স্বাস্থ্য প্রশাসনে অচলাবস্থা, হাসপাতাল পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষক ও চিকিৎসকদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় নাজুক হয়ে পড়েছে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রম। এ অবস্থার উন্নয়নে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে স্বাস্থ্য খাত সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার-সমর্থিত চিকিৎসকরা কর্মরত ছিলেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নিরাপত্তাহীনতায় তারা অনেকেই কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। একই সময়ে সরকারি হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষক ও চিকিৎসকদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আগস্ট মাস চলে গেলেও এখনো অনুমোদন হয়নি আগামী ৫ বছরের স্বাস্থ্য খাতের কর্মপরিকল্পনা (অপারেশন প্ল্যান-ওপি)।
মহাপরিচালককে (ডিজি) অপসারণের দাবিতে প্রায় এক মাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেই ডিজি (মহাপরিচালক) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বর্তমানে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ফলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রশাসনিক, আর্থিক, নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সৃষ্টি হয়েছে স্থবিরতা।
একই সঙ্গে সারা দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজে কর্মরত শিক্ষকদের একটি বড় অংশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ রোগীরা।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে যেটা হচ্ছে সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদের কাজে আনতে হবে।
জানা গেছে, গত বুধবার খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকসহ ৪১ জন ডাক্তারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় বহির্বিভাগে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। খুমেক হাসপাতালের চিকিৎসক ও ছাত্রদের একাংশ জোর করে উপপরিচালককে পদত্যাগ ও ৪১ জন চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় বহির্বিভাগের সেবা প্রায় বন্ধ। অবাঞ্ছিত ঘোষিত চিকিৎসকরা হাসপাতালে আসেননি। এই পরিস্থিতিতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ রোগীরা।
বিগত সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অধ্যক্ষসহ ২১ জন, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ১৫ জন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৪০ জন, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের ৩৯ জন, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৯ জন, পটুয়াখালীর একজনসহ সারা দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষক-চিকিৎসক মিলিয়ে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করায় তারা কর্মস্থলে যাচ্ছেন না।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ প্রশাসনের বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি বিশ্বদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো এখনো শূন্য রয়েছে।
গত ১৮ আগস্ট অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী অভিযোগ এনে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা তার অপসারণ দাবি করে আসছেন। দাবি বাস্তবায়নে তারা ৩ সপ্তাহ ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন। এতে কোনো কর্মকর্তা অধিদপ্তরে যেতে পারছেন না। ফলে অধিদপ্তরের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের যোগাযোগ এক প্রকার বিচ্ছিন্ন।
আন্দোলনের কারণে অধিদপ্তরের স্বাভাবিক সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের তৎপরতা দৃশ্যমান ছিল না। বন্যাদুর্গত এলাকায় ওষুধপত্র ও চিকিৎসক পাঠিয়ে সহযোগিতা করছে সন্ধানী, আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণাকেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)সহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক লাইন ডিরেক্টর খবরের কাগজকে জানান, আগামী ৫ বছরের স্বাস্থ্য খাতের কর্মপরিকল্পনা (অপারেশনাল প্ল্যান) প্রণয়ন করা হলেও সেটি এখনো অনুমোদন হয়নি। এটি গত জুলাই মাসের মধ্যে অনুমোদন হওয়ার কথা ছিল। অপারেশন প্ল্যান অনুমোদনে যত বিলম্ব হবে সারা দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন কার্যক্রম ততই বাধাগ্রস্ত হবে। এমনকি বন্ধ হয়ে যেতে পারে হাসপাতালগুলোর অনেক জরুরি সেবা।
সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামীদ খবরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য প্রশাসনের স্থবিরতা কাটাতে একটা শক্তিশালী সার্চ কমিটি গঠন করা যেত। সেই সার্চ কমিটি যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে সুপারিশ করলে তখন এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতো না। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে তাদের অন্যত্র বদলি করে কাজে লাগানো যেতে পারে। একই সঙ্গে যারা এতদিন পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছে তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করে শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব।