২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে। গত ৫ জুন হাইকোর্ট নবম থেকে তেরো গ্রেডের চাকরিতে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবি জানান। দুই দিন বিরতি দিয়ে ৯ জুন শিক্ষার্থীরা আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন এবং দাবি পূরণে ৩০ জুন পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন।
একই সঙ্গে স্মারকলিপি দেওয়া হয় অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর। এ ছাড়া হাইকোর্টে দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে তা ৪ জুলাই শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়।
আলটিমেটাম শেষ হলে ১ জুলাই আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি পালিত হয়। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে গণপদযাত্রা শুরু হয়। কর্মসূচি থেকে এক ঘণ্টার জন্য রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। ৩ জুলাইও দেড় ঘণ্টার জন্য শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করেন।
আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত না করায় ৪ জুলাই কর্মসূচি থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেন আন্দোলনকারীরা। এদিন শাহবাগ মোড় অবরোধ করা হয় ৫ ঘণ্টার জন্য। ৫ জুলাই চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে সড়ক অবরোধ করা হয়। ৬ জুলাই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির কারণে যান চলাচলসহ সবকিছু স্থবির হয়ে আসে। ৮ জুলাই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়কের পাশাপাশি রেলপথও অবরোধ করা হয়। আর চার দফা দাবির পরিবর্তে এক দফা দাবি জানানো হয়। নির্বাহী বিভাগের কাছে সব গ্রেডের চাকরিতে কোটার সংস্কারের দাবি তুলে ধরেন প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
এদিন প্ল্যাটফর্মের ৬৫ জনের সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়কের নাম ঘোষণা করা হয়। ৯ জুলাইও শাহবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন। এ সময় শুনানিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটা আজকে না, আমি যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিলাম, তখন একটি মামলায় বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এটি সঠিক পদক্ষেপ না।’
১১ জুলাই পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকে বেআইনি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শিক্ষার্থীরা লিমিট ক্রস করছেন বলে মন্তব্য করেন। ১১ জুলাই ছুটির দিনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেলপথ অবরোধ করেন। ১৩ জুলাই শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি দেন। ১৪ জুলাই তারা গণপদযাত্রা-সহকারে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি দেন। দাবি পূরণে ২৪ ঘণ্টার সময় দেন। একই দিন সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটার বিষয়টি আদালতের বলে উল্লেখ করেন। সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ এই উক্তির পরে মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা স্লোগান দিয়ে বলেন, চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার। কে বলেছে?, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
মধ্যরাতে বিক্ষোভ হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের রাজাকার স্লোগানের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ যথেষ্ট বলে মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এর শেষ দেখে ছাড়বেন বলে জানান। ওই দিন বেলা ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিও করা হয়। ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়। নিহত হন ৬ জন। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ভিডিও প্রকাশিত হলে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়। গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৬ জুলাই দিনগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বিতাড়ন করা হয়। ছাত্রলীগমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজা কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিন রাতে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। ১৮ জুলাই ৪১ জন নিহত হন এবং দেশের ৪৭ জেলায় দেড় হাজারের বেশি আহত হন। সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাট ডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় ৫৬ জন নিহত হন। এদিন শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি জানান। রাতে জারি করা হয় কারফিউ।
২০ জুলাই ঢাকার যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। মারা যান ২৬ জন। আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়া হয়। রাতে আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও হাসিব আল ইসলাম আট দফা দেন। ২১ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে কোটার সংস্কার করে রায় দেন। সেখানে মেধায় ৯৩ শতাংশ, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারিত হয়। একই সময়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে সমন্বয়ক রিফাত রশীদ, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে। ২২ জুলাই কোটা নিয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপনের অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৭তে। ২৩ জুলাই কোটার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। হাসপাতালে আহতদের মধ্যে অনেকে মারা যাওয়ায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯৭-এ। রাতে সীমিত আকারে চালু করা হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। ২৪ জুলাই আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়।
নিখোঁজ থাকা সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ও বাকের মজুমদারের সন্ধান পাওয়া যায়। ২৫ জুলাই কোটা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হয়নি উল্লেখ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৬ জুলাই ব্লক রেড দিয়ে সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয় ৬ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে। মামলা হয় ৫৫৫টি। মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৯-এ। হাসপাতাল থেকে প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে হেফাজতে নেয় ডিবি। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকেও হেফাজতে নেওয়া হয়। ১১ দিনে গ্রেপ্তার হয় ৯ হাজার ১২১ জনকে। ২৮ জুলাই আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নেওয়া হয় এবং ডিবি অফিস থেকে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তবে বাকি সমন্বয়করা এই কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা জোর করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
২৯ জুলাই রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটে। অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সরকার সারা দেশে শোক পালনের কর্মসূচি দেয়। সেটি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীরা চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে অনলাইনে প্রতিবাদ জানাতে বলেন। ৩০ জুলাই লাল-কালোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একাকার হয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৩১ জুলাই ঘোষণা করা হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি। ১ আগস্ট ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেয় ডিবি। সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২ আগস্ট শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেন। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে হয় বড় জমায়েত। সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন চালানোর কথা বলেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। ৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ । সারা দেশে নিহত হন শতাধিক। আন্দোলনকারীরা ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। এ কর্মসূচিকে সামনে রেখে সরকার ৪ আগস্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে। এদিনই শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে বলে জানান।