সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রবাসীরা। বিদেশে বিক্ষোভ করে সাজা পাওয়া প্রবাসীদের ব্যাপারে সরকারের ‘অবহেলা’, বিক্ষোভে অংশ নেওয়া প্রবাসীদের তালিকা করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা, টাকা না পাঠালে দেশে আসতে দেওয়া হবে না এমন ‘গুজব’ ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখায় দেশে থাকা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় ক্ষুব্ধ অনেক প্রবাসী।
এমন প্রেক্ষাপটে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রবাসীরা যেন আর কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হন, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলো কাজ করছে।
সৌদি আরবে থাকেন চাঁদপুরের বাসিন্দা শাহজালাল। দেশটিতে ছোটখাটো ব্যবসা করেন তিনি। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রবাসীদের বিক্ষোভ নিয়ে সরকারের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেসব প্রবাসী বিক্ষোভ করায় শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে সরকারের কিছু করার নেই- সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দুজন মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন শাহজালালসহ অনেক প্রবাসী।
শাহজালাল ফোনে খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিদেশে আমাদের অভিভাবক তো সরকার। এমনিতেই দূতাবাসের কাছ থেকে আমরা তেমন সাহায্য-সহযোগিতা পাই না, এখন যদি সরকার এমন অবস্থান নেয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব? নিজের নাগরিক হিসেবে তো সরকারের একটা দায়িত্ব ও করণীয় আছে।’
বাহরাইনপ্রবাসী পাবনার মোশাররফ খবরের কাগজকে বলেন, ‘শুনেছি সরকার নাকি দূতাবাসগুলোর কাছে নামের তালিকা চেয়েছে, যারা বিক্ষোভ করেছে। সরকার যদি এমন বিমাতাসুলভ আচরণ করে, তাহলে তো সেটা দুঃখজনক। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার জন্য সরকার প্রায় এককভাবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপরই নির্ভর করে। এ জন্য আমাদের বিশেষ কোনো সম্মানও দেওয়া হয় না সরকারের পক্ষ থেকে। বিদেশে বিপদে-আপদে পড়লে দূতাবাসের সাহায্য খুব কমই পাওয়া যায়।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে মোশাররফ বলেন, ‘দূতাবাসগুলোর সাহায্য সেভাবে না পেয়েও তো আমরা টিকে আছি। দেশের উন্নয়নে সাধ্যমতো ভূমিকা রাখছি। কিন্তু দূতাবাসগুলো যদি বৈরী হয়, তাহলে তো সমস্যা হয়ে যায়। সমস্যা শুধু যে প্রবাসীদেরই, তা নয়। সমস্যা তো মনে করি সরকারেরও। কারণ ডলারের সংকটের এই কালে রেমিট্যান্সের ওপরই তো সরকার ভরসা করছে।’
প্রবাসীদের ক্ষোভের কারণ
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অনেক বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটি ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত তিনজন আছেন, যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসব প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আইন লঙ্ঘন করেছে। এ কারণে তাদের সাজা হয়েছে। সরকার এদের ব্যাপারে কোনো আপিল করবে না।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী আরও কঠোর অবস্থানের কথা জানান। এক প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এসব বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তা ছাড়া দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ আইনে সাজা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকার পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।’
এসব ঘটনাপ্রবাহ যখন চলছে, ঠিক তখনই প্রবাসীরা জানতে পারেন তাদের মধ্যে যারা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন, তাদের তালিকা সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর কাছে চেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা নিয়েও প্রবাসীদের অনেকের ক্ষোভ রয়েছে।
ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে প্রায় দেড় দশক ধরে প্রবাসী জাকির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার এখন প্রবাসীদেরও ভয়ের মধ্যে রাখতে চাইছে। অথচ সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত সহযোগিতামূলক।’
এ ছাড়া সহিংসতার সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখাটাও ভালোভাবে নেননি প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা বলছেন, সরকার যদি অন্তত ‘ইমো’টাও খোলা রাখত, তাও কথা ছিল। অন্তত সাত দিন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। সন্তানের মুখ দেখতে পাইনি।
প্রবাসীদের ক্ষোভের কারণ আরেকটি ‘গুজব’। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ফেসবুকের একটি স্ক্রিনশট। স্ক্রিনশটে লেখা রয়েছে, রেমিট্যান্স না পাঠালে তাদের দেশে আসতে দেওয়া হবে না। যদিও প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এটিকে ‘গুজব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠানোর ‘ক্যাম্পেইন’ চলছে ফেসবুকে
এ অবস্থায় প্রবাসীরা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন ক্যাম্পেইন চালু করে। ক্যাম্পেইনের বিষয়বস্তু হলো প্রবাসীরা যেন একটি টাকাও ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠান। ক্যাম্পেইনে টাকা পাঠাতে হুন্ডিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রবাসীরা টাকা না পাঠালে সরকার কেমন বিপদে পড়ে, এবার সেটা একটু বুঝুক সংশ্লিষ্টরা। অন্তত ছয় মাস ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠানোর ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে প্রবাসীদের একটি অংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি আসে হুন্ডির মাধ্যমে। বাকি টাকা আসে বৈধ পথে, ব্যাংকিং চ্যানেলে। এখন যদি বাকি টাকাও হুন্ডিতে পাঠানোর জন্য উৎসাহিত করা হয়, তাহলে তো আশঙ্কার ব্যাপার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘এমনিতেই দেশের অর্থনীতি মারাত্মক চাপে আছে। তিন বছর ধরে ডলারসংকটও তীব্র। এ অবস্থায় রেমিট্যান্সই অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এখন প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিকে অগ্রাধিকার দিলে অর্থনৈতিক সংকট আরও ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছাবে।’
সরকার এখন যা বলছে
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে আইনের আওতায় আসা প্রবাসীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বিগ্ন বলে গত শনিবার জানান তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব ঘটনা ঘিরে আমাদের অন্য প্রবাসীরা যেন আর কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হন, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দূতাবাসগুলো কাজ করছে। সরকার প্রবাসীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর।
একই দিন জুনাইদ আহমেদ পলক প্রবাসীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দোহাই আপনারা গুজবে বিভ্রান্ত হবেন না। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনবান্ধব সরকার সব সময় প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে আমাদের সবাইকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। সব ধরনের গুজব ও অপপ্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অপপ্রচারকারীদের রুখতে হবে।’
এ সময় প্রতিমন্ত্রী একটি স্ক্রিনশট উপস্থাপন করে বলেন, ‘এই কথা আমি বলিনি যে যেসব প্রবাসী টাকা পাঠাবেন না তারা দেশে আসতে পারবেন না।’