ঢাকা ২৫ কার্তিক ১৪৩১, রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪

সাংবাদিকরা কোণঠাসা ছিলেন দবিরুলের প্রভাবে

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১২ পিএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৭ পিএম
সাংবাদিকরা কোণঠাসা ছিলেন দবিরুলের প্রভাবে
দবিরুল ইসলাম

উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন শাকিল আহমেদ। তিনি জানতে পারেন ঠাকুরগাঁও-২ (বালিয়াডাঙ্গী, হারিপুর ও রাণীশংকৈল) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, তার স্বজন ও সমর্থকরা দখল করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি। 

এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেন শাকিল আহমেদ। প্রতিবেদনটি নিউজপোর্টাল বিডিনিউজে প্রকাশ পেলে ক্ষিপ্ত হন এমপি দবিরুল ইসলাম। তিনি নিজেই বাদী হয়ে ২০১৬ সালে ২৮ নভেম্বর বালিয়াডাঙ্গী থানায় তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইনে বিডিনিউজের তৎকালীন সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালেদী ও শাকিল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ দীর্ঘ সময় তদন্ত করে। প্রমাণ হয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এমপি দবিরুলের মামলায় আনা অভিযোগ মিথ্যা। আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এর আগে সামাজিকভাবে পদে পদে হেনস্তা হতে হয় সাংবাদিক শাকিলকে।

ঠাকুরগাঁও-২ আসনে ছিল আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের নেতা-কর্মীদের রাজত্ব। এ রাজ্যে অনেকটা রাজার মতোই চলতেন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি মমিনুল ইসলাম ভাসানী। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৬৩০ বস্তা চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। নাম আসে মমিনুল ইসলাম ভাসানীরও। এ নিয়ে বিডিনিউজ ও জাগো নিউজ সংবাদ প্রচার করে। এতে ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বালিয়াডাঙ্গী থানায় মামলা করেন মমিনুল। এ মামলায় বিডিনিউজের সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালেদী, জাগো নিউজের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার ও স্থানীয় তিন সাংবাদিক শাওন আমিন, তানভির হাসান তানু ও রহিম শুভকে আসামি করা হয়। এ মামলা আদালতে এখনো বিচারাধীন।

২০২০ সালে করোনার সময়ে বেকার হয়ে পড়েন মজুর শ্রেণির হাজারও মানুষ। সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ঠাকুরগাঁওয়ে। অভিযোগ ওঠে যতটা না সহযোগিতা করা হয়, তার চেয়ে বেশি প্রচারণা চালায় স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। এ তথ্য আসে সাংবাদিকদের কাছে। স্থানীয় সাংবাদিক আল মামুন জীবন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে সমালোচনা করে একটি পোস্ট দেন। এ নিয়ে বিরক্ত হন তৎকালীন জেলা প্রশাসক কামরুজ্জামান ও পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান। একপর্যায়ে সেবছর ১৪ এপ্রিল সাংবাদিক জীবনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সাব-ইন্সপেক্টর জহুরুল হক।

মামলার বিষয়ে জীবন খবরের কাগজকে বলেন, ‘মামলায় আমার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্রও দেয় পুলিশ। মামলাটি এখনো চলছে।’ 

করোনায় হাসপাতালগুলোতে পুস্টিকর খাবার দেওয়ার নির্দেশ দেয় সরকার। ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন স্থানীয় সাংবাদিক তানভির হাসান তানু, রহিম শুভ ও আব্দুল লতিফ লিটু। তাদের পাঠানো খবর প্রচার হলে বিরক্ত হন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। পরে ঠাকুরগাঁও ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নাদিরুল আজিম চপল বাদী হয়ে মামলা দেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এমপি রমেশ চন্দ্র সেনের নির্দেশেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয় বলে সাংবাদিকরা জানান।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের রোষানলে পড়েন তিন সাংবাদিক মো. আব্দুল আলীম, আবু তারেক বাঁধন ও ফরিদুল ইসলাম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক রূপবাণী পত্রিকার পীরগঞ্জ প্রতিনিধি আব্দুল আলীম। ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন পীরগঞ্জ থানা পুলিশ। ওই মামলায় তাকে কারাগারে রাখা হয় প্রায় চার মাস। বের হওয়ার পর তাকে হাজিরা দিতে যেতে হতো ঢাকায়। এখন অন্যদের মতো তাকে রংপুরে হাজিরা দিতে হচ্ছে। 

এ মামলার নেপথ্যের কারণ কী এ প্রশ্নের জবাবে আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমি আমার পত্রিকায় পীরগঞ্জে মাদক ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করি। এতে বিরক্ত হন পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রভাশালীরা। এর জেরেই সম্ভবত আমার বিরুদ্ধে ওই মামলা করে পুলিশ। তবে পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা কাটা নিয়ে এক সময় গুজব ছড়ায়। আমি তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যামে একটি পোস্ট করি। এ কারণে ওই মামলা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে মামলাটি দেওয়া হয়।’

জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ের অন্তত ৮ জন সাংবাদিককে এখনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় নিয়মিত রংপুরে গিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে হয়।

ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলই ছিল মূল টার্গেট

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ এএম
ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলই ছিল মূল টার্গেট
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

অন্তত ৩০ বছর ধরে সব সরকারের আমলে ঘুষ-বাণিজ্য করেই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়েছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রুগ্‌ণ কোম্পানি কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডকে কৌশলে লিজ নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটানো শুরু করেন।

জানা গেছে, তিনি ওই সময়ে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবিত করে দরপত্র ও প্রতিযোগিতা ছাড়াই কোম্পানিটি হাতিয়ে নেন। এরপর প্রতিটি সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘুষ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী আমলাদের নানা রকম আর্থিক সুবিধা দিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটান। এরপর আর থামেনি ঘুষ-বাণিজ্য।

২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপিকে ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা ছাড়াও দিয়েছেন বিএমডব্লিউর মতো বিলাসবহুল গাড়ি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নানাভাবে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ তার বিরুদ্ধে ১৪টিরও বেশি মামলা হয়। এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় । তবে ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়ী পার্টনার বানিয়েছেন। তাদের বদৌলতে বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্টসহ ঠিকাদারি কাজে নানা রকম দুর্নীতি-অনিয়ম করেও টিকে ছিলেন ১৫ বছর। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা ১৪টি মামলার মধ্যে কয়েকটি মামলার রায়ে ঘুষ-বাণিজ্যের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডির রাস্তায় প্রায় এক দিন পড়ে থাকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি বিএমডব্লিউ। তৎকালীন দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গাড়িটি উদ্ধার করে মালিককে খুঁজতে থাকে। পরে জানা যায় গাড়িটির মালিক বিএনপির সাবেক হুইপ আশরাফ হোসেন। পরে ওই গাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে গাড়িটি ঘুষ হিসেবে দিয়েছিলেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। এ নিয়ে ওই সময়ে আশরাফ হোসেন, ওবায়দুল করিম, হারিছ চৌধুরীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ২০১২ সালে যখন চার্জ গঠন হয় ততক্ষণে ওবায়দুল করিম কৌশলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে ফেলেন। ফলে ওই সরকারের প্রভাবশালী মহলের পরামর্শে চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ওবায়দুল করিম। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট। তবে অপর চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা চলবে বলে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলও করে দুদক। আপিল চলাকালে ২০০০ সালের জুলাই আশরাফ হোসেন এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হারিছ চৌধুরী মারা যান। 

দুদক সূত্র জানায়, নানা কারণে দুদকের আপিলটি এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছে। 

এদিকে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চের দেওয়া রায়ে ওবায়দুল করিম ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২৭৩ পৃষ্ঠার ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়, ওরিয়নের ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড অনৈতিকভাবে কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এর মধ্যে ওবায়দুল করিম তার সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১১০০০১২৮১৪ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে ৮১৯১৩৫৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে ইকবাল মাহমুদ টুকুকে ৫০ লাখ টাকা দেন। এ ছাড়া ২০০৬ সালের ৬ জুন ওবায়দুল করিমের ঘুষ বিতরণের প্রতিষ্ঠান ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের মাধ্যমে ভারতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের ০২৩৩০২২৬১৩ ও ০৫১৩০৯৫৯২০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ১ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব টাকার ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৬ টাকায় একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দেওয়া হয়েছে, ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনে দেওয়া হয়। বাকি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৩ টাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওবায়দুল করিম দাবি করেছেন, সেই টাকা ওই সময়ে ভারতে অবস্থানরত তার ভাইকে বাড়ি ভাড়া বাবদ দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে ২০০৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট থেকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার পে-অর্ডার নম্বর ০৩৯২৯৫৯ মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই পে-অর্ডারে রিসিভার হিসেবে ওবায়দুল করিমের জামাতা মেহেদী হাসানের নাম থাকলেও পরে তার নাম কেটে দিয়ে সেখানে রুমানা মাহমুদ লেখা হয় এবং পার্টিকুলার রিসিভার হিসেবে রুমানা মাহমুদ ওই টাকা উঠিয়ে নেন। এর আগে একই বছরের ২৮ মার্চ রুমানা মাহমুদকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ওবায়দুল করিম অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে রায়ের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। বিচারের সময় সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক এ এফ এম শরিফুল ইসলাম, আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট সাক্ষীরা অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। ফলে অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। 

পুরো রায়টি লেখেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায়ে সমর্থন জানান বিচারপতি খিজির হায়াত। 

অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা এবং এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ওবায়দুল করিম ২০০৯ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করলে সব অপকর্মের দায় থেকে বাঁচতে ওবং ওই সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিসহ ক্ষমতাধর নেতাদের বাগে আনতে তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করে নেন। এর মধ্যে ওরিয়নের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেন সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে। ডাচ্‌-বাংলা পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের পরিচালক পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে। এমন অনেক মন্ত্রী-এমপিকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়ে গত ১৬ বছরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ওবায়দুল করিম, তার পরিবারের সদস্যদের এবং ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনুসন্ধান ও তদন্ত চালাচ্ছে। তবে বসে নেই ওবায়দুল করিম ও ওরিয়নের কর্ণধাররা। তারা বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদেরও আশীর্বাদ পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তবে তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার এখনো কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।

সম্পদের পাহাড় গড়া ছিল হানিফের নেশা

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৩ এএম
সম্পদের পাহাড় গড়া ছিল হানিফের নেশা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

মাহবুবউল আলম হানিফ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং টানা তিন বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। আর এই তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত চার জেলায় অনুসন্ধানে তার সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি কানাডাসহ কয়েকটি দেশে হানিফের সম্পদ ও ব্যবসা আছে বলেও জানা গেছে। মূলত রাজনীতির আড়ালে অর্থ আয় করা ছিল তার নেশা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছেন মাহবুবউল আলম হানিফ। তার দোসররাও পালিয়ে গেছে।

এদিকে হানিফের ক্ষমতাকে পুঁজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্বে থাকা চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা। মাত্র কয়েক বছরেই নিজের আখের গুছিয়েছেন তিনি। অল্পদিনেই হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। হাট ঘাট বা টেন্ডারবাজি সব ছিল তার দখলে। আতার ইশারা ছাড়া যেন কুষ্টিয়ার কোনো গাছের পাতাও নড়ত না। যার কারণে জেলা আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী এবং দুর্দিনের কান্ডারিরা হয়ে পড়েন একঘরে। সরকার পতনের পর থেকে আতাও আত্মগোপনে চলে যান।

হানিফের উত্থান যেভাবে

মাহবুবউল আলম হানিফের বড় ভাই সাবেক সচিব রাশিদুল আলম শেখ পরিবারের জামাই। সেই সূত্র ধরেই হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে মনোনয়ন পান তিনি। তবে পরাজিত হন। এরপর আরও একবার মনোনয়ন পেলেও বিজয়ী হতে পারেননি। ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফ মনোনয়নবঞ্চিত হন। মনোনয়ন দেওয়া হয় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে। দল ক্ষমতায় আসে। হানিফকে করা হয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। ২০১৩ সালে কুষ্টিয়া সদর আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। ওই বছর দলীয় কাউন্সিলে পেয়ে যান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর পিছে তাকাতে হয়নি। বাড়তে থাকে প্রভাব-প্রতিপত্তি। দলে তার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হয় একাধিকবার একই পদ পেয়ে যাওয়ার কারণে। যদিও মন্ত্রী হওয়ার খায়েস থাকলেও আশা পূরণ হয়নি নানা অভিযোগের কারণে।

দলের নেতা-কর্মীদের পাত্তা না দিলেও বড় বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আঁতাত করে চলতেন। এভাবে গত ১৫ বছরে প্রচুর সম্পদের মালিকবনে গেছেন হানিফ। তার পুরো পরিবার থাকে কানাডায়। এ ছাড়া সেখানে তার কয়েকজন ভাইবোনও বাস করেন। কানাডায় হানিফের গাড়ি-বাড়িসহ সম্পদ আছে বলে জানা গেছে।

নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়

হানিফের কপাল খুলে যায় শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ার কারণে। দলের শীর্ষ পদ পাওয়ার পরই তার কাছে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া ঢাকাকেন্দ্রিক নানা কাজের তদবিরও করতেন। দলের পদ-পদবি দেওয়ার নামে যেমন অর্থ বাণিজ্য করেছেন তেমনি নানা তদবির, টেন্ডার বাণিজ্য, বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। হানিফের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল। কারওয়ান বাজারে বিএমটিসি ভবনে তার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক অফিস। সেই অফিস ও কুষ্টিয়ার বাসায় বসেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তার হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেন। সর্বশেষ স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নেন। লালন কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের নতুন ভবনে।

দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হানিফের আয়ের টাকার বড় অংশ পাচার করেছেন কানাডাসহ কয়েকটি দেশে। আর দেশে কয়েকটি বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে বেনামে হানিফের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদের খবর পাওয়া গেছে। 

কুষ্টিয়ায় হানিফ ও তার ভাই আতার নামে মার্কেট, দোকান ও শপিং মলে দোকান আছে বলে জানা গেছে। কুষ্টিয়া শহরের তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘খেলার মাঠের পাশে দুই তলা নতুন যে মার্কেট হয়েছে সেখানে ৮টি দোকান আছে তাদের নামে। দোকানের ভাড়াটিয়ারা জানান, প্রতি মাসে আতা টাকা তুলতেন।’

জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় মহাসড়কের পাশে ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তার ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে।

শহরের বহুতল বিপণিবিতান পরিমল টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে হানিফ ও আতার নামে। মার্কেট কমিটি জানায়, দুটি দোকানের দাম কোটি টাকার ওপরে। ভাড়া ওঠে প্রতি মাসে অর্ধলাখ টাকা। এ ছাড়া সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। শহরের হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, হাউজিংয়ের জমির সঙ্গে স্থানীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। আতার নামে হলেও এর পেছনে ছিলেন হানিফ। পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিন তলা বাড়ি কাগজে-কলমে আতা ও তার স্ত্রীর নামে হলেও হানিফের অর্থে করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। প্রথম দিকে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড এ বাড়িতে লাগানো হয়। 

আতার সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করার পর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া ঢাকা ও কুষ্টিয়ায় তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শেয়ার, ব্যাংকে ডিপোজিট আছে।

দল ও অন্য কয়েকটি সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী অজয় সুরেকার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় কোটি কোটি লগ্নি করা আছে হানিফের। এসব কারণে অজয় সুরেকাকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ করেন হানিফ। এসব বিষয়ে জানতে মুঠো ফোনে অজয় সুরেকার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, জোর করে দলীয় পদ দেওয়া ছাড়া হানিফের সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। আর ওই পদ-পদবির পরিচয়ও তিনি দিতেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হানিফ প্রভাব খাটিয়ে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন সারা দেশে। তার নিজের একাধিক ড্রেজার আছে খননের জন্য। সর্বশেষ গড়াই খননের একটি কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। এতে তার নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতি ড্রেজারের দাম ৩০ কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা আছে হানিফের। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় হানিফের নগদ টাকার পরিমাণ বহু গুণ বেড়েছে বলে দেখা গেছে।

২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে একটি সাধারণ মানের গাড়িতে চড়লেও পরে তিনি একাধিক দামি গাড়ি ক্রয় করেন। যার প্রতিটির দাম কোটি টাকার ওপরে। রাজধানীর গুলশানে তার বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, আছে বনানীতেও। এ ছাড়া খুলনায় তার মাছের ঘেরের সঙ্গে আছে রিসোর্ট। জমি আছে পাবনার ঈশ্বরদী, কক্সবাজারের টেকনাফে। পার্টনারে গাজীপুরে নির্মাণ করেছেন একাধিক রিসোর্ট।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিতর্কিত একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে বেনামে যৌথ ব্যবসা আছে তার। নদী খনন ও শাসনের কাজ করতেন তারা দুজন। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজের নামে কোটি কোটি টাকার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। তবে হানিফের কারণে পার পেয়ে গেছেন ঠিকাদার।

সর্বশেষ কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদীশাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকার অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কবজায় নিয়ে নেন। এসব কাজ পরে কমিশনে বিক্রি করে দেন। এ কাজ থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ। তার সময় কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, কুষ্টিয়া শহরে ফোর লেন করা, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক নির্মাণ, শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু নির্মাণ, মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প। এ ছাড়া সম্প্রতি পদ্মা নদীশাসনে বড় একটি প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিটি থেকেই হানিফ আগাম বাগিয়ে নেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। প্রতিটি প্রকল্প থেকে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ কমিশন আদায় হতো। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, বালুর ঘাটের কমিশনসহ অন্যান্য কাজ থেকে যে আয় হতো তা চাচাতো ভাই আতার মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন। সর্বশেষ কুষ্টিয়া মেডিকেলের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হানিফের পছন্দের প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ।

কুষ্টিয়ার সব ঠিকাদারি কাজ, হাট-ঘাটের ইজারা, সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে নিয়োগ, পদ্মা ও গড়াই নদীর বালু মহাল থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্র থেকে কমিশন আদায় করেছেন হানিফ। এমন কি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পদ বিক্রির অভিযোগও রয়েছে হানিফের বিরুদ্ধে।

প্রতিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন

হানিফের অত্যাচার নির্যাতন থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন বাদ যাননি তেমনি বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েন তার বাহিনী দিয়ে। জেলা যুবদল নেতা আল আমিন কানাই বলেন, গত নির্বাচনের আগে একজন কাউন্সিলর আমার বাসায় গিয়ে বলেন, হানিফের ভাই আতা সাহেব চা খাবেন। আমি বলি এত বড় নেতার সঙ্গে চা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর থেকে তারা আমার বাড়িতে মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্তা করেছে, আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। এখন আমি ব্রেন স্ট্রোকের রোগী। মানসিক ও শারীরিকভাবে তারা আমাকেসহ দলের বহু নেতাকে গত ১৬ বছরে শেষ করে দিয়েছে।

সাংবাদিক নির্যাতন

আওয়ামী লীগ ও হানিফের নামে নিউজ করে মামলা ও হামলার স্বীকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-ছাড়া হয়েছেন একাধিক সংবাদকর্মী। মামলা দিয়ে জেলে পাঠান যুগান্তর প্রতিনিধি এ এম জুবায়েদ রিপনসহ বেশ কয়েকজনকে। এর বাইরে জুয়েল আহম্মেদ শাহিন ও অঞ্জন শুভ নামের স্থানীয় দুই সাংবাদিক হানিফের রোষানলে পড়ে মিথ্যা মামলায় কারাগারে যান। 

৫ আগস্টের পর

হানিফ ও আতাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নামে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। গা-ঢাকা দিয়েছেন সব নেতা। এরপর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় বর্তমান পরিস্থিতি ও হানিফের বিষয়ে। বেশির ভাগই বলছেন, হানিফ রাজনীতি করার জন্য কুষ্টিয়ায় আসেননি। এসেছেন বাণিজ্য করতে। 

কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. আমিনুল হক রতন বলেন, হানিফ-আতা এই দুই ভাইয়ের কারণে কুষ্টিয়ার রাজনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। একক আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছেন। 

বিপুল সম্পদের মালিক আতা

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন আতা। ঘষলেই বেরুত টাকা। তিনি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামের প্রয়াত আবদুস সাত্তারের ছেলে। আবদুস সাত্তার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বাবা আফসার আলীর চাচাতো ভাই। সেই সূত্রে হানিফ আর আতা চাচাতো ভাই। হানিফের পর আতা ছিলেন কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি। দুই ভাই মিলে জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সব সরকারি কাজ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এভাবে আতা জিরো থেকে বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। একসময় মোটরসাইকেলে চড়লেও এখন তার কোটি টাকা দামের একাধিক গাড়ি আছে। স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেও স্বামীর টাকায় তিনিও কোটিপতি। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে আতার।

দলের পদ-পদবি ও টেন্ডারে কাজ পেতে আতার কাছে ধরনা দিতে হতো সবাইকে। তার অত্যাচার ও নির্যাতনে দল ছেড়েছেন অনেকে। এমনকি ঠিকাদারি কাজও ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। অবৈধ বালুঘাট, হাট-বাজার, বিল ও বাঁওড় নিয়ন্ত্রণ করতেন আতা। তিনি এভাবে গত ১৬ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর আতা গা-ঢাকা দেন। তার বাড়ি লুটপাট হয়ে গেছে। একই অবস্থা হানিফের বাড়িরও। আতার স্ত্রীর নামে অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগে দুনীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। আতার অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। যেকোনো সময় মামলা হতে পারে বলে জানা গেছে।

২০২২ সালে আতার বিপুল অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে দুদকে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে বলা হয়, ১০ বছরের ব্যবধানে বাড়ি-গাড়িসহ ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিকবনে গেছেন আতা। এই অভিযোগ ওঠার পর ২০২২ সালে দুদক তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে।

আতা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কুষ্টিয়া অফিস থেকে সাড়ে ৫ কাঠার প্লট নিয়েছেন। শহরের হাউজিং এলাকায় ওই জমিতে ৭ তলা ভবনের কাজ চলছে। স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর নামে তিনি ওই সম্পদ করেছেন। এখানে বিনিয়োগের ব্যাপারে আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। অথচ ভবন করতেই খরচ হয়েছে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা। আতা-ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা এ তথ্য দেন। 

আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় এবং মুঠো ফোন বন্ধ থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে মাহাবুবউল আলম হানিফ এবং তার ভাই আতাউর রহমান আতার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বিএনপি নেতার হাতে ‘পলাতক’ আ.লীগ নেতার পত্রিকা-ব্যবসা!

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫২ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম
বিএনপি নেতার হাতে ‘পলাতক’ আ.লীগ নেতার পত্রিকা-ব্যবসা!
সিলেট নগরীর আবাসিক এলাকা হাউজিং এস্টেটে বিএনপি নেতার কাযালয় এখন আওয়ামী লীগ নেতার পত্রিকা অফিস। শুক্রবার সকালে তোলা। ইনসেটে আ.লীগ নেতা সরওয়ার ও বিএনপি নেতা কয়েস লোদী। খবরের কাগজ

৫ আগস্টের পর হয়েছে ক্ষমতার পালাবদল। দলীয় কোনো সরকার এখনো নির্বাচিত হয়নি। তারপরও দলীয় প্রভাব খাটানো শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জায়গা জমি পর্যন্ত দখল হচ্ছে। এমনকি মিডিয়া হাউসের মালিকানার হাত বদল হয়েছে। সম্প্রতি সিলেটে একটি আঞ্চলিক পত্রিকার মালিকানা বদল নিয়ে চলছে তোলপাড়।

জানা গেছে, কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন সিলেটের আঞ্চলিক পত্রিকা ‘শুভ প্রতিদিন’-এর মালিক। ১৩তম বর্ষে পা রাখা এই পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকও তিনি। পত্রিকার মালিক দেখিয়ে সরওয়ার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেলেও তিনি দলীয় নির্দেশে সিলেট-৬ আসনে ডামি প্রার্থী হয়েছিলেন। আওয়ামী সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হওয়ায় তিনি এখন পলাতক। এরপরই গুঞ্জন উঠেছিল এই পত্রিকার মালিকানা বদলের। এই গুঞ্জনের পালে হাওয়া লাগে যখন সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর কার্যালয়ে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ লেখা সাইনবোর্ড সাঁটানোর পর।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সিসিকের প্যানেল মেয়র ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। এই ওয়ার্ডের হাউজিং স্টেট এলাকায় তার কার্যালয়। সম্প্রতি সেই কার্যালয়ে পত্রিকার নামে উঠেছে নতুন সাইনবোর্ড। তাই অনেকেই বলছেন, ক্ষমতার দাপটে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দখল করেছেন এই পত্রিকা। অনেকে আবার বলছেন মালিক সরওয়ার হোসেনে দল ক্ষমতায় নেই, তাই কয়েস লোদীকে সাময়িকভাবে চালাতে দিয়েছেন।

সরজমিনে দেখা যায়, কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সাইনবোর্ড খুলে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ সাইনবোর্ড লাগালেও এখনো পত্রিকা সংশ্লিষ্ট কোনো আসবাবপত্র বা অন্য কোনো সামগ্রী এখানে সাজানো হয়নি। কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকা অবস্থায় ভিতরে যে সাজসজ্জা ছিল এখনো তাই আছে। পত্রিকাটির কার্যালয় নগরীর নেহার মার্কেটে রয়েছে। 

প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মীদের মাধ্যমে জানা গেছে, কয়েস লোদী পলাতক সরওয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পত্রিকাটির সত্ত্ব নিজ নামে করে নিয়েছেন। বিদেশে অবস্থানরত প্রতিষ্ঠাকালীন একজন কর্মী বলেন, ‘পত্রিকাটি ডিএফপি তালিকাভুক্ত। সরকার বদলের সঙ্গে ডিএফপি তালিকাভুক্ত যাতে থাকে, এ জন্য মালিকানা বদল করা হয়েছে। এতে কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি।’

আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পত্রিকার মালিক বদলের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা সরওয়ার হোসেন একটি ডেন্টাল কলেজ ও একটি ওষুধ কোম্পানিরও পার্টনারশিপ মালিকানায় ছিলেন। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও কয়েস লোদী নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তার ওপর মামলাসহ রাজনৈতিক দমনপীড়নে ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন। 

সরওয়ার হোসেন পলাতক থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরিবার ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছেন, তিনি কয়েস লোদীর কাছে মালিকানা দিয়েই কানাডা পাড়ি দিয়েছিলেন। 

যোগাযোগ করলে বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী খবরের কাগজকে কেবল পত্রিকার মালিকানা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজ সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। এগুলোতে প্রায় ৫৬ থেকে ৬০ জনের শেয়ার আছে।’

পত্রিকার বিষয়ে রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘পত্রিকাটি আমি অনেকদিন আগে কিনেছি। তাই এই পত্রিকার মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এটা উনি আমার কাছে বিক্রি করেছেন, অফিসিয়াল নিয়মনীতি মেন্টেইন করে। জেলা প্রশাসকের কাছে ডকুমেন্ট সাবমিট করে তারপর সেটির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে।’

কবে কিনেছেন পত্রিকা? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দিন তারিখ কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। অনলাইনের জন্য ডকুমেন্ট সাবমিট করা হয়েছে ঢাকায়। এটা এখনো ট্রান্সফার হয়ে আসেনি।’ 

ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতার পত্রিকার মূল মালিক বনে যাওয়া ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারির মালিকানা নেওয়ায় কয়েস লোদী বিতর্কের মুখ পড়েছেন। দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীরা এ বিষয়টি তলে তলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত হিসেবে দেখছেন। এরমধ্যে আঁতাত বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক নুরুল হক শিপু। 

তার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস সূত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘পালাবদলে সিলেটে কতকিছুর হাতবদল হচ্ছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতার এক মিডিয়ার হাতবদলে তলে তলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের এই পত্রিকাটির মালিকানা বদল হয়েছে ৫ আগষ্ট পরবর্তী বাস্তবতায়। এখন মালিক যিনি, তিনি সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী।‘ 

ফেসবুক পোস্টটিতে আরও লেখা হয়, ‘আগের মালিক সরওয়ার হোসেন পলাতক। সরওয়ারের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রেখে মিডিয়া হাউসটি লিখিয়ে নিয়েছেন বিএনপি নেতা কয়েস লোদী। পলাতক সরওয়ার কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর আছে কয়েস লোদীর কাছে! সিলেটে এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রভাব হাইজ‍্যাক করে এখন বিএনপির হয়ে যাচ্ছে। এই দেশে কে বলে আওয়ামী লীগ নাই? তলে তলে সরওয়ার হয়ে কয়েস লোদীরাই টিকিয়ে রাখবে আওয়ামী লীগকে।...’

ফোনে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সাংবাদিক নুরুল হক শিপু খবরের কাগজকে বলেন, ‘কয়েস লোদী সম্প্রতি সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে আসীন হয়েছেন। যদি তিনি এ পদে না থাকতেন, তাহলে এ বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হতো না। এখন যেন ব্যাটে-বলে লেগে গেছে! বিষয়টি বিএনপি-আওয়ামী লীগে আঁতাতের উদাহরণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে!’

শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে
ফাইল ফটো

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করে প্রায় ২৫টি সংস্থা। এর মধ্যে নিরাপত্তাক্ষেত্রে বেশির ভাগ দায়িত্ব পালন করছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক)। সম্প্রতি এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি বিনা নোটিশে দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এভসেকের বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় এভসেকের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে এপিবিএন। এতে সরকারি এ দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শাহজালালে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

তবে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেছেন, পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের সক্ষমতা বাড়লে সেখানে কর্মরত অন্য বাহিনীর সদস্যরা চলে যাবেন। 

গত ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বিমানবন্দর আর্মড পুলিশে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার জাকির হোসেনের করা জিডিতে বলা হয়েছে, ‘সকাল সোয়া ১০টার দিকে এভসেকে কর্মরত স্কোয়াড্রন লিডার তাসফিক তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে বলেন, ‘অ্যাপ্রোন এরিয়ার (অ্যাপ্রোন এলাকা হলো যেখানে বিমান পার্ক করা হয়, লোড-আনলোড করা হয়, রিফুয়েল করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়) ৩৩ নম্বর গেটে আপনাদের (এপিবিএন) অফিস থেকে মালামাল সরিয়ে ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে রাখা হয়েছে। আপনাদের পুলিশ পাঠিয়ে এগুলো নিয়ে যান।’

জিডিতে বলা হয়, ‘পরে তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগে না জানিয়ে কেন মালামাল সরিয়ে অন্যত্র রাখলেন- এমন প্রশ্নে এভসেকের ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশন সাইফুর রহমান জানান, বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম ও এভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার জাহাঙ্গীরের নির্দেশে এগুলো সরানো হয়েছে।’

জিডিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পরে তথ্য নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওই অফিসের প্রবেশমুখে বাম পাশে দেয়ালে লেখা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, এয়ার সাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল লেখা সাইনবোর্ডটি ভঙ্গুর অবস্থায় অফিসের ভেতরে রাখা হয়েছে। অফিসের ভেতরে সরকারি কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, ২০১০ সাল থেকে রক্ষিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্র নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি।’

জানা গেছে, এরই মধ্যে অ্যাপ্রোন এলাকায় থাকা এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি দখলে নিয়ে সেটিকে নিজেদের অফিস বানিয়ে ফেলেছে এভসেক। তবে এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া গেছে বিমানবন্দরে কর্মরতদের কাছ থেকে। 

বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘনিয়ে এলে এপিবিএনের সদস্যরা তাদের অস্ত্র ও দায়িত্ব রেখে পালিয়ে যান। ফলে ওই সময় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং শঙ্কা তৈরি হয়। পরে এভসেকের সদস্য বাড়িয়ে তাদের দিয়ে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সব কাজ করানো হয়। 

অন্যদিকে বন্দরের অন্য আরেকটি পক্ষের অভিযোগ, এভসেকের বাধায় এখন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এপিবিএন। শাহজালাল থেকে এপিবিএন সদস্যদের সরিয়ে দিতে এমনটি করা হয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

তবে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি এ অভিযোগের মধ্যে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি দুই সংস্থার এমন মুখোমুখি অবস্থান নিরাপত্তার জন্য যেমন শঙ্কা হয়ে দেখা দিতে পারে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।

এভিয়েশন বিশ্লেষক ড. কুদারাত-ই খুদা বলেন, ‘দুটি সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাড়তি অন্য কোনো সংস্থা থেকে নিরাপত্তার জন্য লোক আনার প্রয়োজন দেখি না।’

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি দুটি সংস্থার এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান কারও কাম্য নয়। এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে না থেকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিরাপত্তা আরও সুসংহত থাকবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিরাপত্তা ইস্যু আরও প্রশংসিত হবে। আমরা চাই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো একে অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করবে। সর্বশেষ আমি শুনেছি ৫ আগস্টের সময় দায়িত্ব নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল; তবে সে বিষয়ে তারা আলোচনা করে এখন দায়িত্ব ভাগ করে কাজ করছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে থাকা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই এটি রয়েছে। অথচ এখানে প্রায় ২৫-৩০টি সংস্থা নিজ নিজ এখতিয়ারে কাজ করে। এদের প্রত্যেকের পৃথক কমান্ড। এ কারণে মাঝে মাঝেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত একটি সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায় না আসবে, ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে।’

জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এভসেকে যে জনবল রয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাইরে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিমানবাহিনী থেকে ৫০০-এর বেশি জনবল নিয়োগ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৬০ জন, বাংলাদেশ পুলিশের ৭৯ জন শাহজালালে কর্মরত। এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৩ অক্টোবর আবারও ৩২৮ জনসহ আরও প্রায় এক হাজার জনের নিয়োগের মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চাওয়া হয়। 

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ জুন বিমানবন্দরে নিরাপত্তার কাজ শুরু করে আর্মড পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি চোরাচালান রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই সংস্থাটি। 

এপিবিএনের অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সক্ষমতার দিক থেকে আমরা আগে যেমন ছিলাম, এখনো তাই আছি। আমরা দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের সেটি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি পরিপত্র, আইকাও (আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা)-এর নিয়মাবলি যেভাবে রয়েছে, আমরা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখন কেন দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে এটি বোঝা যাচ্ছে না। অ্যাপ্রোন এরিয়ায় আমাদের যে অফিসটি ছিল, আমাদের না জানিয়ে সেটি তারা সরিয়ে ফেলেছে।’

এদিকে বিমানবন্দর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এভসেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা এপিবিএনের জিডির তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে যেহেতু দুটি সংস্থার মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাই তদন্তের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে পুলিশ অপেক্ষা করছে।

এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এখানে বিমানবাহিনীর সদস্যদের এনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারাই ডিউটি করে যাচ্ছেন। আমাদের কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এপিবিএন দায়িত্বে ফিরে এসেছে। আমাদের তিন কিলোমিটারব্যাপী এয়ারপোর্টের এরিয়া, যা সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার। বহিরাঙ্গনের যে নিরাপত্তা সেটির কাজ এপিবিএন করে যাচ্ছে।’

এপিবিএনকে আবার পুরোনো দায়িত্বে ফেরানো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সংস্থাই তো ভেতরে ডিউটি করতে চায়, সবাইকে তো সুযোগ দেওয়া সম্ভব না।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এভিয়েশন সিকিউরিটিকে আরও শক্তিশালী করা। আমাদের সক্ষমতা বাড়লে বিমানবন্দরে কর্মরত এপিবিএনসহ অন্য কোনো বাহিনীই থাকবে না। বর্তমানে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি এভিয়েশন সিকিউরিটির কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। আমরা আরও সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়োগ দিতে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো সিকিউরিটি কাজ করবে। একসময় এভিয়েশন সিকিউরিটি পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যরা চলে যাবে।’

ওএসডির পরও অফিস করছেন কর্মকর্তা!

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১০ এএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১২ এএম
ওএসডির পরও অফিস করছেন কর্মকর্তা!
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

এক চিকিৎসকের কারণে বিপাকে পড়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রোগী ও চিকিৎসকরা। দুই মাসে আগে ওএসডি হওয়া এই চিকিৎসক এখনো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি বহিরাগতদের নিয়ে হাসপাতালে অবস্থান করায় আতঙ্কিত চিকিৎসকরা। তিনি একজন নারী চিকিৎসককে অপদস্থ করেছেন বলেও জানা গেছে। চিকিৎসকদের আতঙ্কের কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক চিকিৎসা ও সেবা কার্যক্রম। এ ছাড়া পরিচালকসহ প্রধান দুটি পদ শূন্য থাকায় ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।

ওই চিকিৎসক হলেন ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবির জুয়েল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে উপপরিচালক হিসেবে যোগদানের ৯ দিনের মাথায় তাকে ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু তিনি সরকারি আদেশের তোয়াক্কা না করে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থাৎ ২ মাসের বেশি সময় ধরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটেই অফিস করে যাচ্ছেন।

ওই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা জানান, সফিকুল কবির দীর্ঘ চার বছর ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সব মিলিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানেই কাটিয়েছেন অন্তত ১০ বছর। অথচ তিনি এখন নিজেকে বৈষম্যের শিকার বলে দাবি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ৪০০ শয্যার মানসিক স্বাস্থ্যের এই হাসপাতালে আন্তবিভাগ ও বহির্বিভাগে রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। প্রায় ৮০ জন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী উচ্চতর কোর্সে অধ্যয়নরত। 

প্রতিষ্ঠানের অস্থিরতার দ্রুত সমাধান চেয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর ৬৬ জন চিকিৎসক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে লিখিতভাবে অবহিত করেছেন। গত ৩১ অক্টোবর সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের স্বার্থে বিশৃঙ্খলা রোধে ও বহিরাগতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। একই দিন চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার ডা. তৈয়বুর রহমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। তার আগে গত ২৭ অক্টোবর থেকে চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিদিন প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে আসছিলেন।

এতে একাত্মতা পোষণ করেছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের (বিএপি) আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) মো. আব্দুল ওহাব, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. নিলুফার আকতার জাহান, যুগ্ম সদস্যসচিব ও বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল আহসান, শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জুবায়ের মিয়া, কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ডা. রাহেনুল ইসলাম প্রমুখ। 

গত বৃহস্পতিবার ওই প্রতিষ্ঠানে উপপরিচালকের রুমের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নেমপ্লেটে এখনো আছে ওএসডি হওয়া ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরের নাম। 

অভিযোগের বিষয়ে ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরের বক্তব্য জানার জন্য তার ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বরে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ১১ মিনিটে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ৭টা ৪ মিনিটে ফোন করে রেদোয়ানা নামে এক নারী নিজেকে সফিকুল কবিরের আইটি অ্যাসিসট্যান্ট পরিচয় দেন। কোন বিষয়ে কথা বলতে চাই, তা জানিয়ে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিতে বলেন। তারপর তিনি বিষয়টি নিয়ে ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরের সঙ্গে আলাপ করবেন বলে জানান। পরে রেদোয়ানা একজন সাংবাদিকের নম্বর দিয়ে তাকে সফিকুল কবিরের প্রেস সচিব জানিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। কথা হলে ওই সাংবাদিক জানান, তিনি তার প্রেস সচিব নন। কিন্তু সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে। সফিকুল কবির যোগদানের পর আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কিছু ভালো উদ্যোগ নেন। যে কারণে তিনি রোষানলে পড়েন।

ওএসডি হয়েও কক্ষ না ছাড়া প্রসঙ্গে ওই সাংবাদিক বলেন, ওএসডি হওয়ার পর সফিকুল কবির স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে দেখা করে সব বিষয় অবহিত করলে তিনি তাকে উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বলেন। সে জন্য তিনি হয়তো দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদের মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনগতভাবে সচিবের মৌখিক নির্দেশে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ নেই।

গত ২১ আগস্ট সফিকুল কবির উপপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। তাকে ১ সেপ্টেম্বর ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ন্যস্ত করা হয়। তখন এই হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ডা. অভ্র দাশ ভৌমিক। সফিকুল কবিরকে ওএসডি করার পর ১২ সেপ্টেম্বর অভ্র দাশ ভৌমিককেও ওএসডি করা হয়। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গত ২৩ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। ওই দিনই তিনি প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফকে পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে যান। 

পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর বলেন, পরিচালক ও উপপরিচালকের শূন্য পদ পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

আগের ঘটনার বিবরণ দিয়ে চিকিৎসকরা জানান, ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ৬ আগস্ট পরিচালকের কার্যালয়সহ ৬ জন শিক্ষকের কক্ষ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। 

অধ্যাপক অভ্র দাশ ভৌমিক পরিচালক থাকাকালীন ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে কক্ষ ভাঙচুর প্রসঙ্গে অবহিত করেন। তাতে তিনি লিখেছেন, পরিচালকের কার্যালয়ের অনার বোর্ড ভাঙার ছবি দেখে একজনকে চিহ্নিত করা হয়। তিনি হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) ডা. এইচ এম মাহমুদ হারুন। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ডা. এইচ এম মাহমুদ হারুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি ওই দিন ঢাকা মেডিকেলে দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ হয়তো এডিট করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার ছবি বসিয়ে দিয়েছেন। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

চিকিৎসকরা জানান, ভাঙচুর ও লুটের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও রিপোর্ট দেওয়ার আগেই গত ২১ আগস্ট কমিটির প্রধান তৎকালীন উপপরিচালক ডা. মো. গোলাম মোস্তফাকে বদলি করা হয়। সেখানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে পদায়ন করা হয়। 

সফিকুল কবির যোগদানের পর তৎকালীন পরিচালক অভ্র দাশ ভৌমিক ছুটিতে গেলে উপপরিচালক ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু তিনি রুটিন দায়িত্বের বাইরে গিয়ে গত ৩১ আগস্ট ৯ জন শিক্ষককে স্ব-স্ব দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন। সরে না গেলে এ ইনস্টিটিউটে ছাত্র ও কর্মচারীদের দ্বারা কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটুক- এটা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন।

সিনিয়র সচিবের বরাবর দেওয়া ওই চিঠিতে সাবেক পরিচালক অভ্র দাশ ভৌমিক লিখেছেন, একজন কোর্স আউট হওয়া পরবর্তী সময়ে মার্সি পিটিশনের মাধ্যমে কোর্সে ফেরত আসা ডা. এ কে এম খালেকুজ্জামানকে দিয়ে একটি ভুয়া কাগজে ৬০ জন প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকের স্বাক্ষর নিয়ে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেন সফিকুল কবির। শিক্ষার্থীরা এই প্রতারণা ও মিথ্যাচারের বিরোধিতা করলে তাদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান এবং হুমকি দেন। একজন নারী প্রশিক্ষার্থী চিকিৎক না বুঝে করা ওই স্বাক্ষর প্রত্যাহারের জন্য সফিকুল কবিরকে অনুরোধ করলেও তিনি অনুরোধ রাখেননি।

জানা গেছে, পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দপ্তরে আবেদন করেন। পরদিন গত ১ সেপ্টেম্বর ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে ওএসডি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পদায়ন করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর ওই নারী চিকিৎসক সাবেক পরিচালক ডা. অভ্র দাশ ভৌমিকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন, যা জানতে পেরে ওই দিন বেলা আড়াইটায় সফিকুল কবিরের রুমে ডেকে বহিরাগত এক চিকিৎসককে দিয়ে ওই নারী চিকিৎসককে অপদস্থ করা হয়। 

খবরের কাগজের হাতে আসা একটি ছবিতে দেখা গেছে, ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবির উপপরিচালকের চেয়ারে বসে আছেন। রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন এবং ডান হাতে চোখ মুছছেন ওই নারী চিকিৎসক। তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ রাঙ্গাচ্ছেন ডা. ফরিদুজ্জামান রানা। 

জানা গেছে, রানা চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এ ঘটনার পর ওই নারী চিকিৎসক গত ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। 

এ বিষয়ে নারী চিকিৎসক ডা. নাজিয়া হক অনি বলেন, ‘অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি এসে তদন্ত করে গেছে, কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি’। তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দাবি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, ওএসডি হওয়ার ক্ষোভে সফিকুল কবির গত ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অস্থির করে তোলেন। তিনি নিজেকে বৈষম্যের শিকার উল্লেখ করে কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে দাবি করেন। 

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, তিনি ওএসডি হওয়ার পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদান না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ অমান্য করে তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উপপরিচালকের কক্ষ দখল করে বহিরাগত ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিং করেন। তিনি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাগত, একাডেমিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ এবং দাপ্তরিক নথিতে স্বাক্ষর করে চলেছেন। 

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে পাঠানো স্মারকলিপিতে বলা হয়, সফিকুল কবির গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা পরিপন্থি কাজ করে নিজেই একজন স্বৈরাচারের ভূমিকা পালন করছেন।  

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ডা. সফিকুল কবিরের কর্মকাণ্ড বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ২২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খন্দকার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি দল তদন্ত করে। 

যুগ্ম সচিব খন্দকার মোহাম্মদ আলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি তদন্তের পর প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। পরবর্তী সময়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আমার জানা নেই।’

তদন্ত কমিটিকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে অবসরে যাওয়া সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন ওএসডি হওয়া ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবির জুয়েলের প্রতিদিন অফিস করার বিষয়টি উল্লেখ করেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সফিকুল কবির পরিচালক হিসেবে (ওএসডি উল্লেখ না করে) নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন বলে জানান।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।