আর্থিক অনিয়ম করায় ৭০টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। জাল কাগজপত্র দিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।
বিগত সরকারের শেষ সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের (দক্ষিণ) করা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ৭০টি প্রতিষ্ঠানের গত পাঁচ বছরের আমদানি, রপ্তানি ও উৎপাদনের তথ্য খতিয়ে দেখে গরমিল পাওয়া গেছে। শাস্তি হিসেবে এই ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বন্ড সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির লাইসেন্স স্থগিত এবং ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর (বিন) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে এনবিআর মামলা করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিকদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে সন্ধান চলছে।
সরকার রপ্তানি উৎসাহিত করতে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিয়েছে। এই ৭০টি প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধা নিয়ে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করেছে। এর মধ্যে ২৭টি প্রতিষ্ঠানের বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই। জাল কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে এসব অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামেও শুল্ক না দিয়ে আমদানি করা কাঁচামালের সবটা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি করা পণ্য তৈরিতে যতটা কাঁচামাল প্রয়োজন ছিল, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি কাঁচামাল আমদানি করেছে। আমদানি করা অতিরিক্ত কাঁচামাল বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, শুধু বন্ড অনিয়মে সরকার বছরে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। রপ্তানি উৎসাহিত করতে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সরকারি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। শুল্ক না দিয়ে আনলে কম দাম পড়ছে। অন্যদিকে একই জাতীয় কাঁচামাল দেশি প্রতিষ্ঠান নিয়মকানুন মেনে রাজস্ব পরিশোধ করে উৎপাদন করে ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা কাঁচামালের চেয়ে বেশি দাম পড়ছে। কম দামে পাওয়া যাওয়ায় ক্রেতা বেশি দিয়ে কিনছেন না। আর এভাবেই দেশি শিল্প অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে। আমদানিকারক অসৎ ব্যবসায়ীদের কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে দেশি শিল্প। এরা সংঘবদ্ধ চক্র। বছরের পর বছর অবৈধ ব্যবসা করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে।
তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মো. হাতেম খবরের কাগজকে বলেন, যারা শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদনে না লাগিয়ে অবৈধভাবে বাজারে বিক্রি করছেন তারা অসাধু ব্যক্তি। এদের কারণে সৎ ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়ছেন। তবে এদের একার পক্ষে এ অপকর্ম করা সম্ভব না। এদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এনবিআর ও ব্যাংকের কিছু অসাধু ব্যক্তি সহযোগিতা করছেন। সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
বন্ড কমিশনারেটের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, সম্পূর্ণ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই ৭০টি প্রতিষ্ঠান এনবিআরে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিনা শুল্কে সুতা, কাপড়, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, শার্টের কলার, হাতায় ব্যবহৃত শক্ত কাগজ, আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার আমদানি করেছে। বৈদ্যুতিক তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, সকেট, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও অ্যাডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, রাসায়নিক দ্রব্য, রডও আমদানি করেছে।
প্রসঙ্গত, বন্ড সুবিধা পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, রপ্তানির জন্য পণ্য তৈরিতে যতটা কাঁচামাল প্রয়োজন, ঠিক ততটাই আমদানি করতে হবে। প্রয়োজনের চেয়ে একটুও বেশি আনা যাবে না। আমদানির সবটা কাঁচামাল কারখানায় পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো কারণে যদি পণ্য উৎপাদনের পর কাঁচামাল অবশিষ্ট থাকে, তবে তা এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে হিসাব কষে শুল্ক-কর-ভ্যাট দিতে হবে। এসব নিয়ম না মানলে বন্ড সুবিধা বাতিল হবে। রাজস্ব আইন অনুসারে শাস্তি হবে। ৭০টি প্রতিষ্ঠান এসব শর্ত ভঙ্গ করেছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত মালিকরা আড়ালে থেকে এসব অপকর্ম করিয়েছেন। তারা ভাড়া করা লোক দিয়ে আমদানি করা কাঁচামাল বন্দর থেকে ছাড়িয়ে আনা ও পরিবহনে তুলে দেওয়ার কাজ করিয়েছেন। পরিবহনচালকের কাছে ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে ভাড়া করা লোকরা সরে পড়েছেন। চালক নির্দিষ্ট ঠিকানামতো কাঁচামাল পৌঁছে দিয়েছেন। গুদামের দায়িত্বে থাকা অন্য ব্যক্তিরা এসব মাল বুঝে নিয়েছেন। এসব ভাড়া করা লোকের কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এরা কেউই প্রকৃত মালিকদের খোঁজ জানেন না। গুদামের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা শুল্কমুক্ত কাঁচামাল দোকানে বিক্রি করে দিয়েছেন। বিক্রি করে পাওয়া অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং বা নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়েছেন। এসব পণ্য এনে রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুর, হাতেম টাওয়ার, উর্দু রোড, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, টঙ্গী, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, চট্টগ্রামের বকশীবাজারের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দিয়েছেন; যা এসব দোকান থেকে সাধারণ ক্রেতারা কিনে নিচ্ছেন।
নরসিংদীর বাবুরহাট, মাধবদী, নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এলাকায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, সোহাগপুর ও বেলকুচিতে বন্ডের সুতা বিক্রি করা হয়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন দোকানে বিনা শুল্কে আনা কাঁচামাল কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে। ৭০টি প্রতিষ্ঠানের অসাধু মালিকরা নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠিয়ে অধিকাংশ সময়ে আগেই জেনে নিয়েছেন কোন দোকানে কোন পণ্য কতটা প্রয়োজন। অনেক সময় অগ্রিমও নিয়ে নিয়েছেন। কৌশলে সুবিধামতো সময়ে ভাড়া করা লোক দিয়ে পণ্য পৌঁছে দিয়েছেন। দেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে কম দামে পাওয়া যাওয়ায় খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে আগ্রহের সঙ্গেই এসব কিনেছেন।