ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এক মাস আগে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় দেড় যুগ পর সরকার পরিচালনায় এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে দ্বৈতনীতিতে চলছে প্রশাসনের কার্যক্রম। দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তারা প্রশাসনিক পিরামিড কাঠামো ভেঙে এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিন ধাপে পদোন্নতি নিয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে ছিল শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ। এসব কর্মকর্তার মধ্য থেকে অনেকেই চেয়েছিলেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) হতে। কিন্তু তারা আশাহত হয়েছেন।
অন্যদিকে প্রবল চাপ সত্ত্বেও দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান চালায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভালো থাকা কর্মকর্তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। ডিসি নিয়োগের তালিকায় তাদেরই প্রাধান্য দেখা গেছে। এ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোক বলে চিহ্নিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।
দলটি (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতাচ্যুত হলেও তাদের রেখে যাওয়া প্রশাসন এখনো বহাল রয়েছে। এই বিষয়টি মানতে পারছেন না বঞ্চিত কর্মকর্তারা, যাদের গত ১৭ বছর বিএনপি-জামায়াতের লোক তকমা দিয়ে উপেক্ষা করা হয়েছিল। তাই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রশাসন সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন।
তাদের দাবি, সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে গুরুত্বহীন বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হোক। যে কারণে এক মাস ধরে গোটা প্রশাসনে চলছে সমন্বয়হীনতা, নেই শৃঙ্খলা। ‘সুবিধাভোগী ও বঞ্চিত’- কর্মকর্তারা এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে চলছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব।
এর মধ্যে গত সোম ও মঙ্গলবার দুই ধাপে ৫৯ জেলায় ডিসি নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এ তালিকায় বঞ্চিতরা উপেক্ষিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়াকে ঘিরে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তারা। এ ইস্যুতে জনপ্রশাসনে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনায় প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আমলা ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
তারা এই ঘটনাকে দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন। মাঠ প্রশাসনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সচিবালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে প্রশাসনের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছরে ব্যাপক দলীয়করণ, মেধা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের কারণে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সময় লাগবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, কারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং কাউকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করায় এখন সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ খালি। এসব মন্ত্রণালয়ের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এদিকে আপত্তির পর সিলেটের ডিসির নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল বুধবার আরও আট জেলার ডিসির নিয়োগ স্থগিত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আরও চার জেলার ডিসি পদে রদবদল আনা হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের ডিসিকে পঞ্চগড়ে, নীলফামারীর ডিসিকে টাঙ্গাইলে, নাটোরের ডিসিকে লক্ষ্মীপুরে এবং পঞ্চগড়ের ডিসিকে নীলফামারীতে বদলি করা হয়েছে।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালের দিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে ডিসি ফিটলিস্ট করা হয়। সেই কমিটি আজকে (গতকাল) বসেছিল। পর্যালোচনা করে ডিসিদের মধ্যে আটজনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী ও দিনাজপুর।
এরপরও ক্ষোভ-বিক্ষোভ বন্ধ হয়নি। বঞ্চিতরা বুধবার বিকেলের মধ্যে ডিসি নিয়োগসংক্রান্ত দুই প্রজ্ঞাপন বাতিলের জন্য নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দফায় দফায় সভা করে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছিলেন। পরে বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ডিসি নিয়োগের দুটি প্রজ্ঞাপন বাতিলের আশ্বাস দিয়েছেন বলে দাবি করেন জেলা প্রশাসক পদ-প্রত্যাশী উপসচিবদের সমন্বয়ক নূরুল করিম ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, এ প্রজ্ঞাপন দুটি বাতিল করবেন বলে জনপ্রশাসন সচিব আশ্বাস দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিনি কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন।
বিকেলে ডিসি পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা গেছে। কেউ কেউ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কক্ষের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। তারা এসব কর্মকর্তার কক্ষে তালা দেওয়ার চেষ্টা করলে অন্যরা তাদের নিবৃত্ত করেন। এ পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কক্ষের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বঞ্চিত এই কর্মকর্তাদের বক্তব্য বিগত সরকারের আমলে প্রশাসনের সর্বস্তরে যারা সুবিধাভোগী এবং ছাত্র-জনতা হত্যার সঙ্গে জড়িতদের সহায়তা করেছিলেন তারা ভালো পোস্টিং পেতে পারেন না। অথচ সেই সব কর্মকর্তাকে ডিসি পদে পদায়ন করা হয়েছে। তাদের বিদায় করতে হবে।
নূরুল করিম ভূঁইয়া বলেন, যে ৫৯ জন ডিসির পদায়নের আদেশ হয়েছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া, সেহেতু যত দ্রুত সম্ভব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে এ দুটি প্রজ্ঞাপন বাতিল করবেন বলে জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব তাদের আশ্বাস দিয়েছেন।
নূরুল করিম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের আজ যেসব কর্মকর্তা সেখানে গিয়েছিলেন তাদের সবাই মেধাবী, যোগ্য ও সৎ। যেহেতু কোটাবিরোধী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মেধাবীরা নিয়োগ পাক, সেহেতু আমরাও চাই মেধাবীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক।’
জানা গেছে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বতী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরও জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। কর্মকর্তাদের কেউ ব্যস্ত পদোন্নতি নিয়ে, কেউ ব্যস্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে যেতে, আবার কেউ তদবির করছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) হতে। প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে ভিড় করছেন তদবিরকারী কর্মকর্তারা। অবশ্য ইতোমধ্যে পদোন্নতি বঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তিন দফায় পদোন্নতি পেয়েছেন।
এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনপ্রশাসনে প্রথম বড় পদোন্নতি হয় গত ১৩ আগস্ট। ওই দিন ১১৭ জন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপসচিব করা হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২২৩ উপসচিবকে যুগ্ম সচিব করা হয়। এরপর ২৫ আগস্ট ১৩১ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। সব মিলিয়ে ৮ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ৪৭১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা, তথ্য, কৃষিসহ অন্যান্য ক্যাডারে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে জোট বেঁধেছেন বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। গত ৩১ আগস্ট তারা আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামের জোট গঠন করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন।
এর মধ্যে গত মঙ্গলবার দুপুরে উপসচিব পদমর্যাদার ৫০-৬০ কর্মকর্তা, যারা ডিসি হতে পারেননি, তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ (এপিডি) শাখায় গিয়ে হইচই ও হট্টগোল করেন। মাঠ প্রশাসনেও একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। যে কারণে প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, ডিসি নিয়োগ ইস্যুতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে যে বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলাবিরোধী। সচিবালয় হচ্ছে সরকারের প্রাণকেন্দ্র। কারণ এই সচিবালয়ে মন্ত্রী-সচিবরা বসেন। এখন সরকারের উপদেষ্টারা বসছেন। এখান থেকেই সারা দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার নিদের্শনা দেওয়া হয়। প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডিসি নিয়োগে কখনোই এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বেদনা থাকতে পারে। তারা সেগুলো যথাযথ পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করতে পারেন।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, এটা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা প্রশাসন সার্ভিসের কর্মকর্তারা করতে পারেন তা ধারণার অতীত। যদি ডিসি নিয়োগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভুলও করে থাকে তাহলে ক্যাডার কর্মকর্তাদের এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত হয়নি। তারা সুশৃঙ্খলভাবে জনপ্রশাসন সচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ জানাতে পারতেন। সেটা না করে বিশৃঙ্খলা করে প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড নষ্ট করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
সচিব ঘেরাও, পুলিশ মোতায়েন
গতকাল বিকেলে জনপ্রশাসন সচিব ড. মোখলেস উর রহমানকে বঞ্চিত কর্মকর্তারা দুই দফা ঘেরাও করে তাদের দাবি মানতে চাপ দেন। একটি অনুষ্ঠান শেষে বের হয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দোতলা এবং পরে নিচতলায় ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা তাকে ঘিরে ধরেন। এ সময় সচিব তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, এ বিষয়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলবেন।
এর আগে ডিসি পদ-প্রত্যাশী এসব কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার কক্ষের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ এবং কয়েকজনের কক্ষে তালা লাগানোর চেষ্টা করেন। অবশ্য সহকর্মীদের হস্তক্ষেপে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত তালা লাগাননি।
এই পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার কক্ষের সামনে গতকাল বিকেল থেকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।