ঢাকা ২৬ কার্তিক ১৪৩১, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

স্বপ্নের মেগা প্রকল্প এখন গলার কাঁটা

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
স্বপ্নের মেগা প্রকল্প এখন গলার কাঁটা
ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্পগুলো এখন হয়ে গেছে গলার কাঁটা।

কথা ছিল এ বছরের অক্টোবরে অর্থাৎ চলতি মাসেই ‘স্বল্প পরিসরে’ চালু হবে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কার্যক্রম। তবে কার্যক্রম শুরু হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো বিগত সরকারের এই মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করতে ২০২৬ সাল লাগতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশাল অঙ্কের বাজেটের এ প্রকল্পের বিদেশি ঋণ পরিশোধের কিস্তি শুরু হবে আগামী ডিসেম্বর থেকেই। তাই সাধারণ মানুষকে স্বপ্ন দেখানো এ মেগা প্রকল্পই যেন এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

২০২৩ সালের অক্টোবরে তাড়াহুড়ো করে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের সফট ওপেনিং (একাংশের উদ্বোধন) করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন জানানো হয়েছিল, ২০২৩ সালের শেষে পরীক্ষামূলকভাবে আর ২০২৪ সালের শেষ ভাগে পুরোদমে শুরু হবে টার্মিনালের কার্যক্রম। পরে গত ৩০ মে সরেজমিন পরিদর্শন গিয়ে তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছিলেন, তৃতীয় টার্মিনাল চলতি বছরের শেষ দিকে বা আগামী বছরের শুরুতে স্বল্প পরিসরে চালু হবে। ওই সময় পর্যন্ত টার্মিনাল ভবনের ৩ শতাংশের মতো কাজ বাকি আছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

বলা হয়েছিল, অত্যাধুনিক এই টার্মিনালে থাকবে যাত্রীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা, যা দেশের এভিয়েশন খাতের চিত্রই পাল্টে দেবে। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই যেন বেরিয়ে আসছে প্রকল্পের পদে পদে পরিকল্পনার ভুল আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও প্রথমে অর্থসংকট এবং এখন চুক্তিগত নানা জটিলতা আর দক্ষ জনবলের অভাব দেখিয়ে টার্মিনালটির কার্যক্রম শুরু হওয়া পেছাতে পেছাতে এখন ঠেকেছে ২০২৬ সালে। 

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্প নিয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সঙ্গে একটি চুক্তি করে। টার্মিনালটি পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিস ও ভেন্ডরের নাম সুপারিশ করার কথা ছিল আইএফসির। টার্মিনালটি পরিচালনার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। এ কারণে পরিচালন ব্যয় নির্ধারণে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তিও করা যায়নি। 

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা এ প্রকল্পের শুরু থেকেই বলে এসেছি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে প্যারালালি টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম কীভাবে নির্ধারিত সময়ে শুরু করা যাবে, সে কাজগুলো যেন করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা শোনেনি। তারা বিল্ডিং নির্মাণে জোর দিয়েছে, কিন্তু এই যে পিপিপি চুক্তি করা, দক্ষ জনবল তৈরি করার জন্য কে কাজ করবে সেসব ঠিক করা, এগুলোতে জোর দেয়নি। ফলে এখন বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার যদি এখন তাড়াহুড়ো করে অদক্ষ জনবল বা অদক্ষ প্রতিষ্ঠানের হাতে এই টার্মিনালের কার্যক্রম পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে বিশ্বে আমাদের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ফলে এই টার্মিনাল দিয়ে যে আমরা আমাদের সেবার মান উন্নত হয়েছে, এটা দেখিয়ে যে একটি বাজার তৈরি করতে চাচ্ছিলাম তা ব্যাহত হবে। আবার এটিকে এভাবে ফেলে রাখলে যদি ভালোভাবে মেইনটেইন না করা হয়, তবে এখানে যেসব যন্ত্রাংশ সেট করা হয়ছে, সেগুলো নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।’ 

২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায় তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। বাকি ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জাইকা। যে ঋণ পরিশোধের প্রথম কিস্তি আগামী ডিসেম্বর থেকেই দিতে হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘পরিকল্পনার শুরু থেকেই কার্যক্রম কীভাবে চলবে তা নিয়ে প্যারালালি কাজ করা প্রয়োজন ছিল। কারণ এই প্রকল্পের একটি বড় টাকা জাইকার কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে, যার কিস্তি আমাদের এ বছরের ডিসেম্বর থেকেই দেওয়া শুরু করতে হবে। কিন্তু প্রকল্প নিয়ে এখন যা হচ্ছে তাতে ডিসেম্বরে এখান থেকে কোনো টাকা তো আসা সম্ভবই না, বরং এটির মেনটেন্যান্সের জন্য সরকারকে টাকা গুনতে হবে। না হলে যা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোও নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে। পাশাপাশি ঋণের কিস্তির বোঝা তো আছেই।’

থার্ড টার্মিনালের কাজ কতটা শেষ হয়েছে এবং কবে কার্যক্রম শুরু হতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘কাজ ৯৮ দশমিক ৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। থার্ড টার্মিনালের অপারেশন ও মেইন্টেন্যান্স কে করবে, আমরা এ সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে দফায় দফায় মিটিং হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত কাজ শুরু করা যায়।’ অপারেশন ও মেইন্টেন্যান্স করার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলেই মূলত কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তবে অপারেশন শুরু করতে করতে সামনের বছরটা অর্থাৎ ২০২৫ সাল চলে যাবে বলেও মনে করছেন তিনি।

বেবিচক জানায়, পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর জনবল নিয়োগ করতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এরপর ট্রায়াল শুরু হবে, প্রণয়ন করা হবে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)। সব মিলিয়ে প্রক্রিয়াটা অনেক দীর্ঘ। টার্মিনালে ৬ ঘণ্টা করে চার শিফটে মোট ছয় হাজার লোক কাজ করবেন। এর মধ্যে র‍্যাব-পুলিশ, এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), এপিবিএন, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ নিরাপত্তা রক্ষাতেই কাজ করবেন প্রায় চার হাজার সদস্য। তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও কাজের জন্য প্রস্তুত করতেও প্রায় এক বছর সময় লাগবে।

এর আগে এ প্রকল্পের শেষ কিস্তির অর্থছাড়ে জটিলতা দেখা দিলে গত ১ জুলাই থার্ড টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক-পিডি এ কে এম মাকসুদুর ইসলাম একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বেবিচককে। সেখানে বেবিচকের কাছে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হয়েছে প্রকল্পটির জন্য। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পকাজের স্বার্থে ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে জিওবি খাতে বরাদ্দ করা তহবিল পাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে প্রকল্পের আয়কর ও ভ্যাট এবং আমদানি করা মালামালের কাস্টম ডিউটি পরিশোধের জন্য ১৫০ কোটি টাকা ঋণ প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে এই ঋণ দেওয়ার জন্য এ চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঋণের অর্থ ছাড় করে বেবিচক। অর্থাৎ সে হিসেবে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা সম্পূর্ণ অর্থই প্রকল্পে চলে গেছে এবং তাদের কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কেনাকাটাই শেষ হয়েছে। ফলে অর্থসংকটের কোনো বিষয় নেই এখন। 

এতকিছুর পরও প্রকল্পটির সুবিধা পেতে এত দেরির বিষয় উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের মেগা প্রকল্প হওয়ার পরও কেন এ প্রকল্পের শুরু থেকেই এর পরিকল্পনায় আয়-ব্যয় নির্ধারণ এবং এর কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ে শুরু করার বিষয়ে কেন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন এবং যারা গাফিলতি করেছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবিও জানান তারা। বলেন, এর জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি হওয়া প্রয়োজন। যেখানে বেবিচকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিশিষ্টজনরা থাকবেন। তারা মূলত এই প্রকল্পের বিভিন্ন ভাগের যারা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবেন। তাহলে হয়তো এর কার্যক্রম শুরু ত্বরান্বিত হতে পারে।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বর্তমানে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনাল দিয়ে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রী বহনের ধারণক্ষমতা রয়েছে। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের তৃতীয় টার্মিনালটি যুক্ত হলে বছরে ২ কোটি পর্যন্ত যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। টার্মিনালটিতে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। ১৬টি ব্যাগেজ বেল্টসহ অত্যাধুনিক সব সুবিধা রয়েছে নতুন এ টার্মিনালে।

পদ-পদবি বিক্রি করেই টাকার কুমির আবদুর রহমান

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৬ পিএম
পদ-পদবি বিক্রি করেই টাকার কুমির আবদুর রহমান
ফরিদপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আবদুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

কথিত রয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন। আর এই পছন্দকে কাজে লাগিয়ে তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন জেলা কমিটি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পদ-পদবি পাইয়ে দিয়ে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ছিল। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন তিনিসহ কয়েকজন। এদের দ্বারাই পছন্দমতো পদ-পদবি বিক্রি হতো। বিভিন্ন অভিনয়, নাটক সাজিয়ে তারা সৃষ্টি করতেন গল্পের নায়ককে। আর নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে কথা বলে সেই নায়ককে পাইয়ে দিতেন বড় পদ। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হতো ত্যাগী নেতা-কর্মীদের।

এর মধ্যে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ নিয়ে ব্যাপক কানাঘুষা রয়েছে। প্রবাসী শামীম হককে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ পাইয়ে দিতে তিনিসহ তার সিন্ডিকেট নেন কয়েক কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়েন ত্যাগ-তিতিক্ষায় থাকা নেতা-কর্মীরা।

বলছি ফরিদপুর-১ আসনে (মধুখালী-বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা) আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আবদুর রহমানের কথা। মঞ্চ কাঁপানো বক্তব্য দিয়ে পছন্দের তালিকায় চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতির। আর এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি ব্যাপক চাঁদাবাজিসহ অপকর্ম করে গেছেন অবলীলায়। নিজস্ব কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও শত শত কোটি টাকার মালিকবনে যান দল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বোয়ালমারী উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রামে কৃষক পরিবারে তার জন্ম। ফরিদপুরের সরকারি ইয়াসিন কলেজে পড়াশোনার সময় জেলা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ঢোকেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বাগিয়ে নেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

গত নির্বাচনের সময় তার দেওয়া হিসাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে তার বার্ষিক আয় ২৮ লাখ ১১ হাজার ৬২৪ টাকা। তার নিজের নামে নেই কোনো ফ্ল্যাট। নিজগ্রাম কামালদিয়ায় রয়েছে একটি বাড়ি। তবে তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট। এসব কথা বলা হলেও তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর নামে রয়েছে ব্যাপক সম্পদ। নিজ আসন বোয়ালমারী মধুখালীতে রয়েছে অনেক জমিজমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এরই মাঝে এসব সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুদুক।

গত নির্বাচনে হলফনামায় আবদুর রহমান আয়ের উৎস জানিয়েছেন, কৃষি খাত থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা, ব্যবসা থেকে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৪০০ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭২ টাকা, চাকরি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পারিতোষিক প্রাপ্তি) ৪ লাখ টাকা, জমি বিক্রয় থেকে মূলধনি লাভ ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৬০২ টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও পারিতোষিক হিসেবে ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বার্ষিক আয় করেন তিনি।

হলফনামা অনুযায়ী অস্থাবর সম্পদের মধ্যে বর্তমানে আবদুর রহমানের নিজ নামে নগদ ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৯২ টাকা, স্ত্রীর নামে ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮১০ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজ নামে জমা ৫ লাখ ৮ হাজার ৮৬২ টাকা, স্ত্রীর নামে ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩ টাকা। বন্ড, ঋণপত্র ও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে রয়েছে এ আর সি সিকিউরিটিজের ৭১ লাখ ৪৩ হাজার ৭ টাকা, সিডিবিএলের ৬২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮২ টাকা, আইসিবির ১০ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে সিডিবিএল ৮ কোটি ৭ হাজার ৯৯৫ টাকা। পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ নিজ নামে ৩৯ লাখ ৮১ হাজার ৭০৯ টাকা, স্ত্রীর নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র ২৫ লাখ টাকা।

এ ছাড়া ৭০ লাখ ২৫ হাজার ৪০৫ টাকার জিপগাড়ি, স্ত্রীর নামে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার প্রাইভেট কার। নিজ নামে ৩০ তোলা স্বর্ণ, ৬৪ হাজার ৩৫০ টাকা রয়েছে।

হলফনামা অনুযায়ী স্থাবর সম্পদ হিসেবে রয়েছে ২৪ লাখ ১১ হাজার ৪২২ টাকা মূল্যের কৃষি জমি, স্ত্রীর নামে ২ কোটি ২২ লাখ ৪১ হাজার ৫৩ টাকা মূল্যের কৃষি জমি। এ ছাড়া ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ১২ টাকা মূল্যের অকৃষি জমি এবং স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ৮৪২ টাকার অকৃষি জমি। নিজগ্রাম কামালদিয়ায় ৫০ লাখ ৮০ হাজার ৬২৫ টাকার একটি দালান রয়েছে। নিজের নামে অ্যাপার্টমেন্ট না থাকলেও স্ত্রীর নামে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার ৮০৯ টাকার ৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।

আবদুর রহমান ফরিদপুর-১ আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথমবার এমপি হওয়ার পর থেকেই তার সম্পদ বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। তবে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ থাকায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। আর গত নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী হন। আবদুর রহমানের সঙ্গে স্ত্রী ও মেয়ের জামাইরাও শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে ২০০২ সালে এক লাফে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আর বর্তমানে তিনি দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।

মধুখালী উপজেলার কামালদিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া আবদুর রহমান পৈতৃক সূত্রে ভিটেবাড়িসহ কয়েক বিঘা জমির মালিক হলেও এমপি হওয়ার পর পরই বাড়তে থাকে তার সম্পদ। তার সঙ্গে স্ত্রী রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. মির্জা নাহিদা হোসেন বন্যারও সম্পদের পরিমাণ কম নয়। তার নামে-বেনামে ঢাকার পূর্বাচলে জমি এবং ধানমন্ডি, উত্তরা ও পরীবাগে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। রয়েছে কয়েকটি ভিআইপি গাড়ি। নিজ ইউনিয়ন কামালদিয়ার টাকদিয়া মাঠ, কামালদিয়া মাঠ, বোয়ালমারী উপজেলার কাদিরদী পোস্ট অফিসের পাশে, কাদিরদী কলেজের সামনে, মুজুরদিয়া ঘাটসংলগ্ন জমি এবং কানখরদী ও বেড়াদীর বিলে আছে কয়েক শ বিঘা জমি। এ ছাড়া কানখরদীর জমিতে ‘রাজ অটো ব্রিকস’ দেখিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে কয়েক শ কোটি টাকা লোন নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

নির্বাচনি এলাকায় নিজের বলয় তৈরি করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন তিনি। তবে ক্ষমতাধর এই নেতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করতে পারেননি কেউ। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগে সভাপতি পদে নিজের পছন্দমতো নেতা বসিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। নিজের তৈরি করা কমিটিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বড় একটি অংশ তার কথায় চলত।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, আবদুর রহমানকে টাকা দিয়ে সহজেই যেকোনো পদ নেওয়া যেত। অর্থলোভী এই নেতাকে টাকা দিয়ে যেকোনো কাজ করানো যেত বলে তিনি জানান। ঘুষ হিসেবে যেকোনো অঙ্কের টাকা তিনি অবলীলায় নিয়ে নিতেন। টাকা দেখলে তার মাথা নষ্ট হয়ে যেত বলেও তিনি জানান।

ফরিদপুর-১ আসনের তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র ‘রাজত্ব’ ছিল আবদুর রহমানের। তার বিরুদ্ধে রয়েছে দখলদারির অভিযোগ। নিজ নামে এবং ছেলেমেয়ের নামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ব্রাহ্মণকান্দায় ‘আবদুর রহমান টেকনিক্যাল কলেজ’ ও ‘আয়েশা-সামি’ জেনারেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারি জায়গায় প্রভাব খাটিয়ে কলেজের নাম দেন। কাদিরদী এলাকায় সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা একটি কারিগরি কলেজের নাম তার মা ও বাবার নামে করার চেষ্টা চালান। মধুখালী নরকোনা কলাগাছিতে রয়েছে আবদুর রহমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

আবদুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নিয়ে রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। তিনি কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলেন, সেটি নিয়ে খোদ মুক্তিযোদ্ধারাও হাসাহাসি করেন।

ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহসভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম বলেন, আবদুর রহমানের ছত্রচ্ছায়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তিন উপজেলায় মাদক দিয়ে সয়লাব করে দিয়েছিলেন। তিনি সরকারি জায়গা দখল করে তার বাবা, ছেলে ও মার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন।

এদিকে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুদক।

গত ৫ আগস্টের পর থেকেই আবদুর রহমান আত্মগোপনে। সরকার তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিলেও শোনা যায়, দেশ ছেড়ে পাশের দেশ বা অন্য কোনো রাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

মাগুরার প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীন নিবাস ও এতিমখানায় নেই এতিম-প্রবীণ

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৫ পিএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১২ পিএম
মাগুরার প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীন নিবাস ও এতিমখানায় নেই এতিম-প্রবীণ
মাগুরার প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীন নিবাস ও এতিমখানা। ছবি: খবরের কাগজ

এতিমদের জন্য বিশাল অট্টালিকা। মন জুড়ানো আলিশান বিল্ডিং। ভালোভাবে নির্মাণ করতে পরামর্শকের পেছনেই খরচ হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। ২০ হাজার বর্গফুটের প্রবীণ নিবাসও নির্মাণ করা হয়েছে। তাদের ব্যবহারের জন্য প্রায় কোটি টাকা খরচ করে নামিদামি আসবাবপত্রও কেনা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে ২৮ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে ‘প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীণ নিবাস, এতিমখানা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহায্যকেন্দ্র, মাগুরা প্রকল্পে। কিন্তু সেখানে নেই কোনো এতিম। নেই তেমন প্রবীণ।’

সরকারি টাকা খরচ করে তিন বছরে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর ও প্রফুল্ল প্রতিভা ট্রাস্ট বাস্তবায়ন করেছে প্রকল্পটি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। 

প্রকল্প পরিচালক ও মাগুরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. জাহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আমরা উদ্যোগী সংস্থা প্রফুল্ল প্রতিভার মালিক স্বপন কুমার ঘোষের কাছে হস্তান্তর করি। তারা দেখভালো করছেন। কাজেই কিছু জানতে হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’

কোনো এতিম নেই, তেমন প্রবীণও নেই- আপনাদের দেখার কিছু নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে মাগুরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বলেন, ‘আমরা আইএমইডি রিপোর্ট হাতে পাইনি, তা পেলে দেখব কেন ভালো করে প্রকল্প করা হলেও এতিম নেই।’ পরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

আইএমইডি ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সূত্র মতে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এলাকার ও মাগুরা ও পার্শ্ববর্তী জেলার প্রবীণ ও এতিমদের সহায়তা, প্রবীণ ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা ও এতিম শিশুদের পরিচর্যা, নিরাপত্তা, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের অনুদানে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ২৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা খরচের অনুমতি দেয় সরকার। মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দুই বছর। ওই সময়ে পুরো কাজ হয়নি। পরে এক বছর সময় বাড়ানো হয়। অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এ সময়ে প্রকল্পটি শেষ হয় এবং খরচ করা হয়েছে ২৮ কোটি টাকা। 

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য স্বাস্থ্যসেবাসহ সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে ২০ হাজার বর্গফুটের ৫ তলাবিশিষ্ট প্রবীণ নিবাস নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া ১০ কোটি টাকা খরচ করে ২ হাজার বর্গফুটের এতিমখানা ভবনও নির্মাণ করা হয়। ৫০ জন প্রবীণের নিরাপদ আবাসন এবং ৫০ জন এতিম ও পিতামাতার স্নেহবঞ্চিত শিশুদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের ব্যবহারের জন্য কোটি টাকার অত্যাধুনিক আসবাবপত্র কেনা হয়েছে। বিল্ডিং দুটি ভালোভাবে নির্মাণ করার জন্য দেখভালো করতে পরামর্শকের পিছনে ৪০ লাখ টাকাও খরচ করা হয়েছে। ৫ লাখ টাকার বইপুস্তকও কেনা হয়েছে। এসব কাজ করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২৭ লাখ টাকা বেতন-ভাতাও দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন খাতে ২৮ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ১০০ ভাগ। কিন্তু সেখানে বর্তমানে মাত্র ৩ জন প্রবীণ বাস করছেন। কোনো এতিম নেই। তবে ভৌত কাজের মান ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ফিজিওথেরাপি মেশিনও কেনা হয়েছে। এতে প্রায় কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় লোকবল দিয়ে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রকল্পের টাকা ঠিকমতো খরচ হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হলে ৭টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এই আপত্তি দ্রুত দ্বিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে তার প্রমাণ আইএমইডির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।

প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্তকরণ প্রতিবেদন (পিসিআর) আইএমইডিতে প্রেরণের নিয়ম থাকলেও এ প্রকল্পে তা করা হয়নি। এক বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১১ জুলাই পাঠানো হয়েছে। আইএমইডির পরিচালক মুহাম্মদ কামাল হোসেন তালুকদার গত ৫ অক্টোবর প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেন।

প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবা প্রদানের জন্য প্রকল্পটি করা হলেও সমাজের পিতা-মাতার স্নেহবঞ্চিতরা সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে জলে গেছে পুরো টাকা। 

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেনা পথেই হাঁটল অন্তর্বর্তী সরকার

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২১ পিএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৮ পিএম
চেনা পথেই হাঁটল অন্তর্বর্তী সরকার
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ

১৯৮৯ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি নিয়ে তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠিত হয়। একই বছর ২৫ জুন প্রথমবারের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারম্যানসহ ৩১ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ গঠিত হয়। পাঁচ বছর অন্তর জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটে পরিষদ গঠন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো সরকারই নির্বাচনের পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ পাহাড়ের মানুষের দাবি, টেকসই সুষম উন্নয়নের স্বার্থে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলো পরিচালনা করা। কিন্তু আগের সরকারগুলোর পথেই হাঁটল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন এই পরিষদে ঠাঁই পাওয়াদের যোগ্যতা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আর বাছাই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা ও সমালোনা চলছে। উঠেছে বৈষম্য এবং স্বজনপ্রীতিরও অভিযোগ। 

সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সাংবাদিক সুশীল প্রসাদ চাকমা বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে নাকি সদস্য করা হয়েছে। এটা কতটুকু সত্য জানি না। এখানে যারা দক্ষ, যোগ্য ও উপযুক্ত শিক্ষিত ছিল তাদের কেউ নেই। অনেকেই বিতর্কিত ও অপরিচিত। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও নেই। অনেকেই এই পরিষদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটা পুনর্বিবেচনা না করলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সুফল মিলবে না।’

রাঙামাটি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, ‘আগেও নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না। এবারও যারা আসছে, তাদের মধ্যে গণমুখী, জনগণের পাশে থাকে এ ধরনের ব্যক্তিত্বের অভাব। আমাদের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ইচ্ছা করলে সমতা বা আরও সদস্য বাড়িয়ে একটা গ্রহণযোগ্য পরিষদ গঠন করতে পারত।’

পরিষদগুলোতে জেলার সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নেই বলেও অভিযোগ উঠেছে। রাঙামাটিতে ১৫ সদস্যের মধ্যে রাঙামাটি সদর থেকে ৯ জনকে নেওয়া হয়েছে। ১০ উপজেলার মধ্যে কাউখালী, জুরাছড়ি, বরকল ও রাজস্থলী এই চার উপজেলা থেকে কোনো প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি। অথচ নানিয়ারচর উপজেলা থেকে নেওয়া হয়েছে দুজনকে। খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলার মধ্যে দীঘিনালা, রামগড়, গুইমারার কোনো প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে খাগড়াছড়ি সদর থেকে ৬ জন ও মাটিরাঙা থেকে ৪ জন নেওয়া হয়েছে। বান্দরবান জেলা পরিষদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। ৭ উপজেলার মধ্যে লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে কোনো প্রতিনিধি নেই। সদর থেকে ৯ ও থানচি ৩ জনকে থেকে নেওয়া হয়েছে।

রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সামশুল আলম বলেন, ‘ জেলা পরিষদগুলো যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গঠন করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে গেছে। দশ উপজেলার মধ্যে চার উপজেলা বাদ পড়েছে। রাঙামাটি সদর থেকেই ৯ জন নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলা ও প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নেওয়া দরকার ছিল। তাই গঠিত এই পরিষদ নিয়ে জনআকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। তাই এই পরিষদ পুনরায় পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।’

নতুন এই পরিষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রাঙামাটিতে কাজল তালুকদার, খাগড়াছড়িতে জিরুনা ত্রিপুরা ও বান্দরবানে অধ্যাপক থানজামা লুসাইকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেক পরিষদে ১৪ জন করে সদস্য রয়েছেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গা-ঢাকা দেন। 

বাইরে আলোচনা যা-ই থাকুক নিজের পরিকল্পনা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানিয়েছেন রাঙামাটির চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার।

তিনি বলেন, ‘আমি যতক্ষণ থাকব কোনো স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি হবে না। আমার অগ্রাধিকার তালিকায় আছে শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং পর্যটন উন্নয়ন।’

রাসিকের সড়কবাতি: খ্যাতির খেসারত ৪৩ কোটি টাকা!

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ এএম
রাসিকের সড়কবাতি: খ্যাতির খেসারত ৪৩ কোটি টাকা!
রাজশাহী নগরের বিলাসবহুল সড়কবাতি। ফাইল ছবি

উন্নত বিশ্বের নামিদামি শহরের মতো আধুনিক দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতির সংযোজন রাতের আঁধার কাটিয়ে রাজশাহী নগরকে করে তোলে আলোকিত। দেশের প্রথম সিটি হিসেবে রাজশাহী নগরের সড়কে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে আলো দেয় সড়কবাতি। আবার কোথাও স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে মুকুটবাতি। সিল্কসিটি, ক্লিনসিটি, গ্রিনসিটির পাশাপাশি সড়কবাতির কারণে রাজশাহী নতুন করে তকমা পায় ‘আলোর শহর’ হিসেবে। তবে বিদেশ থেকে আনা দৃষ্টিনন্দন এই সড়কবাতি দিয়ে শহরকে আলোকিত করতে গিয়ে বর্তমানে বিপাকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। মাত্র ২৩ কিলোমিটার পথ আলোকিত করতে গিয়ে ঘারে চেপে বসেছে বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া। বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে রাসিকের সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে বলে জানিয়েছে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কর্তৃপক্ষ।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, এ ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্প শুধু সরকারি সম্পদের অপব্যবহার নয়, এটা অপচয়ও বটে। এর দায়ভার বহন করতে হবে জনসাধারণকে। এদিকে বকেয়া বিলের কারণ হিসেবে সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের উদাসীনতাকে দুষছেন রাসিকে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। শুধু মধ্যশহরে অতিরিক্ত সড়কবাতি লাগিয়ে অর্থের অপচয় করা হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। এখন বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে রাসিক। তারা জানায়, বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কমানো হচ্ছে সড়কে আলোকবাতির সংখ্যাও।

রাসিক সূত্রে জানা যায়, নগর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১০৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে নান্দনিক সড়কবাতিগুলো স্থাপন করে সিটি করপোরেশন। আলোর ঝলকানিতে শহর সাজাতে নগরের কাশিয়াডাঙ্গা-বন্ধগেট, তালাইমারী-কোর্ট, তালাইমারী-কাটাখালী ও আলিফ-লাম-মিম ভাটার মোড় থেকে বিহাস পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার পথে আছে আধুনিক এসব সড়কবাতি। আলোর তীব্রতা বিশ্লেষণ করে প্রায় ১৫ মিটার দূরত্বে বসানো হয় এসব বাতি। নান্দনিক এসব সড়কবাতি আনা হয় তুরস্ক, চীন ও ইতালি থেকে।

আরও জানা গেছে, নগরের ১৮টি পয়েন্টে উঁচু উঁচু ফ্লাডলাইটও বসানো হয়েছে বিদেশ থেকে এনে। এতেই করপোরেশনের কাঁধে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ বিল। এদিকে এরই মধ্যে সড়কের বাতি কমিয়ে ফেলেছে সিটি করপোরেশন। একটির পর একটি বাতি জ্বালাছেন তারা। অন্যদিকে নান্দনিক বাতির অনেকগুলোই নষ্ট হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের আগে। প্রতিদিনই রক্ষণাবেক্ষণ করে এগুলো সচল রাখা হচ্ছে।

নেসকোর বাণিজ্যিক পরিচালন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস বলেন, রাসিকের বকেয়া বিল আগে থেকেই থাকত। তবে কয়েক বছর ধরে সড়কবাতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বকেয়া বিলের পরিমাণও বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এখন বকেয়া সাড়ে ৪৩ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বকেয়া পরিশোধে মাঝেমধ্যেই রাসিকে চিঠি পাঠানো হয়। তবে বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি। নাগরিক সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নও করা হচ্ছে না।

তবে নাম না প্রকাশ করে নেসকোর এক উপমহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, রাসিকের বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি এতদিন রাজনৈতিক সমঝোতায় চলেছে। তবে এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তাই এসব বকেয়া উদ্ধারে আমরা তৎপর হয়েছি।

তবে রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এ বি এম শরীফ উদ্দিন বলেছেন, ‘শুধু সড়কবাতি নয়, এই বকেয়া নগরের চারটি জোনের পানির পাম্প, বিভিন্ন স্থাপনা ও আরবান হেলথ কেয়ারে ব্যবহৃত বিদ্যুতের। প্রতি মাসের বকেয়া পুঞ্জীভূত হতে হতে একটা বিরাট অঙ্কে এসে দাঁড়িয়েছে। একসঙ্গে এতগুলো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য রাসিকের নেই। সে কারণে প্রতি মাসে ৫০ লাখ টাকা বকেয়া বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় কমিশনার ও রাসিকের প্রশাসক ড. মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘বিদ্যুতের অপচয় কমিয়ে ধীরে ধীরে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কমানো হচ্ছে অতিরিক্ত সড়কবাতি। কেননা, এগুলো ঘিঞ্চিভাবে লাগানো হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে অর্থ অপচয় করা হয়েছে। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি। যেখানে যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে ঠিক করব।’

রাজশাহী জেলা সুজনের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই সড়কবাতিগুলো ছিল রাজনৈতিক প্রকল্প। অথচ যে বাড়তির টাকা বকেয়া হয়েছে তা সিটি করেপারেশনের জনগণের হল্ডিং ট্যাক্স ও অন্যন্য কর থেকে আদায় করা হবে। কিন্তু এমন বিলাসিতার খেসারত নগরবাসীকে কেন দিতে হবে। এটি কাম্য নয়।’

ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায়ে জটিলতা

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায়ে জটিলতা
২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকির তথ্য রয়েছে ১ হাজার ১২৮ জন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে

রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী চতুর রাজস্ব ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এদের মধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ কেউ আছেন আত্মগোপনে। আবার অনেকে আছেন কারাগারে। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা সমুদয় অর্থ জব্দ করেও সরকারের পাওনা আদায় করা সম্ভব হবে না। আইনি জটিলতায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় রাজস্ব ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে বসে নেই এনবিআর, খুঁজছে নতুন পথ।

বিগত সরকারের ১ হাজার ১২৮ জন প্রভাবশালীর কাছ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব কবে নাগাদ আদায় হবে, তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। 

প্রভাবশালী এসব রাজস্ব ফাঁকিবাজের কাছ থেকে কীভাবে অর্থ আদায় করা সম্ভব, তা নিয়ে কৌশল নির্ধারণে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এনবিআরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। নেওয়া হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, বিগত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এক হাজারের বেশি ব্যক্তির রাজস্ব ফাঁকির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে। এদের আয়ের বৈধ উৎস না থাকায় অনেকে ব্যাংকের লেনদেন এড়িয়ে বাড়িঘরে, অন্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ গচ্ছিত রেখেছেন। অনেকে অর্থ পাচার করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় অনেকে অ্যাকাউন্ট প্রায় খালি করে টাকা সরিয়েছেন। তাই এসব ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হলেও সেখানে থাকা সামান্য অর্থ দিয়ে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পরিশোধ করা যাবে না। 

সিআইসি সূত্র জানায়, বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের অনেকের বাড়ি, ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক স্থাপনাসহ জমিজমার মালিকানা দলিলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে সময় লাগছে। অনেকে আবার ফাঁকি দেওয়া টাকায় অন্যের নামে সম্পত্তি কিনেছেন। এসব সম্পত্তির দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর জোগাড় করতে সময় লাগছে। আবার অনেকের সম্পদের খোঁজে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কাগজপত্র ভুয়া। রাজস্ব ফাঁকিবাজদের বেশির ভাগের এ ধরনের সম্পদ রয়েছে। 

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন মেনে এসব সম্পত্তি বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করতে হলে দলিলপত্র জোগাড় করে নিলামে তুলতে হবে, যা বেশ ঝামেলাসাপেক্ষ।

এনবিআর সদস্য সৈয়দ মুহাম্মদ আবু দাউদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআর প্রভাবশালীদের রাজস্ব ফাঁকির অর্থ পরিশোধের জন্য চাপ দিলে তারা মামলা করে দিতে পারেন। মামলা করা প্রতিটি নাগরিকের আইনি অধিকার। এ ক্ষেত্রে মামলা কতদিনে নিষ্পত্তি হবে তা আমার কেন- কার পক্ষেই বলা সম্ভব না।’ 

তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে কয়েক হাজার রাজস্বসংক্রান্ত মামলা আদালতে জমে আছে। এনবিআর থেকে এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যায়ে রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি।’ 

আদালতে ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ হাজারের বেশি রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর ফলে আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে প্রতি দিনই নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। পুরোনো অনেক মামলা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলমান রয়েছে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সরকারের এসব ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তাদের অবৈধ ও বৈধ সব অর্থ পাচার করে দিয়েছেন। পাচারের অর্থ ফেরত এনে এবং সম্পত্তি বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘পাচারের অর্থ আদায়ের প্রথম ধাপে রাজস্ব আইনের পাশাপাশি দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতেও এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এরপর বিদেশে ল ফার্ম নিয়োগ দিয়ে আইনি পথে পাচারের অর্থ আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একই সঙ্গে বিদ্যমান রাজস্ব আইনেও কিছু ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। আইনটির বিশেষ কিছু ধারার আওতায় মামলা করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে পুরো আদায় প্রক্রিয়াটি ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

এনবিআর সূত্র জানায়, গত সপ্তাহ পর্যন্ত এনবিআরের প্রাথমিক তদন্তে বিগত সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌরসভার চেয়ারম্যান, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিল্পী, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীসহ মোট ১ হাজার ১২৮ জন ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানা গেছে। এদের প্রত্যেকের নামে-বেনামে ফ্ল্যাট, বাড়ি ও বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। রয়েছে হাজার একরের বেশি জমি। বিশেষভাবে সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ওবায়দুল কাদের, শাজাহান খান, দীপু মনি ও তার ভাই, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, জুনায়েদ আহমেদ পলক ও তার স্ত্রী কনিকার নামে শতাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট থাকার প্রমাণ রয়েছে। নিজেদের এলাকাতে শত একর জমি, একাধিক মাছ ও গবাদিপশুর খামার থাকারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব সম্পত্তির দলিলপত্রের খোঁজ চলছে। সেনা কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলের নামেও হাজার একরের বেশি জমি থাকার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। আরও প্রমাণ জোগাড়ে কাজ চলছে। 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আটঘাট বেঁধে রাজস্ব ফাঁকি দেন। এদের ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদায় করা কঠিন। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই সম্ভব।’

অন্যদিকে বেক্সিমকো গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (নগদ লিমিটেড), ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডসহ মোট ৩৭ প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে রাজস্ব পরিশোধযোগ্য অর্থ নেই বলে সূত্র জানিয়েছে। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলে সায়ান ফজলুর রহমান, সালমান এফ রহমানের ভাই এ এস এফ রহমান ও তার ছেলে শাহরিয়ার রহমানের ফাঁকি দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এদের নিজেদের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা তাদের কাছে পাওনার চেয়ে অনেক কম। অন্যের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব তারা পরিচালনা করেছেন কি না, তার খোঁজ চলছে। এদের ভোগদখল করা সম্পত্তির মালিকানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে। সেসব দলিলের খোঁজ চলছে। এসব ব্যক্তির পাচার করা ৩৩ হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে এনে রাজস্ব আদায়ে কাজ করছে সরকার। 

এনবিআর সূত্র জানায়, রাজস্ব আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি এসব ব্যক্তির নামে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা করা ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টিও এনবিআর খতিয়ে দেখছে। 

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কর ফাঁকিবাজরা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন এনবিআর স্বচ্ছতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে রাজস্ব ফাঁকির অর্থ আদায় করতে কাজ করছে। যদি কোনো জটিলতা থাকে তবে তার সমাধান করে রাজস্ব ফাঁকির অর্থ আদায় করা হবে। এ বিষয়ে এনবিআর কঠোর অবস্থানে আছে।