ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ইস্যুতে আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একাডেমিক কার্যক্রম। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ৮৩ দিন পর একাডেমিক কার্যক্রম চালুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা না করলে ক্লাসে ফিরবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা কার্যকর ছাত্র সংসদের দাবি করছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের (গণরুম বন্ধ করে মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ) পরেও শ্রেণি কার্যক্রম চালু করা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলসহ তিন দফা দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে নামেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বন্ধ হয়ে যায় একাডেমিক কার্যক্রম। এর মাঝে শুরু হয় চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। ১৭ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ২০ দিন পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ৬ আগস্ট খোলে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হলেও স্থবিরতা দেখা দেয় একাডেমিক কার্যক্রমে। সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত আসে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হবে। একে একে হলগুলোতে বৈধ শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়ার পাশাপাশি গণরুম-গেস্টরুম বন্ধ হলেও শিক্ষার্থীদের আরেক দাবি দলীয় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস।
গত কয়েক দিন ধরে ‘দলীয় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস আন্দোলন’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী দুই দফা দাবিতে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করেছেন। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ রবিবার উপাচার্যের বাসভবনসংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আগামী ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দলীয় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস বিষয়ে যদি কোনো ধরনের আশ্বাস প্রদান ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় ধারাবাহিকভাবে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন তারা।
এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দেশ নতুনভাবে স্বাধীন হয়েছে। হল-ক্যাম্পাসে দলীয় দখলদারত্ব এবং লেজুড়বৃত্তির যে রাজনীতি ছিল, তার অবসান হয়েছে। আমরা চাই না, সেসব আবার ফিরে আসুক। আমাদের যে আন্দোলন ছিল, সেই আন্দোলনের নয় দফার মধ্যে কিন্তু একটি দফা ছিল দলীয় রাজনীতির অবসান। আমরা চাই, ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় রাজনীতি- এগুলো যেন ফিরে না আসে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিরাজনীতিকীকরণের পক্ষে নয়, আমরা চাই সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।’
আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শ্রেণি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। রবিবার আমাদের অবস্থান কর্মসূচি রয়েছে। এ ছাড়া ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নানাভাবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চাপ দেব যেন তারা আমাদের কথা শোনেন। দলীয় রাজনীতিমুক্ত যে ক্যাম্পাস সেটি মেনে নিলে অবশ্যই আমরা ক্লাসে ফিরব। যদি না মেনে নেন, আমরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে কঠোর কর্মসূচিতে যাব। গত শুক্রবার প্রক্টর স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি আমাদের বলেছেন শিক্ষার্থীরা যদি নিয়মতান্ত্রিক ও ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে অবশ্যই উপাচার্য আমাদের যে দাবি সেটি মেনে নিবেন।’
সেশনজট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে এমন প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আন্দোলনের আরেক সংগঠক সমাজবিজ্ঞান স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সেশনজট আরও বৃদ্ধি পাবে এটি ঠিক, তবে তা কিন্তু কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে, কিন্তু ফ্যাসিস্ট সিস্টেমের মাধ্যমে কেউ দলীয় রাজনীতির এজেন্ডা বাস্তবায়ন, দখলদারত্ব এবং রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে যে হুকুম আসবে সেটি বাস্তবায়ন করবে আমরা এমন রাজনীতি চাই না। ইতোমধ্যে রক্ত দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারকে তাড়িয়েছি, এখন আমরা এই সিস্টেম আর চাই না। এখন আমাদের যদি ক্ষতিও হয়, তারপরও এই ফ্যাসিস্ট দলীয় রাজনীতির যে সিস্টেম সেটি উৎখাত করব।’
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘দেশের সব কিছুর মধ্যেই গতিশীলতা ফিরলেও এখনো একাডেমিক স্থবিরতার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যার ফলে সেশনজটের পাশাপাশি চাকরির বাজার থেকে আমাদের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হবে কিন্তু আমাদের যে আন্দোলন সেখানে কিন্তু একটা অন্যতম দাবি ছিল দলীয় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা তো এমন ক্যাম্পাস চাইনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্লাস-পরীক্ষায় শুরুর পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখনই ক্লাস-পরীক্ষায় বসতে রাজি কিন্তু ক্যাম্পাস-হলে দলীয় রাজনীতি থাকবে, এটির পক্ষে তো আমরা না। হলগুলোতে যেহেতু ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিপত্তি নেই, শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো আছেন। আমরা চাই অবিলম্বে ক্যাম্পাসকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হোক, যেন শিক্ষার্থীদের কথা বলা ও সুস্থ রাজনীতি চর্চা করার একটি জায়গা তৈরি হয়।’
চলতি বছরে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার কথা ছিল সংস্কৃত বিভাগের আরিফুল ইসলামের, কিন্তু তিনি সবে স্নাতক শেষ করেছেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘চলতি বছরে স্নাতক শেষ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেখানে কেবল স্নাতক শেষ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের উচিত যারা সেশনজটে পড়েছে তাদের একাডেমিক সেশনজট কাটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’
সার্বিক বিষয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যে কথা বলা হচ্ছে, আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটি বিবেচনা করে দেখবেন।’
সেশনজট প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছেন, ধীরে ধীরে সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তাছাড়া আমি তো সবে যোগদান করেছি। কাজকর্ম শুরু করলে ধীরে ধীরে সব কিছু নিয়ে কাজ করা যাবে। তখন হয়তো পুরো বিষয়টি বোঝা যাবে।’