পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের নামে ভিন্ন ভিন্ন পেশার পরিচয়ে সাতটি পাসপোর্ট নেওয়া এবং সরকারি চাকরিজীবী হয়েও বেসরকারি পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমণ করায় ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশ জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। চলতি সপ্তাহে কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলেই মামলাটি করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
কমিশনে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেনজীর আহমেদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থাকার সময় যতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, প্রতিবারই ‘প্রাইভেট সার্ভিস’ লেখা বেসরকারি পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। এসব ভ্রমণে সরকারের কোনো রকম জিও ব্যবহার করা হয়নি। সরকারের নথিতে তার বিদেশ সফরের কোনো তথ্য নেই। সরকার অফিশিয়ালি জানতেই পারেনি বেনজীর আহমেদ ভ্রমণের সময় কোন দেশে অবস্থান করেছেন। এতে বেনজীর আহমেদ সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘনের পাশাপাশি জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, যা দুদক আইনের তফসিলভুক্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে বেনজীর আহমেদের নামেই মোট সাতটি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। এই পাসপোর্টগুলোতে পেশা হিসেবে প্রথমে ‘সার্ভিস’ পরে নবায়নের ক্ষেত্রে ‘প্রাইভেট সার্ভিস’ উল্লেখ করা হয়। জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৈরি করা পাসপোর্টগুলোর মধ্যে রয়েছে E0017616, AA1073252, BC0111070, BM0828141 ও 800002095।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বেনজীর আহমেদের নামে সাতটি পাসপোর্ট ইস্যু করার ক্ষেত্রে দায়িত্বপালনকারী ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট অন্তত ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদের বক্তব্য ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বেনজীর আহমেদ ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর হাতে লেখা পাসপোর্ট সমর্পণ করে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে এমআরপি পাসপোর্ট নেন। এই পাসপোর্টেও তার পেশা উল্লেখ ছিল কেবল ‘সার্ভিস’। অথচ তিনি তখন ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার। এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত। এই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ না হতেই এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেনজীর আহমেদ আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে দ্বিতীয় এমআরপি নেন। এই পাসপোর্টের আবেদনে পেশার স্থলে তিনি লেখেন ‘প্রাইভেট সার্ভিস’। ওই সময়েও তিনি ডিএমপির কমিশনার ছিলেন। এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় এমআরপির মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর আগে তিনি ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৃতীয় এমআরপি নেন। এটিতেও পেশা প্রাইভেট সার্ভিস। ২০২০ সালের ৪ মার্চ বেনজীর আহমেদ ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। সেখানেও পেশা প্রাইভেট সার্ভিস। সে সময় তিনি ছিলেন আইজিপি।
ওই দিনই দুপুর ১২টা ৪৬ মিনিটে গুলশানে বেনজীরের বাসায় গিয়ে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের মোবাইল টিমের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর শাহেনা হক তার বায়োমেট্রিক, আইরিশ, ছবি তুলে এনে ই-পাসপোর্ট সার্ভারে আপলোড করেন। সাইদুর নামের আরেক অপারেটর বেলা ৩টা ৫১ মিনিটে আবেদনটি সার্ভারে সাবমিট করেন। মাসুম আবু নামের অপারেটর বেলা ৩টা ৫৬ মিনিটে আবেদনটি যাচাই করেন। বিকেল ৪টা ৬ মিনিটে আবেদনটি অনুমোদন করেন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন। পরদিন ই-পাসপোর্টটি প্রিন্টে চলে যায়। ই-পাসপোর্ট বাস্তবায়নকারী জার্মান কোম্পানি ভেরিডোজ জার্মানি থেকে প্রিন্ট করে আনার পর ওই বছরের ১ জুন একজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পাসপোর্টটি বুঝে নেন। শাহেনা হক বর্তমানে জার্মানিতে ওই কোম্পানিতে কর্মরত।
এদিকে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান চলছে। বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে প্রতিনিধি পাঠিয়ে দুদকে তাদের সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছেন। বর্তমানে সেসব অর্থ-সম্পদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমিজমাসহ সব স্থাবর সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এতে অনেকটা সময় ব্যয় হচ্ছে। আইনে নির্ধারিত প্রথম ৪৫ কর্মদিবস পেরিয়ে এখন বর্ধিত আরও ৩০ দিন অর্থাৎ ৭৫ কর্মদিবসের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। নির্ধারিত সময়ে অনুসন্ধান শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক(প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এসব অনুসন্ধানের অগ্রগতি বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ না হয়, সে ক্ষেত্রে কমিশনের এখতিয়ার আছে প্রয়োজনীয় সময় বাড়িয়ে দেওয়ার।