেখান থেকে হয়ে উঠেন শ্রমিক নেতা, পরে দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ। এই চাঁদাবাজির অর্থে তিনি টেকনাফ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেন।

বদির সংস্পর্শে এসে ছেঁড়া জামা ও লুঙ্গি পরা আজগর মাঝি এখন বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে গেছেন। বদির আশীর্বাদে টেকনাফ স্থলবন্দরের সব সেক্টর তার নিয়ন্ত্রণে চলে। তাকে মোটা অঙ্কের বকশিশ না দিলে আমদানি রপ্তানির মালামাল লোড আনলোড হয় না বলে ব্যবসায়ীরা জানান। স্থলবন্দরে দৈনিক ৭ ও ৮ শত রোহিঙ্গা শ্রমিক তার অধীনে কাজ করতেন এবং অবৈধ মালামাল বৈধ মালামালের মধ্যে মিশিয়ে গাড়িতে বোঝাই করে নিয়ে যেতেন বন্দর থেকে।

বদির ক্ষমতা ব্যবহার করে বন্দরসহ বিভিন্ন স্থান দিয়ে মাদক আনতেন বদির ভাই আব্দুস শুক্কুর। এভাবে তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আরেক ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান সাবেক কাউন্সিলর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, মাদক, চোরাচালান, সব কাজে বদির প্রভাব দেখিয়ে ট্রানজিট জেটি ব্যবহার করে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করেন।

এ ছাড়াও বদির অবৈধ ব্যবসার দেখভাল করতেন গফুর আলম, চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলম, ভাগিনা শাহেদ রহমান নিপু (সাগরপথে মাদক আমদানি করেন) ও ভাতিজা আদিব রহমান। তারা মায়ানমারে মালামাল পাচার ও মাদক আমদানি করতেন। ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল মাদক ব্যবসা করে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আরেক ফুফাতো ভাই মো. আব্দুল্লাহ বদির ক্ষমতার দাপটে বন্দর ও এলাকায় প্রভাব দেখিয়ে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার কয়েক কোটি টাকার জমি রয়েছে বলে জানা গেছে।

শ্রমিক নেতা আলী আজগর, সমশু আলম, মতলব, ফয়েজ উল্লাহসহ কয়েকজন বদির প্রতিদিনের আয়ের হিসাব রাখতেন। ভাগিনা কিং সালমান মামা বদির ক্ষমতার প্রভাবে মায়ানমার থেকে নাফ নদী দিয়ে মাদক আমদানি ও অবৈধ অস্ত্র দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতেন।

এ ছাড়া বদির ব্যবসায়িক অংশীদার ওসমান গণি, শহিদ ও মো. শফিক, ভাগিনা ও সাবেক কাউন্সিলর রেজাউল করিম মানিক, বদির ভাই শুক্কুরের ম্যানেজার মারুফ বিন খলিল, বোনের জামাই ওমর ফারুক, বদির আস্থাভাজন মোহাম্মদ আলম বাহাদুর তার ক্ষমতা ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে বদি গ্রেপ্তার হন। তার পরিবার ও সিন্ডিকেট সদস্যরা গা-ঢাকা দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। তার স্ত্রী এমপি শাহীন আক্তার ভারতে পালিয়ে গেছেন। বদির ছেলে লন্ডনে চলে গেছেন। তারপরও স্থানীয় লোকজন তাদের বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। বদির সিন্ডিকেটের ভয় এখনো স্থানীয় জনসাধারণের মনে বিরাজ করছে।