অত্যধিক খেলাপি ঋণের ভার ও তারল্যসংকটে জর্জরিত ব্যাংক খাত সংস্কার করতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ চেয়েছে। এই ঋণের মূল উদ্দেশ্য হলো বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে রিজার্ভকে শক্তিশালী করা।
এদিকে ওই তিন উন্নয়ন অংশীদারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর এখন চাহিদাপত্র ও ঋণের উপখাত সৃজন নিয়ে কাজ চলছে। কী পরিমাণ ঋণ চাওয়া হবে এবং সুদহার কত হবে, তার বিস্তারিত থাকবে ওই চাহিদাপত্রে। তবে এখনো তা চূড়ান্ত হয়নি। মূলত ওই চাহিদাপত্রের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত আসবে আইএমএফ, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক গতকাল বুধবার খবরের কাগজকে বলেন, কী পরিমাণ ঋণ চাওয়া হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ ব্যাপারে কাজ চলছে।
মুখপাত্র বলেন, ‘উন্নয়ন অংশীদাররা মূলত দুভাবে ঋণ দেয়। এর একটি হলো বাজেট সহায়তা, যার কোনো চাহিদাপত্রের প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের ঋণ সাধারণত থোক বরাদ্দ হয়ে থাকে। অন্যটি হলো প্রকল্প ঋণ, যার জন্য একটি প্রকল্প এবং এর খাত-উপখাতভিত্তিক প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা উল্লেখ করা থাকে। আমরা যেহেতু সুনির্দিষ্ট একটি সংস্কার প্রকল্পে অর্থায়ন চাই, সে জন্য সব পক্ষই এ ব্যাপারে কাজ করছে। কোনো অ্যামাউন্ট (ঋণের পরিমাণ) এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর একটি সূত্র জানায়, এডিবি ও বিশ্বব্যাংক থেকে মোট ১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১৮০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ পাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে এডিবির কাছ থেকে ১৩০ কোটি ডলার ও বিশ্বব্যাংক থেকে আরও ৫০ কোটি ডলার ঋণের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকায় খেলাপি ঋণ ও তারল্যসংকট বেড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতেই আমরা সংস্কার করব। এডিবি ও বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে সংস্কার উদ্যোগের প্রথম কাজ হিসেবে দুটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, ব্যাংক খাত সংস্কারের পাশাপাশি এ ঋণ-সহায়তা বাংলাদেশ ব্যাংকের আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা বাড়ানোর কাজেও ব্যয় করা হবে। এ ঋণ থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মূলধন সহায়তা দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এ ঋণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। ঋণ-সহায়তা মিলতে পারে আইএমএফ থেকেও।
বিগত দুই বছর ধরেই ডলারসংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। এর প্রভাবে বিনিময় হারে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয় প্রায় ৩৫ শতাংশ। এ সংকট কাটাতে গত বছর আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে বিগত সরকার।
এদিকে মার্চের পর তিন মাসের ব্যবধানে জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা বা ১৬ শতাংশ। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত ঋণ ও বিনিয়োগের পরিমাণ হলো ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত মার্চে এ হার ছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত ঋণ ও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়া বেসরকারি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকসহ ১০টি ব্যাংক তীব্র তারল্যসংকটে রয়েছে। এসব ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়ী গ্রাহকদের কোনো অর্থ দিতে পারছে না।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ঋণের নামে লুটপাট ও অর্থ পাচারও হয়েছে। সরকার পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঘোষণা দেওয়া হয় কমিশন গঠনের। কিন্তু কমিশন গঠনে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে বিধায় টাস্কফোর্স গঠন করে দ্রুত সংস্কারকাজ শুরু করার কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আগামী ১০ দিনের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা আসবে। টাস্কফোর্সগুলো যেন যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে, সে জন্য দেশি-বিদেশি সর্বোচ্চ কারিগরি জ্ঞান ও সহায়তা নেওয়া হবে।