পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হতে যাচ্ছে চলতি নভেম্বরে। নতুন রেলপথ চালু হলে পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেনগুলোকে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া-দর্শনা দিয়ে খুলনা যেতে হবে না, ভাঙ্গা-মধুমতী সেতু-যশোর হয়ে খুলনা যাবে।
ঢাকা থেকে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া হয়ে বর্তমানে খুলনার দূরত্ব ৪১২ কিলোমিটার, পৌঁছতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্প চালু হলে এই দূরত্ব ১৭৫ কিলোমিটার কমে গিয়ে হবে ২৩৭ কিলোমিটার। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা। অন্যদিকে ঢাকা থেকে যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমান দূরত্ব ৩৫৬ কিলোমিটার, পৌঁছতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু দিয়ে ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথের কারণে ১৮৪ কিলোমিটার কবে যাবে। সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. আফজাল হোসেন গতকাল বুধবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা আগামী ২০ নভেম্বরের মধ্যে একটা তারিখ নির্ধারণ করে ফেলছি। পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প পুরোদমে চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এ মাসে। স্টেশনে এখন সিগন্যাল সিস্টেমের কাজ চলছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই সেটি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। নতুন রেলপথ এ মাসেই উদ্বোধন হবে।’
নতুন রুট চালু হওয়ার পর যশোরের পদ্মবিলা রেল জংশন দিয়ে ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের। তবে বাঘারপাড়া উপজেলার এই স্টেশনটি যশোর মূল শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। এ কারণে পদ্মবিলা জংশনের পরিবর্তে যশোর জংশন হয়ে ট্রেন চলাচলের দাবি জানিয়েছে বৃহত্তর যশোর রেল যোগাযোগ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি।
মো. আফজাল হোসেন বলেন, যেসব ট্রেন বেনাপোল যাবে সেগুলো তো যশোর স্টেশন হয়েই চলাচল করবে। যাত্রীরা বঞ্চিত হবেন না। আর যে ট্রেনগুলো খুলনা যাবে সেগুলো পদ্মবিলা জংশন ঘুরে যাবে। এর কারণ খুলনার ট্রেনগুলো যশোর স্টেশন গেলে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে খুলনা যেতে হবে। এতে ৪০ মিনিট থেকে কখনো কখনো এক ঘণ্টা সময় বেশি সময় লাগবে। এতে যাত্রাপথে সময় বাড়বে। সেদিক বিবেচনায় পদ্মবিলা হয়েই খুলনার ট্রেনগুলো চলাচল করবে। এ ছাড়া এখন যশোর থেকে খুলনার দিকে নতুন রেলপথ নির্মাণ করতে গেলে অনেক মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙতে হতো, জমি ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর উদ্বোধন হয় পদ্মা রেলসেতু প্রকল্পের। তখন ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটারের রেলপথ চালু করা হয়। এখন ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে যশোরের ১৬৯ কিলোমিটারের রেলপথে সরাসরি যোগাযোগ চালু হতে যাচ্ছে। নতুন রেলপথে ভাঙ্গা থেকে যশোরের দূরত্ব ৯৫ কিলোমিটার, যশোর থেকে খুলনার দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার।
২০১৬ সালের ৩ মে একনেক সভায় পদ্মা সেতুর ওপর রেললাইন স্থাপনে ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটির জন্য প্রস্তাবিত ৩১৩ কোটি ডলারের চীনা ঋণের চূড়ান্ত চুক্তি করতে বিলম্ব হওয়ায় সময়মতো কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। চীন প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার কথা জানায়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণচুক্তি করে।
২০১৮ সালের ২২ মে একনেক সভায় প্রকল্পটির ব্যয় ৪ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা করা হয়। মূলত জমি অধিগ্রহণে জমির দাম তিন গুণ হয়ে যাওয়ায় ব্যয় বেড়ে যায়। আর মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর করোনাভাইরাস মহামারিতে কাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হলে দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পদ্মা সেতু দিয়ে মাত্র চারটি ট্রেন চলছে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে তিন আন্তনগর ট্রেন—খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস, বেনাপোলগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ও রাজশাহীগামী মধুমতী এক্সপ্রেস চলছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেন নকশিকাঁথা এক্সপ্রেসও পদ্মা সেতু দিয়ে চলে। বর্তমানে ঢাকা থেকে ট্রেন পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া-দর্শনা হয়ে খুলনায় যায়। এখন রেলওয়ে বলছে, এসব ট্রেন পরিচালনায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে না রেলওয়ে। তাই পদ্মা সেতু দিয়ে চার রুটে চলতি বছরেই নতুন আট জোড়া ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই চার রুট হচ্ছে ঢাকা-যশোর-খুলনা, ঢাকা-যশোর-বেনাপোল, ঢাকা-ভাঙ্গা-গোপালগঞ্জ এবং ঢাকা-ফরিদপুর-দর্শনা।
নতুন রেলপথের সময় কমে যাওয়ায় খুলনা-ঢাকা রুটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি (এক জোড়া) একটা রেক দিয়ে সুন্দরবন প্রভাতী ও গোধূলি নামে চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে চলাচলকারী চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনটিও এক রেক দিয়েই চিত্রা এক্সপ্রেস প্রভাতী ও গোধূলি নামে চলতে পারে। পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলকারী ঢাকা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিও এক জোড়ার পরিবর্তে দুই জোড়া পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও চিত্রা এক্সপ্রেসের রুট পরিবর্তন করা হলে ঢাকা থেকে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া-দর্শনা রুটে কোনো ট্রেন থাকছে না। তাই এ রুটে নতুন একটি রেক দিয়ে দুই জোড়া ট্রেন চালানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে রেলওয়ে। এ ছাড়া ঢাকা-কলকাতা রুটের আন্তর্জাতিক ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেসও রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় চলাচল করবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী গতকাল বিকেলে বলেন, ‘নভেম্বরের মধ্যেই পদ্মা রেলসেতু সংযোগ প্রকল্প পুরোদমে চালু হচ্ছে। এতে ঢাকা-খুলনা পথের দূরত্ব কমে যাচ্ছে। এতে শুধু যাত্রীরা লাভবান হবেন তা নয়, রেলওয়ে লাভবান হবে। যাত্রার সময় কমে গেলে এ রেলপথের ট্রেনগুলো আমরা দুবার করেও পরিচালনা করতে পারব দিনে। এ বিষয়টি পরিকল্পনায় রয়েছে।’
নতুন রেলপথ চালু হলে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহের যাত্রীদের রেলসেবা বিঘ্নিত হবে। এ বিষয়ে রেলওয়ের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, এখন রেলওয়ের ইঞ্জিন, রেক, বগির সংকট রয়েছে। ফরিদপুর-দর্শনা রুটে এখন কোনো নতুন ট্রেন দেওয়ার পরিকল্পনা রেলওয়ের নেই।