রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক ইমরান হোসেন। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে গত কয়েক দিন ধরে জমিতে স্বাভাবিক সেচ দিতে পারছেন না। এমনিতেই প্রচণ্ড গরম, তার ওপর বিদ্যুতের আসা যাওয়ার খেলায় জমির ফসল নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন।
তিনি বলেন, ‘তীব্র রোদ ও গরমের কারণে জমি ফেটে যাচ্ছে। এখন পানির অনেক প্রয়োজন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে পাম্প বন্ধ। পানির অভাবে রোদে পুড়ে ধানগাছ লাল হয়ে গেছে। ফলন নিয়ে শঙ্কায় আছি।’
শুধু গ্রামাঞ্চল নয়, রাজশাহী শহরেরও একই অবস্থা। দিনের একটি বড় অংশ পুরো নগর বিদ্যুৎহীন থাকে। কথা হয় সিটি করপোরেশনের ষষ্টীতলা এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে।
প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘গত সোমবার থেকে লোডশেডিংয়ের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বুধবার (গতকাল) সকাল, দুপুর ও বিকেল মিলিয়ে প্রায় ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। রাতে কী হবে তা ভেবেই আতঙ্কে আছি। লোডশেডিংয়ের কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কারণ তারা তীব্র গরমে জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার।’
শুধু রাজশাহী জেলা নয়, এই বিভাগের আট জেলার পাশাপাশি পুরো রংপুর বিভাগেরও একই অবস্থা। দিনের একটি বড় অংশই এই দুই বিভাগের ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ থাকছে না। প্রচণ্ড গরমে সব বয়সী মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ ছাড়া লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। মিল-কারখানা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সব কার্যক্রম থমকে যাচ্ছে।
পানির পাম্প বন্ধ থাকায় কৃষক সেচ দিতে পারছেন না। বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। পিক আওয়ারে ৩০ শতাংশও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের প্রায় সব জেলা-উপজেলায় প্রতি তিন ঘণ্টা পর এক থেকে দেড় ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। লোডশেডিং বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, গত সোমবার থেকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় গ্রাহককে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে রাজশাহীর একটি বড় অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এর মধ্যে বেশ কিছু উপজেলাও রয়েছে। তবে তাদের লোডশেডিং নেসকোর চেয়ে বেশি। ফলে গ্রামের কৃষকরা সেচসংকটে পড়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে সারা দেশের মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগেই সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে, যা এখন অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এর প্রভাব ছোট-বড় কলকারখানা ও ব্যবসাতে পড়তে শুরু করেছে। ব্যাঘাত ঘটছে উৎপাদন কার্যক্রম। বিলাসবহুল শপিংমল, বিপণী বিতানসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে কেনাবেচায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।
রাজশাহী শহরে পিভিসি প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আব্দুস সাত্তার। লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসায়ীক দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন জানিয়ে প্রতিবেদককে বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করায় ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে। গ্রাহকদের কাজ সঠিক সময়ে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার কর্মচারীদেরও বসে থাকতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।’
লোডশেডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, রাজশাহী জেলার জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক রমেন্দ্র চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা রাজশাহীর কাটাখালী উপকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে সরবরাহ করি। কিন্তু সেখান থেকেও আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ঘন ঘন লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’
নেসকোর রংপুর জোনের প্রধান প্রকৌশলী (অপারেশন) আশরাফুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, ‘রংপুর বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে মাত্র ৭০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর সব এলাকায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। তবু চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
নেসকোর রাজশাহী জোনের প্রধান প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিড থেকে ১ হাজার ১৭০ মেগাওয়াটের মতো পাওয়া যাচ্ছে। ফলে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।’