ঢাকা ২৫ কার্তিক ১৪৩১, রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪

দখলবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্যে নারায়ণ চন্দ্রের জুড়ি নেই

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪২ এএম
আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪৩ এএম
দখলবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্যে নারায়ণ চন্দ্রের জুড়ি নেই
নারায়ণ চন্দ্র চন্দ

স্কুলশিক্ষক থেকে সংসদ সদস্য। সাদামাটা চালচলন। স্থানীয় রাজনীতিতেও খুব একটা প্রভাব বিস্তার করেননি। এমন ভালোমানুষী চেহারার আড়ালে দখলবাজি ও নিয়োগ-বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে নির্বাচনে পরপর চারবার সংসদ সদস্য ও দুই দফায় মন্ত্রী হওয়ায় এলাকার সব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে নিয়োগে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাণিজ্য করেছেন তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারে প্রথমবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং শেষবার ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় স্বজনদের নিয়ে তিনি অনিয়মের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তার ছেলে বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক সদস্য এবং তার এপিএস সমীরণ দে গোরা নানা অপকর্ম ও লুটপাট করে বিতর্কিত হয়েছেন। মন্ত্রীর মেজো ছেলে সত্যজিৎ চন্দ্র বিসিআইসির সার ও সেনা কল্যাণ সংস্থার সিমেন্টের ডিলার। সত্যজিতের মালিকানাধীন ঊষা এন্টারপ্রাইজ ১৫ বছর ধরে এককভাবে সারের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে।

২০২৪ সালে দেওয়া হলফনামায় নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সম্পদের মধ্যে ব্যাংকে জমা ৫৫ লাখ টাকা, ৪ দশমিক ১৭ একর কৃষিজমি, কিছু অকৃষি জমি, একটি দালান ও একটি সেমিপাকা ভবন রয়েছে। তবে স্থানীয়রা জানান, এর বাইরে নারায়ণ চন্দ্রের একাধিক ইটভাটা, কৃষিজমি, ঢাকা ও কলকাতায় ফ্ল্যাট রয়েছে। 

৭ অক্টোবর ছদ্মবেশে ভারতে পালানোর সময় ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সীমান্ত থেকে তাকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। স্থানীয় অনেকে বলছেন, নারায়ণ চন্দ্র ও তার ছেলে বিশ্বজিৎ চন্দ্র হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন প্রতিবেশী দেশে। সে কারণে বাংলাদেশে তাদের সম্পদ কম।

নিয়োগ-পদোন্নতিতে অর্থবাণিজ্য
২০১৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ডুমুরিয়া উপজেলার একটি কলেজ সরকারীকরণের উদ্যোগ নেয়। তবে শর্ত অনুযায়ী ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে হতে হবে। কিন্তু কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে নারায়ণ চন্দ্র প্রভাব খাটিয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপক্ষো করে ১৪ কিলোমিটার দূরে শাহাপুর-মধুগ্রাম কলেজকে সরকারিকরণ করেন। 

এ ছাড়া তিনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ ও বদলিতে বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ আয় করেছেন। জানা যায়, ডুমুরিয়া কলেজে প্রভাষক পদে তার এক পুত্রবধূ সুলগ্না বসু, লাইব্রেরিয়ান পদে আরেক পুত্রবধূ কেয়া রানী চন্দ্র, প্রভাষক পদে তার সাবেক এপিএস সমীরণ দের শ্যালক শোভন দে, সাবেক এপিএস সত্যম রায়, ভাতিজা জয়ন্ত কুমার দে, নাতি দ্বীপ চন্দ্র চন্দ চাকরি করেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়োগে তিনি প্রভাব বিস্তার করেন।

নারায়ণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে দুই মামলা
ডুমুরিয়ার ইটভাটার নামে প্রায় ১০০ বিঘা জমি দখলের অভিযোগে নারায়ণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ভদ্রাদিয়া গ্রামের শংকর মল্লিক জানান, ২০২১-এর ২১ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রামের ১০ জন জমির মালিককে লিজের টাকা না দিয়ে নারায়ণ চন্দ্র ও তার দুই ছেলে সেখানে ইটভাটা গড়ে তোলেন। এতে লিজ বাবদ তাদের কাছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে শিমুল দাস ৯ লাখ, লাইলী কারিগর ৯ লাখ, সুমন মল্লিক ৯০ হাজার, নজরুল গাজী ১ লাখ ৫৩ হাজার, আহমদ গাজী ১ লাখ ৫৩ হাজারসহ ১০ জনের পাওনা ১ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৩০০ টাকা।

তিনি বলেন, প্রতি শতাংশ বাবদ বছরে ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল এবং প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা চুক্তি থাকার কথা। কিন্তু অনেকে রাজি না হলেও জোর করে কোনো চুক্তি ছাড়াই ইটভাটা নির্মাণ করা হয়। অনেককে শুরু থেকেই লিজের টাকা দেওয়া হয়নি। ইটভাটা শুরু হওয়ার পর আশপাশে জমিতে কোনো ফসল উৎপন্ন হয় না। গাছপালা, মৎস্য খামারসহ পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে আরও প্রায় ২ কোটি টাকার। ওই ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে মামলা করা হয়েছে।

এ ছাড়া খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বর থেকে ধর্ষণের শিকার নারীকে অপহরণের ঘটনায় ২৯ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি করা হয়। ওই নারী নারায়ণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে অপহরণে সহযোগিতা ও তার সহযোগী উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। 

চরমপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্ক
স্থানীয় চরমপন্থিদের সঙ্গে নারায়ণ চন্দ্র চন্দের যোগাযোগ ছিল। নিজের বলয় তৈরি করতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের বাইরে গিয়ে পছন্দের মাই ম্যানকে বিজয়ী করতে প্রভাব বিস্তার করেন।

ভান্ডারপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. হিমাংশু বিশ্বাস বলেন, ১৬ বছরে নারায়ণ চন্দ্র তিনটি ইটভাটা করেছেন। তিনি এক ছেলের নামে সারের ডিলারশিপ নিয়েছেন। পরিবারের একাধিক সদস্যকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন। এ ছাড়া অন্যদের চাকরি দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ ও ৬ আগস্ট বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ ডুমুরিয়ায় তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে দোতলা বাড়ির আসবাবসহ গ্যারেজে থাকা দুটি গাড়ি পুড়ে যায়।

ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলই ছিল মূল টার্গেট

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪০ এএম
ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিলই ছিল মূল টার্গেট
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

অন্তত ৩০ বছর ধরে সব সরকারের আমলে ঘুষ-বাণিজ্য করেই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়েছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রুগ্‌ণ কোম্পানি কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডকে কৌশলে লিজ নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটানো শুরু করেন।

জানা গেছে, তিনি ওই সময়ে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবিত করে দরপত্র ও প্রতিযোগিতা ছাড়াই কোম্পানিটি হাতিয়ে নেন। এরপর প্রতিটি সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘুষ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী আমলাদের নানা রকম আর্থিক সুবিধা দিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটান। এরপর আর থামেনি ঘুষ-বাণিজ্য।

২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপিকে ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা ছাড়াও দিয়েছেন বিএমডব্লিউর মতো বিলাসবহুল গাড়ি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নানাভাবে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ তার বিরুদ্ধে ১৪টিরও বেশি মামলা হয়। এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় । তবে ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়ী পার্টনার বানিয়েছেন। তাদের বদৌলতে বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্টসহ ঠিকাদারি কাজে নানা রকম দুর্নীতি-অনিয়ম করেও টিকে ছিলেন ১৫ বছর। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা ১৪টি মামলার মধ্যে কয়েকটি মামলার রায়ে ঘুষ-বাণিজ্যের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডির রাস্তায় প্রায় এক দিন পড়ে থাকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি বিএমডব্লিউ। তৎকালীন দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গাড়িটি উদ্ধার করে মালিককে খুঁজতে থাকে। পরে জানা যায় গাড়িটির মালিক বিএনপির সাবেক হুইপ আশরাফ হোসেন। পরে ওই গাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে গাড়িটি ঘুষ হিসেবে দিয়েছিলেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। এ নিয়ে ওই সময়ে আশরাফ হোসেন, ওবায়দুল করিম, হারিছ চৌধুরীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ২০১২ সালে যখন চার্জ গঠন হয় ততক্ষণে ওবায়দুল করিম কৌশলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে ফেলেন। ফলে ওই সরকারের প্রভাবশালী মহলের পরামর্শে চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ওবায়দুল করিম। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট। তবে অপর চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা চলবে বলে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলও করে দুদক। আপিল চলাকালে ২০০০ সালের জুলাই আশরাফ হোসেন এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হারিছ চৌধুরী মারা যান। 

দুদক সূত্র জানায়, নানা কারণে দুদকের আপিলটি এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছে। 

এদিকে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চের দেওয়া রায়ে ওবায়দুল করিম ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২৭৩ পৃষ্ঠার ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়, ওরিয়নের ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড অনৈতিকভাবে কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এর মধ্যে ওবায়দুল করিম তার সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১১০০০১২৮১৪ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে ৮১৯১৩৫৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে ইকবাল মাহমুদ টুকুকে ৫০ লাখ টাকা দেন। এ ছাড়া ২০০৬ সালের ৬ জুন ওবায়দুল করিমের ঘুষ বিতরণের প্রতিষ্ঠান ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের মাধ্যমে ভারতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের ০২৩৩০২২৬১৩ ও ০৫১৩০৯৫৯২০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ১ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব টাকার ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৬ টাকায় একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দেওয়া হয়েছে, ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনে দেওয়া হয়। বাকি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৩ টাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওবায়দুল করিম দাবি করেছেন, সেই টাকা ওই সময়ে ভারতে অবস্থানরত তার ভাইকে বাড়ি ভাড়া বাবদ দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে ২০০৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট থেকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার পে-অর্ডার নম্বর ০৩৯২৯৫৯ মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই পে-অর্ডারে রিসিভার হিসেবে ওবায়দুল করিমের জামাতা মেহেদী হাসানের নাম থাকলেও পরে তার নাম কেটে দিয়ে সেখানে রুমানা মাহমুদ লেখা হয় এবং পার্টিকুলার রিসিভার হিসেবে রুমানা মাহমুদ ওই টাকা উঠিয়ে নেন। এর আগে একই বছরের ২৮ মার্চ রুমানা মাহমুদকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ওবায়দুল করিম অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে রায়ের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। বিচারের সময় সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক এ এফ এম শরিফুল ইসলাম, আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট সাক্ষীরা অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। ফলে অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। 

পুরো রায়টি লেখেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায়ে সমর্থন জানান বিচারপতি খিজির হায়াত। 

অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা এবং এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ওবায়দুল করিম ২০০৯ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করলে সব অপকর্মের দায় থেকে বাঁচতে ওবং ওই সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিসহ ক্ষমতাধর নেতাদের বাগে আনতে তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করে নেন। এর মধ্যে ওরিয়নের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেন সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে। ডাচ্‌-বাংলা পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের পরিচালক পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে। এমন অনেক মন্ত্রী-এমপিকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়ে গত ১৬ বছরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ওবায়দুল করিম, তার পরিবারের সদস্যদের এবং ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনুসন্ধান ও তদন্ত চালাচ্ছে। তবে বসে নেই ওবায়দুল করিম ও ওরিয়নের কর্ণধাররা। তারা বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদেরও আশীর্বাদ পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তবে তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার এখনো কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।

সম্পদের পাহাড় গড়া ছিল হানিফের নেশা

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৩ এএম
সম্পদের পাহাড় গড়া ছিল হানিফের নেশা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

মাহবুবউল আলম হানিফ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং টানা তিন বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। আর এই তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত চার জেলায় অনুসন্ধানে তার সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি কানাডাসহ কয়েকটি দেশে হানিফের সম্পদ ও ব্যবসা আছে বলেও জানা গেছে। মূলত রাজনীতির আড়ালে অর্থ আয় করা ছিল তার নেশা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছেন মাহবুবউল আলম হানিফ। তার দোসররাও পালিয়ে গেছে।

এদিকে হানিফের ক্ষমতাকে পুঁজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্বে থাকা চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা। মাত্র কয়েক বছরেই নিজের আখের গুছিয়েছেন তিনি। অল্পদিনেই হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। হাট ঘাট বা টেন্ডারবাজি সব ছিল তার দখলে। আতার ইশারা ছাড়া যেন কুষ্টিয়ার কোনো গাছের পাতাও নড়ত না। যার কারণে জেলা আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী এবং দুর্দিনের কান্ডারিরা হয়ে পড়েন একঘরে। সরকার পতনের পর থেকে আতাও আত্মগোপনে চলে যান।

হানিফের উত্থান যেভাবে

মাহবুবউল আলম হানিফের বড় ভাই সাবেক সচিব রাশিদুল আলম শেখ পরিবারের জামাই। সেই সূত্র ধরেই হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে মনোনয়ন পান তিনি। তবে পরাজিত হন। এরপর আরও একবার মনোনয়ন পেলেও বিজয়ী হতে পারেননি। ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফ মনোনয়নবঞ্চিত হন। মনোনয়ন দেওয়া হয় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে। দল ক্ষমতায় আসে। হানিফকে করা হয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। ২০১৩ সালে কুষ্টিয়া সদর আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। ওই বছর দলীয় কাউন্সিলে পেয়ে যান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর পিছে তাকাতে হয়নি। বাড়তে থাকে প্রভাব-প্রতিপত্তি। দলে তার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হয় একাধিকবার একই পদ পেয়ে যাওয়ার কারণে। যদিও মন্ত্রী হওয়ার খায়েস থাকলেও আশা পূরণ হয়নি নানা অভিযোগের কারণে।

দলের নেতা-কর্মীদের পাত্তা না দিলেও বড় বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আঁতাত করে চলতেন। এভাবে গত ১৫ বছরে প্রচুর সম্পদের মালিকবনে গেছেন হানিফ। তার পুরো পরিবার থাকে কানাডায়। এ ছাড়া সেখানে তার কয়েকজন ভাইবোনও বাস করেন। কানাডায় হানিফের গাড়ি-বাড়িসহ সম্পদ আছে বলে জানা গেছে।

নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়

হানিফের কপাল খুলে যায় শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ার কারণে। দলের শীর্ষ পদ পাওয়ার পরই তার কাছে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া ঢাকাকেন্দ্রিক নানা কাজের তদবিরও করতেন। দলের পদ-পদবি দেওয়ার নামে যেমন অর্থ বাণিজ্য করেছেন তেমনি নানা তদবির, টেন্ডার বাণিজ্য, বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। হানিফের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল। কারওয়ান বাজারে বিএমটিসি ভবনে তার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক অফিস। সেই অফিস ও কুষ্টিয়ার বাসায় বসেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তার হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেন। সর্বশেষ স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নেন। লালন কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের নতুন ভবনে।

দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হানিফের আয়ের টাকার বড় অংশ পাচার করেছেন কানাডাসহ কয়েকটি দেশে। আর দেশে কয়েকটি বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে বেনামে হানিফের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদের খবর পাওয়া গেছে। 

কুষ্টিয়ায় হানিফ ও তার ভাই আতার নামে মার্কেট, দোকান ও শপিং মলে দোকান আছে বলে জানা গেছে। কুষ্টিয়া শহরের তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘খেলার মাঠের পাশে দুই তলা নতুন যে মার্কেট হয়েছে সেখানে ৮টি দোকান আছে তাদের নামে। দোকানের ভাড়াটিয়ারা জানান, প্রতি মাসে আতা টাকা তুলতেন।’

জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় মহাসড়কের পাশে ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তার ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে।

শহরের বহুতল বিপণিবিতান পরিমল টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে হানিফ ও আতার নামে। মার্কেট কমিটি জানায়, দুটি দোকানের দাম কোটি টাকার ওপরে। ভাড়া ওঠে প্রতি মাসে অর্ধলাখ টাকা। এ ছাড়া সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। শহরের হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্ল্যাট। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, হাউজিংয়ের জমির সঙ্গে স্থানীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। আতার নামে হলেও এর পেছনে ছিলেন হানিফ। পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিন তলা বাড়ি কাগজে-কলমে আতা ও তার স্ত্রীর নামে হলেও হানিফের অর্থে করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। প্রথম দিকে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড এ বাড়িতে লাগানো হয়। 

আতার সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করার পর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া ঢাকা ও কুষ্টিয়ায় তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শেয়ার, ব্যাংকে ডিপোজিট আছে।

দল ও অন্য কয়েকটি সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী অজয় সুরেকার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় কোটি কোটি লগ্নি করা আছে হানিফের। এসব কারণে অজয় সুরেকাকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ করেন হানিফ। এসব বিষয়ে জানতে মুঠো ফোনে অজয় সুরেকার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, জোর করে দলীয় পদ দেওয়া ছাড়া হানিফের সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। আর ওই পদ-পদবির পরিচয়ও তিনি দিতেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হানিফ প্রভাব খাটিয়ে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন সারা দেশে। তার নিজের একাধিক ড্রেজার আছে খননের জন্য। সর্বশেষ গড়াই খননের একটি কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। এতে তার নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতি ড্রেজারের দাম ৩০ কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা আছে হানিফের। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় হানিফের নগদ টাকার পরিমাণ বহু গুণ বেড়েছে বলে দেখা গেছে।

২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে একটি সাধারণ মানের গাড়িতে চড়লেও পরে তিনি একাধিক দামি গাড়ি ক্রয় করেন। যার প্রতিটির দাম কোটি টাকার ওপরে। রাজধানীর গুলশানে তার বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, আছে বনানীতেও। এ ছাড়া খুলনায় তার মাছের ঘেরের সঙ্গে আছে রিসোর্ট। জমি আছে পাবনার ঈশ্বরদী, কক্সবাজারের টেকনাফে। পার্টনারে গাজীপুরে নির্মাণ করেছেন একাধিক রিসোর্ট।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিতর্কিত একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে বেনামে যৌথ ব্যবসা আছে তার। নদী খনন ও শাসনের কাজ করতেন তারা দুজন। ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজের নামে কোটি কোটি টাকার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। তবে হানিফের কারণে পার পেয়ে গেছেন ঠিকাদার।

সর্বশেষ কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদীশাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকার অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কবজায় নিয়ে নেন। এসব কাজ পরে কমিশনে বিক্রি করে দেন। এ কাজ থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ। তার সময় কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, কুষ্টিয়া শহরে ফোর লেন করা, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক নির্মাণ, শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু নির্মাণ, মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প। এ ছাড়া সম্প্রতি পদ্মা নদীশাসনে বড় একটি প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিটি থেকেই হানিফ আগাম বাগিয়ে নেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। প্রতিটি প্রকল্প থেকে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ কমিশন আদায় হতো। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, বালুর ঘাটের কমিশনসহ অন্যান্য কাজ থেকে যে আয় হতো তা চাচাতো ভাই আতার মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন। সর্বশেষ কুষ্টিয়া মেডিকেলের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হানিফের পছন্দের প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ।

কুষ্টিয়ার সব ঠিকাদারি কাজ, হাট-ঘাটের ইজারা, সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে নিয়োগ, পদ্মা ও গড়াই নদীর বালু মহাল থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্র থেকে কমিশন আদায় করেছেন হানিফ। এমন কি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পদ বিক্রির অভিযোগও রয়েছে হানিফের বিরুদ্ধে।

প্রতিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন

হানিফের অত্যাচার নির্যাতন থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন বাদ যাননি তেমনি বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েন তার বাহিনী দিয়ে। জেলা যুবদল নেতা আল আমিন কানাই বলেন, গত নির্বাচনের আগে একজন কাউন্সিলর আমার বাসায় গিয়ে বলেন, হানিফের ভাই আতা সাহেব চা খাবেন। আমি বলি এত বড় নেতার সঙ্গে চা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর থেকে তারা আমার বাড়িতে মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্তা করেছে, আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। এখন আমি ব্রেন স্ট্রোকের রোগী। মানসিক ও শারীরিকভাবে তারা আমাকেসহ দলের বহু নেতাকে গত ১৬ বছরে শেষ করে দিয়েছে।

সাংবাদিক নির্যাতন

আওয়ামী লীগ ও হানিফের নামে নিউজ করে মামলা ও হামলার স্বীকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-ছাড়া হয়েছেন একাধিক সংবাদকর্মী। মামলা দিয়ে জেলে পাঠান যুগান্তর প্রতিনিধি এ এম জুবায়েদ রিপনসহ বেশ কয়েকজনকে। এর বাইরে জুয়েল আহম্মেদ শাহিন ও অঞ্জন শুভ নামের স্থানীয় দুই সাংবাদিক হানিফের রোষানলে পড়ে মিথ্যা মামলায় কারাগারে যান। 

৫ আগস্টের পর

হানিফ ও আতাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নামে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। গা-ঢাকা দিয়েছেন সব নেতা। এরপর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় বর্তমান পরিস্থিতি ও হানিফের বিষয়ে। বেশির ভাগই বলছেন, হানিফ রাজনীতি করার জন্য কুষ্টিয়ায় আসেননি। এসেছেন বাণিজ্য করতে। 

কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. আমিনুল হক রতন বলেন, হানিফ-আতা এই দুই ভাইয়ের কারণে কুষ্টিয়ার রাজনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। একক আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছেন। 

বিপুল সম্পদের মালিক আতা

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন আতা। ঘষলেই বেরুত টাকা। তিনি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামের প্রয়াত আবদুস সাত্তারের ছেলে। আবদুস সাত্তার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বাবা আফসার আলীর চাচাতো ভাই। সেই সূত্রে হানিফ আর আতা চাচাতো ভাই। হানিফের পর আতা ছিলেন কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি। দুই ভাই মিলে জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সব সরকারি কাজ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এভাবে আতা জিরো থেকে বনে গেছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। একসময় মোটরসাইকেলে চড়লেও এখন তার কোটি টাকা দামের একাধিক গাড়ি আছে। স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেও স্বামীর টাকায় তিনিও কোটিপতি। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে আতার।

দলের পদ-পদবি ও টেন্ডারে কাজ পেতে আতার কাছে ধরনা দিতে হতো সবাইকে। তার অত্যাচার ও নির্যাতনে দল ছেড়েছেন অনেকে। এমনকি ঠিকাদারি কাজও ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। অবৈধ বালুঘাট, হাট-বাজার, বিল ও বাঁওড় নিয়ন্ত্রণ করতেন আতা। তিনি এভাবে গত ১৬ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর আতা গা-ঢাকা দেন। তার বাড়ি লুটপাট হয়ে গেছে। একই অবস্থা হানিফের বাড়িরও। আতার স্ত্রীর নামে অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগে দুনীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। আতার অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। যেকোনো সময় মামলা হতে পারে বলে জানা গেছে।

২০২২ সালে আতার বিপুল অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে দুদকে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে বলা হয়, ১০ বছরের ব্যবধানে বাড়ি-গাড়িসহ ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিকবনে গেছেন আতা। এই অভিযোগ ওঠার পর ২০২২ সালে দুদক তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে।

আতা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কুষ্টিয়া অফিস থেকে সাড়ে ৫ কাঠার প্লট নিয়েছেন। শহরের হাউজিং এলাকায় ওই জমিতে ৭ তলা ভবনের কাজ চলছে। স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর নামে তিনি ওই সম্পদ করেছেন। এখানে বিনিয়োগের ব্যাপারে আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। অথচ ভবন করতেই খরচ হয়েছে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা। আতা-ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা এ তথ্য দেন। 

আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় এবং মুঠো ফোন বন্ধ থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে মাহাবুবউল আলম হানিফ এবং তার ভাই আতাউর রহমান আতার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বিএনপি নেতার হাতে ‘পলাতক’ আ.লীগ নেতার পত্রিকা-ব্যবসা!

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫২ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম
বিএনপি নেতার হাতে ‘পলাতক’ আ.লীগ নেতার পত্রিকা-ব্যবসা!
সিলেট নগরীর আবাসিক এলাকা হাউজিং এস্টেটে বিএনপি নেতার কাযালয় এখন আওয়ামী লীগ নেতার পত্রিকা অফিস। শুক্রবার সকালে তোলা। ইনসেটে আ.লীগ নেতা সরওয়ার ও বিএনপি নেতা কয়েস লোদী। খবরের কাগজ

৫ আগস্টের পর হয়েছে ক্ষমতার পালাবদল। দলীয় কোনো সরকার এখনো নির্বাচিত হয়নি। তারপরও দলীয় প্রভাব খাটানো শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জায়গা জমি পর্যন্ত দখল হচ্ছে। এমনকি মিডিয়া হাউসের মালিকানার হাত বদল হয়েছে। সম্প্রতি সিলেটে একটি আঞ্চলিক পত্রিকার মালিকানা বদল নিয়ে চলছে তোলপাড়।

জানা গেছে, কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন সিলেটের আঞ্চলিক পত্রিকা ‘শুভ প্রতিদিন’-এর মালিক। ১৩তম বর্ষে পা রাখা এই পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকও তিনি। পত্রিকার মালিক দেখিয়ে সরওয়ার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেলেও তিনি দলীয় নির্দেশে সিলেট-৬ আসনে ডামি প্রার্থী হয়েছিলেন। আওয়ামী সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হওয়ায় তিনি এখন পলাতক। এরপরই গুঞ্জন উঠেছিল এই পত্রিকার মালিকানা বদলের। এই গুঞ্জনের পালে হাওয়া লাগে যখন সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর কার্যালয়ে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ লেখা সাইনবোর্ড সাঁটানোর পর।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সিসিকের প্যানেল মেয়র ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। এই ওয়ার্ডের হাউজিং স্টেট এলাকায় তার কার্যালয়। সম্প্রতি সেই কার্যালয়ে পত্রিকার নামে উঠেছে নতুন সাইনবোর্ড। তাই অনেকেই বলছেন, ক্ষমতার দাপটে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দখল করেছেন এই পত্রিকা। অনেকে আবার বলছেন মালিক সরওয়ার হোসেনে দল ক্ষমতায় নেই, তাই কয়েস লোদীকে সাময়িকভাবে চালাতে দিয়েছেন।

সরজমিনে দেখা যায়, কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সাইনবোর্ড খুলে ‘সম্পাদকীয় কার্যালয় শুভ প্রতিদিন’ সাইনবোর্ড লাগালেও এখনো পত্রিকা সংশ্লিষ্ট কোনো আসবাবপত্র বা অন্য কোনো সামগ্রী এখানে সাজানো হয়নি। কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকা অবস্থায় ভিতরে যে সাজসজ্জা ছিল এখনো তাই আছে। পত্রিকাটির কার্যালয় নগরীর নেহার মার্কেটে রয়েছে। 

প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মীদের মাধ্যমে জানা গেছে, কয়েস লোদী পলাতক সরওয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পত্রিকাটির সত্ত্ব নিজ নামে করে নিয়েছেন। বিদেশে অবস্থানরত প্রতিষ্ঠাকালীন একজন কর্মী বলেন, ‘পত্রিকাটি ডিএফপি তালিকাভুক্ত। সরকার বদলের সঙ্গে ডিএফপি তালিকাভুক্ত যাতে থাকে, এ জন্য মালিকানা বদল করা হয়েছে। এতে কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি।’

আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পত্রিকার মালিক বদলের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা সরওয়ার হোসেন একটি ডেন্টাল কলেজ ও একটি ওষুধ কোম্পানিরও পার্টনারশিপ মালিকানায় ছিলেন। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও কয়েস লোদী নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তার ওপর মামলাসহ রাজনৈতিক দমনপীড়নে ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন। 

সরওয়ার হোসেন পলাতক থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরিবার ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছেন, তিনি কয়েস লোদীর কাছে মালিকানা দিয়েই কানাডা পাড়ি দিয়েছিলেন। 

যোগাযোগ করলে বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী খবরের কাগজকে কেবল পত্রিকার মালিকানা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানি ও ডেন্টাল কলেজ সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। এগুলোতে প্রায় ৫৬ থেকে ৬০ জনের শেয়ার আছে।’

পত্রিকার বিষয়ে রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘পত্রিকাটি আমি অনেকদিন আগে কিনেছি। তাই এই পত্রিকার মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এটা উনি আমার কাছে বিক্রি করেছেন, অফিসিয়াল নিয়মনীতি মেন্টেইন করে। জেলা প্রশাসকের কাছে ডকুমেন্ট সাবমিট করে তারপর সেটির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে।’

কবে কিনেছেন পত্রিকা? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দিন তারিখ কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। অনলাইনের জন্য ডকুমেন্ট সাবমিট করা হয়েছে ঢাকায়। এটা এখনো ট্রান্সফার হয়ে আসেনি।’ 

ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতার পত্রিকার মূল মালিক বনে যাওয়া ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারির মালিকানা নেওয়ায় কয়েস লোদী বিতর্কের মুখ পড়েছেন। দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীরা এ বিষয়টি তলে তলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত হিসেবে দেখছেন। এরমধ্যে আঁতাত বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক নুরুল হক শিপু। 

তার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস সূত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘পালাবদলে সিলেটে কতকিছুর হাতবদল হচ্ছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতার এক মিডিয়ার হাতবদলে তলে তলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের এই পত্রিকাটির মালিকানা বদল হয়েছে ৫ আগষ্ট পরবর্তী বাস্তবতায়। এখন মালিক যিনি, তিনি সিলেট মহানগর বিএনপির সদ্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী।‘ 

ফেসবুক পোস্টটিতে আরও লেখা হয়, ‘আগের মালিক সরওয়ার হোসেন পলাতক। সরওয়ারের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রেখে মিডিয়া হাউসটি লিখিয়ে নিয়েছেন বিএনপি নেতা কয়েস লোদী। পলাতক সরওয়ার কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর আছে কয়েস লোদীর কাছে! সিলেটে এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রভাব হাইজ‍্যাক করে এখন বিএনপির হয়ে যাচ্ছে। এই দেশে কে বলে আওয়ামী লীগ নাই? তলে তলে সরওয়ার হয়ে কয়েস লোদীরাই টিকিয়ে রাখবে আওয়ামী লীগকে।...’

ফোনে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সাংবাদিক নুরুল হক শিপু খবরের কাগজকে বলেন, ‘কয়েস লোদী সম্প্রতি সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে আসীন হয়েছেন। যদি তিনি এ পদে না থাকতেন, তাহলে এ বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হতো না। এখন যেন ব্যাটে-বলে লেগে গেছে! বিষয়টি বিএনপি-আওয়ামী লীগে আঁতাতের উদাহরণ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে!’

শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে
ফাইল ফটো

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করে প্রায় ২৫টি সংস্থা। এর মধ্যে নিরাপত্তাক্ষেত্রে বেশির ভাগ দায়িত্ব পালন করছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক)। সম্প্রতি এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি বিনা নোটিশে দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এভসেকের বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় এভসেকের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে এপিবিএন। এতে সরকারি এ দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শাহজালালে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

তবে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেছেন, পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের সক্ষমতা বাড়লে সেখানে কর্মরত অন্য বাহিনীর সদস্যরা চলে যাবেন। 

গত ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বিমানবন্দর আর্মড পুলিশে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার জাকির হোসেনের করা জিডিতে বলা হয়েছে, ‘সকাল সোয়া ১০টার দিকে এভসেকে কর্মরত স্কোয়াড্রন লিডার তাসফিক তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে বলেন, ‘অ্যাপ্রোন এরিয়ার (অ্যাপ্রোন এলাকা হলো যেখানে বিমান পার্ক করা হয়, লোড-আনলোড করা হয়, রিফুয়েল করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়) ৩৩ নম্বর গেটে আপনাদের (এপিবিএন) অফিস থেকে মালামাল সরিয়ে ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে রাখা হয়েছে। আপনাদের পুলিশ পাঠিয়ে এগুলো নিয়ে যান।’

জিডিতে বলা হয়, ‘পরে তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগে না জানিয়ে কেন মালামাল সরিয়ে অন্যত্র রাখলেন- এমন প্রশ্নে এভসেকের ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশন সাইফুর রহমান জানান, বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম ও এভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার জাহাঙ্গীরের নির্দেশে এগুলো সরানো হয়েছে।’

জিডিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পরে তথ্য নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওই অফিসের প্রবেশমুখে বাম পাশে দেয়ালে লেখা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, এয়ার সাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল লেখা সাইনবোর্ডটি ভঙ্গুর অবস্থায় অফিসের ভেতরে রাখা হয়েছে। অফিসের ভেতরে সরকারি কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, ২০১০ সাল থেকে রক্ষিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্র নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি।’

জানা গেছে, এরই মধ্যে অ্যাপ্রোন এলাকায় থাকা এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি দখলে নিয়ে সেটিকে নিজেদের অফিস বানিয়ে ফেলেছে এভসেক। তবে এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া গেছে বিমানবন্দরে কর্মরতদের কাছ থেকে। 

বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘনিয়ে এলে এপিবিএনের সদস্যরা তাদের অস্ত্র ও দায়িত্ব রেখে পালিয়ে যান। ফলে ওই সময় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং শঙ্কা তৈরি হয়। পরে এভসেকের সদস্য বাড়িয়ে তাদের দিয়ে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সব কাজ করানো হয়। 

অন্যদিকে বন্দরের অন্য আরেকটি পক্ষের অভিযোগ, এভসেকের বাধায় এখন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এপিবিএন। শাহজালাল থেকে এপিবিএন সদস্যদের সরিয়ে দিতে এমনটি করা হয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

তবে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি এ অভিযোগের মধ্যে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি দুই সংস্থার এমন মুখোমুখি অবস্থান নিরাপত্তার জন্য যেমন শঙ্কা হয়ে দেখা দিতে পারে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।

এভিয়েশন বিশ্লেষক ড. কুদারাত-ই খুদা বলেন, ‘দুটি সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাড়তি অন্য কোনো সংস্থা থেকে নিরাপত্তার জন্য লোক আনার প্রয়োজন দেখি না।’

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি দুটি সংস্থার এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান কারও কাম্য নয়। এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে না থেকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিরাপত্তা আরও সুসংহত থাকবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিরাপত্তা ইস্যু আরও প্রশংসিত হবে। আমরা চাই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো একে অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করবে। সর্বশেষ আমি শুনেছি ৫ আগস্টের সময় দায়িত্ব নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল; তবে সে বিষয়ে তারা আলোচনা করে এখন দায়িত্ব ভাগ করে কাজ করছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে থাকা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই এটি রয়েছে। অথচ এখানে প্রায় ২৫-৩০টি সংস্থা নিজ নিজ এখতিয়ারে কাজ করে। এদের প্রত্যেকের পৃথক কমান্ড। এ কারণে মাঝে মাঝেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত একটি সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায় না আসবে, ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে।’

জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এভসেকে যে জনবল রয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাইরে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিমানবাহিনী থেকে ৫০০-এর বেশি জনবল নিয়োগ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৬০ জন, বাংলাদেশ পুলিশের ৭৯ জন শাহজালালে কর্মরত। এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৩ অক্টোবর আবারও ৩২৮ জনসহ আরও প্রায় এক হাজার জনের নিয়োগের মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চাওয়া হয়। 

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ জুন বিমানবন্দরে নিরাপত্তার কাজ শুরু করে আর্মড পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি চোরাচালান রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই সংস্থাটি। 

এপিবিএনের অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সক্ষমতার দিক থেকে আমরা আগে যেমন ছিলাম, এখনো তাই আছি। আমরা দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের সেটি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি পরিপত্র, আইকাও (আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা)-এর নিয়মাবলি যেভাবে রয়েছে, আমরা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখন কেন দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে এটি বোঝা যাচ্ছে না। অ্যাপ্রোন এরিয়ায় আমাদের যে অফিসটি ছিল, আমাদের না জানিয়ে সেটি তারা সরিয়ে ফেলেছে।’

এদিকে বিমানবন্দর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এভসেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা এপিবিএনের জিডির তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে যেহেতু দুটি সংস্থার মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাই তদন্তের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে পুলিশ অপেক্ষা করছে।

এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এখানে বিমানবাহিনীর সদস্যদের এনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারাই ডিউটি করে যাচ্ছেন। আমাদের কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এপিবিএন দায়িত্বে ফিরে এসেছে। আমাদের তিন কিলোমিটারব্যাপী এয়ারপোর্টের এরিয়া, যা সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার। বহিরাঙ্গনের যে নিরাপত্তা সেটির কাজ এপিবিএন করে যাচ্ছে।’

এপিবিএনকে আবার পুরোনো দায়িত্বে ফেরানো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সংস্থাই তো ভেতরে ডিউটি করতে চায়, সবাইকে তো সুযোগ দেওয়া সম্ভব না।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এভিয়েশন সিকিউরিটিকে আরও শক্তিশালী করা। আমাদের সক্ষমতা বাড়লে বিমানবন্দরে কর্মরত এপিবিএনসহ অন্য কোনো বাহিনীই থাকবে না। বর্তমানে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি এভিয়েশন সিকিউরিটির কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। আমরা আরও সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়োগ দিতে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো সিকিউরিটি কাজ করবে। একসময় এভিয়েশন সিকিউরিটি পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যরা চলে যাবে।’

চোরাচালান: গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরি

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ এএম
চোরাচালান: গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরি
সীমান্তে দেদার ঢুকছে মাদকসহ নানা ধরনের পণ্য। ফাইল ফটো।

চিহ্নিত অপরাধীদের গতিবিধি নজরদারি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণত সাদাপোশাকে গোয়েন্দা নিযুক্ত করে থাকে। এবার সীমান্ত এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাই উল্টো অপরাধী চক্রের নজরদারিতে। 

সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র‌্যাবের গতিবিধি নজরদারি (রেকি) করে মাদকসহ নানা ধরনের পণ্য দেদার চোরাচালান হচ্ছে। ‘রেকি’ তৎপরতা চালিয়ে পাচারের ‘রুট ক্লিয়ারেন্স’ দেওয়া হয়, তারপর শুরু হয় চোরাচালান। এ যেন গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাগিরি। 

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা বলেছেন, পাচারের রুট ও বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের আনাগোনার তথ্য জানাতে এসব দায়িত্বের জন্য চক্রগুলো নিজেরা ‘বেতনভুক্ত’ বিশ্বস্ত লোক নিয়োগ করে থাকে। মায়ানমারসংলগ্ন কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা টেকনাফ-উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ ভারতসংলগ্ন বেশ কিছু সীমান্ত এলাকায় এ ধরনের অভিনব তৎপরতা রয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে বিজিবির মুখপাত্র কর্নেল শরীফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্তে বিশেষ নজরদারির পাশাপাশি নিয়মিত যৌথ টহল ও অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপতৎপরতার খবর পেলেই বিজিবি অত্যন্ত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।’

যেসব কৌশলে ঢুকছে মাদকসহ চোরাই পণ্য
মায়ানমার সীমান্তে চোরাচালান চক্রের এক বা একাধিক সদস্য রুট পাহারা দিয়ে খোদ বিজিবি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলের ওপর নজরদারি করে থাকে। সেই সদস্য চোরাচালানের পণ্য বহনকারী আরেক চক্রকে যখন ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয় বা রুটটি নিরাপদ বলে জানায়, তখনই সেই চালানটি নিয়ে চক্র অগ্রসর হয়। মাদক কারবারিরা মায়ানমার সীমান্তে কক্সবাজারের নাফ নদী এবং ভারত সীমান্তে রাজশাহীর পদ্মা নদী এলাকায় আরও কিছু অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। 

প্রশিক্ষিত সাঁতারু রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচার চক্রে অংশ নিচ্ছে। এর বাইরে অন্যতম আরেকটি কৌশল হচ্ছে ককশিটের ভেতরে মাছের আড়ালে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইন ঢুকিয়ে ভেলার মতো ভাসিয়ে সীমান্ত পার করা। এই প্রক্রিয়ায় বহনকারী হিসেবে সাধারণত কিশোর বয়সীদের ব্যবহার হয়। এটি ভারত সীমান্তসংলগ্ন পদ্মা নদীতে বেশি হয়। এমনকি ওই সব এলাকায় এক ধরনের ‘চুঙ্গা’ (অতি সরু ভাসমান বাহন) ব্যবহার হয়, যার ভেতরে মাদকসহ মূল্যবান চোরাই পণ্য নিয়ে সীমান্তের এপারে আনা হয়।

সীমান্তের যেসব এলাকায় চক্রের তৎপরতা বেশি
মায়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাকারবারিদের অপতৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির তথ্য জানিয়েছেন টেকনাফের স্থানীয় সামাজিক একটি সংগঠনের নেতৃত্ব স্থানীয় এক ব্যক্তি। যার অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। খবরের কাগজের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপকালে নির্ভরযোগ্য ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে টেকনাফ সীমান্ত এলাকার মাদক-চোরাকারবারিরা তৎপর হয়ে উঠেছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিরাও প্রকাশ্যে চালাচ্ছে তাদের কারবার। বিশেষ করে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, খারাইঙ্গাঘোনা, কোণাপাড়া, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, কানজরপাড়া, নয়াবাজার, খারাংখালী, হ্নীলা, সাইটপাড়া, ওয়াব্রাং, এইচকে আনোয়ার প্রজেক্ট এলাকায় চোরাকারবারিদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মায়ানমার থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে মূলত ইয়াবা, আইসসহ অন্যান্য মাদক ও অস্ত্র আসে বাংলাদেশে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে খাদ্য ও কৃষিপণ্য পাচার হয়ে থাকে মায়ানমারে, যার মধ্যে তেল, মরিচ, সার অন্যতম। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা যা বলছেন 
বিজিবির উপমহাপরিচালক (মিডিয়া উইং) ও মুখপাত্র কর্নেল শরীফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন ছাড়াও সীমান্তে বাড়তি নজরদারি অব্যাহত রেখেছি। এর ফলে মাদকসহ নানা ধরনের চোরাচালানসামগ্রী উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উদ্ধার করা হচ্ছে। এর মধ্যে মায়ানমারের সীমান্ত এলাকাগুলোতে সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে।’ 

একই প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় আমরা সাধারণত যৌথ অভিযান পরিচালনা করি। সীমান্ত এলাকার মূল দায়িত্বে রয়েছে বিজিবি। আমরা বিজিবির সঙ্গে যৌথভাবে কিংবা কোনো ক্ষেত্রে তাদের অবগত করে মাদকসহ চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই।’ চোরাচালান চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নজরদারি করার জন্য সাদাপোশাকে নিজস্ব সোর্স নিয়োগ করে রেখেছে বলে খবর রয়েছে। এ সম্পর্কে কী জানেন জিজ্ঞাসা করলে মুনিম ফেরদৌস বলেন, ‘এ রকম খবর আমরাও পেয়েছি। আমরা সার্বিকভাবে অবগত হয়েই মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি।’

পরিসংখ্যান যা বলছে
বিজিবির সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান বলছে, গত অক্টোবর মাসে তাদের অভিযানে সীমান্ত এলাকা থেকে ৫ লাখ ৯০ হাজার ৯৭৭ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এ ছাড়া বিজিবি গত ১ মাসে ৩ কেজি ১৯৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ১১ কেজি ৮০২ গ্রাম হেরোইন, ২৬ হাজার ৫৯৯ বোতল ফেনসিডিল, ২১ হাজার ৬০৫ বোতল বিদেশি মদসহ বিপুল পরিমাণ মাদকজাতীয় পণ্য উদ্ধার করেছে।

সর্বশেষ শুক্রবার (৮ নভেম্বর) ফেনীর সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ কোটি ১৭ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্য আটক করা হয়েছে, যা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসে। 

এদিকে মাদকবিরোধী অভিযানে অন্যতম ভূমিকা রাখা র‌্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩ মাসে (৫ আগস্ট থেকে ৫ নভেম্বর) কেবল র‌্যাবের অভিযানে মোট ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া একই সময়ে ২১ কেজি ৫৪ গ্রাম হেরোইন, ৪ হাজার ৭৯০ কেজি গাঁজা এবং ৪৪ হাজার ৮৩৬ পিস ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে। এসব মাদক জব্দের পাশাপাশি মাদকসংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯০১ জনকে।