বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল গান বাংলার চেয়ারম্যান ও সুরকার, সংগীতপরিচালক কৌশিক হোসেন তাপসকে হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে তাপসকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির উত্তরা-পূর্ব থানার পুলিশ।
সোমবার (৪ নভেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুজ্জামানের আদালতে হাজির করা হলে তাপসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপস্থিত না থাকায় আগামীকাল ৬ নভেম্বর রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
মিডিয়া অঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত কৌশিক হোসেন তাপস। তার ব্যাপারে জানতে যত গভীরে যাওয়া হচ্ছে ততই বেরিয়ে আসছে কুকীর্তির কথা। মিডিয়া মাফিয়া তাপস সংগীতাঙ্গনকে যেভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন, তা নজিরবিহীন। তার দখল করা ‘গান বাংলা চ্যানেলে’ গানের আড়ালে চলত রঙ্গলীলা। দেশি-বিদেশি অভিনেত্রী-শিল্পীদের ব্যবহার করা হতো প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী ও আমলাদের মনোরঞ্জনের জন্য। বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগী নারীরা এসব বিষয়ে তাপসের বিরুদ্ধে যথাযথ স্থানে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু ওপরের মহলের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত তাপস সব সময় ছিলেন অধরা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে তাপসের সাজানো বাগানেও ধস নামে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে তাপসের কুকীর্তির ফিরিস্তি জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের আমলে জিরো থেকে হিরো হন তাপস। নিজের স্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের থেকে নিয়েছেন সুবিধা, বিনিময়ে তাদের টাকাও বিদেশে পাচার করেন এই দম্পতি।
তাপসের উত্থান:
২০০৬-০৭ সালের দিকে একটি টেলিভিশনে প্রোগ্রামের আয়োজন করেন তাপস। এর মাধ্যমে মিডিয়াতে কাজ শুরু করেন তিনি। সখ্য বাড়ে মিডিয়া অঙ্গনে ও সংগঠনে। এই সুযোগে পরিচয় হয় মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা করা এক ব্যক্তির স্ত্রী ফারজানা মুন্নির সঙ্গে। যিনি রূপচর্চা ও ফ্যাশন এক্সপার্ট হিসেবে পরিচিত। তাপসের কথায় ও গিটারের সুরে মুগ্ধ হন মুন্নি। সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের তথাকথিত ভাতিজি মুন্নি প্রেমে পড়েন তাপসের। আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে তাপসকে বিয়ে করেন যুব মহিলা লীগের নেত্রী মুন্নি। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিউটিশিয়ান হিসেবেও নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন মুন্নি। এভাবে আওয়ামী লীগের অঙ্গনে তাপসের প্রবেশ ঘটে।
লোটাস কামালের প্রভাব খাটিয়ে মিডিয়া অঙ্গনে নিজেকে মাফিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তাপস। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবৃত্তিশিল্পী রবিশঙ্কর মৈত্রীর গান বাংলা চ্যানেলটি দখল করেন তাপস। রবিশঙ্করকে সপরিবারে প্রাণনাশের হুমকি দেন তাপস। সেই ভয়ে সপরিবারে দেশ ত্যাগ করেও শাস্তি পেতে হয় তাকে। ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল তাপস প্রভাব খাটিয়ে রবিশঙ্করের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এই নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর খোলা চিঠিও দিয়েছেন রবিশঙ্কর। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। দখল করা গান বাংলার মাধ্যমে মিডিয়া জগতে আধিপত্য শুরু হয় তাপসের।
প্রভাবশালীরা ছিলেন তাপসের ঘনিষ্ঠ:
কুরুচিপূর্ণ বাংলা গানের মূল হোতা তাপস গণভবনে যাতায়াত করা ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। বিদেশ থেকে নারী অভিনেত্রী ও শিল্পীদের দেশে এনে গানের আড়ালে প্রভাশালীদের মনোরঞ্জেনের কাজে লাগাতেন তিনি। বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশি শিল্পীরা যাতে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারেন সে লক্ষ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও শেখ হাসিনার সাবেক উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসের খুরশিদ আলমের সঙ্গে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেহব্যবসার জাল বিস্তার করেছিলেন তাপস। কর ফাঁকি দিয়ে গান বাংলার নাম করে ইউক্রেন-রাশিয়া-ইন্ডিয়া-দুবাই থেকে নারী এনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনে পাঠাতেন তিনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একাধিকবার বিদেশি কয়েকজন নারীকে আটকে দিয়েছিল পুলিশ। তখন শাহরিয়ার ও খোকনকে ফোন করে তাদের ছাড়িয়ে নেন তাপস।
তাপসের সঙ্গে দেশের আর্থিক খাতের মাফিয়া সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের অপকর্ম চালিয়ে গেছেন তাপস। ২০২২ সালে নিজের মেয়ের বিয়েতে নাচাতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে সাবেক পর্নো তারকা সানি লিওনকে ঢাকায় আনেন। এতে পরোক্ষ সহযোগিতা করেন প্রভাবশালী সালমান এফ রহমান। কলকাতার নুসরাত জাহান, মিমি চক্রবর্তীসহ অনেকে তার মেয়ের বিয়েতে যোগ দেন। বলিউড নায়িকা নার্গিস ফাখরিও তার হাত ধরে ঢাকায় এসেছিলেন। এসবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জন করা।
বিদেশি শিল্পীদের দেশে আনার পেছনে বড় একটা কারণ ছিল তাপস-মুন্নির। তাদের আনা-নেওয়ার মাধ্যমে প্রভাবশালীদের মোটা অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করতেন এই দম্পতি।
তাপসের কাজ হাতিয়ে নেওয়ার স্টাইল:
তাপসের স্ত্রী মুন্নি শেখ হাসিনার বিউটিশিয়ান হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মুন্নির ওঠাবসা ছিল। সেটাকেই কাজে লাগান তাপস। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক অনুষ্ঠানে যাতায়াত শুরু করেন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে গেলে নানা কায়দায় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন তাপস। তা আবার ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করতেন। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাগিয়ে নিতে তিনি এসব কৌশল প্রয়োগ করেন।
আওয়ামী লীগের আমলের সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন মিডিয়া মাফিয়া তাপস। এই সুবাদে মুজিববর্ষের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান একক নিয়ন্ত্রণে নেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আয়োজিত লাল-সবুজের মহোৎসব ও ২০২২ সালে চট্টগ্রাম-বরিশালে ‘জয়বাংলা উৎসব’ নামে একাধিক কনসার্ট করেন তাপস। বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকারা এসব অনুষ্ঠানে পারফরম্যান্স করতেন। সেখানে সালমান এফ রহমান, স্থানীয় মেয়র ও প্রভাবশালী নেতারা অতিথি থাকতেন। কনসার্টে অংশ নেওয়া শিল্পীদের বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশ নিজের পকেটে নিতেন তাপস। এভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তাপস।
আইসিটিতে তাপসের থাবা:
নারী সাপ্লাই দিয়ে সরকারে উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী-সচিবদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন তাপস-মুন্নি দম্পতি। তাদের দুজনের সঙ্গে সখ্য ছিল সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের। এই মন্ত্রণালয়ে সরকারি সব কাজেও তাপসের হাত ছিল। বিশেষ করে তার পছন্দের ব্যবসায়ীদের মন্ত্রী পলকের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতেন। এভাবে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দিতেন তাদের। বিনিময়ে কাজের মোট টাকার নির্দিষ্ট একটি পার্সেন্টিস পেতেন তাপস। সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মো. এ আরাফাতের সঙ্গেও তাপসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
উঠতি গায়িকারা ছিলেন তাপসের হাতে বন্দি:
নাইটক্লাবের মতো রাত যত গভীর হয় তাপসের গান বাংলা টেলিভিশন তত বেশি জমজমাট হয়ে উঠত। মধ্যরাতে অফিসে প্রবেশ করতেন তাপস ও মুন্নি। রাত গভীর হলেই গান বাংলার অফিসে উঠতি বয়সী গায়িকা এবং দেশের খ্যাতনামা অভিনেত্রীদের আনাগোনা বাড়ত। উঠতি বহু গায়িকা ছিল তাপসের হাতে বন্দি। তাপসের ইশারায় এই শিল্পীরা প্রভাবশালী নেতা ও আমলাদের মনোরঞ্জনে নিয়োজিত ছিল। এই শিল্পীদের মিডিয়া অঙ্গনে তাপসের গায়িকা হিসেবে ডাকা হতো। বিনিময়ে গায়িকাদের নিজের টেলিভিশনে ও কনসার্টে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিতেন তাপস। দেশের বিখ্যাত গানগুলো বিকৃত করেছেন সেসব গায়িকারা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঠিক চার দিন আগে নিজের খোলস পাল্টেছেন সমালোচিত এই তাপস। নিজের ফেসবুক পেজের প্রোফাইল ও কাভার পিকচার লাল করে ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন তিনি। তার অপকর্মের কারণে শেষ রক্ষা হয়নি তাপসের। গতকাল তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে।
উত্তরা পূর্ব থানার উপপরিদর্শক মো. মহিবুল্লাহ অভিযুক্তের সাত দিনের রিমান্ড আবেদনে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে হত্যাচেষ্টার অভিযোগের মামলায় তাপসের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাকে জামিন দেওয়া হলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, তদন্তে ব্যাঘাতসহ আসামির দেশত্যাগেরও শঙ্কা রয়েছে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সক্রিয় এই কর্মী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের দমনে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও উসকানি দিয়েছেন। মামলার আলামত উদ্ধার করতে এবং জড়িত বাকি আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার জন্য আসামিকে পুলিশি হেফাজতে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এ সময় তাপসের আইনজীবী তার রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করলেও আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গত ২৯ অক্টোবর ইশতিয়াক মাহমুদ নামের এক ব্যবসায়ী পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১২৬ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। এ মামলাতেই তাপসকে ৯ নম্বর আসামি করা হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত ১৮ জুলাই ইশতিয়াক মাহমুদ ব্যবসায়ী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের আজমপুর নওয়াব হাবিবুল্লাহ হাইস্কুলের সামনে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ হামলা চালায় এবং গুলিবর্ষণ করে। এ সময় ইশতিয়াকের পেটে গুলি লাগে। তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।