‘আগে রাত হলেই পাড়া-মহল্লায় পুলিশের টহল ও আনাগোনা দেখা যেত। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা আড্ডা দিতেন, তারা গল্প করার পাশাপাশি মহল্লার নানা খোঁজখবর নিতেন। এতে করে মনে একটা সাহস বা স্বস্তি কাজ করত। এখন আর কাউকেই দেখা যায় না। রাত হলে এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের আতঙ্ক বাড়ে।’
কথাগুলো বলেছেন রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার জেরিন নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক মো. ইয়ানুস আলী। কেবল তিনি নন, একই বিষয়ে আলাপকালে প্রায় অভিন্ন মন্তব্য পাওয়া গেছে আরও কয়েকজনের কাছ থেকেও। আলাপকালে তারা বলেছেন, পুলিশের সামাজিক নেটওয়ার্ক হিসেবে পরিচিত ‘কমিউনিটি পুলিশিংয়ের’ মাধ্যমে আগে পাড়া-মহল্লার স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করত থানা পুলিশ। কিন্তু জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনীর আগের কাঠামোর পাশাপাশি ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, বিগত সরকারের সময়ে কমিউনিটি পুলিশের সঙ্গে কাজ করতেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী। কিন্তু সরকার পতনের পরই তাদের বেশির ভাগ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেকেই এখন আত্মগোপনে। তবে বিএনপি বা অন্য কোনো সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এখনো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি। ফলে কমিউনিটি পুলিশে লোকবল বলতে এখন আর কিছুই নেই।
জানা গেছে, মূলত লোকবল সংকটের কারণেই কমিউনিটি পুলিশের ধারণা তৈরি হয়েছিল। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে আনুপাতিক হিসেবে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। সংশ্লিষ্টদের হিসাবমতে, গড়ে ৮১২ নাগরিকের জন্য দায়িত্বে রয়েছেন একজন মাত্র পুলিশ সদস্য। অথচ ভারতে এবং উন্নত বিশ্বে পুলিশ সদস্যের এই আনুপাতিক হার চার থেকে পাঁচগুণেরও বেশি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, “কমিউনিটি পুলিশিং এখন প্রায় পুরোপুরি বন্ধ আছে। কমিউনিটি পুলিশের আগে যেসব কমিটি ছিল, সেগুলোর আর অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া ওই সব কমিটির প্রধান বা মূল ব্যক্তিদের নিয়েও আগে স্বেচ্ছাচারিতা বা পক্ষপাতের অনেক অভিযোগও ছিল। সবমিলে কমিউনিটি পুলিশিং নতুন করে আর সচল করা হয়নি। তবে বর্তমানে পুলিশের উদ্যোগে ‘নাগরিক কমিটি’ বা সিটিজেন ফোরাম নামে নতুন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।”
নাগরিক কমিটি সম্পর্কে ডিসি তালেবুর রহমান বলেন, ‘এটি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো নয়, নাগরিক কমিটির কাজ মূলত পুলিশকে পরামর্শ ও মতামত দিয়ে সহায়তা করা। সবেমাত্র কাজটি শুরু হয়েছে। নাগরিক কমিটি সংশ্লিষ্ট থানার আওতাধীন সমাজের গণমান্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। থানা পুলিশ তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে মতবিনিময়সহ নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।’
এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি জানতে গত শনিবার (৭ ডিসেম্বর) কথা হয় ডিএমপির একাধিক থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) সঙ্গে। তাদের মধ্যে তেজগাঁও থানার ওসি মো. মোবারক হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার থানার আওতায় বর্তমানে নাগরিক কমিটি বা সিটিজেন ফোরামের কার্যক্রম চলছে। এটি পুলিশের নতুন উদ্যোগ। যে উদ্যোগের মধ্যে আমরা নাগরিকদের কাছ থেকে প্রত্যাশাগুলো জানতে চাচ্ছি। পুলিশের দৈনন্দিন কাজের বিষয়েও পরামর্শ নিচ্ছি। গত ৫ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানার হলরুমে দলমত নির্বিশেষে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। যেখানে সাংস্কৃতিক কর্মী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, শিক্ষক, একাধিক ধর্মীয় নেতাও অংশ নেন।’ তিনি বলেন, ‘আগে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে পুলিশ জনগণের কাছে গিয়ে পাড়া-মহল্লার নানা তথ্য সংগ্রহসহ অভিযানিক সহায়তা নিত। বর্তমানে এ কাজগুলো পুরোপুরি বন্ধ আছে। তবে শিগগিরই এ-জাতীয় পুলিশিং আবারও শুরু হবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।’
একই বিষয়ে আলাপকালে রামপুরা থানার ওসি আতাউর রহমান আকন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সমাজের সম্মানিত নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে আমরা ইতোমধ্যেই নানা বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। জনগণ আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করলে আমরাও সহজেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন ঘটাতে পারব।’
এ বিষয়ে সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অপরাধের যে ধরন ও বাস্তবতা, সে অনুসারে সমাজের সহযোগিতা বা ভূমিকা ছাড়া পুলিশের একার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য কমিউনিটি পুলিশিং খুবই কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত সময়ে অনেক ক্ষেত্রে এই কমিউনিটি পুলিশিং রাজনৈতিক প্রভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করেছে বলে আমরা জানতে পারি। ফলে রাজনৈতিক গুরুত্ব না দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কমিটিতে রেখে কমিউনিটি পুলিশিং করা গেলে খুব ভালো ফল পাওয়া যাবে।’
ঢাবির সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে বর্তমানে জমিজমা দখল বা মালিকানা বিরোধ, কিশোর অপরাধ, চুরি, ছিনতাই, মাদকসহ নানা সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত কমিউনিটি পুলিশিং অথবা এই বৈশিষ্ট্যের কোনো ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করা গেলে সমাজের অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং অবশ্যই প্রয়োজন। এর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পুলিশের কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটা আছে। সেটা যেকোনো নামে বা ‘ফরম্যাটে’ হতে পারে। কারণ একটি দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য বিরাটসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা সম্ভব হয় না। তখন পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হয়। তাছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করলে বড়সংখ্যক পুলিশের প্রয়োজনও হবে না।’
নুরুল হুদা আরও বলেন, ‘কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। জনগণের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক থাকলে অপরাধসংক্রান্ত আগাম তথ্য পাওয়া যায়, তাতে করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আবার কোনো অপরাধ ঘটে গেলেও তদন্তে ভালো সহযোগিতা পাওয়া যাবে। ফলে কমিউনিটি পুলিশিং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ।’
৮১২ নাগরিকের জন্য পুলিশ সদস্য মাত্র ১ জন: পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সর্বশেষ আদম শুমারি অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার (১৭৩.৫২ মিলিয়ন)। অপরদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ পুলিশে বর্তমানে মোট জনবলের সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৪। সে হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ৮১২ জন নাগরিকের জন্য পুলিশ সদস্য মাত্র ১ জন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বৃহৎ জনসংখ্যার আনুপাতিক হিসেবে পুলিশ সদস্য অপ্রতুল। তাই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো যেকোনো ব্যবস্থায় জনগণকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে না পারলে পুলিশের একার পক্ষে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কমিউনিটি পুলিশিং কী: বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট পিলের গণমুখী পুলিশিং এর মূলনীতি থেকেই মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা আসে। কমিউনিটি পুলিশিং হচ্ছে অপরাধ সমস্যা সমাধানে পুলিশ ও জনগণের যৌথ অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার একটি পুলিশিং দর্শন। বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে র্কাযকরভাবে অপরাধ প্রতিরোধের জন্য কমিউনিটি পুলিশিং ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং যেভাবে শুরু: ১৯৯৪ সালে দেশে প্রথম কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা থেকে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়। তৎকালীন ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম শহীদুল হক, যিনি পরবর্তী সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন। তিনিই মূলত এই ব্যবস্থার বিকাশ ঘটান। সে সময় ময়মনসিংহে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় চুরি, ছিনতাই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৎকালীন এসপি আহমাদুল হক গঠন করেন ‘টাউন ডিফেন্স পার্টি’। এটি মূলত কমিউনিটি পুলিশিংয়ের একটি অংশ। ঠিক সে সময়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম শহীদুল হক কমিউনিটি পুলিশিং নিয়ে কাজ শুরু করেন, যা পরবর্তী সময় ডিএমপিসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ড অপরাধ প্রতিরোধ তথা অপরাধ যাতে ঘটতে না পারে সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে।