ছাত্র আন্দোলনে গুরুতর আহত ১৩ জন বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে এদের সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় পাঠানো হতে পারে। বাকি আটজনের চিকিৎসা দেশে বিদ্যমান ব্যবস্থায় করা সম্ভব বলে জানানো হয়েছে।
আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড গত ৩১ অক্টোবর এক সভা করে। সভায় প্রতি রোগীর বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও হালনাগাদ তথ্য বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। ওই দিনই মেডিকেল বোর্ড এই পাঁচজন রোগীকে বিদেশ পাঠানোর লিখিত সুপারিশ ঢামেক পরিচালকের কাছে জমা দেয়। ঢামেকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গত ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ওই সভায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তাক আহাম্মদ সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়া ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদ রায়হান, অর্থোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল ইসলাম আকন ও মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকারিয়া আল আজিজ উপস্থিত ছিলেন।
যাদের বিদেশ পাঠাতে সুপারিশ করা হয়েছে তারা হলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পাকুল্লা গ্রামের পরেশ চন্দ্র বালার ছেলে দীপংকর বালা (২৬), রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার কলিমোহর গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৩১), দিনাজপুর সদর উপজেলার জোতসাতনালা গ্রামের মো. রফিকুল ইসলামের ছেলে মো.হাফিজুর রহমান হাবিব (১৭), ময়মনসিংহের গৌরীপুরের শালীহর গ্রামের মো. নাজিম উদ্দিনের ছেলে মোশাররফ হোসেন (৪০)। আরেকজন রোগী আছেন। যাকেও বিদেশ পাঠানো লাগতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। তার অবস্থা এসব রোগীর তুলনায় কম গুরুতর। তাকে ফলোআপ করা হচ্ছে। ওই রোগীর পরিচয় নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
জানা গেছে, দীপংকর বালার বাম পায়ে গুলি লেগে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সেখানে চামড়া-মাংস কিছু ছিল না। অর্থোপেডিক সার্জনরা একধরনের এক্সটার্নাল ফিক্সেটর দিয়ে ফিক্সড করেন। পরে ওই জায়গা মাংস দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার পা এখনো ঠিক হয়নি। আরও কিছু সার্জারির প্রয়োজন আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, ‘একটা ইয়াং ছেলে। তার পা সম্পূর্ণ ঠিক হওয়া নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত। লম্বা সময় লাগবে। বিদেশে আরও উন্নত চিকিৎসা দেওয়া যায় কি না, আমরা বিবেচনা করছি। আমাদের চেয়ে আরও অ্যাডভান্স কান্ট্রিতে নিয়ে চিকিৎসা দিতে পারলে তার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
মোশাররফের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তার ডান পায়ের উরুতে গুলি লেগেছে। পায়ের প্রধান রক্তনালি ছিঁড়ে গেছে। আমাদের এখানে তাকে কৃত্রিম রক্তনালি দিয়ে গ্রাফ করা হয়। গ্রাফ করে প্রাইমারি কাজ চালু করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এই গ্রাফটা টেকেনি। রক্তনালি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়। তারা তার বিদেশ যাওয়া বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এই রোগীর বিষয়ে যতটুকু পেরেছি আমরা করেছি। বিষয়টা অনেক জটিল, বিদেশে গিয়েও পরিপূর্ণ সুস্থ হবে কি না, সেই বিষয়ে আমরা চূড়ান্ত কথা বলে তারপরেই পাঠাব।’
আরেকজন আনোয়ার হোসেন। চিকিৎসকরা জানান, তার কাঁধে গুলি লেগে ওপরের দিকে স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরি হয়েছে। যে কারণে তার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। চলাচল করতে পারে না। এরই মধ্যে তার পিঠেও একটি ঘা হয়। যেটি প্লাস্টিক সার্জারি করে ঠিক করা হয়। কিন্তু নিচের অংশ ঠিক হয়নি।
ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, ‘এটা খুবই জটিল। সারা পৃথিবীতে এর চিকিৎসা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি কেউ সুস্থতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আমাদের নিউরো সার্জন যারা আছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন।’
হাবিবের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, তার পিঠে গুলি লেগেছে। তারও স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরি হয়েছে। নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে পারে না। এরই মধ্যে তার পিঠে একটি ঘা হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার সেখানে প্লাস্টিক সার্জারি করা হবে। এটার বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত। বিদেশে নিয়ে স্টেমসেল থেরাপি দিয়ে দেখা যেতে পারে। স্টেমসেল থেরাপি দিলে কখনো কাজ হয় আবার কখনো কাজ হয় না। এটা অনেক ব্যয়বহুল।
এসব রোগীকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চললেও বিষয়টি জানেন না রোগীরা। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জানি না কী হবে। কত দিন থাকতে হবে। কত দিনে সুস্থ হব, কত দিনে হাঁটতে পারব। এভাবে থাকা ভীষণ কষ্টের।’
মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার যে উদ্যোগই নিক না কেন, যেন একটু দ্রুত নেয়। আমার ওপর আমার পরিবার নির্ভরশীল। আমি এভাবে বিছানায় পড়ে থাকলে আমার পরিবার শেষ হয়ে যাবে। তাদের পথে বসে যেতে হবে। আমার আয়ের ওপরই নির্ভর সাতজন। গার্মেন্টে কাজ করে ২০-২২ হাজার টাকা পেতাম, তা দিয়েই সংসার চলত। এখন আমাদের সবকিছুই অনিশ্চিত।