প্রবাসী বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া এবং ভোটার নিবন্ধনভুক্তির কাযর্ক্রমকে গতিশীল করতে সম্প্রতি নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে বিগত ৪ বছরে এই কার্যক্রমের ৪ ভাগের ১ ভাগও শেষ করতে পারেনি ইসি। ৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল বিশ্বের ৪০টি দেশে থাকা প্রবাসীদের মাঝে স্মার্ট এনআইডি বিতরণের কার্যক্রম সম্প্রসারণ। কিন্তু গত ৪ বছরে সংস্থাটি তাদের এই কার্যক্রম চালু করতে পেরেছে মাত্র ৭টি দেশে। নতুন করে আরও ৯টি দেশে কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে ইসি। তারপরও নির্ধারিত সময় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে মাত্র ৬ মাসে সংস্থাটির এই কার্যক্রম শেষ হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর, প্রকল্পের কার্যকালের শেষ বছরে এই কার্যক্রম দ্রুত সম্প্রসারণে চলছে ইসির নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসীদের মাঝে স্মার্ট এনআইডি বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে সে দেশ সফরে যাচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তার সফরসঙ্গী হবেন ইসি সচিব শফিউল আজিমসহ আরও দুই কর্মকর্তা। এর আগে গত ৩ জুলাই মালয়েশিয়ায় ইসির প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের প্রাথমিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে সে দেশ সফর করে এসেছেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের নেতৃত্বে ইসির ৩ কর্মকর্তা। গত ২ জুলাই থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত তারা মালয়েশিয়া সফর করেন। এর আগে এই কার্যক্রম তদারকিতে ইতালি সফর করেন অশোক কুমার দেবনাথ।
প্রবাসে এনআইডি সেবা কার্যক্রমকে গতিশীল করতে এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, কুয়েত, কাতার ও যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মাঝে স্মার্ট এনআইডি কার্ড বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন হয়। প্রবাসীদের জন্য স্মার্ট এনআইডির কার্যক্রম উদ্বোধন করতে এর আগে কুয়েতে যান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, যুক্তরাজ্যে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর, ইতালিতে যান বেগম রাশেদা সুলতানা। পরিকল্পনায় থাকা অন্যান্য দেশে এই কার্যক্রম চালুর প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণে সেসব দেশে পর্যায়ক্রমে সফর করছেন নির্বাচন কমিশনার, সংস্থার প্রবাসী শাখা, আইটি ও টেকনিক্যাল শাখার কর্মকর্তারা।
ইসির এই কার্যক্রম লক্ষ্যমাত্রা থেকে কেন এত পিছিয়ে? এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই কার্যক্রম শুরুর পরের বছরই বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রভাব শুরু হয়। সেই পরিস্থিতিতে প্রায় দুই বছর এ ব্যাপারে বিদেশি দূতাবাসগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। পরে একেকটি দেশে কার্যক্রম শুরু করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মতি, সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে সমন্বয় করতে সময় লেগেছে। তারপর ২০২২ সালের শেষ দিকে কাজটি আমরা পুনরায় শুরু করি। এ ছাড়া গত ২০২৩ সাল জুড়েই ছিল জাতীয় নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ। সংসদ নির্বাচনের পর দূতাবাসগুলোর সঙ্গে আমাদের আলোচনা আরও এগিয়েছে। এমনকি সারা দেশে বিগত উপজেলা নির্বাচন চলাকালেও আমরা প্রবাসে এই কার্যক্রম চালিয়েছি’।
১৯৯৮ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার সংবিধান স্বীকৃত বলে ঘোষণা দেয় দেশের উচ্চ আদালত। অথচ দীর্ঘ ২৬ বছরেও সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে ইসি আহসান হাবিব খান বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরও মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে বঞ্চিত ছিলেন। নাগরিকত্ব সনদ (এনআইডি) না থাকায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো, পাসপোর্ট করাসহ নানা কাজে তারা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। মাতৃভূমি বাংলাদেশে মাঝে মাঝে ফিরে আসার ইচ্ছা থাকার পরও সেই সুযোগ তাদের ছিল না। তাদের দীর্ঘদিনের সেই সংকট অবসানে প্রবাসীদের স্মার্ট এনআইডি দিয়ে ভোটার তালিকাভুক্ত করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন’।
ইসির প্রবাসী নিবন্ধন শাখার পরিচালক মো. আব্দুল মমিন সরকার খবরের কাগজকে জানান, চলমান এই কার্যক্রম সম্প্রসারণে বাকি থাকা ৩৫টি দেশের দূতাবাসের সঙ্গে ইসির কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ওইসব দেশে প্রবাসীদের মাঝে স্মার্ট এনআইডি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ পর্যায়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কুয়েত, কাতার ও সৌদি আরবে ইসির প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে।
কার্যক্রম চলমান থাকা ওইসব দেশে মোট আবেদনকারীর সংখ্যা ২৭ হাজার ৪৮৪ জন। তাদের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত স্মার্ট এনআইডি হাতে পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৯৩ জন প্রবাসী বাঙালি। কার্যক্রমটি দ্রুত সম্প্রসারণে পর্যায়ক্রমে বাকি দেশগুলোর দূতাবাসের মাধ্যমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তার অংশ হিসেবে আরও ৯টি দেশে- সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালদ্বীপ, ওমান, বাহরাইন, জর্দান, লেবানন ও লিবিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্যও এনআইডি কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে খুব শিগগির কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্তত তিনটি দেশে এনআইডির প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
পরিচালক আব্দুল মমিন আরও জানান, শুধু সৌদি আরব ছাড়া এ পর্যায়ে কার্যক্রম চলমান থাকা সব দেশেই কাজ এগোচ্ছে দ্রুতগতিতে। গত বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে সৌদি আরবে এনআইডি প্রদান কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎপরতা ছিল কম। ফলে সে দেশে বসবাসরত প্রায় ২৮ লাখ অভিবাসীর মধ্যে বিগত ৮ মাসে ১ হাজারের বেশি প্রবাসী এনআইডির জন্য আবেদন করেন। তাদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত হয়েছে শতাধিক বাংলাদেশির জাতীয় পরিচয়পত্র। সৌদি প্রবাসীদের হাতে স্মার্ট এনআইডি দিয়ে সেখানকার কার্যক্রম উদ্বোধনে আগামী ২০ জুলাই সৌদি আরব যাচ্ছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। তার সফরসঙ্গী হবেন তার একান্ত সচিব শাহ মো. কামরুল হুদা ও ইসির সিস্টেম ম্যানেজার মো. রফিকুল হক। ইসি আনিছুর রহমান তার স্ত্রী ও পুত্রকেও নিজ খরচে নিয়ে যাবেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি রয়েছেন প্রায় ২ কোটি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় ২০১৯ সালে প্রবাসী ওইসব বাংলাদেশির মাঝে এনআইডি সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা। ৪০টি দেশে পাঁচ বছর মেয়াদি ওই কার্যক্রমটি পরিচালনায় ইসির বরাদ্দ ছিল এক শ কোটি টাকা। আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং এক্সেস টু সার্ভিসেস-আইডিইএ (স্মার্ট এনআইডি) প্রকল্পের আওতায় প্রবাসীদের মাঝে স্মার্ট এনআইডি কার্যক্রম উদ্বোধন করে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন।
২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাসকারী প্রবাসীদের মাঝে এর প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। তার আগে একই বছর ৫ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এবং স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার অংশ হিসেবে অনলাইনে আবেদন গ্রহণের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের অনলাইনের ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করে ইসি। সে বছর থেকে করোনা মহামারির প্রভাবে প্রায় ২ বছর স্থবির ছিল প্রবাসে ইসির স্মার্ট এনআইডির কর্মপরিকল্পনা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থবির থাকা সেই কার্যক্রম ফের পুনরুজ্জীবিত হয়।