ঢাকা ২৫ কার্তিক ১৪৩১, রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪

জাহিরের ত্রাসে তটস্থ ছিল হবিগঞ্জ

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৪৯ পিএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৭ পিএম
জাহিরের ত্রাসে তটস্থ ছিল হবিগঞ্জ
আবু জাহির

হবিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) অ্যাডভোকেট আবু জাহির। আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে তিনি হবিগঞ্জজুড়ে কায়েম করেছেন ত্রাসের রাজত্ব। হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগকে ‘পারিবার লীগে’ পরিণত করা, নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্পে কমিশন নেওয়া, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ ঘুষ-বাণিজ্য, শিল্পাঞ্চলে একক অধিপত্য বিস্তার, ব্যক্তি ও সরকারি মালিকানাধীন জমি-বাড়ি দখল করাসহ অর্থনৈতিক এমন কোনো খাত নেই, যেখানে আবু জাহিরের হাত ছিল না। এ ছাড়া আবু জাহির নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রীকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাগনে আতাউর রহমান সেলিমকে হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র, শ্যালক কামরুজ্জামান আল বশিরকে বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউপির চেয়ারম্যান এবং চাচাতো ভাই আবদুর রহিমকে রিচি ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। অতিসম্প্রতি তার অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

আবু জাহিরের উত্থান 
আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের প্রবীণ রাজনীতিকদের তথ্যমতে, ছাত্র ইউনিয়নের হাত ধরে রাজনীতিতে পা রাখেন জাহির। তার কিছু দিন পর যোগ দেন ছাত্রলীগে। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। হয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। একই সময় তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আর এখান থেকে আবু জাহিরের মূল উত্থান শুরু।

সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। এ সময় আবু জাহির গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পর কপাল খুলে যায় তার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবারের মতো হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন আবু জাহির। 

অবৈধ আয়েই ‘লাল’ জাহির
এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে আবু জাহির ছিলেন আয়কর আইনজীবী। এ পেশার আয় দিয়ে তার সংসার চলত। ওই সময় হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশের একটি টিনশেড বাসায় পরিবার নিয়ে তিনি ভাড়ায় থাকতেন। নিয়মিত বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। তবে এমপি হওয়ার পর যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান তিনি। শহরে গড়েছেন কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল ছয়তলা বাড়ি। মালিক হয়েছেন আড়াইশ ভরি সোনার। সেই সঙ্গে ছিল একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন একাধিক জমি ও বাড়ি দখলের। এমনকি হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের কোয়ার্টার এবং মার্কেট তার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। সে সব দখল করে দিয়েছেন নিজের ভাইকে। এ ছাড়া ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পেছনের পুকুরের ১৮ শতাংশ জমি স্ত্রীর নামে করে নিয়েছেন। এসব ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কমিশন, শহরে বিরোধপূর্ণ জমি-জমার মীমাংসায় কমিশন, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ ঘুষের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন জাহির। তা ছাড়া কেদারা কোর্ট এলাকায় শত কোটি টাকা মূল্যে স্ত্রী আলেয়া আক্তার, ছেলে ইফাদ জামিল, ভাই বদরুল আলম, ভাতিজা সাঈদুর রহমান এবং নিজের পিএস সুদ্বীপ দাসের নামে ২০০ শতাংশ জমি কিনে ছিলেন তিনি। পরে ওই এলাকায় বাল্লা স্থলবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে, সেই জমি তিনি চারগুণ মূল্যে সরকারের কাছে বিক্রি করেন। এ ছাড়া হবিগঞ্জ বিসিকে ছেলের নামে রয়েছে বিশাল প্লট। সেই সঙ্গে রাজউকেও প্লট রয়েছে আবু জাহিরের।

শিল্পাঞ্চলে আবু জাহিরের অধিপত্য
গত এক যুগে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলায় গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক শিল্প কারখানা। সেখানেও ছিল আবু জাহিরের অধিপত্য। জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে তাকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের কমিশন। তাকে কমিশন না দিয়ে এক বিঘা জমিও রেজিস্ট্রি করতে পারেনি কোনো কোম্পাননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শিল্প কারখানার জমি কেনার সময় আবু জাহিরের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকত। তার কমিশন বুঝিয়ে না দেওয়ার আগে জমি রেজিস্ট্রি হতো না। এমনকি হবিগঞ্জ ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় যত শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, সে সবের মালিকদের আবু জাহিরকে বিশেষ সুবিধা দিতে হতো। কেউ তাকে এড়িয়ে গেলে, কারখানা চালু হতে দেওয়া হতো না। এমন উদাহরণও অনেক আছে।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘শিল্প এলাকায় লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু এখানে কোনো শ্রমিক সংগঠন নেই। তাই শ্রমিকসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য কোম্পানিগুলো থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন আবু জাহির।’

বালু ও জলমহালে নিয়ন্ত্রণ
চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলার বিভিন্ন সরকারি বালুমহালে নিয়ন্ত্রণ ছিল জাহিরের। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ভাই বদরুল আলমকে দিয়ে ইজারা নিতেন বালুমহাল। এ ছাড়া প্রভাব খাটিয়ে ইজারাবহির্ভূত স্থান থেকেও বালু উত্তোলন করত তার ভাই। 

বাহুবলের অধিকাংশ টিলা সমতল ভূমিতে পরিণত 
খোয়াই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে আবু জাহির জড়িত থাকায় নীরব ছিল প্রশাসন। একইভাবে জেলা তাঁতী লীগ সভাপতি মুদ্দত আলীকে দিয়ে বাহুবলের অধিকাংশ টিলার মাটি কেটে বিক্রি করেছেন। সাড়ে ১৫ বছরে সেগুলো সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এতে হুমকিতে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। 

জলমহালে নিয়ন্ত্রণ
আওয়ামী লীগ নেতা ও লাখাই উপজেলা চেয়ারম্যান মুশফিউল আলম আজাদকে দিয়ে জলমহাল নিয়ন্ত্রণে রেখে ছিলেন জাহির। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাখাই এলাকার একটি সমবায় সমিতির নেতা জানান, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জলমহাল ইজারা নিতে হলে সমবায় সমিতির সনদ লাগে। যে কারণে এ এলাকার সমিতিগুলোকে কখনো হুমকি-ধমকি, কখনো কমিশনের মাধ্যমে সনদ নিয়ে জলমহাল ইজারা নিতেন মুশফিউল আলম। এতে সরাসরি জড়িত থাকতেন আবু জাহির।

স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য
জেলাজুড়ে ওপেন সিক্রেট, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানেই আবু জাহিরের পকেট গরম।’ এমপি থাকা অবস্থায় পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। জেলায় তার অপছন্দের ব্যক্তি পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার নজির খুব একটা নেই। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার পরও নির্বাচনে পল্টি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একজনকে মনোনয়ন দিয়ে, গোপনে গুজিবাজি করে বিজয়ি করেছেন অন্য প্রার্থীকে।

রাজনৈতিক দমন-পীড়ন
দমন-পীড়ন ছিল আবু জাহিরের প্রধান অস্ত্র। গত সাড়ে ১৫ বছরে তার দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন দলের নেতা-কর্মীসহ ভিন্ন মতের লোকজন। যারাই তার মতের বিরুদ্ধে গেছেন, তারা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়েছেন।

২০১৯ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে আবু জাহিরের বিপক্ষে থাকায় জেলা আওয়ামী লীগে ঠাঁই হয়নি তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, সাবেক নারী এমপি আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়াসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার। যদিও পরে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে বাদ দেওয়াদের কয়েকজনকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘আবু জাহিরের ছবি ওপরে না লাগিয়ে একটি শুভেচ্ছা পোস্টারও লাগাতে পারেননি আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী। যারা আবু জাহিরের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, তারা বিভিন্নভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। আবার তাকে হুজুর হুজুর করে অনেক বহিরাগতও জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন।’

হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের মতো স্বৈরাচার দেখিনি। এই সাড়ে ১৫ বছরে তারা আমাদের সঙ্গে যা করেছে, তা ভোলার না। আমরা ভালোভাবে একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করতে পারিনি। শারীরিকভাবে নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে আমাদের দমানো হয়েছে।’

হবিগঞ্জের সিনিয়র সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর হবিগঞ্জের মানুষ একটা আতঙ্কের মাঝেই ছিলেন। অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন, হয়রানি করেছেন আবু জাহির।’

আওয়ামী লীগকে ‘পারিবার লীগে’ পরিণত
আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্ব ছিল জাহিরের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের হাতে। আবু জাহিরের স্ত্রী জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক, বছরের পর বছর দেশের বাইরে থাকা ছেলে ইফাত জামিল জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ভাই বদরুল আলম জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ভাতিজা ফয়জুর রহমান জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ভাতিজা সাঈদুর ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের বিগত কমিটির সভাপতি।

দুদকের অনুসন্ধান শুরু 
জাহিরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তথ্যানুসন্ধানকালে তার নিজ নামে ব্যাংকে নগদ টাকা, সঞ্চয়পত্র, রাজউকে প্লট, স্ত্রীর নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক।

জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, ‘মানুষ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন কিছু চাটুকার তৈরি হয়। এই চাটুকাররা ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে এমনভাবে বুঝায়, ‘যে তার ক্ষমতা পৃথিবী জুড়ে।’ ফলে চেয়ারে যিনি থাকেন, তারও একটা ভাব হয় যে আমিই সব। এই অহংকারের জন্য জনপ্রতিনিধিরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর প্রতিফলনই এবার আমরা দেখলাম।’

রাসিকের সড়কবাতি: খ্যাতির খেসারত ৪৩ কোটি টাকা!

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ এএম
রাসিকের সড়কবাতি: খ্যাতির খেসারত ৪৩ কোটি টাকা!
রাজশাহী নগরের বিলাসবহুল সড়কবাতি। ফাইল ছবি

উন্নত বিশ্বের নামিদামি শহরের মতো আধুনিক দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতির সংযোজন রাতের আঁধার কাটিয়ে রাজশাহী নগরকে করে তোলে আলোকিত। দেশের প্রথম সিটি হিসেবে রাজশাহী নগরের সড়কে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে আলো দেয় সড়কবাতি। আবার কোথাও স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে মুকুটবাতি। সিল্কসিটি, ক্লিনসিটি, গ্রিনসিটির পাশাপাশি সড়কবাতির কারণে রাজশাহী নতুন করে তকমা পায় ‘আলোর শহর’ হিসেবে। তবে বিদেশ থেকে আনা দৃষ্টিনন্দন এই সড়কবাতি দিয়ে শহরকে আলোকিত করতে গিয়ে বর্তমানে বিপাকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। মাত্র ২৩ কিলোমিটার পথ আলোকিত করতে গিয়ে ঘারে চেপে বসেছে বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া। বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে রাসিকের সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে বলে জানিয়েছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কর্তৃপক্ষ।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, এ ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্প শুধু সরকারি সম্পদের অপব্যবহার নয়, এটা অপচয়ও বটে। এর দায়ভার বহন করতে হবে জনসাধারণকে। এদিকে বকেয়া বিলের কারণ হিসেবে সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের উদাসীনতাকে দুষছেন রাসিকে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। শুধু মধ্যশহরে অতিরিক্ত সড়কবাতি লাগিয়ে অর্থের অপচয় করা হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। এখন বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে রাসিক। তারা জানায়, বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কমানো হচ্ছে সড়কে আলোকবাতির সংখ্যাও।

রাসিক সূত্রে জানা যায়, নগর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১০৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে নান্দনিক সড়কবাতিগুলো স্থাপন করে সিটি করপোরেশন। আলোর ঝলকানিতে শহর সাজাতে নগরের কাশিয়াডাঙ্গা-বন্ধগেট, তালাইমারী-কোর্ট, তালাইমারী-কাটাখালী ও আলিফ-লাম-মিম ভাটার মোড় থেকে বিহাস পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার পথে আছে আধুনিক এসব সড়কবাতি। আলোর তীব্রতা বিশ্লেষণ করে প্রায় ১৫ মিটার দূরত্বে বসানো হয় এসব বাতি। নান্দনিক এসব সড়কবাতি আনা হয় তুরস্ক, চীন ও ইতালি থেকে।

আরও জানা গেছে, নগরের ১৮টি পয়েন্টে উঁচু উঁচু ফ্লাডলাইটও বসানো হয়েছে বিদেশ থেকে এনে। এতেই করপোরেশনের কাঁধে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ বিল। এদিকে এরই মধ্যে সড়কের বাতি কমিয়ে ফেলেছে সিটি করপোরেশন। একটির পর একটি বাতি জ্বালাছেন তারা। অন্যদিকে নান্দনিক বাতির অনেকগুলোই নষ্ট হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের আগে। প্রতিদিনই রক্ষণাবেক্ষণ করে এগুলো সচল রাখা হচ্ছে।

নেসকোর বাণিজ্যিক পরিচালন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস বলেন, রাসিকের বকেয়া বিল আগে থেকেই থাকত। তবে কয়েক বছর ধরে সড়কবাতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বকেয়া বিলের পরিমাণও বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এখন বকেয়া সাড়ে ৪৩ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বকেয়া পরিশোধে মাঝেমধ্যেই রাসিকে চিঠি পাঠানো হয়। তবে বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি। নাগরিক সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নও করা হচ্ছে না।

তবে নাম না প্রকাশ করে নেসকোর এক উপমহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, রাসিকের বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি এতদিন রাজনৈতিক সমঝোতায় চলেছে। তবে এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তাই এসব বকেয়া উদ্ধারে আমরা তৎপর হয়েছি।

তবে রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এ বি এম শরীফ উদ্দিন বলেছেন, ‘শুধু সড়কবাতি নয়, এই বকেয়া নগরের চারটি জোনের পানির পাম্প, বিভিন্ন স্থাপনা ও আরবান হেলথ কেয়ারে ব্যবহৃত বিদ্যুতের। প্রতি মাসের বকেয়া পুঞ্জীভূত হতে হতে একটা বিরাট অঙ্কে এসে দাঁড়িয়েছে। একসঙ্গে এতগুলো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য রাসিকের নেই। সে কারণে প্রতি মাসে ৫০ লাখ টাকা বকেয়া বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় কমিশনার ও রাসিকের প্রশাসক ড. মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কমানো হচ্ছে অতিরিক্ত সড়কবাতি। কেননা, এগুলো ঘিঞ্চিভাবে লাগানো হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে অর্থ অপচয় করা হয়েছে। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি। যেখানে যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে ঠিক করব।’

রাজশাহী জেলা সুজনের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই সড়কবাতিগুলো ছিল রাজনৈতিক প্রকল্প। অথচ যে বাড়তির টাকা বকেয়া হয়েছে তা সিটি করেপারেশনের জনগণের হল্ডিং ট্যাক্স ও অন্যন্য কর থেকে আদায় করা হবে। কিন্তু এমন বিলাসিতার খেসারত নগরবাসীকে কেন দিতে হবে। এটি কাম্য নয়।’

ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায়ে জটিলতা

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায়ে জটিলতা
২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকির তথ্য রয়েছে ১ হাজার ১২৮ জন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে

রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী চতুর রাজস্ব ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এদের মধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ কেউ আছেন আত্মগোপনে। আবার অনেকে আছেন কারাগারে। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা সমুদয় অর্থ জব্দ করেও সরকারের পাওনা আদায় করা সম্ভব হবে না। আইনি জটিলতায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় রাজস্ব ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে বসে নেই এনবিআর, খুঁজছে নতুন পথ।

বিগত সরকারের ১ হাজার ১২৮ জন প্রভাবশালীর কাছ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব কবে নাগাদ আদায় হবে, তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। 

প্রভাবশালী এসব রাজস্ব ফাঁকিবাজের কাছ থেকে কীভাবে অর্থ আদায় করা সম্ভব, তা নিয়ে কৌশল নির্ধারণে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এনবিআরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। নেওয়া হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, বিগত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এক হাজারের বেশি ব্যক্তির রাজস্ব ফাঁকির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে। এদের আয়ের বৈধ উৎস না থাকায় অনেকে ব্যাংকের লেনদেন এড়িয়ে বাড়িঘরে, অন্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন। অনেকে অর্থ পাচার করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় অনেকে অ্যাকাউন্ট প্রায় খালি করে টাকা সরিয়েছেন। তাই এসব ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হলেও সেখানে থাকা সামান্য অর্থ দিয়ে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পরিশোধ করা যাবে না। 

সিআইসি সূত্র জানায়, বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের অনেকের বাড়ি, ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ জমিজমার মালিকানা দলিলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে সময় লাগছে। অনেকে আবার ফাঁকি দেওয়া টাকায় অন্যের নামে সম্পত্তি কিনেছেন। এসব সম্পত্তির দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর জোগাড় করতে সময় লাগছে। আবার অনেকের সম্পদের খোঁজে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কাগজপত্র ভুয়া। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের বেশির ভাগের এ ধরনের সম্পদ রয়েছে। 

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন মেনে এসব সম্পত্তি বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করতে হলে দলিলপত্র জোগাড় করে নিলামে তুলতে হবে, যা বেশ ঝামেলাসাপেক্ষ।

এনবিআর সদস্য সৈয়দ মুহাম্মদ আবু দাউদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআর প্রভাবশালীদের রাজস্ব ফাঁকির অর্থ পরিশোধের জন্য চাপ দিলে তারা মামলা করে দিতে পারেন। মামলা করা প্রতিটি নাগরিকের আইনি অধিকার। এ ক্ষেত্রে মামলা কতদিনে নিষ্পত্তি হবে তা আমার কেন- কার পক্ষেই বলা সম্ভব না।’ 

তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে কয়েক হাজার রাজস্বসংক্রান্ত মামলা আদালতে জমে আছে। এনবিআর থেকে এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যায়ে রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি।’ 

আদালতে ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ হাজারের বেশি রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর ফলে আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে প্রতি দিনই নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। পুরোনো অনেক মামলা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলমান রয়েছে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সরকারের এসব ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তাদের অবৈধ ও বৈধ সব অর্থ পাচার করে দিয়েছেন। পাচারের অর্থ ফেরত এনে এবং সম্পত্তি বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘পাচারের অর্থ আদায়ের প্রথম ধাপে রাজস্ব আইনের পাশাপাশি দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতেও এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এরপর বিদেশে ল ফার্ম নিয়োগ দিয়ে আইনি পথে পাচারের অর্থ আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একই সঙ্গে বিদ্যমান রাজস্ব আইনেও কিছু ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। আইনটির বিশেষ কিছু ধারার আওতায় মামলা করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে পুরো আদায় প্রক্রিয়াটি ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

এনবিআর সূত্র জানায়, গত সপ্তাহ পর্যন্ত এনবিআরের প্রাথমিক তদন্তে বিগত সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌরসভার চেয়ারম্যান, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিল্পী, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীসহ মোট ১ হাজার ১২৮ জন ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানা গেছে। এদের প্রত্যেকের নামে-বেনামে ফ্ল্যাট, বাড়ি ও বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। রয়েছে হাজার একরের বেশি জমি। বিশেষভাবে সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ওবায়দুল কাদের, শাজাহান খান, দীপু মনি ও তার ভাই, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, জুনায়েদ আহমেদ পলক ও তার স্ত্রী কনিকার নামে শতাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট থাকার প্রমাণ রয়েছে। নিজেদের এলাকাতে শত একর জমি, একাধিক মাছ ও গবাদিপশুর খামার থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব সম্পত্তির দলিলপত্রের খোঁজ চলছে। সেনা কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলের নামেও হাজার একরের বেশি জমি থাকার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। আরও প্রমাণ জোগাড়ে কাজ চলছে। 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আটঘাট বেঁধে রাজস্ব ফাঁকি দেন। এদের ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায় করা কঠিন। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই সম্ভব।’

অন্যদিকে বেক্সিমকো গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (নগদ লিমিটেড), ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডসহ মোট ৩৭ প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে রাজস্ব পরিশোধযোগ্য অর্থ নেই বলে সূত্র জানিয়েছে। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলে সায়ান ফজলুর রহমান, সালমান এফ রহমানের ভাই এ এস এফ রহমান ও তার ছেলে শাহরিয়ার রহমানের ফাঁকি দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এদের নিজেদের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা তাদের কাছে পাওনার চেয়ে অনেক কম। অন্যের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব তারা পরিচালনা করেছেন কি না, তার খোঁজ চলছে। এদের ভোগদখল করা সম্পত্তির মালিকানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে। সেসব দলিলের খোঁজ চলছে। এসব ব্যক্তির পাচার করা ৩৩ হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে এনে রাজস্ব আদায়ে কাজ করছে সরকার। 

এনবিআর সূত্র জানায়, রাজস্ব আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি এসব ব্যক্তির নামে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা করা ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টিও এনবিআর খতিয়ে দেখছে। 

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কর ফাঁকিবাজরা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন এনবিআর স্বচ্ছতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে রাজস্ব ফাঁকির অর্থ আদায় করতে কাজ করছে। যদি কোনো জটিলতা থাকে তবে তার সমাধান করে রাজস্ব ফাঁকির অর্থ আদায় করা হবে। এ বিষয়ে এনবিআর কঠোর অবস্থানে আছে।

নিজেদের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চায় বিএনপি

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৭ এএম
নিজেদের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চায় বিএনপি
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপি যে একমাত্র বড় রাজনৈতিক দল এবং ক্ষমতায় আসার জন্য তাদেরই একমাত্র সক্ষমতা রয়েছে- এ বিষয়টি নানাভাবে বোঝাতে চাইছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলটি একদিকে ধৈর্ষের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে জানান দেওয়ার মতো কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে। 

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গত শুক্রবার ঢাকায় বড় শোডাউন করেছে দলটি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এটাই সবচেয়ে বড় কর্মসূচি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, রাজধানীর নয়াপল্টন থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩ ঘণ্টাব্যাপী এ শোভাযাত্রাটি প্রদক্ষিণ করে। এতে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে।

অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো জনগণের সামনে আনতে, বিশেষ করে ৩১ দফা নিয়ে আগামী ২৩ নভেম্বর সেমিনার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। রাজধানীর একটি হোটেলে এই সেমিনার হবে। ৩১ দফার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, ‘নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা প্রভৃতি। ৩১ দফা বাস্তবায়নে জনমত গড়তে জেলা ও মহানগরে বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনা সভা করবে দলটি। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা এখন এলাকায় এলাকায় যাচ্ছেন। আগামী দিনে বিএনপি কী করতে চায় এবং ৩১ দফা রূপরেখা জনগণের কাছে তুলে ধরছেন তারা। 

তিনি বলেন, অতীতে আওয়ামী লীগের মতো বড় ধরনের ভুলত্রুটি বিএনপি করেনি। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ দেশের জনগণকে ভোট দিতে দেয়নি। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এখনো কাজ করছে। আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে স্বচ্ছ বিএনপিকে পাবে জনগণ। এ জন্যই শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইতোমধ্যে এক হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিএনপির একাধিক নেতা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে কী করবে, আগের ভুলত্রুটি সংশোধন করে কীভাবে এগোবে- এ বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে চায় বিএনপি। অর্থাৎ জনগণের মধ্যে তারা ইতিবাচক বার্তা দিতে চান। বিএনপি আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে জনসাধারণের উন্নয়নের লক্ষ্যেই কাজ করবে। ইতোপূর্বে বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। সেই সময়ে ছোটখাটো অনেক বিষয়ে ভুলভ্রান্তি হয়েছে, তা এখন অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছেন নেতারা। ফলে সব ভুলত্রুটি দূর করে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগোনোর পক্ষে দলটি। 

সূত্রমতে, দলের মধ্যে অতিরিক্ত দলবাজি, দুর্নীতি এবং ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করা সনাতন পদ্ধতি চালু রয়েছে- এখান থেকেও বেরিয়ে আসতে চায়। ইতোমধ্যে দখল ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ১ হাজার ১০০-এর বেশি নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের বার্তা গেছে- আগের মতো একই কাজ করা যাবে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যেসব দোষে সমালোচিত হয়েছে ওই ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখা বা থামাতে চায় হাইকমান্ড। 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই দলের কোনো রকমের দুর্নাম হোক চাইছেন না। ইতোমধ্যে প্রভাবশালী নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনসহ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। তাদের দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে শোকজ করা হয়েছে। যাদের উত্তর সন্তোষজনক হয়নি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে অনিয়ম ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কোনো কাজ করা যাবে না- এমন বার্তাও গেছে নেতা-কর্মীদের কাছে। 

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত তিন মাসে যে পরিমাণ বহিষ্কার ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তা বিএনপির ইতিহাসে ঘটেনি। আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন ছাত্ররা। কিন্তু বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলোর যে ভূমিকা রয়েছে তাও অস্বীকার করছেন না পর্যবেক্ষকরা। 

অবশ্য তারা এও বলছেন, একটি দেশের মূল বিষয় হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক চর্চা। আর গণতান্ত্রিক চর্চা মানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিএনপি নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। কিন্তু আগামী নির্বাচনে দলটি বড় শক্তি নিয়ে রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে পারবে- এটাও কেউ মনে করছেন না। ফলে বিএনপি হচ্ছে একমাত্র বড় রাজনৈতিক দল। যদিও বিএনপির সঙ্গে যেসব দল শেখ হাসিনার সরকার পতন আন্দোলনে ছিল তাদের আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে নির্বাচন বিএনপি এককভাবেই করবে বলে মনে হয়।

দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপির সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা আছে এগুলোও বলছেন নেতারা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে এমনও আলোচনা রয়েছে- আওয়ামী লীগ বিগত তিন টার্ম নির্বাচনগুলো সঠিকভাবে দিলে এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণ না করলে তাদের এ রকম পরিণতি ভোগ করতে হতো না। মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতো না। সুতরাং দ্রুত জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং তাদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা- এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করে বিএনপি। তবে নির্বাচনের আগে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হোক, এটি বিএনপি চাইছে না। যে কারণে সব ধরনের সংঘাত এড়ানোর পক্ষে। পাশাপাশি দলকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার পক্ষে। 

এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘অতীতের ভুলত্রুটি শোধরানোর জন্য বিএনপি নিয়মিত ক্লাস করছে। সেই পরীক্ষার ফলই হলো রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা। এই ৩১ দফায় নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যাতে তারা ৩১ দফার আলোকে নিজেদের তৈরি করতে পারেন এবং আগামী দিনে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’ 

তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে বিএনপিকে জনগণ আরও স্বচ্ছভাবে পাবে। জনগণের কাছে আরও বেশি দায়বদ্ধ থাকবে বিএনপি। আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ৩১ দফা বাস্তবায়ন করবে।’ 

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। ফলে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা আগামী দিনে কাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাবে। তিনি বলেন, বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ৩১ দফা ঘোষণা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও কিছু সংস্কারের কথা বলেছে। তারা কিছু সংস্কারও করবে। বাকি কাজ নির্বাচিত সরকার করবে। বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করার আগে চার-পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্ট্যাডি করেছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, প্রয়োজনে আরও কিছু সংস্কার বা সংশোধন করা হবে। আগামী দিনে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে পথচলা বিএনপির টার্গেট। 

সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় ঘটে। এরপর থেকেই ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ পরিচালনায় সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে বিএনপি। এই সরকারে সুশীল সমাজের পাশাপাশি ছাত্রদের অংশীদারত্ব রয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংবিধান সংশোধনসহ চলমান সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচন দেবে নাকি সবকিছু সংস্কার করে নির্বাচন দেবে, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। 

গতকাল শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম বলেছেন, শুধু নির্বাচনের জন্য দুই হাজার মানুষ জীবন দেয়নি। অর্ধলাখ মানুষ রক্ত দেয়নি। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিস্টেমগুলোর যৌক্তিক সংস্কার করে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনে যাওয়া উচিত। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অতিদ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 

এমন পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে এক বছর নাকি আরও বেশি সময় লাগবে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের দাবিতে চাপ অব্যাহত রাখতে চায় দলটি। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেহেতু এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেই সেহেতু তারাই বড় দল। আজ বা কাল হোক নির্বাচন তো দিতে হবেই। বিএনপি নির্বাচনের দিন-তারিখ, বিশেষ করে রোডম্যাপের তাগিদ দেবে- এটা স্বাভাবিক বিষয়। তিনি মনে করেন, তারা ক্ষমতায় যেতেও প্রস্তুত। এ জন্য দলীয় শৃঙ্খলা যারা ভঙ্গ করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলই ছিল মূল টার্গেট

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ এএম
ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলই ছিল মূল টার্গেট
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

অন্তত ৩০ বছর ধরে সব সরকারের আমলে ঘুষ-বাণিজ্য করেই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়েছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রুগ্‌ণ কোম্পানি কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডকে কৌশলে লিজ নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটানো শুরু করেন।

জানা গেছে, তিনি ওই সময়ে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবিত করে দরপত্র ও প্রতিযোগিতা ছাড়াই কোম্পানিটি হাতিয়ে নেন। এরপর প্রতিটি সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘুষ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী আমলাদের নানা রকম আর্থিক সুবিধা দিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটান। এরপর আর থামেনি ঘুষ-বাণিজ্য।

২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপিকে ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা ছাড়াও দিয়েছেন বিএমডব্লিউর মতো বিলাসবহুল গাড়ি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নানাভাবে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ তার বিরুদ্ধে ১৪টিরও বেশি মামলা হয়। এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় । তবে ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়ী পার্টনার বানিয়েছেন। তাদের বদৌলতে বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্টসহ ঠিকাদারি কাজে নানা রকম দুর্নীতি-অনিয়ম করেও টিকে ছিলেন ১৫ বছর। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা ১৪টি মামলার মধ্যে কয়েকটি মামলার রায়ে ঘুষ-বাণিজ্যের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডির রাস্তায় প্রায় এক দিন পড়ে থাকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি বিএমডব্লিউ। তৎকালীন দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গাড়িটি উদ্ধার করে মালিককে খুঁজতে থাকে। পরে জানা যায় গাড়িটির মালিক বিএনপির সাবেক হুইপ আশরাফ হোসেন। পরে ওই গাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে গাড়িটি ঘুষ হিসেবে দিয়েছিলেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। এ নিয়ে ওই সময়ে আশরাফ হোসেন, ওবায়দুল করিম, হারিছ চৌধুরীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ২০১২ সালে যখন চার্জ গঠন হয় ততক্ষণে ওবায়দুল করিম কৌশলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে ফেলেন। ফলে ওই সরকারের প্রভাবশালী মহলের পরামর্শে চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ওবায়দুল করিম। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট। তবে অপর চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা চলবে বলে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলও করে দুদক। আপিল চলাকালে ২০০০ সালের জুলাই আশরাফ হোসেন এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হারিছ চৌধুরী মারা যান। 

দুদক সূত্র জানায়, নানা কারণে দুদকের আপিলটি এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছে। 

এদিকে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চের দেওয়া রায়ে ওবায়দুল করিম ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২৭৩ পৃষ্ঠার ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়, ওরিয়নের ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড অনৈতিকভাবে কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এর মধ্যে ওবায়দুল করিম তার সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১১০০০১২৮১৪ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে ৮১৯১৩৫৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে ইকবাল মাহমুদ টুকুকে ৫০ লাখ টাকা দেন। এ ছাড়া ২০০৬ সালের ৬ জুন ওবায়দুল করিমের ঘুষ বিতরণের প্রতিষ্ঠান ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের মাধ্যমে ভারতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের ০২৩৩০২২৬১৩ ও ০৫১৩০৯৫৯২০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ১ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব টাকার ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৬ টাকায় একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দেওয়া হয়েছে, ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনে দেওয়া হয়। বাকি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৩ টাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওবায়দুল করিম দাবি করেছেন, সেই টাকা ওই সময়ে ভারতে অবস্থানরত তার ভাইকে বাড়ি ভাড়া বাবদ দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে ২০০৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট থেকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার পে-অর্ডার নম্বর ০৩৯২৯৫৯ মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই পে-অর্ডারে রিসিভার হিসেবে ওবায়দুল করিমের জামাতা মেহেদী হাসানের নাম থাকলেও পরে তার নাম কেটে দিয়ে সেখানে রুমানা মাহমুদ লেখা হয় এবং পার্টিকুলার রিসিভার হিসেবে রুমানা মাহমুদ ওই টাকা উঠিয়ে নেন। এর আগে একই বছরের ২৮ মার্চ রুমানা মাহমুদকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ওবায়দুল করিম অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে রায়ের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। বিচারের সময় সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক এ এফ এম শরিফুল ইসলাম, আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট সাক্ষীরা অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। ফলে অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। 

পুরো রায়টি লেখেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায়ে সমর্থন জানান বিচারপতি খিজির হায়াত। 

অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা এবং এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ওবায়দুল করিম ২০০৯ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করলে সব অপকর্মের দায় থেকে বাঁচতে ওবং ওই সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিসহ ক্ষমতাধর নেতাদের বাগে আনতে তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করে নেন। এর মধ্যে ওরিয়নের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেন সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে। ডাচ্‌-বাংলা পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের পরিচালক পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে। এমন অনেক মন্ত্রী-এমপিকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়ে গত ১৬ বছরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ওবায়দুল করিম, তার পরিবারের সদস্যদের এবং ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনুসন্ধান ও তদন্ত চালাচ্ছে। তবে বসে নেই ওবায়দুল করিম ও ওরিয়নের কর্ণধাররা। তারা বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদেরও আশীর্বাদ পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তবে তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার এখনো কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।

সম্পদের পাহাড় গড়া ছিল হানিফের নেশা

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৩ এএম
সম্পদের পাহাড় গড়া ছিল হানিফের নেশা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

মাহবুবউল আলম হানিফ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং টানা তিন বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। আর এই তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত চার জেলায় অনুসন্ধানে তার সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি কানাডাসহ কয়েকটি দেশে হানিফের সম্পদ ও ব্যবসা আছে বলেও জানা গেছে। মূলত রাজনীতির আড়ালে অর্থ আয় করা ছিল তার নেশা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছেন মাহবুবউল আলম হানিফ। তার দোসররাও পালিয়ে গেছে।

এদিকে হানিফের ক্ষমতাকে পুঁজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্বে থাকা চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা। মাত্র কয়েক বছরেই নিজের আখের গুছিয়েছেন তিনি। অল্পদিনেই হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। হাট ঘাট বা টেন্ডারবাজি সব ছিল তার দখলে। আতার ইশারা ছাড়া যেন কুষ্টিয়ার কোনো গাছের পাতাও নড়ত না। যার কারণে জেলা আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী এবং দুর্দিনের কান্ডারিরা হয়ে পড়েন একঘরে। সরকার পতনের পর থেকে আতাও আত্মগোপনে চলে যান।

হানিফের উত্থান যেভাবে

মাহবুবউল আলম হানিফের বড় ভাই সাবেক সচিব রাশিদুল আলম শেখ পরিবারের জামাই। সেই সূত্র ধরেই হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে মনোনয়ন পান তিনি। তবে পরাজিত হন। এরপর আরও একবার মনোনয়ন পেলেও বিজয়ী হতে পারেননি। ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফ মনোনয়নবঞ্চিত হন। মনোনয়ন দেওয়া হয় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে। দল ক্ষমতায় আসে। হানিফকে করা হয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। ২০১৩ সালে কুষ্টিয়া সদর আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। ওই বছর দলীয় কাউন্সিলে পেয়ে যান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর পিছে তাকাতে হয়নি। বাড়তে থাকে প্রভাব-প্রতিপত্তি। দলে তার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হয় একাধিকবার একই পদ পেয়ে যাওয়ার কারণে। যদিও মন্ত্রী হওয়ার খায়েস থাকলেও আশা পূরণ হয়নি নানা অভিযোগের কারণে।

দলের নেতা-কর্মীদের পাত্তা না দিলেও বড় বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আঁতাত করে চলতেন। এভাবে গত ১৫ বছরে প্রচুর সম্পদের মালিকবনে গেছেন হানিফ। তার পুরো পরিবার থাকে কানাডায়। এ ছাড়া সেখানে তার কয়েকজন ভাইবোনও বাস করেন। কানাডায় হানিফের গাড়ি-বাড়িসহ সম্পদ আছে বলে জানা গেছে।

নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়

হানিফের কপাল খুলে যায় শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ার কারণে। দলের শীর্ষ পদ পাওয়ার পরই তার কাছে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া ঢাকাকেন্দ্রিক নানা কাজের তদবিরও করতেন। দলের পদ-পদবি দেওয়ার নামে যেমন অর্থ বাণিজ্য করেছেন তেমনি নানা তদবির, টেন্ডার বাণিজ্য, বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। হানিফের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল। কারওয়ান বাজারে বিএমটিসি ভবনে তার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক অফিস। সেই অফিস ও কুষ্টিয়ার বাসায় বসেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তার হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেন। সর্বশেষ স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নেন। লালন কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের নতুন ভবনে।

দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হানিফের আয়ের টাকার বড় অংশ পাচার করেছেন কানাডাসহ কয়েকটি দেশে। আর দেশে কয়েকটি বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে বেনামে হানিফের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদের খবর পাওয়া গেছে। 

কুষ্টিয়ায় হানিফ ও তার ভাই আতার নামে মার্কেট, দোকান ও শপিং মলে দোকান আছে বলে জানা গেছে। কুষ্টিয়া শহরের তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘খেলার মাঠের পাশে দুই তলা নতুন যে মার্কেট হয়েছে সেখানে ৮টি দোকান আছে তাদের নামে। দোকানের ভাড়াটিয়ারা জানান, প্রতি মাসে আতা টাকা তুলতেন।’

জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় মহাসড়কের পাশে ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তার ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে।

শহরের বহুতল বিপণিবিতান পরিমল টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে হানিফ ও আতার নামে। মার্কেট কমিটি জানায়, দুটি দোকানের দাম কোটি টাকার ওপরে। ভাড়া ওঠে প্রতি মাসে অর্ধলাখ টাকা। এ ছাড়া সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। শহরের হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, হাউজিংয়ের জমির সঙ্গে স্থানীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। আতার নামে হলেও এর পেছনে ছিলেন হানিফ। পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিন তলা বাড়ি কাগজে-কলমে আতা ও তার স্ত্রীর নামে হলেও হানিফের অর্থে করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। প্রথম দিকে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড এ বাড়িতে লাগানো হয়। 

আতার সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করার পর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া ঢাকা ও কুষ্টিয়ায় তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শেয়ার, ব্যাংকে ডিপোজিট আছে।

দল ও অন্য কয়েকটি সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী অজয় সুরেকার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় কোটি কোটি লগ্নি করা আছে হানিফের। এসব কারণে অজয় সুরেকাকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ করেন হানিফ। এসব বিষয়ে জানতে মুঠো ফোনে অজয় সুরেকার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, জোর করে দলীয় পদ দেওয়া ছাড়া হানিফের সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। আর ওই পদ-পদবির পরিচয়ও তিনি দিতেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হানিফ প্রভাব খাটিয়ে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন সারা দেশে। তার নিজের একাধিক ড্রেজার আছে খননের জন্য। সর্বশেষ গড়াই খননের একটি কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। এতে তার নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতি ড্রেজারের দাম ৩০ কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা আছে হানিফের। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় হানিফের নগদ টাকার পরিমাণ বহু গুণ বেড়েছে বলে দেখা গেছে।

২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে একটি সাধারণ মানের গাড়িতে চড়লেও পরে তিনি একাধিক দামি গাড়ি ক্রয় করেন। যার প্রতিটির দাম কোটি টাকার ওপরে। রাজধানীর গুলশানে তার বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, আছে বনানীতেও। এ ছাড়া খুলনায় তার মাছের ঘেরের সঙ্গে আছে রিসোর্ট। জমি আছে পাবনার ঈশ্বরদী, কক্সবাজারের টেকনাফে। পার্টনারে গাজীপুরে নির্মাণ করেছেন একাধিক রিসোর্ট।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিতর্কিত একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে বেনামে যৌথ ব্যবসা আছে তার। নদী খনন ও শাসনের কাজ করতেন তারা দুজন। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজের নামে কোটি কোটি টাকার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। তবে হানিফের কারণে পার পেয়ে গেছেন ঠিকাদার।

সর্বশেষ কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদীশাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকার অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কবজায় নিয়ে নেন। এসব কাজ পরে কমিশনে বিক্রি করে দেন। এ কাজ থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ। তার সময় কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, কুষ্টিয়া শহরে ফোর লেন করা, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক নির্মাণ, শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু নির্মাণ, মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প। এ ছাড়া সম্প্রতি পদ্মা নদীশাসনে বড় একটি প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিটি থেকেই হানিফ আগাম বাগিয়ে নেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। প্রতিটি প্রকল্প থেকে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ কমিশন আদায় হতো। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, বালুর ঘাটের কমিশনসহ অন্যান্য কাজ থেকে যে আয় হতো তা চাচাতো ভাই আতার মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন। সর্বশেষ কুষ্টিয়া মেডিকেলের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হানিফের পছন্দের প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ।

কুষ্টিয়ার সব ঠিকাদারি কাজ, হাট-ঘাটের ইজারা, সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে নিয়োগ, পদ্মা ও গড়াই নদীর বালু মহাল থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্র থেকে কমিশন আদায় করেছেন হানিফ। এমন কি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পদ বিক্রির অভিযোগও রয়েছে হানিফের বিরুদ্ধে।

প্রতিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন

হানিফের অত্যাচার নির্যাতন থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন বাদ যাননি তেমনি বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েন তার বাহিনী দিয়ে। জেলা যুবদল নেতা আল আমিন কানাই বলেন, গত নির্বাচনের আগে একজন কাউন্সিলর আমার বাসায় গিয়ে বলেন, হানিফের ভাই আতা সাহেব চা খাবেন। আমি বলি এত বড় নেতার সঙ্গে চা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর থেকে তারা আমার বাড়িতে মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্তা করেছে, আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। এখন আমি ব্রেন স্ট্রোকের রোগী। মানসিক ও শারীরিকভাবে তারা আমাকেসহ দলের বহু নেতাকে গত ১৬ বছরে শেষ করে দিয়েছে।

সাংবাদিক নির্যাতন

আওয়ামী লীগ ও হানিফের নামে নিউজ করে মামলা ও হামলার স্বীকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-ছাড়া হয়েছেন একাধিক সংবাদকর্মী। মামলা দিয়ে জেলে পাঠান যুগান্তর প্রতিনিধি এ এম জুবায়েদ রিপনসহ বেশ কয়েকজনকে। এর বাইরে জুয়েল আহম্মেদ শাহিন ও অঞ্জন শুভ নামের স্থানীয় দুই সাংবাদিক হানিফের রোষানলে পড়ে মিথ্যা মামলায় কারাগারে যান। 

৫ আগস্টের পর

হানিফ ও আতাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নামে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। গা-ঢাকা দিয়েছেন সব নেতা। এরপর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় বর্তমান পরিস্থিতি ও হানিফের বিষয়ে। বেশির ভাগই বলছেন, হানিফ রাজনীতি করার জন্য কুষ্টিয়ায় আসেননি। এসেছেন বাণিজ্য করতে। 

কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. আমিনুল হক রতন বলেন, হানিফ-আতা এই দুই ভাইয়ের কারণে কুষ্টিয়ার রাজনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। একক আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছেন। 

বিপুল সম্পদের মালিক আতা

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন আতা। ঘষলেই বেরুত টাকা। তিনি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামের প্রয়াত আবদুস সাত্তারের ছেলে। আবদুস সাত্তার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বাবা আফসার আলীর চাচাতো ভাই। সেই সূত্রে হানিফ আর আতা চাচাতো ভাই। হানিফের পর আতা ছিলেন কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি। দুই ভাই মিলে জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সব সরকারি কাজ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এভাবে আতা জিরো থেকে বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। একসময় মোটরসাইকেলে চড়লেও এখন তার কোটি টাকা দামের একাধিক গাড়ি আছে। স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেও স্বামীর টাকায় তিনিও কোটিপতি। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে আতার।

দলের পদ-পদবি ও টেন্ডারে কাজ পেতে আতার কাছে ধরনা দিতে হতো সবাইকে। তার অত্যাচার ও নির্যাতনে দল ছেড়েছেন অনেকে। এমনকি ঠিকাদারি কাজও ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। অবৈধ বালুঘাট, হাট-বাজার, বিল ও বাঁওড় নিয়ন্ত্রণ করতেন আতা। তিনি এভাবে গত ১৬ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর আতা গা-ঢাকা দেন। তার বাড়ি লুটপাট হয়ে গেছে। একই অবস্থা হানিফের বাড়িরও। আতার স্ত্রীর নামে অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগে দুনীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। আতার অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। যেকোনো সময় মামলা হতে পারে বলে জানা গেছে।

২০২২ সালে আতার বিপুল অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে দুদকে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে বলা হয়, ১০ বছরের ব্যবধানে বাড়ি-গাড়িসহ ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিকবনে গেছেন আতা। এই অভিযোগ ওঠার পর ২০২২ সালে দুদক তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে।

আতা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কুষ্টিয়া অফিস থেকে সাড়ে ৫ কাঠার প্লট নিয়েছেন। শহরের হাউজিং এলাকায় ওই জমিতে ৭ তলা ভবনের কাজ চলছে। স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর নামে তিনি ওই সম্পদ করেছেন। এখানে বিনিয়োগের ব্যাপারে আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। অথচ ভবন করতেই খরচ হয়েছে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা। আতা-ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা এ তথ্য দেন। 

আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় এবং মুঠো ফোন বন্ধ থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে মাহাবুবউল আলম হানিফ এবং তার ভাই আতাউর রহমান আতার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।