‘আমিও কইতে পারি না, এই আসামি কারা?’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক এক হত্যা মামলার আসামিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে খবরের কাগজকে কথাগুলো বলেন মামলার বাদী মো. রফিকুল ইসলাম। তার ভাই মো. সুজনকে হত্যার অভিযোগে ৭৯ জনের নাম উল্লেখ করে এই মামলা করেন তিনি।
শুধু তিনি নন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক বিভিন্ন মামলার আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মামলার আসামিদের চেনেন না। আবার অনেক আসামি জানিয়েছেন যে, মামলাসংশ্লিষ্ট ঘটনার সঙ্গে তাদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই, এমনকি আন্দোলনের সময় বা এর অনেক আগে থেকে বিদেশে অবস্থান করা ব্যক্তিদেরও এসব হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, এভাবে ঢালাও মামলা করার মাধ্যমে ঘটনাগুলোকে হালকা করে দেওয়া হচ্ছে, ফলে আন্দোলনে আত্মদানকারীদের অবদানকেই খাটো করা হচ্ছে। আবার সাধারণ মানুষও হেনস্তার শিকার হচ্ছে। সর্বোপরি দেশে-বিদেশে সবখানে দেশের দুর্নাম হচ্ছে।
মামলার বাদী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মো. সুজন ছিল আমার আপন ছোট ভাই। সে ট্রাকের হেলপার ছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সে মারা গেছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় করা এই মামলার ১৩ নম্বর আসামি ‘যুবলীগ নেতা মিলন চৈতা’, ৩২ নম্বর আসামি ‘আওয়ামী লীগ নেতা পীযুষ বাবু’ ও ৭০ নম্বর আসামি জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল (মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন)।
এ আসামিদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনারা কারা আমিও কইতে পারি না। আমি যে সময় মামলাটা করেছিলাম তখন আমার সঙ্গে জামায়াত ছিল, মোহাম্মদপুর থানার তখনকার ওসি ছিলেন। আমি তো আর এতটা শিক্ষিত না। নিজের নামটাও ঠিকমতো লিখতে পারি না। নাম-ঠিকানা কোনটা কীভাবে দিয়েছে, তা তো আর আমি জানি না। আমাকে চারদিন ঘুরিয়ে বলেছে, আপনার মামলা (প্রস্তুত) হয়ে গেছে। আপনি একটা সাইন দেন। পরে টেবিলে কাগজটা আনছে। তখন আমি কোনো রকমে সাইন করি।’
নিহতের পরিবার হিসেবে এরই মধ্যে তারা জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে ২ লাখ টাকা এবং আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া সরকারি সহযোগিতার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছেন বলেও জানান রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার এই মামলার বাদী।
শুধু শহুরে বাদী নন, গ্রামে বসবাস করা এক বাদী রুজিনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। রুজিনার সঙ্গে দৈনিক খবরের কাগজের কথোপকথন ছিল এমন:
‘মেয়র তাপস’ কে?
‘জানি না’
‘আপনার মামলার ৪ নম্বর আসামি। আরও প্রায় দেড় ডজন আসামির পরিচয়ে উনার সংশ্লিষ্টতা দেখানো হয়েছে।’
‘বোধ হয় বোরহান উদ্দিনের (ভোলা জেলার উপজেলা)’।
এই মামলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আসামিদের সংশ্লিষ্টতা বর্ণনা করা হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘মেয়র তাপসের সহযোগী ও অর্থদাতা’, ‘তাপসের সহযোগী’ ও ‘ভোট চোর মেয়র তাপসের সহযোগী’ ইত্যাদি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীতে তার স্বামী মো. মনিরকে হত্যার অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানায় এই মামলা করেন বাদী রুজিনা আক্তার। এই মামলায় মোট ২২৪ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১৭ জন আসামির পরিচয় দেওয়া হয়েছে সাবেক মেয়র তাপসের সঙ্গে জড়িয়ে। অথচ এই আসামিকেই তিনি চেনেন না! রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল পরিচিত সাবেক মেয়র তাপসকে যেমন মামলার বাদী চিনতে পারেননি, আবার আসামির তালিকায় ১৫০ নম্বরে থাকা অখ্যাত ব্যক্তি বেনজির আহমেদকেও চেনেন না বলে জানান ভোলার এই গৃহিণী।
তিনি বলেন, শুধু তার উপজেলা তজুমদ্দিনের আসামিদের তিনি চেনেন। অন্যদের নাম গুছিয়ে দিয়েছেন আইনজীবী।
এ বিষয়ে তার আইনজীবী ফারহানা আখতার (লুবনা) বলেন, একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন মামলা আমলে নেন, তখন তা বুঝেশুনেই নেন। মামলাটি আমলে নিয়েছেন আদালত। সুতরাং আইনত এটি ঠিকই আছে। মামলার বাদী আসামিদের চেনেন।
মামলায় নিহতের পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার আলতাফ আলী দফাদার বাড়ির জয়নাল আবেদীনের ছেলে। জানা গেছে, নিহতের বাবার নাম মূলত আবদুল মান্নান। এই বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শুভ দেবনাথ দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি নিহতের জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) বাবার নাম জয়নাল আবেদীন লেখা থাকলেও আসলে তার বাবার নাম আবদুল মান্নান। জয়নাল আবেদীন নিহতের দাদার নাম। এখান থেকে আমরা কাগজপত্রে তার বাবার নাম উল্লেখ করেছি জয়নাল আবেদীন ওরফে আবদুল মান্নান।
এই মামলার আসামিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীও আছেন। তারা বলছেন, মামলার বাদীকে না জানিয়ে এসব নাম লেখার কারণেই এমনটা হয়েছে। কারণ নিহতের বাবা এই মামলার বাদীর শ্বশুর। কোনোভাবেই তিনি শ্বশুরের নাম ভুল বলতেন না।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক আরেক ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। রাজধানীর আদাবর থানায় করা এই মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৫৬ ব্যক্তি ও সংগঠনকে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে এই মামলায়। মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামিদের মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এবং সাবেক এমপি সাকিব আল হাসানসহ বেশ কয়েকজন আসামি ঘটনার সময় বা তারও আগে থেকে বিদেশে অবস্থান করছিলেন।
এই বিষয়ে কথা বলতে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা বাদীর ফোন নম্বরে ফোন করলে অন্য একজন কল রিসিভ করেন। তিনি জানান, তার নাম মো. শিবলী আহমেদ। মামলার বাদী রফিকুল ইসলাম তার চাচা হন। রফিকুল ইসলাম শিক্ষিত নন, কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। মামলায় উল্লেখ করা ফোন নম্বরটি তারই (শিবলী)।
প্রমিত উচ্চারণে কথা বলা শিবলী জানান, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তা তিনিসহ কয়েকজন মিলে লিখে দিয়েছেন। কারও প্ররোচনা ছাড়াই এই নামগুলো দিয়েছেন তারা। মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের জন্য আবেদন করা হবে বলেও জানান তিনি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক আরেক হত্যা মামলার বাদী কোহিনূর আক্তার। তার ছেলে ইমরান হাসানকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য, তার মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকসহ ২৯৭ জনের নাম উল্লেখ করে এই মামলা করেন। এ ছাড়া আরও ২৫০-৩০০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয় মামলায়।
মামলায় ১১৯ নম্বর আসামি জাহাঙ্গীরের পরিচয় উল্লেখ করা আছে ‘তোফায়েল আহমেদের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে।’ ১৭৬ নম্বর আসামি মাহিনের পরিচয় লেখা আছে ‘ছাত্রলীগ নেতা’ এবং ১৭৭ নম্বর আসামি জুয়েলের পরিচয় উল্লেখ করা আছে ‘যুবলীগ নেতা’। এই দুজনের ফোন নম্বরও এজাহারে উল্লেখ করেছেন বাদী।
তবে যাত্রাবাড়ী থানার এই মামলার এসব আসামির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একজন গৃহিণী। যাত্রাবাড়ীতে থাকি না। আমি থাকি সোনারগাঁওয়ে। যাত্রাবাড়ীর আসামিদের নাম দিয়েছেন আমাদের সংগঠন থেকে।’
‘আপনাদের কোন পার্টি?’ –প্রশ্নের জবাবে কোহিনূর আক্তার বলেন, বিএনপি- জামায়াতের লোকজন নামগুলো দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক এক হত্যা মামলার ‘ঢালাও আসামি’ হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহামুদুল হক। তিনি জানান, মামলার বাদীর সম্মতি ছাড়াই তাকে এই মামলার আসামি করা হয়েছে।
গত ১৮ জুলাই রংপুরে মডার্ন মোড়ে অটোচালক মানিক মিয়া হত্যা মামলায় আসামি করা হয় সাংবাদিকতার এই শিক্ষককে। মামলার বাদী নিহত মানিক মিয়ার মা নুরজাহান বেগম।
মাহামুদুল হক জানান, কোটা আন্দোলনের সময় থেকেই তার অবস্থান ছিল কোটার বিরুদ্ধে। সেই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া তার পোস্টগুলো তার প্রমাণ। তিনি বলেন, যারা নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলায় আসামি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের উচিত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
এই শিক্ষক বলেন, মামলার বাদী এফিডেভিট করে আমিসহ ৭-৮ জন নিরপরাধ আসামিকে লিখিত দিয়েছেন যে, নামগুলো তিনি দেননি। এসব আদালতে জানানো হবে বা আইওকে দেওয়া হবে।
জানা গেছে, এই মামলায় নিহতের আপন মামা অর্থাৎ বাদীর আপন ভাইকেও আসামি করা হয়েছে।
শুধু রংপুরের এই শিক্ষক নন। খোদ রাজধানীতেও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা ব্যক্তিদের আসামি করার উদাহরণ আছে। তাদের একজন শামীমা সুলতানা।
মামলার বাদী এই নারী আসামিকে চেনেন না। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর সূত্রাপুর থানার সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে পাকা রাস্তার ওপর (লক্ষ্মীবাজারের অংশ) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গুলি চালালে মিছিলে থাকা সাগর মিয়ার পায়ে গুলি লাগে। এর ২ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান সাগর, এই অভিযোগে একটি হত্যা মামলা করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর দৈনিক খবরের কাগজে ‘মিছিলকারীরাও আসামি’ শিরোনামে দৈনিক খবরের কাগজে এই নিয়ে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই মামলার বাদী বাছিরুল ইসলাম খান। দৈনিক খবরের কাগজকে তিনি বলেছেন, তিনি কারও বিরুদ্ধে মামলা করেননি। তিনি তাদের চেনেন না। এ ছাড়া মামলায় এসব আসামির নাম তিনি দেননি। দিয়েছেন অন্য কেউ।
খবরের কাগজকে ওই বক্তব্য দেওয়ায় দেড় মাস পর গত বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) দৈনিক খবরের কাগজকে আবারও তিনি বলেন, ‘মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না ভাই।’
গৃহিণী শামীমা খবরের কাগজকে বলেছেন, মামলার ঘটনাস্থল সূত্রাপুরে তিনি জীবনেও যাননি। তাছাড়া তিনি ধানমন্ডি মোহাম্মদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অভিভাবক হিসেবে মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন। তার পরও কেন তাকে হত্যা মামলার আসামি করা হলো, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
একইভাবে নাটোরের সিংড়া থানার আজিজ, মুন্সীগঞ্জের সাঈদ শেখ, গাজীপুরের মোজ্জামেল হক কাকন এবং কেরানীগঞ্জের সরোওয়ার্দী শেখকেও এই মামলায় ঢালাও আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
সাকিব আল হাসানের মতো চেনাজানা মানুষ বিদেশে থেকেও যেমন আসামি, আবার অখ্যাত সাধারণ মানুষও আসামি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, গত ৫ আগস্টের পর দেশে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর সুযোগে কিছু মানুষ ফাঁদ পেতেছে। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোতে এমন কিছু মানুষের নাম আসছে আসামির তালিকায়, সাধারণ মানুকেও আসামি করা হচ্ছে এসব মামলায়। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এসব নিয়ে বাণিজ্য চলছে। জেনেছি এসব বন্ধে সরকার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এখনই এসব বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, এখন নামগুলো আসছে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে। এখানে বাদী আসামিকে সেভাবে না জেনেও আসামি করতে পারেন। তবে মূলত মামলার কার্যক্রম শুরু হবে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর। তবুও বলব, এভাবে না দিয়ে নাম সুনির্দিষ্টভাবে দেওয়া উচিত।