গত জুনে হওয়ার কথা থাকলেও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনায় অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) এখনো অনুমোদন হয়নি। যে কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উন্নয়নসংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় কিছু কিছু সংকট ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। দ্রুত ওপি অনুমোদন না হলে সামনে আরও সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ আশাবাদী, সংকট উত্তরণে সরকারের কোনো না কোনো পরিকল্পনা রয়েছে। তবে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ওপি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে হতে পারে অনুমোদন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওপি অনুমোদন না হওয়ায় জুলাই থেকে বেতন পাচ্ছেন না সারা দেশের ১৪ হাজার কর্মরত কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)।
বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার হোগলাবুনিয়া ইউনিয়নের বদনিভাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘চার মাস হলো বেতন পাই না। কবে নাগাদ যে বেতন পাব তারও কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। জিনিসপত্রের যে দাম, ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। কতদিনই বা ধারদেনা করে চলব। এভাবে মাসের পর মাস চলাও কষ্টকর। কী যে করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কবে নাগাদ বেতন পাব তাও যদি জানতে পারতাম, তাহলেও একটু নিশ্চিন্ত হতাম।’
কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি ডা. আবু মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকের যারা আছেন, আশা করি তারা জানুয়ারিতে গিয়ে বেতন পাবেন। ওপি অনুমোদন না হওয়ার কারণে তাদের বেতন হচ্ছে না। আশা করি, দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা সময় যেটা করা হতো, তা হলো আগে প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান (পিআইপি) অনুমোদন হতো। তারপর ওপি হতো। কিন্তু মাঝখানে তারা এটা উল্টে আগে ওপি অনুমোদন দিয়ে তারপর পিআইপি অনুমোদন দিত। এখন আবার সেই আগের মতোই পিআইপি অনুমোদন হবে। তারপর ওপি অনুমোদন। নভেম্বরে হয়তো পিআইপি অনুমোদন হবে। তারপর ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে ওপি অনুমোদন হবে। আশা করি, কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত সিএইচসিপিরা জানুয়ারিতে বেতন পাবেন। ওপি অনুমোদনে বিলম্ব হওয়ায় শুধু সিএইচসিপিরা নন, ওপিসংশ্লিষ্ট সবাই সমস্যায় আছেন।’
সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘শিশুদের টিকা, জরুরি ওষুধ, নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন ইত্যাদি জরুরি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত ওপি অনুমোদন করা উচিত।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক শেখ দাউদ আদনান বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে ওপি অনুমোদন হয়ে চলে আসে, এবার এখনো আসেনি। আমরা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে সাহায্য চাচ্ছি। সরকারও নিশ্চয়ই একটা উদ্যোগ নেবে। সরকারের একটা পরিকল্পনা অবশ্যই আছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ ১২টি ওপির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সেগুলো হলো কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি), নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি), হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (এইচএসএম), অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি), লাইফস্টাইল অ্যান্ড হেলথ এডুকেশন (এলঅ্যান্ডএইচএ), টিবি লেপ্রোসি অ্যান্ড এসডিটিএইডস প্রোগ্রাম (টিবিএল অ্যান্ড এএসপি), কমিউনিটি ক্লিনিক অ্যান্ড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি), পিএমআর (প্রাইমারি হেলথ কেয়ার), হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড ই-হেলথ, উপজেলা হেলথ কেয়ার (ইউএইচসি), ন্যাশনাল নিউট্রেশন সার্ভিস (এনএনএস) এবং ম্যাটারনাল, নিউবর্ন, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলোসেন্ট হেলথ (এমএনসিঅ্যান্ড এইচ)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওপি অনুমোদন না হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য খাতের সব এমএসআরের (মেডিকেল সার্জিক্যাল রিক্যুইজিট) কেনাকাটা। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে টিকাদান, কৃমি নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন ‘এ’ ক্যাম্পেইন, সাপেকাটা রোগীদের অ্যান্টিভেনম, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়ার, র্যাবিস (কুকুরে কামড়ানোর প্রতিষেধক) টিকা, হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের টিকা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা কেনা । ফলে বিগত অর্থবছরে কেনা টিকার মজুত ফুরিয়ে গেলে দেশের মানুষকে এসব টিকা বাজার থেকে কিনে ব্যবহার করতে হবে। তবে এগুলোর দাম অনেক বেশি হওয়ায় সবার পক্ষে সেটা সম্ভব হবে না।
কোভিড মহামারি, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ, বন্যা, খরা ও শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থা করা হয় ওপির টাকা দিয়ে। এবার ওপি অনুমোদন না হওয়ায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়েছে। আসন্ন শীতকালের রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া, নিপাহ, সিওপিডি (ক্রনিক অবসট্রাকক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ), শিশুদের নিউমোনিয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। মুখ থুবড়ে পড়বে মরণব্যাধি এইডস ও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। এতে এই ভয়াবহ রোগগুলো ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
ওপি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরামর্শক ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, ‘নতুন ওপি না হওয়া পর্যন্ত রোগীর স্বার্থে পুরোনো ওপির বরাদ্দ অব্যাহত রাখতে হবে। না হলে বড় রকমের সংকট তৈরি হবে।’
ওপি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর।