জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সব মানুষই শিশু এবং বাংলাদেশও মেনে চলে এ সংজ্ঞা। সে অনুযায়ী দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশুর নিজস্ব মোবাইল ফোন রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স (এসভিআরএস) ২০২৩ জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫ বছর থেকে ১৫ বছর বয়সী মোট জনগোষ্ঠীর ৫৯.৯ শতাংশের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য মোবাইল ফোন রয়েছে। আর এদের মধ্যে ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এদের অধিকাংশই জানে না নিরাপদ ও কার্যকরীভাবে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে। ফলে প্রতিদিনই শিশুদের মাঝে বাড়ছে ডিজিটাল ডিমেনশিয়া। এমন অবস্থায় ‘প্রতিটি শিশুর অধিকার, রক্ষা করা আমাদের অঙ্গীকার’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস।
ডিজিটাল ডিমেনশিয়া কী?
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সে দেশের ৯৫ শতাংশ শিশুই ডিজিটাল ডিমেনশিয়ায় ভুগছে। যেখানে বিশেষজ্ঞরা ডিজিটাল ডিমেনশিয়াকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- স্ক্রিনে অতিরিক্ত টাইম দেওয়ার ফলে অনেক সমস্যা দেখা দেয় যেমন- আচরণে পরিবর্তন, দুর্বল স্মৃতিশক্তি, ফোকাস করতে অক্ষমতা, আগ্রাসী আচরণ, বিরক্তিভাব, দুর্বল সামাজিক দক্ষতা, ক্লান্তি এবং কম ঘুম ও আত্মবিশ্বাসের অভাব। এগুলোকেই ডিজিটাল ডিমেনশিয়া বলা হচ্ছে। এ গবেষণা বলছে, বর্তমানে শিশুদের একটি ডিভাইস ব্যবহার করার গড় সময় দিনে ৭.৫ ঘণ্টা। কিছু কিছু কিশোরের ক্ষেত্রে এটি দিনে ৮-১২ ঘণ্টাও হয়ে যায়। আর ফোনের অত্যধিক ব্যবহার এবং তার ওপর নির্ভরশীল এসব বাচ্চারাই ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার শিকার হচ্ছে। সেই কারণে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হচ্ছে তাদের।
বাংলাদেশে বাড়ছে ডিজিটাল ডিমেনশিয়া
ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার এসব লক্ষণ এখন বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার আগেও এ ধরনের সমস্যা নিয়ে তেমন শিশু আসত না মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে এখন অভিভাবকরা যেমন ভুলে যাওয়া, বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা ও দুর্বল সামাজিক দক্ষতার অভিযোগ নিয়ে শিশুদের নিয়ে আসছেন।
এর কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, মূলত তিনটি কারণে শিশুদের মধ্যে মোবাইলের ব্যবহার বেড়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো করোনাকালে অনলাইন স্কুলিং হওয়ায়, তখন অভিভাবকরা শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন দিয়েছেন। সেই সময় শিশুরা মোবাইল নিজে ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে যা পরে আর পরিবর্তন করা হয়নি। অন্যটি হলো, অভিভাবকরা প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে এখনকার দিনে। কারণ তাদের চাকরি, বাসার কাজে সাহায্যকারী না থাকা, যৌথ পরিবারে না থাকা। ফলে তারা সময় দিতে পারছেন না সন্তানকে, তখন তারা শিশুদের ব্যস্ত রাখার জন্য তাদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছেন। এ ছাড়া যেহেতু অনেক বাচ্চাই এখন মোবাইল ব্যবহার করে, তাই সচেতন বাবা-মা যারা শিশুর হাতে মোবাইল দিচ্ছেন না তারাও এখন তার বাচ্চাদের কাছে চাপের মুখে পড়ছে যে তাদের বন্ধুরা মোবাইল ব্যবহার করছে কিন্তু সে কেন মোবাইল ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে ওই অভিভাবকরাও বাচ্চাকে মোবাইল ব্যবহার করতে দিচ্ছেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে মানসিক অসুস্থতা, যেমন উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা আমাদের শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে স্মার্টফোন বা ডিজিটাল আসক্তি সবার মধ্যেই কমবেশি দেখা যায়। কখনো কাজ, তো কখনো সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং, কখনো বা সিনেমা দেখা, কখনো আবার গেম খেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আসক্ত থাকে। যার ফলে শারীরিক এবং মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। ফলে মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতা কমে যেতে থাকে। বিশেষ করে ডিজিটাল ডিভাইসের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে অল্প বয়সীদের আক্রান্ত করছে ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার মতো সমস্যা।
একাগ্রতা এবং ভুলে যাওয়ার সমস্যা বাড়ছে
অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের কাছে অভিভাবকরা শিশুদের মধ্যে বেশিক্ষণ কোনো বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা বা একাগ্রতা রাখতে না পারা এবং পড়ার কিছুক্ষণ পর বা কিছুদিন পরই তা ভুলে যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসছেন।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, স্ক্রিন টাইম দিনে তিন ঘণ্টার বেশি হলে তা আসক্তি হয়ে যায়। বিশেষ করে অনেকের স্ক্রিন টাইম ১২-১৫ ঘণ্টা, যা বেশ বিপজ্জনক। পাশাপাশি রাতে বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করলে তা ঘুমের ওপরেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। স্ক্রিনের নীল আলো মস্তিষ্ককে জাগ্রত রাখে এবং ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় মেলাটোনিন হরমোনের মাত্রা কমায়।
বাঁচার উপায়
এসব সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে ডিজিটাল ডিটক্সের নিয়ম মেনে চলা উচিত। অর্থাৎ এ সময় কোনো ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে না। স্ক্রিন টাইম নির্ধারণের পাশাপাশি বিরতিও নিতে হবে। একজনকে ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বেরিয়ে বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত। আর সেই সঙ্গে নিয়মিত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত এবং স্ক্রিন টাইম ৩ ঘণ্টারও কম রাখা উচিত। তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলোতে শিশুরা মোবাইল ব্যবহার করে কিন্তু সেটি হয় ইতিবাচক ব্যবহার। আমাদের দেশের শিশুরাও যদি ইতিবাচক ব্যবহার করতে পারে তবে শিশুদের মোবাইল ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। তবে মোবাইলের নিরাপদ, যৌক্তিক ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ সে যে মোবাইল ব্যবহার করছে সেটি কতটা কার্যকরী হচ্ছে তার জন্য তা দেখতে হবে এবং কার্যকরী ব্যবহার তাকে শেখাতে হবে। পাশাপাশি শিশুটি মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজে বা অন্যকে ঝুঁকিতে ফেলছে কি না তাও তাকে শেখাতে হবে। পরিমিত ব্যবহার তাকে শেখাতে হবে যেন সে একটি নির্দিষ্ট সময় মোবাইল ব্যবহার করে। এবং সবচেয়ে বড় বিষয় অভিভাবকদেরকেও মোবাইলের ব্যবহারে পরিমিত হতে হবে।’
অনেকটা একই মত দিয়ে অধ্যাপক সালমা আক্তার খবরের কাগজকে বলেন, ‘স্কুলে মোবাইল ব্যবহারে যে রেস্ট্রিকশনটা আছে সেটা রাখা, এবং বাচ্চাদের জন্য হেলদি প্লে-টাইম বের করতে হবে। এ ছাড়া স্কুলেও যদি তাদের বিতর্ক, খেলা, ছবি আঁকা বা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তাহলেও তাদের যোগাযোগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও বাচ্চাদেরকে বেশি সময় দিতে হবে, তাদের বাইরে খোলা জায়গায় খেলতে নিয়ে যেতে হবে।’