ফের সচল হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। চলছে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের প্রস্তুতি। যদিও বিচারকশূন্য ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ কয়েক মাস ধরে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। তবে গত ১৪ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ দায়ের হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যক্রমে গতি সঞ্চার হয়েছে। এখন ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হলেই আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হবে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে গত রবিবার নতুন চিফ প্রসিকিউটরসহ কয়েকজন প্রসিকিউটর যোগদান করায় তদন্ত সংস্থার কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। অভিযোগের সূত্র ধরে গণহত্যার যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত ও আলামত সংগ্রহের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে হতাহতদের তথ্য চেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, বড় বড় কবরস্থান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে এ চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
অবশ্য ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অন্তত ৬৩১ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ১৯ হাজার ২০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
গণহত্যার সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আসামি পক্ষ প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আইনজীবী আনলেও প্রসিকিউশন পক্ষ আপত্তি করবে না বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
তিনি গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালে শেখ হাসিনাসহ গণহত্যা মামলার আসামিরা চাইলে বিদেশি আইনজীবী রাখতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রসিকিউশন টিমের কোনো আপত্তি থাকবে না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রসিকিউশন টিমের যা যা করা দরকার, সেটা করবে। প্রসিকিউশন টিম কয়েকটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেছে। হাসপাতাল পরিচালকদের কাছেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে জেলা প্রশাসক, গণমাধ্যম, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা ভিডিও-ছবির জন্য চিঠি পাঠানো হচ্ছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত করার জন্যই এই উদ্যোগ। যাতে করে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকে। ক্ষতিগ্রস্তরা এই গণহত্যার বিচারের জন্য মুখিয়ে আছেন। সাক্ষীরাও আগ্রহী। আলামত তাজা থাকতেই বিচার প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। সে সময় মামলার তদন্ত ও বিচারকাজে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও তৈরি হয়। বিচারকাজ ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এ সময়ের মধ্যে অনেক আলোচিত মামলার রায় হয় এবং সেসব রায় কার্যকর করা হয়।
গত ১৪ বছরে ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এসব মামলায় ১৪৯ জনকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ৬ জনের। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা ৫ জন এবং একজন বিএনপির নেতা। ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে স্থবিরতা তৈরি হয় গত বছরেই। সর্বশেষ চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের নকলার তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সেই সময় ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার চলছিল। এরপর আর কোনো মামলার বিচারকাজ পরিচালনা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারকের মধ্যে একজন অবসরে যান, আরেকজনকে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং সর্বশেষ বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ-পিআরএল ভোগরত) এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া গত ২৭ আগস্ট অব্যাহতি নিলে বিচারকাজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়।
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা, সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী ও বেশ কিছুসংখ্যক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ১৪ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে ১১টি অভিযোগ দায়ের হয়। এরপর তদন্ত সংস্থার কার্যক্রম পুনরায় জোরদার হয়। বিচারকাজ শুরু করতে এখন অপেক্ষা শুধু বিচারক নিয়োগের।