ফরিদপুর-৪ আসন থেকে টানা তিনবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী। নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে চটকদার বক্তৃতা আর হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করে তিনি লাইমলাইটে আসেন। প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। তার কথা বিশ্বাস করে ভোট দেন ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন এলাকার মানুষ। হারিয়ে দেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফরুল্লাহকে।
এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ক্ষমতা। শেখ পরিবারের আত্মীয় পরিচয়ে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। বাড়তে থাকে সম্পদের পরিমাণ।
অভিযোগ আছে, যে জমির দিকে তার চোখ পড়ত, কিছুদিন পর তিনি সেই জমির মালিক হয়ে যেতেন। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও নামমাত্র মূল্যে স্থানীয়দের তার কাছে জমি বিক্রি করতে হতো। কেউ দ্বিমত পোষণ করলেই তাকে নিক্সন চৌধুরীর বাগানবাড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস দেখাতেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাঙ্গার আজিমনগরের ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে নিক্সন চৌধুরী যে বাগানবাড়ি করেছেন, সেই জমিটিও নামমাত্র মূল্যে কিনেছিলেন। মহাসড়কের কাছাকাছি এসব ফসলি জমি বিঘাপ্রতি তিনি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকায় কিনে নেন। কিন্তু তখন জমির প্রকৃত মূল্য ছিল কেনা দামের চেয়ে তিনগুণ বেশি।
ভাঙ্গার সূর্যনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে নিক্সন চৌধুরীর বাগানবাড়ির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। এই সড়কের দুই পাশে হাজারেরও বেশি বিঘা ফসলি জমি আর কিছু খাস জমি তিনি দখলে নিয়েছেন। জায়গাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আয়মান আইল্যান্ড’।
এলাকাবাসী জানান, জমি দখলে নিতে নিক্সন চোধুরী বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখাতেন। তাদের বলা হতো, সেখানে হাসপাতাল, পার্ক ইত্যাদি গড়ে তোলা হবে। কিন্তু পরে তিনি মহাসড়কের পাশে, পদ্মা সেতুর কাছাকাছি জায়গাগুলো প্লট আকারে বিক্রি করতে শুরু করেন।
ওই এলাকার কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা জানান, আয়মান আইল্যান্ডের জন্য তাদের ফসলি জমি হারাতে হয়েছে। পরে তাদের বসতভিটাও চাওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক পালাবদল না হলে হয়তো বাড়িও ছেড়ে দিতে হতো।
সম্রাট শিকদার নামে ওই এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হতো।’
এমপি হওয়ার পর বাড়তে থাকে সম্পদ
জানা গেছে, মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী ১০ বছর আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন) আসন থেকে নির্বাচিত হন। ওই সময় ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তার নামে কোনো জমি ছিল না। বর্তমানে আজিমনগর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণপাড়ায় ২০৩৯ দশমিক ২৮ শতাংশ (২০ একর) জমির মালিক তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, এসব এলাকার অনেক হিন্দু পরিবারের জমি তিনি নামমাত্র দাম দিয়ে কিনে নেন। তারা বিভিন্ন সময় বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলেও তাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামার তথ্য সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গায় নিক্সন চৌধুরী প্রথম পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮) ৯৭৫ দশমিক ২৩ শতাংশ জমির মালিক হয়েছিলেন। পরের পাঁচ বছরে (২০১৮-২০২৩) ওই জমির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ১০৬৪ দশমিক ০৫ শতাংশ জমি। এখন ওই এলাকায় তার জমির পরিমাণ ২০৩৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিক্সন চৌধুরী ভাঙ্গার ব্রাহ্মণপাড়ায় নির্মাণাধীন দোতলা ভবনসহ সম্পদ দেখিয়েছিলেন ১৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ওই ভবনের দাম দেখানো হয়েছে ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পাশাপাশি নতুন করে একতলা অফিস রুম, মিটিং রুম, রান্নাঘর, ডরমেটরি, সিসি রাস্তা, সীমানা প্রাচীর ও পুকুরঘাট বাবদ আরও ৩৪ লাখ ৫২ হাজার টাকার সম্পদ দেখানো হয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার কৃষি জমির আর্থিক মূল্য দেখানো হয়েছিল ৩ কোটি ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৯১০ টাকা, যা পাঁচ বছরে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার ২৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৭ কোটি ৫৪ লাখ ১১ হাজার ১৬০ টাকায় দাঁড়ায়।
ফরিদপুরের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকায় নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রীর নামে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া তার নামে রয়েছে একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে নীপা পরিবহন লিমিটেড, রিতা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, স্বাধীন বাংলা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিসিং স্টেশন, এন ডেইরি ফার্ম, এন ডাক ফার্ম ও এন ফিশারিজ ফার্ম অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও তার বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে বলে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্পদ আর ক্ষমতার দাপটে নিজেকে তিনি অপ্রতিরোধ্য ভেবেছিলেন। ভিন্নমত দমনে তার আজিমনগরের বাড়িতে তৈরি করেছিলেন টর্চার সেল। তার কথা কেউ না শুনলে ওই বাগানবাড়িতে ধরে এনে শীতের রাতে পুকুরে চোবানো হতো। এর সঙ্গে চলত শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা কখনই মুখ খোলার সাহস পেতেন না। মাদারীপুরের শিবচরের লোকজন তার এই বাড়ি পাহারাদারের মতো ঘিরে বসে থাকতেন। শুধু এলাকাবাসী নয়, স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও ভয়ে নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতেন না।
শেখ পরিবারের পরিচয়ে অপ্রতিরোধ্য
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর ছেলে এবং সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের ছোট ভাই নিক্সন। শুধু শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাত্র ১৯ দিন আগে এসে ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্যবনে যান। ২০২০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন নিক্সন। এ পদ দিয়েই সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় পরিচয়ে এলাকায় হয়ে ওঠেন এক এবং অদ্বিতীয় নেতা। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও তার ছিল ব্যাপক প্রভাব। বিভিন্ন ভাবে ম্যানেজ করে তার পক্ষে এক প্রবাসীকে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ নিয়ে দেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদকের পদ পান তারই প্রতিদ্বন্দ্বী কাজী জাফরউল্লাহর এক কর্মী। দুজন ভাগ করে নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ।
তখন কথা ওঠে দলের ত্যাগী নেতা-কর্মী জেলায় থাকার পরও কেন ‘অযোগ্যদের’ হাতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ তুলে দেওয়া হলো? এ ক্ষেত্রে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তখন কথা বলে জানা যায়, দুজনকে এ পদ পাইয়ে দিতে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ঠিক একই ভাবে জেলা যুবলীগের কমিটিতেও ভাগ বসান নিক্সন।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে নিক্সন চৌধুরী পলাতক রয়েছেন। এরই মধ্যে আদালত থেকে তার দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় তার নামে মামলা হয়েছে। তবে এখনো তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয় অনেকেই তার সীমাহীন অত্যাচারের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তার পরও তারা নিক্সন ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন।
তারা বলছেন, নিক্সনের অনেক টাকা। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজা। তিনি হয়তো সব কিছু ম্যানেজ করে আবার ভাঙ্গায় ফিরে আসবেন।